ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পথে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ বলছে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের একটি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো-সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে অধিক হারে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষ উন্নয়নের কোন সুফল পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের মালিক। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিপরীতে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশের মালিক। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয়, হয় কমেছে নয় এক জায়গাতেই থমকে আছে।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের নোবেল খ্যাত একটি অতি সম্মানজনক পদক হচ্ছে জুলিও কুরি পদক। ১৯০৩ সালে ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি দম্পতি যৌথভাবে পদার্থবিদ্যায় এবং মেরি কুরি ১৯১১ সালে এককভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী দম্পতি বিজ্ঞান সাধনা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছিলেন, তা অবিস্মরণীয় করে রাখতে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য স্মরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে থাকে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করা হয়। পদক পরিয়ে দেয়ার সময় বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, বিশ্ববন্ধুও।’
এর আগে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বিশ্ব শান্তি ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটি আকস্মিক কোন বিষয় ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে যখন জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করা হয় তখনও বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র দেশ সেই সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দরিদ্র দেশের সরকারপ্রধানকে বৈশ্বিক শান্তি পদক প্রদান বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নিরলস প্রচেষ্টা, তার কর্ম ও দর্শনের স্বীকৃতি।
বঙ্গবন্ধুর শান্তির দর্শনের অন্যতম উপাদান ছিল যুদ্ধ পরিহার করে যেকোন বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, সব প্রকার বঞ্চনা ও শোষণমুক্তির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধু সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায় প্রত্যক্ষ দুটো ব্লকে বিভক্ত হয়ে যায়। নিজেদের প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে গড়ে তোলে সামরিক জোটও। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কোন সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সব শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ব্যতিরেকে কখনোই বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তাই ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার সম্মানে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না প্রতিশোধ গ্রহণে কোন মহৎ কর্তব্য পালন করা যায়।’ তিনি বলেছিলেন, আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার বন্ধ্যা নীতির অবসান হবে। আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করে আমরা যেন তা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করি। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব, যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি এবং যেখানে আমাদের মানুষের মঙ্গলার্থে আমরা গঠনমূলক নীতিমালা অনুসরণ করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’
উপমহাদেশের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যখন শান্তির এই অমিয়বাণী উচ্চারণ করেন, তখনও রণাঙ্গন থেকে রক্তের দাগও মুছে যায়নি, আঞ্চলিক সহযোগিতা বিকাশের এই উদাত্ত আহ্বান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর শান্তির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের পরিচায়ক।
পৃথিবীটা সবার, অন্যের স্বস্তি নিশ্চিত করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে। সবারই মনে রাখতে হবে, বিশ্বনেতা হতে হলে পৃথিবীর যত্ন নেয়া শিখতে হবে, বিশ্বনেতা মানেই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণী অর্থাৎ পুরো প্রকৃতির যত্ন নিতে শেখা। নিজে আলোকিত হয়ে উঠতে হবে, বিশ্ববাসীকে আলোকিত করে জাগিয়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা সেটা হলো সুশিক্ষাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। যে অস্থিরতার কারণে মানুষ নিজের দেশেই যেমন অসহায়, তেমনি অন্যদের জন্য যেন আতঙ্ক না হয়ে উঠতে পারে, তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। নিজ নিজ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। সমন্বয়ের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত সম্পদ ব্যবহারেও সচেষ্ট হতে হবে। চোরাচালান এবং মাদকের ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কঠোর হতে হবে। যে করেই হোক, সীমান্তহত্যা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সুন্দর পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এই সুন্দর পৃথিবীটা হলো প্রাণের আবাসস্থল! সুশিক্ষার আলোতে প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠবে একেকজন সহনশীল এবং মানবিক বিশ্বনেতা। বিশ্বনেতাদের দায়িত্বশীল নেতৃত্বে বিশ্ব ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত হয়ে একটি সুন্দর বাসযোগ্য ধরণিতে পরিণত হবে। রাজনীতির প্রতিপক্ষের হিংস্রতায় একে অন্যের প্রতিপক্ষ না হয়ে বিশ্বের অনিবার্য ধ্বংসকে ঠেকাতে হবে। অবরোধ, যুদ্ধ আর নিষ্ঠুরতার ফল কোনভাবে শুভ হয় না। তাই পৃথিবীর গণমানুষ আজ শান্তি চায়, মনেপ্রাণেই শান্তি চায়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই বৃহৎ শক্তিবগের্র শুভবুদ্ধি। আর এ শুভবুদ্ধিতে বিশ্বে শান্তির দীপশিখাটি প্রজ্বলিত হবে-সেটিই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।
সামাজিক জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় জীবনে সহনশীলতার বড়ই অভাব। আমাদের রাজনীতি থেকে তো সহনশীলতা একবারেই বিদায় নিয়েছে। ভিন্নমতকে দমন করার জন্য পৃথিবীব্যাপী যে অসহনশীলতার চর্চা শুরু হয়েছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীন দেশে ভিন্নমত থাকবে, সমলোচনা থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। নিজের ক্ষমতার শক্তি প্রমাণে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোর ওপর যে হত্যা নির্যাতন চালাচ্ছে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তাদের সর্বোচ্চ সহনশীল হওয়া দরকার ছিল। সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের অধিকার হনন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। সহনশীল আচরণ কী জিনিস ক্ষমতার দাপটে তা আজ ভুলেই গেছে। পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনে সহনশীলতার চর্চা ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীটা সবার, অন্যের স্বস্তি নিশ্চিত করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে
সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একে অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি ও অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক জীবনে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তথা বয়স্ক, বৃদ্ধ ও দুর্বল শ্রেণীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহনশীল আচরণের শিক্ষা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত। তিনি ১৯৭৩ সালের ২৩ শে মে জুলিও কুরি শান্তিপদকে ভূষিত হন- যা বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং সেই সম্মান ও মর্যাদার ধারাবাহিকতায় আমাদের সহনশীল ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ব্রত গ্রহণ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২
বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পথে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ বলছে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের একটি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো-সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে অধিক হারে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষ উন্নয়নের কোন সুফল পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের মালিক। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিপরীতে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশের মালিক। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয়, হয় কমেছে নয় এক জায়গাতেই থমকে আছে।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের নোবেল খ্যাত একটি অতি সম্মানজনক পদক হচ্ছে জুলিও কুরি পদক। ১৯০৩ সালে ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি দম্পতি যৌথভাবে পদার্থবিদ্যায় এবং মেরি কুরি ১৯১১ সালে এককভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী দম্পতি বিজ্ঞান সাধনা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছিলেন, তা অবিস্মরণীয় করে রাখতে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য স্মরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে থাকে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করা হয়। পদক পরিয়ে দেয়ার সময় বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, বিশ্ববন্ধুও।’
এর আগে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বিশ্ব শান্তি ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটি আকস্মিক কোন বিষয় ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে যখন জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদান করা হয় তখনও বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র দেশ সেই সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দরিদ্র দেশের সরকারপ্রধানকে বৈশ্বিক শান্তি পদক প্রদান বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নিরলস প্রচেষ্টা, তার কর্ম ও দর্শনের স্বীকৃতি।
বঙ্গবন্ধুর শান্তির দর্শনের অন্যতম উপাদান ছিল যুদ্ধ পরিহার করে যেকোন বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, সব প্রকার বঞ্চনা ও শোষণমুক্তির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধু সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায় প্রত্যক্ষ দুটো ব্লকে বিভক্ত হয়ে যায়। নিজেদের প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে গড়ে তোলে সামরিক জোটও। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কোন সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সব শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ব্যতিরেকে কখনোই বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তাই ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার সম্মানে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না প্রতিশোধ গ্রহণে কোন মহৎ কর্তব্য পালন করা যায়।’ তিনি বলেছিলেন, আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার বন্ধ্যা নীতির অবসান হবে। আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করে আমরা যেন তা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করি। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব, যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি এবং যেখানে আমাদের মানুষের মঙ্গলার্থে আমরা গঠনমূলক নীতিমালা অনুসরণ করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’
উপমহাদেশের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যখন শান্তির এই অমিয়বাণী উচ্চারণ করেন, তখনও রণাঙ্গন থেকে রক্তের দাগও মুছে যায়নি, আঞ্চলিক সহযোগিতা বিকাশের এই উদাত্ত আহ্বান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর শান্তির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের পরিচায়ক।
পৃথিবীটা সবার, অন্যের স্বস্তি নিশ্চিত করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে। সবারই মনে রাখতে হবে, বিশ্বনেতা হতে হলে পৃথিবীর যত্ন নেয়া শিখতে হবে, বিশ্বনেতা মানেই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণী অর্থাৎ পুরো প্রকৃতির যত্ন নিতে শেখা। নিজে আলোকিত হয়ে উঠতে হবে, বিশ্ববাসীকে আলোকিত করে জাগিয়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা সেটা হলো সুশিক্ষাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। যে অস্থিরতার কারণে মানুষ নিজের দেশেই যেমন অসহায়, তেমনি অন্যদের জন্য যেন আতঙ্ক না হয়ে উঠতে পারে, তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। নিজ নিজ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। সমন্বয়ের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত সম্পদ ব্যবহারেও সচেষ্ট হতে হবে। চোরাচালান এবং মাদকের ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কঠোর হতে হবে। যে করেই হোক, সীমান্তহত্যা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সুন্দর পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এই সুন্দর পৃথিবীটা হলো প্রাণের আবাসস্থল! সুশিক্ষার আলোতে প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠবে একেকজন সহনশীল এবং মানবিক বিশ্বনেতা। বিশ্বনেতাদের দায়িত্বশীল নেতৃত্বে বিশ্ব ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত হয়ে একটি সুন্দর বাসযোগ্য ধরণিতে পরিণত হবে। রাজনীতির প্রতিপক্ষের হিংস্রতায় একে অন্যের প্রতিপক্ষ না হয়ে বিশ্বের অনিবার্য ধ্বংসকে ঠেকাতে হবে। অবরোধ, যুদ্ধ আর নিষ্ঠুরতার ফল কোনভাবে শুভ হয় না। তাই পৃথিবীর গণমানুষ আজ শান্তি চায়, মনেপ্রাণেই শান্তি চায়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই বৃহৎ শক্তিবগের্র শুভবুদ্ধি। আর এ শুভবুদ্ধিতে বিশ্বে শান্তির দীপশিখাটি প্রজ্বলিত হবে-সেটিই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।
সামাজিক জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় জীবনে সহনশীলতার বড়ই অভাব। আমাদের রাজনীতি থেকে তো সহনশীলতা একবারেই বিদায় নিয়েছে। ভিন্নমতকে দমন করার জন্য পৃথিবীব্যাপী যে অসহনশীলতার চর্চা শুরু হয়েছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীন দেশে ভিন্নমত থাকবে, সমলোচনা থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। নিজের ক্ষমতার শক্তি প্রমাণে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোর ওপর যে হত্যা নির্যাতন চালাচ্ছে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তাদের সর্বোচ্চ সহনশীল হওয়া দরকার ছিল। সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের অধিকার হনন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। সহনশীল আচরণ কী জিনিস ক্ষমতার দাপটে তা আজ ভুলেই গেছে। পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনে সহনশীলতার চর্চা ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীটা সবার, অন্যের স্বস্তি নিশ্চিত করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে
সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একে অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি ও অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক জীবনে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তথা বয়স্ক, বৃদ্ধ ও দুর্বল শ্রেণীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহনশীল আচরণের শিক্ষা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত। তিনি ১৯৭৩ সালের ২৩ শে মে জুলিও কুরি শান্তিপদকে ভূষিত হন- যা বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং সেই সম্মান ও মর্যাদার ধারাবাহিকতায় আমাদের সহনশীল ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ব্রত গ্রহণ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]