আলমগীর খান
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা গ্রন্থ ‘অব্যক্ত’ প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও জগদীশচন্দ্রের মানসিক গড়নের খবরও এখানে পাওয়া যায়। তিনি সেই সাধক যিনি তার চিন্তাকে কল্পনার উন্মুখ রাজ্যে অবাধে প্রেরণ করে আবার পর মুহূর্তে তাকে শাসনের অধীনে এনে প্রকৃতির বৈষম্যের মধ্যে একতার সন্ধানে ছুটেছেন এবং জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে এক সেতু বাধার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যা নিয়ে আশানুরূপ আলোচনা হয়নি তা হলো- এই মহান সাধকের ভেতরে ছিল এক চাপা বিদ্রোহ- ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে হৃদয়ের গহিনে তীব্র ক্ষোভের ধিকিধিকি জ্বলন্ত আগুন। তার প্রকাশ দেখা যায় নানাভাবে-দাউ দাউ করে জ্বলা অগ্নিশিখায় নয়, ছাইচাপা অঙ্গার থেকে প্রকাশিত উত্তাপে।
ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অগ্রদূত ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। জন্মেছিলেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর। জন্ম ভারতব্যাপী ইংরেজের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত মহাবিদ্রোহের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে সেই সময়ে, আর মৃত্যু হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে কেন্দ্র করে ভারত বিভক্তির বছর দশক আগে। অর্থাৎ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। দেখেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নৃশংস রূপ, দেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও একটি ঔপনিবেশিক দেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় প্রতিবন্ধকতা।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গৌরব জগদীশচন্দ্র বসুও। জগদীশচন্দ্র বসু মনেপ্রাণে ধারণ করতেন তার জন্মভূমি তৎকালীন পূর্ববঙ্গকে। জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, পড়ালেখা ফরিদপুরের একটি স্কুলে আর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরে। পরে পড়ালেখা করতে কোলকাতা হয়ে গেলেন ক্যামব্রিজ। পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও কী তিনি ভুলে গিয়েছিলেন মাতৃভূমি বাংলাকে এবং বিশেষ করে বিক্রমপুরকে যা এখন মুন্সীগঞ্জ?
মাতৃভূমির প্রতি জগদীশচন্দ্রের ভালোবাসা কেমন ছিল বোঝা যায় ১৯১১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনীর ময়মনসিংহ অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণে। ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ শীর্ষক এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কেহ এড়াইতে পারে না। সেই অদৃশ্য শক্তিবলে বহু বৎসর পরে আজ আমি আমার জন্মস্থানে উপনীত হইয়াছি। ... এই সাহিত্য-সম্মিলন বাঙ্গালীর মনের এক ঘনীভূত চেতনাকে বাংলা দেশের এক সীমা হইতে অন্য সীমায় বহন করিয়া চলিয়াছে এবং সফলতার চেষ্টাকে সর্বত্র গভীরভাবে জাগাইয়া তুলিতেছে।’
আর ১৯১৫ সালে মাতৃক্রোড়তুল্য বিক্রমপুরে ‘বোধন’ শীর্ষক প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই বিক্রমপুর বিক্রমশালী সন্তানের জন্মভূমি, মনুষ্যত্বহীন দুর্ব্বলের নহে। আমার পূজা হয়তো তিনি গ্রহণ করিয়াছেন, এই সাহসে ভর করিয়া আমি বহুদিন বিদেশে যাপন করিয়া জননীর স্নেহময় ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। হে জননী, তোমারই আশীর্ব্বাদে আমি বঙ্গভূমি এবং ভারতের সেবকরূপে গৃহীত হইয়াছি।’
মাতৃভাষা বাংলার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর দরদি। এ দিক থেকে আজীবন বন্ধু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার মিল লক্ষণীয়। ১৯২১-এ প্রকাশিত তার ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সে সময়ে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে পড়ার চল থাকলেও তার পিতা ভগবানচন্দ্র বসু তাকে বাঙলা স্কুলেই ভর্তি করেছিলেন। কেবল বিজ্ঞানের সাধানাই তিনি করেননি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে তাকে। বাংলাভাষায় পশ্চিমা বিজ্ঞানচর্চার সেই ঊষাপর্বে তার দুরূহ বৈজ্ঞানিক সাধনাসমূহের কথা বাংলায় লিখে দেশবাসীকে জানাতে থাকেন।
নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির নামও বাংলায় রাখতে শুরু করেছিলেন। গাছের বৃদ্ধি মাপার জন্য জগদীশচন্দ্র ক্রেস্কোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এ দিয়ে এক সেকেন্ডের সহস্রভাগের একভাগ মাপা যেত। এর মাধ্যমে তিনি পরিমাপ করেন যে, প্রতি মিনিটে গাছ এক ইঞ্চির লক্ষ ভাগের মধ্যে ৪২ ভাগ বাড়ে। ‘অব্যক্ত’ বইয়ের ‘দীক্ষা’ রচনাটিতে ‘আহতের সাড়া’ পরিচ্ছেদে তিনি জানান, তার ইচ্ছে ছিল কলটির নাম রাখেন ‘বৃদ্ধিমান’। সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি জানতেন ইংরেজের উচ্চারণে ‘বৃদ্ধিমান’ হয়ে যাবে ‘র্বাডোয়ান’।
প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরিতে ইংরেজ শিক্ষকদের সঙ্গে তার বেতনের বৈষম্য দেখে প্রতিবাদে বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়িয়েছিলেন তিন বছর। ইংরেজ ও পশ্চিমাদের এই অবজ্ঞার তীর তাকে জীবনে বহুবার বিদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানি ও লেখক আশরাফ আহমেদ জগদীশচন্দ্রের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার নমুনা হিসেবে লিখেছেন (বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি, ফেব্রুয়ারি ২০২১, ঢাকা): “স্বদেশী ও বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে তার ছাত্র মেঘনাদ সাহাকে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ধারণা করি জগদীশচন্দ্রের পেশা ও সামাজিক অবস্থান থেকে সেই যুগের বিপ্লবীদের মতো তিনি বৃটিশদের বিরোধিতা করতে পারেননি। কিন্তু অন্তত একটি ক্ষেত্রে সেই মনোভাব তিনি প্রকাশ করেছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ রচনাটি বলভদ্র থাপা নামে এক নেপালী বীরের ইংরেজের বিরুদ্ধে ১৮১৪ সালে কলুঙ্গা যুদ্ধের কাহিনী। তীর ধনুক ও ভাঙা বন্দুকে সজ্জিত কলুঙ্গার ৩০০ সৈন্য ইংরেজের সুসজ্জিত ৩৫০০ সৈন্যকে মাসাধিককাল ঠেকিয়ে রেখেছিল এবং ইংরেজ সেনাপতিকে নিহত করেছিল। পরবর্তীতে পরাজয় না মেনে যুদ্ধস্থল ত্যাগ করে রণজিত সিংহের শিখ সৈন্যদলের হয়ে আফগান যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে মৃত্যুবরণ করেন। শত্রুর এই বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইংরেজরা কলুঙ্গার সেই যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছিল। গল্পটি ঐতিহাসিক হলেও এতে জগদীশচন্দ্রের চরিত্রের স্বদেশপ্রীতিটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বর্ণিত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে নেপালি নারী, পুরুষ, ও শিশু যোদ্ধাকে এমন উচ্চস্থানে তুলে ধরেছেন যে তাদের প্রতি অসীম ভালোবাসা না থাকলে তা এভাবে কলমের কালিতে প্রকাশ পেতো না। এই গল্পে নেপালী যোদ্ধাদের উপরে তুলে ধরে প্রকারান্তরে আক্রমণকারী বৃটিশদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। এরপর ‘আহত উদ্ভিদ’ প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদটির (প্যারাগ্রাফ) দিকে লক্ষ্য করুন : ‘পশ্চিমে কয় বৎসর যাবত আকাশ ধুমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দৃষ্টি পৌঁছিত না। অপরিস্ফুট আর্তনাদ কামানের গর্জনে পরাহত। কিন্তু যেদিন হইতে শিখ ও পাঠান, গুরখা ও বাঙালি সেই মহারণে জীবন আহুতি দিতে গিয়াছে, সেদিন হইতে আমাদের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হঠাৎ বাড়িয়া গিয়াছে।’ অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধে পশ্চিমাদের নিজেদের বিবাদ মেটাতে মহান ভারতীয়রা জীবন বিসর্জন দিয়েছে!’
জগদীশচন্দ্রের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ লেখাটি পড়তে পড়তে যদি কারো মনে কল্পনা আসে যে, একাত্তরে বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের রাঢ়িখালের এই মহান বিজ্ঞানীও বৃদ্ধ কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতো আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইতেন, তবে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। বাংলা ১৩২৮এর পহেলা বৈশাখ ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের ‘কথারম্ভে’ জগদীশচন্দ্র লিখেছেন, ‘ভিতর ও বাহিরের উত্তেজনায় জীব কখনও কলরব কখনও আর্তনাদ করিয়া থাকে। মানুষ মাতৃক্রোড়ে যে ভাষা শিক্ষা করে সে ভাষাতেই সে আপনার সুখ-দুঃখ জ্ঞাপন করে।’
এ সম্পর্কে আশরাফ আহমেদ লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার সময় বেতন বৈষম্য এবং অনুমতি ব্যতিরেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েকটি মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে ভারত বা কোলকাতায় এ সংক্রান্ত কোনো আদালত না থাকায় আদালতটি ছিল বিলাতে। আদালতের ভাষাও ছিল ইংরেজি। জগদীশচন্দ্র বসু লিখেছেন, ‘জাতীয় জীবনের পক্ষে ইহা অপেক্ষা অপমান আর কি হইতে পারে?’
উল্লেখ্য, এই মহান বিজ্ঞানি তার গবেষণাসমূহের ফলাফল সর্বপ্রথমে প্রকাশ করেছেন মাতৃভাষা বাংলায়। তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোও প্রথমে প্রদর্শন করেছিলেন স্বদেশে। বর্তমানে বাংলা ভাষার দুরবস্থায় আমাদের শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক প্রায় কেউ আর অপমান বোধ করেন না। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসুর যে ‘অব্যক্ত’ আর্তনাদ ও নীরব বিদ্রোহ তা হয়তো কারও মনে পড়ে না। মহান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ও মৃত্যু দিবস দুটি আমাদের জীবনে নীরবে আসে ও অব্যক্ত থেকে চলে যায়। জগদীশের বৃক্ষরা সাড়া দিলেও আমরা দেই না বললেই চলে।
[লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]
আলমগীর খান
রোববার, ২৭ নভেম্বর ২০২২
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা গ্রন্থ ‘অব্যক্ত’ প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও জগদীশচন্দ্রের মানসিক গড়নের খবরও এখানে পাওয়া যায়। তিনি সেই সাধক যিনি তার চিন্তাকে কল্পনার উন্মুখ রাজ্যে অবাধে প্রেরণ করে আবার পর মুহূর্তে তাকে শাসনের অধীনে এনে প্রকৃতির বৈষম্যের মধ্যে একতার সন্ধানে ছুটেছেন এবং জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে এক সেতু বাধার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যা নিয়ে আশানুরূপ আলোচনা হয়নি তা হলো- এই মহান সাধকের ভেতরে ছিল এক চাপা বিদ্রোহ- ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে হৃদয়ের গহিনে তীব্র ক্ষোভের ধিকিধিকি জ্বলন্ত আগুন। তার প্রকাশ দেখা যায় নানাভাবে-দাউ দাউ করে জ্বলা অগ্নিশিখায় নয়, ছাইচাপা অঙ্গার থেকে প্রকাশিত উত্তাপে।
ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অগ্রদূত ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। জন্মেছিলেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর। জন্ম ভারতব্যাপী ইংরেজের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত মহাবিদ্রোহের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে সেই সময়ে, আর মৃত্যু হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে কেন্দ্র করে ভারত বিভক্তির বছর দশক আগে। অর্থাৎ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। দেখেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নৃশংস রূপ, দেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও একটি ঔপনিবেশিক দেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় প্রতিবন্ধকতা।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গৌরব জগদীশচন্দ্র বসুও। জগদীশচন্দ্র বসু মনেপ্রাণে ধারণ করতেন তার জন্মভূমি তৎকালীন পূর্ববঙ্গকে। জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, পড়ালেখা ফরিদপুরের একটি স্কুলে আর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরে। পরে পড়ালেখা করতে কোলকাতা হয়ে গেলেন ক্যামব্রিজ। পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও কী তিনি ভুলে গিয়েছিলেন মাতৃভূমি বাংলাকে এবং বিশেষ করে বিক্রমপুরকে যা এখন মুন্সীগঞ্জ?
মাতৃভূমির প্রতি জগদীশচন্দ্রের ভালোবাসা কেমন ছিল বোঝা যায় ১৯১১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনীর ময়মনসিংহ অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণে। ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ শীর্ষক এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কেহ এড়াইতে পারে না। সেই অদৃশ্য শক্তিবলে বহু বৎসর পরে আজ আমি আমার জন্মস্থানে উপনীত হইয়াছি। ... এই সাহিত্য-সম্মিলন বাঙ্গালীর মনের এক ঘনীভূত চেতনাকে বাংলা দেশের এক সীমা হইতে অন্য সীমায় বহন করিয়া চলিয়াছে এবং সফলতার চেষ্টাকে সর্বত্র গভীরভাবে জাগাইয়া তুলিতেছে।’
আর ১৯১৫ সালে মাতৃক্রোড়তুল্য বিক্রমপুরে ‘বোধন’ শীর্ষক প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই বিক্রমপুর বিক্রমশালী সন্তানের জন্মভূমি, মনুষ্যত্বহীন দুর্ব্বলের নহে। আমার পূজা হয়তো তিনি গ্রহণ করিয়াছেন, এই সাহসে ভর করিয়া আমি বহুদিন বিদেশে যাপন করিয়া জননীর স্নেহময় ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। হে জননী, তোমারই আশীর্ব্বাদে আমি বঙ্গভূমি এবং ভারতের সেবকরূপে গৃহীত হইয়াছি।’
মাতৃভাষা বাংলার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর দরদি। এ দিক থেকে আজীবন বন্ধু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার মিল লক্ষণীয়। ১৯২১-এ প্রকাশিত তার ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সে সময়ে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে পড়ার চল থাকলেও তার পিতা ভগবানচন্দ্র বসু তাকে বাঙলা স্কুলেই ভর্তি করেছিলেন। কেবল বিজ্ঞানের সাধানাই তিনি করেননি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে তাকে। বাংলাভাষায় পশ্চিমা বিজ্ঞানচর্চার সেই ঊষাপর্বে তার দুরূহ বৈজ্ঞানিক সাধনাসমূহের কথা বাংলায় লিখে দেশবাসীকে জানাতে থাকেন।
নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির নামও বাংলায় রাখতে শুরু করেছিলেন। গাছের বৃদ্ধি মাপার জন্য জগদীশচন্দ্র ক্রেস্কোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এ দিয়ে এক সেকেন্ডের সহস্রভাগের একভাগ মাপা যেত। এর মাধ্যমে তিনি পরিমাপ করেন যে, প্রতি মিনিটে গাছ এক ইঞ্চির লক্ষ ভাগের মধ্যে ৪২ ভাগ বাড়ে। ‘অব্যক্ত’ বইয়ের ‘দীক্ষা’ রচনাটিতে ‘আহতের সাড়া’ পরিচ্ছেদে তিনি জানান, তার ইচ্ছে ছিল কলটির নাম রাখেন ‘বৃদ্ধিমান’। সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি জানতেন ইংরেজের উচ্চারণে ‘বৃদ্ধিমান’ হয়ে যাবে ‘র্বাডোয়ান’।
প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরিতে ইংরেজ শিক্ষকদের সঙ্গে তার বেতনের বৈষম্য দেখে প্রতিবাদে বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়িয়েছিলেন তিন বছর। ইংরেজ ও পশ্চিমাদের এই অবজ্ঞার তীর তাকে জীবনে বহুবার বিদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানি ও লেখক আশরাফ আহমেদ জগদীশচন্দ্রের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার নমুনা হিসেবে লিখেছেন (বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি, ফেব্রুয়ারি ২০২১, ঢাকা): “স্বদেশী ও বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে তার ছাত্র মেঘনাদ সাহাকে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ধারণা করি জগদীশচন্দ্রের পেশা ও সামাজিক অবস্থান থেকে সেই যুগের বিপ্লবীদের মতো তিনি বৃটিশদের বিরোধিতা করতে পারেননি। কিন্তু অন্তত একটি ক্ষেত্রে সেই মনোভাব তিনি প্রকাশ করেছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ রচনাটি বলভদ্র থাপা নামে এক নেপালী বীরের ইংরেজের বিরুদ্ধে ১৮১৪ সালে কলুঙ্গা যুদ্ধের কাহিনী। তীর ধনুক ও ভাঙা বন্দুকে সজ্জিত কলুঙ্গার ৩০০ সৈন্য ইংরেজের সুসজ্জিত ৩৫০০ সৈন্যকে মাসাধিককাল ঠেকিয়ে রেখেছিল এবং ইংরেজ সেনাপতিকে নিহত করেছিল। পরবর্তীতে পরাজয় না মেনে যুদ্ধস্থল ত্যাগ করে রণজিত সিংহের শিখ সৈন্যদলের হয়ে আফগান যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে মৃত্যুবরণ করেন। শত্রুর এই বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইংরেজরা কলুঙ্গার সেই যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছিল। গল্পটি ঐতিহাসিক হলেও এতে জগদীশচন্দ্রের চরিত্রের স্বদেশপ্রীতিটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বর্ণিত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে নেপালি নারী, পুরুষ, ও শিশু যোদ্ধাকে এমন উচ্চস্থানে তুলে ধরেছেন যে তাদের প্রতি অসীম ভালোবাসা না থাকলে তা এভাবে কলমের কালিতে প্রকাশ পেতো না। এই গল্পে নেপালী যোদ্ধাদের উপরে তুলে ধরে প্রকারান্তরে আক্রমণকারী বৃটিশদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। এরপর ‘আহত উদ্ভিদ’ প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদটির (প্যারাগ্রাফ) দিকে লক্ষ্য করুন : ‘পশ্চিমে কয় বৎসর যাবত আকাশ ধুমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দৃষ্টি পৌঁছিত না। অপরিস্ফুট আর্তনাদ কামানের গর্জনে পরাহত। কিন্তু যেদিন হইতে শিখ ও পাঠান, গুরখা ও বাঙালি সেই মহারণে জীবন আহুতি দিতে গিয়াছে, সেদিন হইতে আমাদের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হঠাৎ বাড়িয়া গিয়াছে।’ অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধে পশ্চিমাদের নিজেদের বিবাদ মেটাতে মহান ভারতীয়রা জীবন বিসর্জন দিয়েছে!’
জগদীশচন্দ্রের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ লেখাটি পড়তে পড়তে যদি কারো মনে কল্পনা আসে যে, একাত্তরে বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের রাঢ়িখালের এই মহান বিজ্ঞানীও বৃদ্ধ কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতো আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইতেন, তবে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। বাংলা ১৩২৮এর পহেলা বৈশাখ ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের ‘কথারম্ভে’ জগদীশচন্দ্র লিখেছেন, ‘ভিতর ও বাহিরের উত্তেজনায় জীব কখনও কলরব কখনও আর্তনাদ করিয়া থাকে। মানুষ মাতৃক্রোড়ে যে ভাষা শিক্ষা করে সে ভাষাতেই সে আপনার সুখ-দুঃখ জ্ঞাপন করে।’
এ সম্পর্কে আশরাফ আহমেদ লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার সময় বেতন বৈষম্য এবং অনুমতি ব্যতিরেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েকটি মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে ভারত বা কোলকাতায় এ সংক্রান্ত কোনো আদালত না থাকায় আদালতটি ছিল বিলাতে। আদালতের ভাষাও ছিল ইংরেজি। জগদীশচন্দ্র বসু লিখেছেন, ‘জাতীয় জীবনের পক্ষে ইহা অপেক্ষা অপমান আর কি হইতে পারে?’
উল্লেখ্য, এই মহান বিজ্ঞানি তার গবেষণাসমূহের ফলাফল সর্বপ্রথমে প্রকাশ করেছেন মাতৃভাষা বাংলায়। তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোও প্রথমে প্রদর্শন করেছিলেন স্বদেশে। বর্তমানে বাংলা ভাষার দুরবস্থায় আমাদের শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক প্রায় কেউ আর অপমান বোধ করেন না। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসুর যে ‘অব্যক্ত’ আর্তনাদ ও নীরব বিদ্রোহ তা হয়তো কারও মনে পড়ে না। মহান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ও মৃত্যু দিবস দুটি আমাদের জীবনে নীরবে আসে ও অব্যক্ত থেকে চলে যায়। জগদীশের বৃক্ষরা সাড়া দিলেও আমরা দেই না বললেই চলে।
[লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]