শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
২০ নভেম্বর দুপুর ২টায় পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত যে দুই আসামিকে আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেয় তাদের একজন হলো আবু সিদ্দিীক সোহেল অন্যজন হলো মইনুল আহসান শামীম। এই দুজনই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি টিমের সদস্য। পরবর্তীতে তারা মেজর জিয়ার জঙ্গি গ্রুপ আনসার আল ইসলামে যোগ দেয়।
এই দুই জঙ্গি প্রকাশক ও মুক্তমনা লেখক দীপনকে হত্যা করে। এই হত্যার অপরাধের আদালত তাদের মৃত্যুদন্ডে দন্ড প্রদান করে। প্রকাশক ও মুক্তমনা লেখক ফয়সাল আরেফিন জামান দীপনকে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বিকেল ৪টায় তার জাগৃতি প্রকাশনী কার্যালয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা হত্যা করেছিল। দীপন হত্যার মূলে ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা ভাই নামক একটি মৌলবাদী সংগঠন। দীপনকে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী তার শাহবাগের প্রকাশনা কার্যালয়ে ঢুকে পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করে। হত্যাকারীরা হত্যাকান্ড ঘটিয়ে দীপনের অফিসের অটো লক তালা লক করে পালিয়ে যায়। দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর থেকে মৌলবাদীরা বাংলাদেশের মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালায়। এই ধারাবাহিক হামলার শিকার মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশক দীপন। ২০২১ সালে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউল হকসহ ৮ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। বিচারকের ৫৩ পৃষ্ঠা রায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, এ মামলার আসামিদের লক্ষ্য ছিল ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা করে দেশের মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া এবং মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে জননিরাপত্তা বিঘিœত করা। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
দীপন খুন হওয়ার পর, দীপন হত্যাকারীদের দাবি ছিল তারা নাস্তিকদের হত্যা করছে। তাই কিছু মানুষেরও মৌন সমর্থন হত্যাকারী পিশাচরা সেই সময় থেকে পেয়ে আসছে। ২০১৫ সালের বাঙালির প্রাণের মেলা, একুশে বই মেলা চলাকালীন সময়ের মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়কে টিএসসির সামনে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের জন্য যারা মৃত্যুদন্ড পেয়েছে তাদেরকেই জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম। এর আগে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে বাংলা ভাইয়ের গ্রুপের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ছিনিয়ে নেয় ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। এবার জনাকীর্ণ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আসামি ছিনতাই করে আবারও পালালো মৌলবাদীরা।
গণমাধ্যমের সংবাদে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলে করে ছিনতাইকারীরা আসামি নিয়ে পালাচ্ছে। যার ফুটেজ সিসি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখার সময় কেন তাদের গতিরোধ করা গেল না? বিভিন্ন মহলে এই আসামি ছিনতাইয়ের বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের আলাচনা করছেন।
বাংলাদেশে মৌলবাদ এবং ধর্মচর্চার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। অনেক মানুষের কাছে নিজের জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতা। মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধতার মোহাবিষ্ট অনেকেই এখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও জননিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত বলে অভিযোগ রয়েছে। দীপনকে জঙ্গিরা নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে খুন করে।
দীপন হত্যার খুনিরা মনে করেন তারা ধর্মের জন্য একটি ভালো কাজ করেছে। ধর্মরক্ষার জন্য তারা দীপন-অভিজিৎকে হত্যা করে। ধর্মের সমৃদ্ধির হোক এই ধারণা নিয়েই তারা হত্যাকান্ডসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালায়। কারণ দীপনের সঙ্গে কারও সম্পত্তি বা কোন আর্থিক, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল না। দীপন ছিলেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা একজন মানুষ। সমাজে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারটা কমে যায়। মুক্ত মেধা চর্চার পথ বিকাশের জন্য দীপন নিভৃতে কাজ করছিলেন। তাই দীপন হয়ে ওঠে মৌলবাদীদের বড় শত্রু। এ কারণেই জঙ্গিরা দীপনকে খুন করে।
দীপন হত্যাকারী খুনিদের কতখানি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে আদালতে আনা হয়েছিল? এটার তদন্ত করা উচিত। বাংলাদেশে শাসনতান্ত্রিক আইনের নানা দিকের কারণে মুক্তভাবে ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ে কোন কথা বলা যায় না। এতদ বিষয়ে কোন আলোচনা করলেই দেখা যায়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। ধর্মের নামে এক ধরনের স্বৈরান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে দেশে। এ ব্যবস্থাটিরও প্রতিকারের জন্য কোন কথা বলা যায় না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য যাত্রাপালাসহ বাংলার আবহমান কালের সংস্কৃতির কোন অনুষ্ঠান করতে গেলে পুলিশের অনুমতি লাগে, অথচ স্বাধীনতাবিরোধী আর্দশের পাকস্তানি স্টাইলের ওয়াজ মাহফিলে কোন অনুমতির নেয়ার দরকার হয় না।
বাংলা জনপদের সাংস্কৃতি চর্চা অনুষ্ঠানে সরকারবিরোধী কোন কিছু অষ্পষ্টভাবে পরীলক্ষিত হলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয় অথচ রাতভর পাকিস্তানি ভাবধারায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থি বয়ানকারির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এভাবেই দেশকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৌলবাদের অতল গহ্বরে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, জঙ্গি ছিনতাইয়ের বিষয়টি কারাগারে বসেই জঙ্গিরা পরিকল্পনা করেছিল। বন্দী জঙ্গিরা কারাগার থেকে মোবাইল ফোনে বাইরের থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এবং কিভাবে পালাবে এবং পুরো পালানোর পক্রিয়াটাও নাকি মোবাইলের ভিডিওর মাধ্যমে র্যাকি করে তৈরি করে একটি পরিকল্পনটি।
কাশিমপুর কারাগারে দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা মোবাইল ফোনে বাইরের জগতও নাকি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের খবর আগেও বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমে এসেছে। সাধারণত আমরা জানি , মুত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কনডেম সেলে থাকে। কনডেম সেলের যে বর্ণনা শোনা যায়, এই সেল থেকে মোবাইল ব্যবহার বা অন্য কোন কয়েদির সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও নিয়মানুসারে যায় না। আবু সিদ্দিীক সোহেল এবং মইনুল আহসান শামীম দুজনেরও তো পরষ্পরে সঙ্গে কারাগারে দেখা হওয়ার কথা না।
দেশের কারাগারগুলোর অভ্যন্তরে কী ঘটছে তার তদন্ত হওয়া দরকার। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশের কারাগারগুলোতে ইসলামিক জলসারমতো অনুষ্ঠানও নাকি হয়ে থাকে। স্বাধীনতাবিরোধী ’৭১এর ঘাতক এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর চারপাশ ঘিরে কয়েদি কারারক্ষীরাও তার ওয়াজ শোনে। জঙ্গিরা কারাগারের অভ্যন্তরে কী করে ওয়াজ নসিহত করার সুযোগ পায়। সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, সারাদেশের বন্দী জঙ্গিরা জেলের অভ্যন্তরে কারারক্ষী এবং কয়েদিদের ধর্মের নামে মগজধোলাই করে ফেলছে। এ দুই মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি অবশ্যই কারাকর্তৃপক্ষের দেয়া সুযোগে বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে বলেই বাইরে থাকাসহ জঙ্গীদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে পালায়।
জঙ্গি নিরোধের জন্য জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালে আসলে কি লাভ হচ্ছে? এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, জঙ্গিরা কারগার থেকে আরও জঙ্গির সৃষ্টি করছে। পুলিশসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের মনস্তাত্বিকভাবে ধর্ম বিশ্বাসটা এমনভাবে প্রোথিত হয়েছে যে, মুক্তমনা আলোচক, লেখক এবং প্রগতিশীলদের তারা মনে করে নাস্তিক। একজন নাস্তিককে নিধন করাটা অনেকেরই কাছে পুণ্যের কাজ। রামুর, দিরাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলার বাহিনী নিষ্প্রভতাই প্রমাণ করে তারা মনস্তাত্বিকভাবে ধর্মান্ধতার দিকেই ঝুঁকছে। দেশের শিক্ষাসহ সব কাজকর্মে ধর্মের ব্যবহারটা কমাতে না পারলে দেখা যাবে, একদিন এই জঙ্গিরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তখন কারও কিছুর করার থাকবে না।
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর ২০২২
২০ নভেম্বর দুপুর ২টায় পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত যে দুই আসামিকে আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেয় তাদের একজন হলো আবু সিদ্দিীক সোহেল অন্যজন হলো মইনুল আহসান শামীম। এই দুজনই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি টিমের সদস্য। পরবর্তীতে তারা মেজর জিয়ার জঙ্গি গ্রুপ আনসার আল ইসলামে যোগ দেয়।
এই দুই জঙ্গি প্রকাশক ও মুক্তমনা লেখক দীপনকে হত্যা করে। এই হত্যার অপরাধের আদালত তাদের মৃত্যুদন্ডে দন্ড প্রদান করে। প্রকাশক ও মুক্তমনা লেখক ফয়সাল আরেফিন জামান দীপনকে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বিকেল ৪টায় তার জাগৃতি প্রকাশনী কার্যালয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা হত্যা করেছিল। দীপন হত্যার মূলে ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা ভাই নামক একটি মৌলবাদী সংগঠন। দীপনকে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী তার শাহবাগের প্রকাশনা কার্যালয়ে ঢুকে পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করে। হত্যাকারীরা হত্যাকান্ড ঘটিয়ে দীপনের অফিসের অটো লক তালা লক করে পালিয়ে যায়। দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর থেকে মৌলবাদীরা বাংলাদেশের মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালায়। এই ধারাবাহিক হামলার শিকার মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশক দীপন। ২০২১ সালে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউল হকসহ ৮ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। বিচারকের ৫৩ পৃষ্ঠা রায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, এ মামলার আসামিদের লক্ষ্য ছিল ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা করে দেশের মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া এবং মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে জননিরাপত্তা বিঘিœত করা। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
দীপন খুন হওয়ার পর, দীপন হত্যাকারীদের দাবি ছিল তারা নাস্তিকদের হত্যা করছে। তাই কিছু মানুষেরও মৌন সমর্থন হত্যাকারী পিশাচরা সেই সময় থেকে পেয়ে আসছে। ২০১৫ সালের বাঙালির প্রাণের মেলা, একুশে বই মেলা চলাকালীন সময়ের মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়কে টিএসসির সামনে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের জন্য যারা মৃত্যুদন্ড পেয়েছে তাদেরকেই জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম। এর আগে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে বাংলা ভাইয়ের গ্রুপের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ছিনিয়ে নেয় ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। এবার জনাকীর্ণ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আসামি ছিনতাই করে আবারও পালালো মৌলবাদীরা।
গণমাধ্যমের সংবাদে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলে করে ছিনতাইকারীরা আসামি নিয়ে পালাচ্ছে। যার ফুটেজ সিসি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখার সময় কেন তাদের গতিরোধ করা গেল না? বিভিন্ন মহলে এই আসামি ছিনতাইয়ের বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের আলাচনা করছেন।
বাংলাদেশে মৌলবাদ এবং ধর্মচর্চার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। অনেক মানুষের কাছে নিজের জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতা। মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধতার মোহাবিষ্ট অনেকেই এখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও জননিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত বলে অভিযোগ রয়েছে। দীপনকে জঙ্গিরা নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে খুন করে।
দীপন হত্যার খুনিরা মনে করেন তারা ধর্মের জন্য একটি ভালো কাজ করেছে। ধর্মরক্ষার জন্য তারা দীপন-অভিজিৎকে হত্যা করে। ধর্মের সমৃদ্ধির হোক এই ধারণা নিয়েই তারা হত্যাকান্ডসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালায়। কারণ দীপনের সঙ্গে কারও সম্পত্তি বা কোন আর্থিক, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল না। দীপন ছিলেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা একজন মানুষ। সমাজে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারটা কমে যায়। মুক্ত মেধা চর্চার পথ বিকাশের জন্য দীপন নিভৃতে কাজ করছিলেন। তাই দীপন হয়ে ওঠে মৌলবাদীদের বড় শত্রু। এ কারণেই জঙ্গিরা দীপনকে খুন করে।
দীপন হত্যাকারী খুনিদের কতখানি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে আদালতে আনা হয়েছিল? এটার তদন্ত করা উচিত। বাংলাদেশে শাসনতান্ত্রিক আইনের নানা দিকের কারণে মুক্তভাবে ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ে কোন কথা বলা যায় না। এতদ বিষয়ে কোন আলোচনা করলেই দেখা যায়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। ধর্মের নামে এক ধরনের স্বৈরান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে দেশে। এ ব্যবস্থাটিরও প্রতিকারের জন্য কোন কথা বলা যায় না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য যাত্রাপালাসহ বাংলার আবহমান কালের সংস্কৃতির কোন অনুষ্ঠান করতে গেলে পুলিশের অনুমতি লাগে, অথচ স্বাধীনতাবিরোধী আর্দশের পাকস্তানি স্টাইলের ওয়াজ মাহফিলে কোন অনুমতির নেয়ার দরকার হয় না।
বাংলা জনপদের সাংস্কৃতি চর্চা অনুষ্ঠানে সরকারবিরোধী কোন কিছু অষ্পষ্টভাবে পরীলক্ষিত হলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয় অথচ রাতভর পাকিস্তানি ভাবধারায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থি বয়ানকারির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এভাবেই দেশকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৌলবাদের অতল গহ্বরে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, জঙ্গি ছিনতাইয়ের বিষয়টি কারাগারে বসেই জঙ্গিরা পরিকল্পনা করেছিল। বন্দী জঙ্গিরা কারাগার থেকে মোবাইল ফোনে বাইরের থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এবং কিভাবে পালাবে এবং পুরো পালানোর পক্রিয়াটাও নাকি মোবাইলের ভিডিওর মাধ্যমে র্যাকি করে তৈরি করে একটি পরিকল্পনটি।
কাশিমপুর কারাগারে দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা মোবাইল ফোনে বাইরের জগতও নাকি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের খবর আগেও বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমে এসেছে। সাধারণত আমরা জানি , মুত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কনডেম সেলে থাকে। কনডেম সেলের যে বর্ণনা শোনা যায়, এই সেল থেকে মোবাইল ব্যবহার বা অন্য কোন কয়েদির সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও নিয়মানুসারে যায় না। আবু সিদ্দিীক সোহেল এবং মইনুল আহসান শামীম দুজনেরও তো পরষ্পরে সঙ্গে কারাগারে দেখা হওয়ার কথা না।
দেশের কারাগারগুলোর অভ্যন্তরে কী ঘটছে তার তদন্ত হওয়া দরকার। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশের কারাগারগুলোতে ইসলামিক জলসারমতো অনুষ্ঠানও নাকি হয়ে থাকে। স্বাধীনতাবিরোধী ’৭১এর ঘাতক এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর চারপাশ ঘিরে কয়েদি কারারক্ষীরাও তার ওয়াজ শোনে। জঙ্গিরা কারাগারের অভ্যন্তরে কী করে ওয়াজ নসিহত করার সুযোগ পায়। সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, সারাদেশের বন্দী জঙ্গিরা জেলের অভ্যন্তরে কারারক্ষী এবং কয়েদিদের ধর্মের নামে মগজধোলাই করে ফেলছে। এ দুই মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি অবশ্যই কারাকর্তৃপক্ষের দেয়া সুযোগে বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে বলেই বাইরে থাকাসহ জঙ্গীদের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে পালায়।
জঙ্গি নিরোধের জন্য জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালে আসলে কি লাভ হচ্ছে? এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, জঙ্গিরা কারগার থেকে আরও জঙ্গির সৃষ্টি করছে। পুলিশসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের মনস্তাত্বিকভাবে ধর্ম বিশ্বাসটা এমনভাবে প্রোথিত হয়েছে যে, মুক্তমনা আলোচক, লেখক এবং প্রগতিশীলদের তারা মনে করে নাস্তিক। একজন নাস্তিককে নিধন করাটা অনেকেরই কাছে পুণ্যের কাজ। রামুর, দিরাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলার বাহিনী নিষ্প্রভতাই প্রমাণ করে তারা মনস্তাত্বিকভাবে ধর্মান্ধতার দিকেই ঝুঁকছে। দেশের শিক্ষাসহ সব কাজকর্মে ধর্মের ব্যবহারটা কমাতে না পারলে দেখা যাবে, একদিন এই জঙ্গিরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তখন কারও কিছুর করার থাকবে না।
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]