নিয়াজ আহমদ
আমরা জেনে এসেছি মানুষের মৌলিক অধিকার পাঁচটা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা। কিন্তু এগুলা মানুষের মৌলিক অধিকার নয়।
এগুলো মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক উপকরণ-যা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে লিপিবদ্ধ আছে।
চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক উপকরণ বা যেটাই হোক না কেন আমরা সেবাটা চাই। কিন্তু এটা যে আজ অনেক মানুষের কাছে আরাধ্য। চিকিৎসার মতো মৌলিক উপকরণ জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় আপামর জনতাকে। এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসা ব্যাপারটা কখন আসে? আমরা যখন অসুস্থ হই তখন। তাছাড়া আমরা অসুস্থ হই বা কেন? সুস্থতাটাই বা কী? আমাদের অসুস্থ হওয়ার পেছনে অনেক নিয়ামক কাজ করে। খাদ্য, পরিবেশসহ আরো অনেক কিছু। খাদ্য অন্যতম একটা নিয়ামক। যেটা এখন আমাদের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি গবেষণায় প্রকাশিত কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক।
১-
কিছুদিন আগে নেচার জার্নালে একটা গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল।
‘ঢাকার পাঁচটি বাজারের মুরগির দেহে আশঙ্কাজনক পরিমাণে মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া বা শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সুপারবাগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এর ফলে মানবস্বাস্থ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে মানুষের দেহে বড় কোনো রোগের ওষুধও অকার্যকর হয়ে যায়।
ঢাকার পাঁচটি মুরগির বাজার থেকে ৫০০ ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির বিষ্ঠা; এবং ৫০টি কমন সুয়ারেজ লাইনের পানির স্যাম্পল টেস্ট করা হয় এই গবেষণায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এই গবেষণায় সংগৃহীত মুরগির নমুনায় মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট ঝধষসড়হবষষধ ব্যাকটেরিয়া, ঊ. পড়ষরএবং ঝ. ধঁৎবঁং পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত রেজিস্টেন্সের পরিসীমা ৯৩-১০০ শতাংশ।
গবেষণাদলের প্রধান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন মেডিসিন এবং এএমআর ল্যাবরেটরির অধ্যাপক (মেডিসিন বিভাগ) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মুরগিতে মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। এই মুরগি রান্নার সময় যদি কোনভাবে ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে তা দেহের অনেক ক্ষতি করবে।’
গবেষণায় দেখা গেছে, এই বাজারগুলো থেকে ঢাকার পাইকারি বাজার, সুপারশপ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং কমিউনিটি সেন্টারে দৈনিক ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার মুরগি বিক্রি করা হয়।
মুরগির তরল বর্জ্য যেমন রক্ত, বিষ্ঠার সঙ্গে মিশ্রিত তরল বুড়িগঙ্গাতে ফেলা হয়। এই পানি ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে, কঠিন বর্জ্য সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলা হয়। এমনকি কারওয়ান বাজারের কঠিন বর্জ্য মাছ চাষিদের কাছে বিক্রি করা হয় বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।’
একটু চিন্তা করি। আমি বা আপনি ঢাকার ভেতর বা বাইরে যারায় পোলট্রি মুরগি খাই না কেন সেগুলোর শরীর যে
মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়ামুক্ত সে বিষয়ে কী আপনি পুরাপুরি নিশ্চিত? আমাদের কাছে কী এমন যুক্তি আছে যেটা নিশ্চিত হতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ মনের অজান্তে আমরা আমাদের শরীরে সুপারবাগ প্রবেশ করাচ্ছি। আর অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ও কমছে ধীরে ধীরে। মানবদেহে কাজ করছে না বহুল প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ ৬৭ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক। এখন কথা হচ্ছে আমরা জেনেও পোলট্রি মুরগি খাই। কিন্তু কেন? কারণ দামে সস্তা। বাজারমূল্য আমাদের পছন্দের ব্যাপারটাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। এ-তো গেল খাদ্যের বিশাল সম্রাজ্যের পোলট্রি মুরগি নামক এক প্রজার গল্প।
২-
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাকির হোসেন বেগুন নিয়ে গবেষণা করে মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হেভিমেটাল পেয়েছেন। অথচ বেগুন আমাদের খুব প্রিয় খাবার। আমরা সবাই জানি হেভিমেটাল মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে বিধায় জগতজুড়ে খাদ্যে হেভিমেটাল থাকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো চাল-ডাল-শাকসবজি, মাছ-মাংস সবকিছুতেই হেভিমেটালের আধিক্য।
৩-
শুধু ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতেই ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। হাট-বাজার ঘুরে কেমিক্যালমুক্ত মাছ মেলে না কোথাও। এর মধ্যেই ক্ষতিকর পিরানহা মাছ, রাক্ষুসে মাগুর, জীবনহানিকর পটকা মাছের দেদার বাজারজাত চলছে। মাছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল প্রয়োগ মোটেও বন্ধ করা যাচ্ছে না। সবুজ সবজিতেও ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে অবাধে। পাইকারি আড়তগুলোতে মাছের স্তূপ দিয়ে তার ওপর প্রকাশ্যেই ফরমালিন ছিটানো হতো অথবা স্প্রে করা হতো কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। প্রশাসনের নজরদারির ভয়ে এখন আর আড়তে কেমিক্যাল মেশানোর ঝুঁকি নেয় না কেউ। মাছ আহরণস্থল থেকেই প্রয়োগ করা হয় ফরমালিন। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছগুলোতে তাজা থাকা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ করা হয়। আর ছোট আকারের মাছগুলো শুধু ফরমালিন মিশ্রিত পানির ড্রামে চুবিয়ে তুললেই চলে। ব্যবসায়ীরা বাজারে ফরমালিন ব্যবহারের ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাট বাজারের বেশির ভাগ দোকানেই অবাধে ফরমালিন ব্যবহার করতে দেখা যায়। আড়তগুলো ফরমালিন মিশ্রিত বরফ দ্বারা মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করছে অভিনব স্টাইলে। এক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানো পানি দিয়েই বরফের পাটা বানানো হয়। সেই ফরমালিন বরফের মধ্যেই দিনভর চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ।
এ রকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। আমরা শুনি, পড়ি, বলি কিন্তু আইন মানি না।
ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন।
ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তা হলো-অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি। আর এই দুর্ভোগগুলোর কারণ হলো খাদ্যে ভেজাল, আমাদের অবাধ্যতা, অসচেতনতা, অজ্ঞতা। এজন্যই অতীতে অনেক জাতিকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।
পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্য খাদ্য এবং সরঞ্জাম, জলের পাইপ এবং সিসা দিয়ে তৈরি আরও অনেক যানবাহন তৈরি করেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, মহিলাদের মধ্যে উর্বরতা হ্রাস পায় এবং শিশুদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধকতা ঘটে। সম্ভবত সে কারণেই রোমান সাম্রাজ্য সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া রোমান সাম্রাজ্য আজ শুধুই গল্প। আর আমরা? ভবিষ্যৎ রোমান সাম্রাজ্য হতে যাচ্ছি না তো?
আসুন আরেকটা তথ্য জেনে আসি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব শহরের প্রতি গ্রামে ৫০-৭০ জন করে ক্যান্সার রোগী। বাংলাদেশে ও ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের গল্প শুনি প্রায়। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে ক্যান্সার রোগী। একটা পরিবারে চারজন থাকলে তার দুজন থাকবে ক্যান্সারে আক্রান্ত। আসলেই কি সত্যিই? না, আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। তবে আমাদের অসচেতনতাসহ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, নানাবিধ অপকর্মই বলে দেয় আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।
আমাদের দেশের দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে অসুস্থ হতে যাওয়া বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা করার দায়ভার কেই বা নেবে?
আমাদের ভুলেই আমাদের অসুস্থতার জন্ম। আর স্বাস্থ্যসেবা, সে তো বিলাসিতা।
কিন্তু সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আমরা অনাগত প্রজন্মকে অনুমেয় বিভীষিকার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। এখনই সময় পরিবর্তনের। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রন, অতিরিক্ত কেমিক্যাল যুক্তকরণসহ সব অপকর্মকে না বলি। উন্নত হোক স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো আর নিশ্চিত হোক আমাদের স্বাস্থ্যসেবা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
নিয়াজ আহমদ
বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২২
আমরা জেনে এসেছি মানুষের মৌলিক অধিকার পাঁচটা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা। কিন্তু এগুলা মানুষের মৌলিক অধিকার নয়।
এগুলো মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক উপকরণ-যা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে লিপিবদ্ধ আছে।
চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক উপকরণ বা যেটাই হোক না কেন আমরা সেবাটা চাই। কিন্তু এটা যে আজ অনেক মানুষের কাছে আরাধ্য। চিকিৎসার মতো মৌলিক উপকরণ জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় আপামর জনতাকে। এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসা ব্যাপারটা কখন আসে? আমরা যখন অসুস্থ হই তখন। তাছাড়া আমরা অসুস্থ হই বা কেন? সুস্থতাটাই বা কী? আমাদের অসুস্থ হওয়ার পেছনে অনেক নিয়ামক কাজ করে। খাদ্য, পরিবেশসহ আরো অনেক কিছু। খাদ্য অন্যতম একটা নিয়ামক। যেটা এখন আমাদের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি গবেষণায় প্রকাশিত কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক।
১-
কিছুদিন আগে নেচার জার্নালে একটা গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল।
‘ঢাকার পাঁচটি বাজারের মুরগির দেহে আশঙ্কাজনক পরিমাণে মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়া বা শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সুপারবাগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এর ফলে মানবস্বাস্থ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে মানুষের দেহে বড় কোনো রোগের ওষুধও অকার্যকর হয়ে যায়।
ঢাকার পাঁচটি মুরগির বাজার থেকে ৫০০ ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির বিষ্ঠা; এবং ৫০টি কমন সুয়ারেজ লাইনের পানির স্যাম্পল টেস্ট করা হয় এই গবেষণায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এই গবেষণায় সংগৃহীত মুরগির নমুনায় মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট ঝধষসড়হবষষধ ব্যাকটেরিয়া, ঊ. পড়ষরএবং ঝ. ধঁৎবঁং পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত রেজিস্টেন্সের পরিসীমা ৯৩-১০০ শতাংশ।
গবেষণাদলের প্রধান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন মেডিসিন এবং এএমআর ল্যাবরেটরির অধ্যাপক (মেডিসিন বিভাগ) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মুরগিতে মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। এই মুরগি রান্নার সময় যদি কোনভাবে ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে তা দেহের অনেক ক্ষতি করবে।’
গবেষণায় দেখা গেছে, এই বাজারগুলো থেকে ঢাকার পাইকারি বাজার, সুপারশপ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং কমিউনিটি সেন্টারে দৈনিক ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার মুরগি বিক্রি করা হয়।
মুরগির তরল বর্জ্য যেমন রক্ত, বিষ্ঠার সঙ্গে মিশ্রিত তরল বুড়িগঙ্গাতে ফেলা হয়। এই পানি ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে, কঠিন বর্জ্য সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলা হয়। এমনকি কারওয়ান বাজারের কঠিন বর্জ্য মাছ চাষিদের কাছে বিক্রি করা হয় বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।’
একটু চিন্তা করি। আমি বা আপনি ঢাকার ভেতর বা বাইরে যারায় পোলট্রি মুরগি খাই না কেন সেগুলোর শরীর যে
মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়ামুক্ত সে বিষয়ে কী আপনি পুরাপুরি নিশ্চিত? আমাদের কাছে কী এমন যুক্তি আছে যেটা নিশ্চিত হতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ মনের অজান্তে আমরা আমাদের শরীরে সুপারবাগ প্রবেশ করাচ্ছি। আর অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ও কমছে ধীরে ধীরে। মানবদেহে কাজ করছে না বহুল প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ ৬৭ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক। এখন কথা হচ্ছে আমরা জেনেও পোলট্রি মুরগি খাই। কিন্তু কেন? কারণ দামে সস্তা। বাজারমূল্য আমাদের পছন্দের ব্যাপারটাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। এ-তো গেল খাদ্যের বিশাল সম্রাজ্যের পোলট্রি মুরগি নামক এক প্রজার গল্প।
২-
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাকির হোসেন বেগুন নিয়ে গবেষণা করে মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হেভিমেটাল পেয়েছেন। অথচ বেগুন আমাদের খুব প্রিয় খাবার। আমরা সবাই জানি হেভিমেটাল মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে বিধায় জগতজুড়ে খাদ্যে হেভিমেটাল থাকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো চাল-ডাল-শাকসবজি, মাছ-মাংস সবকিছুতেই হেভিমেটালের আধিক্য।
৩-
শুধু ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতেই ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। হাট-বাজার ঘুরে কেমিক্যালমুক্ত মাছ মেলে না কোথাও। এর মধ্যেই ক্ষতিকর পিরানহা মাছ, রাক্ষুসে মাগুর, জীবনহানিকর পটকা মাছের দেদার বাজারজাত চলছে। মাছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল প্রয়োগ মোটেও বন্ধ করা যাচ্ছে না। সবুজ সবজিতেও ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে অবাধে। পাইকারি আড়তগুলোতে মাছের স্তূপ দিয়ে তার ওপর প্রকাশ্যেই ফরমালিন ছিটানো হতো অথবা স্প্রে করা হতো কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। প্রশাসনের নজরদারির ভয়ে এখন আর আড়তে কেমিক্যাল মেশানোর ঝুঁকি নেয় না কেউ। মাছ আহরণস্থল থেকেই প্রয়োগ করা হয় ফরমালিন। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছগুলোতে তাজা থাকা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ করা হয়। আর ছোট আকারের মাছগুলো শুধু ফরমালিন মিশ্রিত পানির ড্রামে চুবিয়ে তুললেই চলে। ব্যবসায়ীরা বাজারে ফরমালিন ব্যবহারের ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাট বাজারের বেশির ভাগ দোকানেই অবাধে ফরমালিন ব্যবহার করতে দেখা যায়। আড়তগুলো ফরমালিন মিশ্রিত বরফ দ্বারা মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করছে অভিনব স্টাইলে। এক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানো পানি দিয়েই বরফের পাটা বানানো হয়। সেই ফরমালিন বরফের মধ্যেই দিনভর চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ।
এ রকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। আমরা শুনি, পড়ি, বলি কিন্তু আইন মানি না।
ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন।
ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তা হলো-অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি। আর এই দুর্ভোগগুলোর কারণ হলো খাদ্যে ভেজাল, আমাদের অবাধ্যতা, অসচেতনতা, অজ্ঞতা। এজন্যই অতীতে অনেক জাতিকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।
পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্য খাদ্য এবং সরঞ্জাম, জলের পাইপ এবং সিসা দিয়ে তৈরি আরও অনেক যানবাহন তৈরি করেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, মহিলাদের মধ্যে উর্বরতা হ্রাস পায় এবং শিশুদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধকতা ঘটে। সম্ভবত সে কারণেই রোমান সাম্রাজ্য সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া রোমান সাম্রাজ্য আজ শুধুই গল্প। আর আমরা? ভবিষ্যৎ রোমান সাম্রাজ্য হতে যাচ্ছি না তো?
আসুন আরেকটা তথ্য জেনে আসি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব শহরের প্রতি গ্রামে ৫০-৭০ জন করে ক্যান্সার রোগী। বাংলাদেশে ও ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের গল্প শুনি প্রায়। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে ক্যান্সার রোগী। একটা পরিবারে চারজন থাকলে তার দুজন থাকবে ক্যান্সারে আক্রান্ত। আসলেই কি সত্যিই? না, আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। তবে আমাদের অসচেতনতাসহ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, নানাবিধ অপকর্মই বলে দেয় আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।
আমাদের দেশের দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে অসুস্থ হতে যাওয়া বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা করার দায়ভার কেই বা নেবে?
আমাদের ভুলেই আমাদের অসুস্থতার জন্ম। আর স্বাস্থ্যসেবা, সে তো বিলাসিতা।
কিন্তু সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আমরা অনাগত প্রজন্মকে অনুমেয় বিভীষিকার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। এখনই সময় পরিবর্তনের। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রন, অতিরিক্ত কেমিক্যাল যুক্তকরণসহ সব অপকর্মকে না বলি। উন্নত হোক স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো আর নিশ্চিত হোক আমাদের স্বাস্থ্যসেবা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]