alt

উপ-সম্পাদকীয়

তিস্তার পানি আটকাবার পেছনে মোদি-মমতার আসল উদ্দেশ্য

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর ২০২২

দীর্ঘ প্রায় একযুগ ধরে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিচুক্তি স্বাক্ষর করছে না। তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। নদীটি পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো আন্তর্জাতিক নদীর পানি উৎপত্তি স্থলের দেশ গায়ের জোরে বন্ধ করে রেখে উজানে বওয়া দেশকে শুকিয়ে মারতে পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করবার কার্যত বিনিময় হিসেবেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গঙ্গার শাখা পদ্মাকে শুকিয়ে মারতে ফারাক্কা বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ভারতের এই আধিপত্যবাদ, আন্তর্জাতিক আঈন লঙ্ঘন, গাজোয়ারি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছিল। তার শত্রুশিবির ইন্দিরা গান্ধীর কর্মকান্ডে উৎসাহ পেয়েছিল। উৎসাহিত হয়েছিল হানাদার পাক শক্তি। খুনি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও যে ফরাক্কা বাঁধ ঘিরে ভারতের গা-জোয়ারি, দাদাগিরি একটা বাড়তি সুযোগ করে দেয়নি- এ কথা বলা যায় না। শ্রীমতী গান্ধীর সেই স্বৈরাচারী মানসিকতার যোগ্য উত্তর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু গঙ্গার পানি চুক্তি রূপায়ণে মুখ্য ভূমিকা পালনের ভিতর দিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময়ে জ্যোতিবাবু তো বটেই, তার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় বাংলাদেশে পৌঁছেছিল যে, শেখ হাসিনা রসিকতা করে আমাকে বলেছিলেন- আমার কনস্টিটুয়েন্সি থেকে অসীমবাবু দাঁড়ালে আমি হেরে যেতে পারি!

জ্যোতিবাবুর ভূমিকার ফলে একটা সময়ে আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর ফারাক্কায় বাঁধ তৈরি করে বাংলাদেশ কে পানি তে মারবার যে ‘অপরাধ’ ভারত সরকার করেছিল, তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব হয়েছিল গঙ্গার পানি চুক্তির ফলে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি একতরফাভাবে আটকে রেখে, তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে বর্তমানে ভারত সরকার যে ‘অপরাধ’ করে চলেছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় থেকেই যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। মমতা বামপন্থিদের ক্ষমতাচ্যুত করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই দক্ষিণ এশিয়াতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে নতুন মাত্রা দিতে তাকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আড়কাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে মার্কিন প্রশাসন। বস্তুত এই স্বার্থের দিকে তাকিয়েই আমেরিকা মমতার পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘শিল্পতাড়–য়া’ ভূমিকাকে সব রকমভাবে সাহায্য করেছিল।

মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের ড. মনমোহন সিং। মমতা ড. সিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ড. সিং যখন তিস্তার পানিচুক্তির উদ্যোগ নেন, মমতা তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেছেন এবং হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে তার গোপন বৈঠকটিও হয়ে গেছে। সেই বৈঠকের পর তিস্তার পানি বাংলাদেশ কে না দেওয়ার জন্যে মমতার যে জেদ বেড়ে যাওয়া, তা নিয়ে ভারতের কোনো সংবাদমাধ্যমই সেভাবে সাড়াশব্দ করেনি। হিলারি ক্লিন্টন যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে তিস্তার পানি চুক্তিতে মমতাকে সম্মতি জানাতে নিষেধ করেছিলেন, সেই বিষয়টি যাতে ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের কাছে গোপন থাকে তার জন্য একদম বিজেপির ভঙ্গিমায় তিস্তার পানি ঘিরে একধরণের শ্যভিনিজমের আমদানি ঘটিয়েছিলেন মমতা। ভারত বাঁধ দিয়ে তিস্তার গতিপথ বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে একটা কৃত্রিম পানি সংকট তৈরি করেছে। সেই সংকটের আসল চেহারাটা মমতা থেকে কংগ্রেস, বিজেপি-সবাইই ভারতীয় নাগরিকদের কাছ থেকে গোপন করে- ‘আমাদের দেশেই তিস্তাতে পানি নেই, আমরা আবার কী করে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিই’- এই জিগির তোলা হয়েছে।

ভারত কী করে ফারাক্কা ব্যারেজের মতোই তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাংলাদেশের সমস্ত আপত্তিকে নস্যাৎ করে বাঁধ তৈরি করেছে- কংগ্রেস, বিজেপি বা মমতা কেউই কিন্তু সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি। তিস্তার পানির যে কৃত্রিম সংকট, তা এই মুহূর্তেই দূর করে দেওয়া সম্ভব অবৈধ বাঁধকে ভেঙে দিয়ে। সে কথা কিন্তু মমতা একটিবারের জন্যও বলছেন না। ভারতের মানুষকে তিস্তার পানি চুক্তি ঘিরে তার প্রবল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের চেতনাবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শরিক হিসেবে ভূমিকা- এসব কিছু গোপন করতেই মমতা ভারতেই তিস্তাতে পানি নেই- এই নির্জলা মিথ্যা কথাটা ধারাবাহিকভাবে বলে চলেছেন।

মমতা মুখে শেখ হাসিনার প্রতি সৌহার্দপূর্ণ কথাবার্তা বলেন, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে হাসিনা বিরোধী মানসিকতারই সব রকম পরিচয় রাখেন। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মমতার দলের এক সময়ের রাজ্যসভার এক সদস্যের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও মমতার দলের সেই সময়ের কর্মরত সাংসদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ভারত সরকারকে জানানো হয়েছিল বলে বিভিন্ন ভারতীয় খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

অনেকেরই মনে হতে পারে, শেখ হাসিনার প্রতি এত সৌহার্দ দেখানো মমতা কি কখন ও হাসিনা বিপদে পড়তে পারেন, রাজনৈতিকভাবে কমজোরি হতে পারেন, তেমন কোনো কাজ করতে পারেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কংগ্রেস দল ছেড়ে মমতা যখন তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে, তখন ভারতের নির্বাচন কমিশনে সেই দলের নথিবন্ধকরণ এবং নির্বাচনী প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে লিখিত সুপারিশ করেছিলেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম অংশীদার লালকৃষ্ণ আদবানী। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যাতে ভারতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হয় তার জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের গোটা পূর্বাঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ধারকবাহক হলেন মমতা। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শরিক হিসেবেই আরএসএস-বিজেপি চায় বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হোন শেখ হাসিনা। আমেরিকার তালে তাল দিয়ে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি চায় বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশ হয়ে উঠুক। এ জন্যই বাংলাদেশে যাতে শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারান- সেই উদ্দেশেই ভারতের সমস্ত ধরনের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা চায় তিস্তার পানি চুক্তি না হোক।

শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকার পরিচালনাতে তার প্রভাব, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলাদেশে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু নির্যাতনের তত্ত্ব এবং সেই তত্ত্ব ব্যবহার করে ভারতে মুসলমানদের ওপর আর্থ-সামাজিক শারীরিক অত্যাচার চালাবার পথটা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে সেখানকার সংখ্যাগুরু মৌলবাদ যাতে শক্তিশালী হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি যাতে সেদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন চালাতে পারে, যার জেরে ভারতে মুসলমানদের ওপরে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাবে ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি- সেই পরিবেশ তৈরির চেষ্টাতেই মমতাকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদি তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদন করছেন না।

ভারত কী করে ফারাক্কা ব্যারেজের মতোই তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাংলাদেশের সমস্ত আপত্তিকে নস্যাৎ করে বাঁধ তৈরি করেছে- কংগ্রেস, বিজেপি বা মমতা কেউই কিন্তু সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি

মোদি-মমতার তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনে বাধার ভিতর দিয়ে শেখ হাসিনা বিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আরও শক্ত রাজনৈতিক জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। হাসিনা সম্পর্কে ‘ভারতপ্রেমী’ অপবাদ দিয়ে গোটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি তাকে যে রাজনৈতিকভাবে অপদস্ত করবার নিরন্তর চেষ্টা করে, তিস্তার পানি চুক্তি ঘিরে মোদি-মমতার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বদৌলতে বাংলাদেশ সরকার ব্যবসা বাণিজ্যসহ বহু ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের যে পর্যায় শুরু করেছেন তা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভিত্তিকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। বদরুদ্দিন উমরদের মতো কিছু কিছু স্বঘোষিত ‘চীনপন্থি’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাল থেকে ধারাবাহিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছিলেন। চীনের সময়োপযোগী নেতৃত্বের সেই ভুল ভাঙাতে সক্ষম হওয়া শেখ হাসিনার একটি বিশেষ কূটনৈতিক সাফল্য।

আরএসএস-বিজেপি-মমতার ত্রিবিধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, শেখ হাসিনা বিরোধী, সর্বপোরি বাংলাদেশ বিরোধী যে অবস্থান, তা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আগামীতে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। ত্রিবিধ শক্তির রাজনৈতিক কৌশলের ফলে বাংলাদেশের বিদেশ নীতিতে চীনের প্রতি যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, তা চীনের সঙ্গে বহুবিধ সীমান্ত সমস্যায় দীর্ণ ভারতকে আগামী দিনে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমেরিকাকে খুশি করতে বাংলাদেশকে চীনমুখী করে ভারতকে আরও আমেরিকামুখী করাও মোদি-মমতার অন্যতম উদ্দেশ্য কিনা- সময়ের সঙ্গেই তা পরিষ্কার হবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

তিস্তার পানি আটকাবার পেছনে মোদি-মমতার আসল উদ্দেশ্য

গৌতম রায়

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর ২০২২

দীর্ঘ প্রায় একযুগ ধরে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিচুক্তি স্বাক্ষর করছে না। তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। নদীটি পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো আন্তর্জাতিক নদীর পানি উৎপত্তি স্থলের দেশ গায়ের জোরে বন্ধ করে রেখে উজানে বওয়া দেশকে শুকিয়ে মারতে পারবে না।

মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করবার কার্যত বিনিময় হিসেবেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গঙ্গার শাখা পদ্মাকে শুকিয়ে মারতে ফারাক্কা বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ভারতের এই আধিপত্যবাদ, আন্তর্জাতিক আঈন লঙ্ঘন, গাজোয়ারি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছিল। তার শত্রুশিবির ইন্দিরা গান্ধীর কর্মকান্ডে উৎসাহ পেয়েছিল। উৎসাহিত হয়েছিল হানাদার পাক শক্তি। খুনি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও যে ফরাক্কা বাঁধ ঘিরে ভারতের গা-জোয়ারি, দাদাগিরি একটা বাড়তি সুযোগ করে দেয়নি- এ কথা বলা যায় না। শ্রীমতী গান্ধীর সেই স্বৈরাচারী মানসিকতার যোগ্য উত্তর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু গঙ্গার পানি চুক্তি রূপায়ণে মুখ্য ভূমিকা পালনের ভিতর দিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময়ে জ্যোতিবাবু তো বটেই, তার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় বাংলাদেশে পৌঁছেছিল যে, শেখ হাসিনা রসিকতা করে আমাকে বলেছিলেন- আমার কনস্টিটুয়েন্সি থেকে অসীমবাবু দাঁড়ালে আমি হেরে যেতে পারি!

জ্যোতিবাবুর ভূমিকার ফলে একটা সময়ে আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার ওপর ফারাক্কায় বাঁধ তৈরি করে বাংলাদেশ কে পানি তে মারবার যে ‘অপরাধ’ ভারত সরকার করেছিল, তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব হয়েছিল গঙ্গার পানি চুক্তির ফলে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি একতরফাভাবে আটকে রেখে, তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে বর্তমানে ভারত সরকার যে ‘অপরাধ’ করে চলেছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় থেকেই যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। মমতা বামপন্থিদের ক্ষমতাচ্যুত করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই দক্ষিণ এশিয়াতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে নতুন মাত্রা দিতে তাকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আড়কাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে মার্কিন প্রশাসন। বস্তুত এই স্বার্থের দিকে তাকিয়েই আমেরিকা মমতার পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘শিল্পতাড়–য়া’ ভূমিকাকে সব রকমভাবে সাহায্য করেছিল।

মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের ড. মনমোহন সিং। মমতা ড. সিংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ড. সিং যখন তিস্তার পানিচুক্তির উদ্যোগ নেন, মমতা তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেছেন এবং হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে তার গোপন বৈঠকটিও হয়ে গেছে। সেই বৈঠকের পর তিস্তার পানি বাংলাদেশ কে না দেওয়ার জন্যে মমতার যে জেদ বেড়ে যাওয়া, তা নিয়ে ভারতের কোনো সংবাদমাধ্যমই সেভাবে সাড়াশব্দ করেনি। হিলারি ক্লিন্টন যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে তিস্তার পানি চুক্তিতে মমতাকে সম্মতি জানাতে নিষেধ করেছিলেন, সেই বিষয়টি যাতে ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের কাছে গোপন থাকে তার জন্য একদম বিজেপির ভঙ্গিমায় তিস্তার পানি ঘিরে একধরণের শ্যভিনিজমের আমদানি ঘটিয়েছিলেন মমতা। ভারত বাঁধ দিয়ে তিস্তার গতিপথ বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে একটা কৃত্রিম পানি সংকট তৈরি করেছে। সেই সংকটের আসল চেহারাটা মমতা থেকে কংগ্রেস, বিজেপি-সবাইই ভারতীয় নাগরিকদের কাছ থেকে গোপন করে- ‘আমাদের দেশেই তিস্তাতে পানি নেই, আমরা আবার কী করে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিই’- এই জিগির তোলা হয়েছে।

ভারত কী করে ফারাক্কা ব্যারেজের মতোই তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাংলাদেশের সমস্ত আপত্তিকে নস্যাৎ করে বাঁধ তৈরি করেছে- কংগ্রেস, বিজেপি বা মমতা কেউই কিন্তু সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি। তিস্তার পানির যে কৃত্রিম সংকট, তা এই মুহূর্তেই দূর করে দেওয়া সম্ভব অবৈধ বাঁধকে ভেঙে দিয়ে। সে কথা কিন্তু মমতা একটিবারের জন্যও বলছেন না। ভারতের মানুষকে তিস্তার পানি চুক্তি ঘিরে তার প্রবল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের চেতনাবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শরিক হিসেবে ভূমিকা- এসব কিছু গোপন করতেই মমতা ভারতেই তিস্তাতে পানি নেই- এই নির্জলা মিথ্যা কথাটা ধারাবাহিকভাবে বলে চলেছেন।

মমতা মুখে শেখ হাসিনার প্রতি সৌহার্দপূর্ণ কথাবার্তা বলেন, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে হাসিনা বিরোধী মানসিকতারই সব রকম পরিচয় রাখেন। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মমতার দলের এক সময়ের রাজ্যসভার এক সদস্যের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও মমতার দলের সেই সময়ের কর্মরত সাংসদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ভারত সরকারকে জানানো হয়েছিল বলে বিভিন্ন ভারতীয় খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

অনেকেরই মনে হতে পারে, শেখ হাসিনার প্রতি এত সৌহার্দ দেখানো মমতা কি কখন ও হাসিনা বিপদে পড়তে পারেন, রাজনৈতিকভাবে কমজোরি হতে পারেন, তেমন কোনো কাজ করতে পারেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কংগ্রেস দল ছেড়ে মমতা যখন তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে, তখন ভারতের নির্বাচন কমিশনে সেই দলের নথিবন্ধকরণ এবং নির্বাচনী প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে লিখিত সুপারিশ করেছিলেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম অংশীদার লালকৃষ্ণ আদবানী। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যাতে ভারতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হয় তার জন্য শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের গোটা পূর্বাঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ধারকবাহক হলেন মমতা। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শরিক হিসেবেই আরএসএস-বিজেপি চায় বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হোন শেখ হাসিনা। আমেরিকার তালে তাল দিয়ে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি চায় বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশ হয়ে উঠুক। এ জন্যই বাংলাদেশে যাতে শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারান- সেই উদ্দেশেই ভারতের সমস্ত ধরনের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা চায় তিস্তার পানি চুক্তি না হোক।

শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকার পরিচালনাতে তার প্রভাব, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলাদেশে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু নির্যাতনের তত্ত্ব এবং সেই তত্ত্ব ব্যবহার করে ভারতে মুসলমানদের ওপর আর্থ-সামাজিক শারীরিক অত্যাচার চালাবার পথটা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে সেখানকার সংখ্যাগুরু মৌলবাদ যাতে শক্তিশালী হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি যাতে সেদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন চালাতে পারে, যার জেরে ভারতে মুসলমানদের ওপরে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাবে ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি- সেই পরিবেশ তৈরির চেষ্টাতেই মমতাকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদি তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদন করছেন না।

ভারত কী করে ফারাক্কা ব্যারেজের মতোই তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাংলাদেশের সমস্ত আপত্তিকে নস্যাৎ করে বাঁধ তৈরি করেছে- কংগ্রেস, বিজেপি বা মমতা কেউই কিন্তু সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি

মোদি-মমতার তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনে বাধার ভিতর দিয়ে শেখ হাসিনা বিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আরও শক্ত রাজনৈতিক জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। হাসিনা সম্পর্কে ‘ভারতপ্রেমী’ অপবাদ দিয়ে গোটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি তাকে যে রাজনৈতিকভাবে অপদস্ত করবার নিরন্তর চেষ্টা করে, তিস্তার পানি চুক্তি ঘিরে মোদি-মমতার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বদৌলতে বাংলাদেশ সরকার ব্যবসা বাণিজ্যসহ বহু ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের যে পর্যায় শুরু করেছেন তা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভিত্তিকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। বদরুদ্দিন উমরদের মতো কিছু কিছু স্বঘোষিত ‘চীনপন্থি’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাল থেকে ধারাবাহিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছিলেন। চীনের সময়োপযোগী নেতৃত্বের সেই ভুল ভাঙাতে সক্ষম হওয়া শেখ হাসিনার একটি বিশেষ কূটনৈতিক সাফল্য।

আরএসএস-বিজেপি-মমতার ত্রিবিধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, শেখ হাসিনা বিরোধী, সর্বপোরি বাংলাদেশ বিরোধী যে অবস্থান, তা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আগামীতে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। ত্রিবিধ শক্তির রাজনৈতিক কৌশলের ফলে বাংলাদেশের বিদেশ নীতিতে চীনের প্রতি যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, তা চীনের সঙ্গে বহুবিধ সীমান্ত সমস্যায় দীর্ণ ভারতকে আগামী দিনে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমেরিকাকে খুশি করতে বাংলাদেশকে চীনমুখী করে ভারতকে আরও আমেরিকামুখী করাও মোদি-মমতার অন্যতম উদ্দেশ্য কিনা- সময়ের সঙ্গেই তা পরিষ্কার হবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top