alt

উপ-সম্পাদকীয়

যুদ্ধ ও মানবসভ্যতা

মোশারফ হোসেন

: রোববার, ২৭ নভেম্বর ২০২২

আধুনিক সভ্যতার দ্রুত উন্নতি-অগ্রগতি-প্রগতির ফসল রূপে অপার সম্ভবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রকৃতি জগৎময় ও মর্ত্যরে মানুষের জয়ের প্রবল নেশা, ইচ্ছাশক্তি, অজানাকে জানার, নতুনকে আলিঙ্গন করার ব্যাকুলতা, পারস্পরিক যোগাযোগ সৃষ্টি ও সমন্বয় সাধন, বিভিন্ন আবিষ্কার-উদ্ভাবন, কর্মক্ষেত্রের বৈচিত্র্যতা, দক্ষতা বৃদ্ধি, মানব সম্পদ তৈরি, জ্ঞান বিজ্ঞানে অভাবনীয় সাফল্য, বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি- কৌশল, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, সাংস্কৃতিক চর্চা, মেধা-মননশীলতা, প্রতিভার বিকাশের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের বিশ্বব্রহ্মা- নিয়ে জানবার, নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।

অন্যদিকে মানুষের জ্ঞান-প্রজ্ঞা-সংযত-সংহতি, সহমর্মিতা-সহশীলতা মনোভাব, ভাব ভালোবাসার প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। আধুনিক যুগে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনার মধ্য থেকেও উদ্ভাবন আবিষ্কার প্রগতিবাদীতার আড়ালে যে সৃষ্টিশীলতা অনুসন্ধিৎসা ও নান্দনিকতা, নন্দনচিন্তা, সত্যানুসন্ধান শান্তি, সমৃদ্ধি প্রতিনিয়ত বিনষ্ট হচ্ছে। একদিন যুদ্ধকে মনে করা হতো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। বাণিজ্য জয়ের নেশায়, নতুন নতুন স্থান, দেশ আবিষ্কারের নেশায় মদ-মত্ততায় মানুষ বিরল খেতাবে ভূষিত হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণী দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। সভ্যতার সেই প্রত্যুষ থেকেই যুদ্ধ, সংঘর্ষ, রক্তপাত কখনো বা শান্তির বাণী। নানাভাবে নামা স্তরে, নানা কৌশলে, নানা প্রেক্ষাপটে স্থান যুগ-যুগব্যাপী। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে প্রভুত্ব বিস্তারের বিলাসিতা। যুদ্ধ মানে সভ্যতার বিনাশ, ধ্বংস-লীলা, আগুনের লেলিহান শিখা, হতাহত, বীভৎসতা, লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা। যুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাওয়া কোন আকস্মিক সাময়িক, মামুলি ঘটনা নয়। আবার স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে কোন ব্যক্তি বা দলের কেবলমাত্র সংঘাতে লিপ্ত হওয়া নয়। যুদ্ধ হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতিকরণ ও দীর্ঘ সময়, দেন দরবার, হুমকি চলমান পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধামকি, সর্তক সংকেত নানা আশ্রয় অবলম্বন করে আপন প্রজাতির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দলবদ্ধ আক্রমণ। ধর্মযাজক ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, মনোবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, দার্শনিক কূটনৈতিক অনেকে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন নানাভাবে। সুচিন্তিতভাবে, সুদূরপ্রসারী, চিন্তার জায়গা থেকে। আবার অনুমানভিত্তিক চিন্তা থেকে। এই মতামত কখনো কখনো অসমর্থিত চিন্তানির্ভর হয়ে থাকে, আবার কখনো বা যুদ্ধের কার্যকারণ ব্যাখ্যা সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক বিশ্লেষণে, অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে। ইতিহাসবিদ আরনন্ড টয়েনবি যুদ্ধ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন এভাবে যে, যুদ্ধকে একটি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা বলে তিনি মেনে নিয়েছেন।

যুদ্ধের বা যুদ্ধ বাধার নানাবিদ কারণ রয়েছে একনায়কতন্ত্র, জাত্যাভিমান, ব্যক্তিগত অহমবোধ, একগুঁয়েমিতা, সাম্রাজ্যবাদিতা, অরিণামদর্শীতা, দখলদারিত্বতা, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদিতা, কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব, অপকৌশল, হীনতা-দীনতা মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া। পুরো বিশ্ব একটি ক্রান্তিলগ্নে বীভিষীকাময় ভয়াল পরিস্থিতির অশনি সংকেতের পূর্বাভাস অনাগত দিনগুলোকে করবে অনিশ্চিত। সমগ্র পৃথিবী তাই মানুষসহ এ গ্রহের সফল জীবন পরিবেশ প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, শিক্ষা সাহিত্য সাধনা, সংস্কৃত চর্চা, মূল্যবোধ, মানবতা, সাময়িকরণ, শান্তি সমৃদ্ধিকরণ- প্রগতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংগীত চর্চা, খেলাধুলা সংহতি সভ্যতা চর্চা সভ্যতা বিলুপ্তির ঝুঁকির দোলনার ঝুলছে। সভ্যতার সমস্ত আরোহণ সঞ্চয় সম্ভবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে যুদ্ধ। আগামী প্রজন্ম অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিয়ে ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে ধ্বংসের দামামা বাধিয়ে পৃথিবীকে করবে প্রবৃত্তি। মানুষ মানবিক মূল্যবোধহীন হয়ে আত্মঘাতী যুদ্ধেই হয় না বরং তার মধ্যে পশুসুলভ হি¯্র প্রকৃতি উপস্থিতি বিদ্যমান বলেই সে আপন প্রজাতির জন্য এবং নিজের বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হি¯্র, থাবা ও দন্তহীন মানুষ তার জৈব গঠনের বৈশিষ্ট্য অনুসঙ্গরূপে আক্রমণের কৌশল পদ্ধতি দক্ষতা নেকড়ের মতো হলেও যুদ্ধেও আড়ালে নৃসিংসতহা, যুদ্ধহীনতা, লোলুপতা, শক্তি-সাহস-ক্ষমতা লিপ্সা মানবকে দানবে পরিণত করে। যুদ্ধেও বিভীষিকাময়তার ছোবলে উদ্ভিদ প্রাণীকূল তথা মানবকূলের ওপর বিরূপ প্রভাব ভূত-ভবিষ্যতে পুষিয়ে উঠা সত্যি দুরূহ ব্যাপার হবে।

একদিন যুদ্ধকে মনে করা হতো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক অনুসন্ধিৎসুতা, জয়ের নেশা, নতুনকে জানার বুঝার কৌতূহল মানুষকে জল পথ থেকে আকাশ পথ আবিষ্কার জীবন-জীবিকার সন্ধানে নিরন্তর ছুটে চলছে দেশ থেকে দেশান্তরে যুগ থেকে যুগান্তরে।

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার নামে দুর্যোগের ঘনঘটা বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে সভ্যতা ধ্বংসের পথে মানবতা লঙ্গিত হচ্ছে। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, রাসায়নিক জৈব ও পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন, স্তূপীকরণ এবং অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন ও দূরে নিক্ষেপণের মরাণাস্ত্রের আয়োজন দায়িত্বকান্ডজ্ঞানহীন অপরিণামদর্শী, জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়নায় তাড়িত হয়ে তৈরি করেছে ভয়াবহ সব যুদ্ধাস্ত্র, পারমাণবিক, রাসায়নিক, জীবনু যুদ্ধের অন্তহীন প্রাচুর্য ও উন্নতির সম্ভবনা সমগ্র মানব সভ্যতাকে বিলীন করার আত্মঘাতী প্রচেষ্টা শুধু মানবজাতিকেই নয় সমস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণিকূলকে জটিল সমীকরণে ফেলে দিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সভ্যতা ইঞ্জিনকে প্রচন্ড শক্তি দিয়েছে। মেধা-মননশীলতা সুদূরপ্রসারী চিন্তা, জ্ঞান সাধনা, নতুন উদ্ভাবন উদ্ভাবনী শক্তি সৃষ্টির বিজয় উল্লাস, বিজ্ঞানের আশ্রয়ে বৈজ্ঞানিক নতুন তত্ত্ব তথ্যের সম্মলনে পৃথিবী যেমন আশির্বাদপুষ্ট হয়েছে আবার বিপরীতে ধ্বংসের পরস্পরবিরোধী সম্ভবনাকে আশঙ্কার বার্তা দিয়েছে। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি বিবেক নিরলস চেষ্টা, কৌশল দিয়ে খুঁজে পেল অজ্ঞাত শক্তির উৎস। মানুষ হয়ে উঠল আরও শক্তিধর। বানালো নতুন অস্ত্র পারমাণবিক বোমা, মর্টার শেল। এসব মরণাস্ত্রের নিক্ষেপন, নৃশংসতা, অপচয়, অমানবিকতা, উন্মাদনার সীমাই শুধু অতিক্রম করেনি মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির এক দুর্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

কারও এখন অজানা নেই যুদ্ধের প্রস্তুতির আড়ালে যুদ্ধকালীন, যুদ্ধপরবর্তী সময় ভোগ করতে হয় নিদারুণ দুঃখ, জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, আপনজন হারানোর বেদনা, প্রতিশোধপরায়ণতা নতুনরূপে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণান্তর চেষ্টা, জাতিগত বিদ্বেষ, প্রজন্ম ধ্বংসের অপূরণীয় ক্ষতি-অবিশ্বাস, উসকানি, অশ্রদ্ধা, মৃত্যু-ক্ষুধা, উপবাস, অপুষ্টি, খাদ্য ঘাটতি, অর্থনৈতিক মন্দা, অবকাঠামোর ধ্বংস, আর্থসামাজিক-স্বাংস্কৃতিক ক্ষতি অর্থাৎ তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার বিনাশ।

যুদ্ধের প্রস্তুতির মধ্যে বাণিজ্যকভাবে সহযোগিতা, কূটনৈতিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত হয় আত্মরক্ষা, আত্মত্যাগ, পারস্পারিক সহযোগিতা সন্ত্রাস দমন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শ্রম বাজার সৃষ্টি, বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান, অবকাঠামো উন্নয়ন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, স্বপ্নপূরণের হাতকে প্রসারিতকরণ কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন যে ভূরাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন, যুদ্ধাস্ত্রের বাজার সৃষ্টি, আধিপত্য ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে কায়েমী র্স্বাথ হাসিল সংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীতা, মিথ্যা আশ্বাস, বিভ্রান্তিকরণ মিথ্যা প্রলোভন। যুদ্ধের পিছনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ কার্যকর তা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

সভ্যতা একটি সজীব-সক্রিয়, প্রাণবন্ত প্রাণ প্রাচুর্যতা সম্পন্ন বাড়ন্ত প্রাণীর মতো অফুরন্ত সুযোগ, সম্ভাবণা, উন্নতি-প্রগতিশীলতা, উন্নত চিন্তা সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা যার একটি অনিবার্যতা আছে। আছে স্বপ্ন পূরণের অবধারিত সুযোগ উন্নত জীবনবোধ। যুদ্ধের আতঙ্ক, অপচয়, অসঙ্গতি, সভ্যতার সহজাত বিকাশের পথ প্রক্রিয়ার জন্য একটি মারাত্মক ব্যাধি। নিত্য দিনের স্বাভাবিক জীবন, স্বপ্ন পূরণের একান্ত প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অভিজ্ঞতা, উপলদ্ধি, সত্যানুসন্ধান, উৎপাদিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিনিময়, অভিজ্ঞতা, গভীর উপলদ্ধি, দেশীয় আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকে সূক্ষ্ম বুনন, সম্প্রীতির বন্ধনের ক্ষেত্রে যে ঐক্য সৃষ্টি করে যুদ্ধ কাজ করে তার বিপরীতে। সভ্যতার এই সুস্থতাকে যুদ্ধাতঙ্ক আক্রমণ করে তখন এর প্রতিরোধক, প্রতিষেধক, অনুঘটন হিসেবে একান্তভাবে প্রয়োজন পড়ে স্বচ্ছতা, কার্যকরি যোগাযোগ, মানসিক সংযোগ, বুদ্ধিগত বিকাশ, দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক, বোঝাপড়া, মূল্যবোধ, সত্যের অনুসন্ধান সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে কার্যকরি ভূমিকা রাখে। যুদ্ধোত্তর সংলাপ, বাক পটুতা, সাংস্কৃতিক সংযোগ বিনিময়, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতা, বুদ্ধিগত উৎকর্ষতা, মানবতা, আলোকিত মানব সমাজ গড়ার মূলমন্ত্র এহেন সমস্যাকে লাগব করতে সমর্থ হবে বলে বিশ্বাস। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার তথা পারমাণবিক জুয়া খেলা ভবিষ্যৎ সুখ-সমৃদ্ধি বিশ্বব্যাপি শান্তির নববার্তা, আলোকময় ভুবনকে নরকে পরিণত করবে। নিঃসন্দেহে বিচারহীনতা তার সংস্কৃতি, যুদ্ধপরাধী, যুদ্ধবন্ধি বেড়ে যাবে। অসংখ্য বিয়োগান্তক হৃদয় বিদারক ঘটনার মহাপুঞ্জিভূতকরণ হবে। বিশ্ব মাঝে বেড়ে যাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব শান্তি ভূলুণ্ঠিত হবে। পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা যতো বৃদ্ধি পাচ্ছে, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভবনা এবং আনুষাঙ্গিক ধ্বংসযজ্ঞের আশংখা ঘনীভূত হচ্ছে। অকল্পণীয় , অপূরণীয় ক্ষতির মহাপ্লাবনে সভ্যতা বিলুপ্তি তথা মানবকূলের বিপন্নতার বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে যে তেজস্ক্রীয় বিকীরণ এবং তেজস্ক্রীয় ধুলিকণা ছড়িয়ে পড়লে আকাশ-বাতাস তেজস্ক্রীয় দূষণে দূষিত হবে। তাতে মানব জাতির এই ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। যুদ্ধাস্ত্রের জায়গা দখল করে নিয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। ভারী পরমাণুু বিভাজিত হয়ে নানা উপায়ে অবলম্বনে তৈরি হয়েছে পারমাণবিক বোমা। রসায়ন শাস্ত্রকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে বিস্ফোরক বোমা এবং পরবর্তীতে স্নায়ু গ্যাস। প্রাণিবিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সাধন করে সৃষ্টি হয়েছে জীবাণু অস্ত্র। যন্ত্র প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে কামান, যুদ্ধট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ। পারমাণবিক পরীক্ষা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলে সৃষ্টি তেজস্ক্রিয় বিকিরণে মানব প্রজাতির জিনগত সমস্যা তৈরি হবে। মানবমৃত্যু, দৈহিক বিকৃতি, মানসিক বিবৃতি, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা কোনোভাবেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। যেকোন যুদ্ধ সামাজিক, প্রকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে জীববৈচিত্র্য, বিলুপ্তি, প্রজাতি ধ্বংস, সাধন করে, অধিকারকে খর্ব করে। শোষিত বঞ্চিত, নিপীড়িত বাসযোগ্যহীনতা, জুলুম-নির্যাতন, পাশবিকতা, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুমন্ত্রণার ওপর পারমাণবিক তেজস্ক্রীয় বিকিকরণের প্রভাব পরিসংখ্যানিক, গাণিতিক হিসাব দ্বারা ক্ষতির পরিমাপ কোনোভাবেই নিরূপন করা সম্ভব নয়। আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে ভবিষ্যতের একজন মানুষের মৃত্যু হয়। একটি শিশুও যদি বিকালঙ্গের শিকার হয়, তাহলে সে অপরাধ হবে ক্ষমার অযোগ্য। বিশ্বের সব মানুষ স্বস্তিতে বাঁচতে চায়। সুন্দর-সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার সবারই আছে। যুদ্ধাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ গবেষণার আনুষাঙ্গিক কর্মকান্ডে, যুদ্ধের কৌশলের রূপরেখা প্রণয়নে আগে-পরে যে অর্থ, সম্পদ,জান-মাল, ইজ্জত আব্রু, মানব সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যয়, সময়, মেধা, শ্রম, সৃজনশীলতা, প্রগতিরচিন্তা, শিল্প সাহিত্য চর্চায় যে আপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হয় সেটির বিকল্প কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবার নয়।

স্বদেশ প্রেম জাতীয়বাদের জন্ম দেয়। এটি একটি অনুভূতি, মহৎ গুণ। কিন্তু উগ্র জাতীয়বাদ যেমন আন্তর্জাতিকতাবাদের অংশ কোনোভাবেই হতে পারে না তেমনি প্রেম- প্রীতিহীন মানবিক মূল্যবোধহীনতা অন্যের প্রতি সহমর্মিতা সম্প্রীতিহীন, সংযমহীনতা জাতিগত দাঙ্গা, অরাজনীতিকরণ, সমরনীতিবর্হিভূত, সীমান্তে সুরক্ষাহীনতা, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত কর্মকান্ড হিংসা বিদ্বেষের বিষবাষ্প মরণাস্ত্রের পাহাড় জাতিগত বিভেদের দেয়ালে সুবিশাল প্রাচীর তৈরি করেই চলছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে সোচ্চার হতে হবে। মানব মুক্তির লক্ষ্যে শান্তির অমোঘ বাণী প্রচার করতে হবে স্ব-স্ব জায়গা থেকে বিশ্ব শান্তি কোন অবান্তর কল্পনা নয়। এই অসুস্থতা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা, মানবতা চর্চা, মূল্যবোধ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দরকে লালন পালন। শান্তির বাণী পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। মানব ধর্ম পরম ধর্ম। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। বিশ্ববাসীর প্রতি উদাও আহ্বান জানাচ্ছি। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বকে রক্ষার আওয়াজ তুলতে হবে। এভাবে- ‘আর যুদ্ধ নয়।/ আর নয় মায়েদের কান্না/ রক্ত কি, ধ্বংস কি, যুদ্ধ-আর না,/ আর না।’ সত্য, ন্যায়, সুন্দর সাম্য, মৈত্রী, অন্তর আত্মার বিকাশ প্রস্ফুটিত হোক। সত্য-শিক্ষা ও সত্যের সন্ধান করার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বমানবতার অতন্ত্র প্রহরী হয়ে বিশ্বপ্রেমের মূলমন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত হলে মানবতার জয় হবে।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা ]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

যুদ্ধ ও মানবসভ্যতা

মোশারফ হোসেন

রোববার, ২৭ নভেম্বর ২০২২

আধুনিক সভ্যতার দ্রুত উন্নতি-অগ্রগতি-প্রগতির ফসল রূপে অপার সম্ভবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রকৃতি জগৎময় ও মর্ত্যরে মানুষের জয়ের প্রবল নেশা, ইচ্ছাশক্তি, অজানাকে জানার, নতুনকে আলিঙ্গন করার ব্যাকুলতা, পারস্পরিক যোগাযোগ সৃষ্টি ও সমন্বয় সাধন, বিভিন্ন আবিষ্কার-উদ্ভাবন, কর্মক্ষেত্রের বৈচিত্র্যতা, দক্ষতা বৃদ্ধি, মানব সম্পদ তৈরি, জ্ঞান বিজ্ঞানে অভাবনীয় সাফল্য, বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি- কৌশল, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, সাংস্কৃতিক চর্চা, মেধা-মননশীলতা, প্রতিভার বিকাশের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের বিশ্বব্রহ্মা- নিয়ে জানবার, নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।

অন্যদিকে মানুষের জ্ঞান-প্রজ্ঞা-সংযত-সংহতি, সহমর্মিতা-সহশীলতা মনোভাব, ভাব ভালোবাসার প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। আধুনিক যুগে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনার মধ্য থেকেও উদ্ভাবন আবিষ্কার প্রগতিবাদীতার আড়ালে যে সৃষ্টিশীলতা অনুসন্ধিৎসা ও নান্দনিকতা, নন্দনচিন্তা, সত্যানুসন্ধান শান্তি, সমৃদ্ধি প্রতিনিয়ত বিনষ্ট হচ্ছে। একদিন যুদ্ধকে মনে করা হতো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। বাণিজ্য জয়ের নেশায়, নতুন নতুন স্থান, দেশ আবিষ্কারের নেশায় মদ-মত্ততায় মানুষ বিরল খেতাবে ভূষিত হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণী দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। সভ্যতার সেই প্রত্যুষ থেকেই যুদ্ধ, সংঘর্ষ, রক্তপাত কখনো বা শান্তির বাণী। নানাভাবে নামা স্তরে, নানা কৌশলে, নানা প্রেক্ষাপটে স্থান যুগ-যুগব্যাপী। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে প্রভুত্ব বিস্তারের বিলাসিতা। যুদ্ধ মানে সভ্যতার বিনাশ, ধ্বংস-লীলা, আগুনের লেলিহান শিখা, হতাহত, বীভৎসতা, লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা। যুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাওয়া কোন আকস্মিক সাময়িক, মামুলি ঘটনা নয়। আবার স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে কোন ব্যক্তি বা দলের কেবলমাত্র সংঘাতে লিপ্ত হওয়া নয়। যুদ্ধ হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতিকরণ ও দীর্ঘ সময়, দেন দরবার, হুমকি চলমান পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধামকি, সর্তক সংকেত নানা আশ্রয় অবলম্বন করে আপন প্রজাতির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দলবদ্ধ আক্রমণ। ধর্মযাজক ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, মনোবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, দার্শনিক কূটনৈতিক অনেকে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন নানাভাবে। সুচিন্তিতভাবে, সুদূরপ্রসারী, চিন্তার জায়গা থেকে। আবার অনুমানভিত্তিক চিন্তা থেকে। এই মতামত কখনো কখনো অসমর্থিত চিন্তানির্ভর হয়ে থাকে, আবার কখনো বা যুদ্ধের কার্যকারণ ব্যাখ্যা সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক বিশ্লেষণে, অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে। ইতিহাসবিদ আরনন্ড টয়েনবি যুদ্ধ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন এভাবে যে, যুদ্ধকে একটি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা বলে তিনি মেনে নিয়েছেন।

যুদ্ধের বা যুদ্ধ বাধার নানাবিদ কারণ রয়েছে একনায়কতন্ত্র, জাত্যাভিমান, ব্যক্তিগত অহমবোধ, একগুঁয়েমিতা, সাম্রাজ্যবাদিতা, অরিণামদর্শীতা, দখলদারিত্বতা, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদিতা, কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব, অপকৌশল, হীনতা-দীনতা মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া। পুরো বিশ্ব একটি ক্রান্তিলগ্নে বীভিষীকাময় ভয়াল পরিস্থিতির অশনি সংকেতের পূর্বাভাস অনাগত দিনগুলোকে করবে অনিশ্চিত। সমগ্র পৃথিবী তাই মানুষসহ এ গ্রহের সফল জীবন পরিবেশ প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, শিক্ষা সাহিত্য সাধনা, সংস্কৃত চর্চা, মূল্যবোধ, মানবতা, সাময়িকরণ, শান্তি সমৃদ্ধিকরণ- প্রগতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংগীত চর্চা, খেলাধুলা সংহতি সভ্যতা চর্চা সভ্যতা বিলুপ্তির ঝুঁকির দোলনার ঝুলছে। সভ্যতার সমস্ত আরোহণ সঞ্চয় সম্ভবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে যুদ্ধ। আগামী প্রজন্ম অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিয়ে ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে ধ্বংসের দামামা বাধিয়ে পৃথিবীকে করবে প্রবৃত্তি। মানুষ মানবিক মূল্যবোধহীন হয়ে আত্মঘাতী যুদ্ধেই হয় না বরং তার মধ্যে পশুসুলভ হি¯্র প্রকৃতি উপস্থিতি বিদ্যমান বলেই সে আপন প্রজাতির জন্য এবং নিজের বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হি¯্র, থাবা ও দন্তহীন মানুষ তার জৈব গঠনের বৈশিষ্ট্য অনুসঙ্গরূপে আক্রমণের কৌশল পদ্ধতি দক্ষতা নেকড়ের মতো হলেও যুদ্ধেও আড়ালে নৃসিংসতহা, যুদ্ধহীনতা, লোলুপতা, শক্তি-সাহস-ক্ষমতা লিপ্সা মানবকে দানবে পরিণত করে। যুদ্ধেও বিভীষিকাময়তার ছোবলে উদ্ভিদ প্রাণীকূল তথা মানবকূলের ওপর বিরূপ প্রভাব ভূত-ভবিষ্যতে পুষিয়ে উঠা সত্যি দুরূহ ব্যাপার হবে।

একদিন যুদ্ধকে মনে করা হতো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক অনুসন্ধিৎসুতা, জয়ের নেশা, নতুনকে জানার বুঝার কৌতূহল মানুষকে জল পথ থেকে আকাশ পথ আবিষ্কার জীবন-জীবিকার সন্ধানে নিরন্তর ছুটে চলছে দেশ থেকে দেশান্তরে যুগ থেকে যুগান্তরে।

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার নামে দুর্যোগের ঘনঘটা বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে সভ্যতা ধ্বংসের পথে মানবতা লঙ্গিত হচ্ছে। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, রাসায়নিক জৈব ও পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন, স্তূপীকরণ এবং অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন ও দূরে নিক্ষেপণের মরাণাস্ত্রের আয়োজন দায়িত্বকান্ডজ্ঞানহীন অপরিণামদর্শী, জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়নায় তাড়িত হয়ে তৈরি করেছে ভয়াবহ সব যুদ্ধাস্ত্র, পারমাণবিক, রাসায়নিক, জীবনু যুদ্ধের অন্তহীন প্রাচুর্য ও উন্নতির সম্ভবনা সমগ্র মানব সভ্যতাকে বিলীন করার আত্মঘাতী প্রচেষ্টা শুধু মানবজাতিকেই নয় সমস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণিকূলকে জটিল সমীকরণে ফেলে দিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সভ্যতা ইঞ্জিনকে প্রচন্ড শক্তি দিয়েছে। মেধা-মননশীলতা সুদূরপ্রসারী চিন্তা, জ্ঞান সাধনা, নতুন উদ্ভাবন উদ্ভাবনী শক্তি সৃষ্টির বিজয় উল্লাস, বিজ্ঞানের আশ্রয়ে বৈজ্ঞানিক নতুন তত্ত্ব তথ্যের সম্মলনে পৃথিবী যেমন আশির্বাদপুষ্ট হয়েছে আবার বিপরীতে ধ্বংসের পরস্পরবিরোধী সম্ভবনাকে আশঙ্কার বার্তা দিয়েছে। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি বিবেক নিরলস চেষ্টা, কৌশল দিয়ে খুঁজে পেল অজ্ঞাত শক্তির উৎস। মানুষ হয়ে উঠল আরও শক্তিধর। বানালো নতুন অস্ত্র পারমাণবিক বোমা, মর্টার শেল। এসব মরণাস্ত্রের নিক্ষেপন, নৃশংসতা, অপচয়, অমানবিকতা, উন্মাদনার সীমাই শুধু অতিক্রম করেনি মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির এক দুর্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

কারও এখন অজানা নেই যুদ্ধের প্রস্তুতির আড়ালে যুদ্ধকালীন, যুদ্ধপরবর্তী সময় ভোগ করতে হয় নিদারুণ দুঃখ, জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, আপনজন হারানোর বেদনা, প্রতিশোধপরায়ণতা নতুনরূপে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণান্তর চেষ্টা, জাতিগত বিদ্বেষ, প্রজন্ম ধ্বংসের অপূরণীয় ক্ষতি-অবিশ্বাস, উসকানি, অশ্রদ্ধা, মৃত্যু-ক্ষুধা, উপবাস, অপুষ্টি, খাদ্য ঘাটতি, অর্থনৈতিক মন্দা, অবকাঠামোর ধ্বংস, আর্থসামাজিক-স্বাংস্কৃতিক ক্ষতি অর্থাৎ তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার বিনাশ।

যুদ্ধের প্রস্তুতির মধ্যে বাণিজ্যকভাবে সহযোগিতা, কূটনৈতিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত হয় আত্মরক্ষা, আত্মত্যাগ, পারস্পারিক সহযোগিতা সন্ত্রাস দমন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শ্রম বাজার সৃষ্টি, বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান, অবকাঠামো উন্নয়ন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, স্বপ্নপূরণের হাতকে প্রসারিতকরণ কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন যে ভূরাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন, যুদ্ধাস্ত্রের বাজার সৃষ্টি, আধিপত্য ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে কায়েমী র্স্বাথ হাসিল সংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীতা, মিথ্যা আশ্বাস, বিভ্রান্তিকরণ মিথ্যা প্রলোভন। যুদ্ধের পিছনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ কার্যকর তা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

সভ্যতা একটি সজীব-সক্রিয়, প্রাণবন্ত প্রাণ প্রাচুর্যতা সম্পন্ন বাড়ন্ত প্রাণীর মতো অফুরন্ত সুযোগ, সম্ভাবণা, উন্নতি-প্রগতিশীলতা, উন্নত চিন্তা সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা যার একটি অনিবার্যতা আছে। আছে স্বপ্ন পূরণের অবধারিত সুযোগ উন্নত জীবনবোধ। যুদ্ধের আতঙ্ক, অপচয়, অসঙ্গতি, সভ্যতার সহজাত বিকাশের পথ প্রক্রিয়ার জন্য একটি মারাত্মক ব্যাধি। নিত্য দিনের স্বাভাবিক জীবন, স্বপ্ন পূরণের একান্ত প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অভিজ্ঞতা, উপলদ্ধি, সত্যানুসন্ধান, উৎপাদিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিনিময়, অভিজ্ঞতা, গভীর উপলদ্ধি, দেশীয় আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকে সূক্ষ্ম বুনন, সম্প্রীতির বন্ধনের ক্ষেত্রে যে ঐক্য সৃষ্টি করে যুদ্ধ কাজ করে তার বিপরীতে। সভ্যতার এই সুস্থতাকে যুদ্ধাতঙ্ক আক্রমণ করে তখন এর প্রতিরোধক, প্রতিষেধক, অনুঘটন হিসেবে একান্তভাবে প্রয়োজন পড়ে স্বচ্ছতা, কার্যকরি যোগাযোগ, মানসিক সংযোগ, বুদ্ধিগত বিকাশ, দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক, বোঝাপড়া, মূল্যবোধ, সত্যের অনুসন্ধান সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে কার্যকরি ভূমিকা রাখে। যুদ্ধোত্তর সংলাপ, বাক পটুতা, সাংস্কৃতিক সংযোগ বিনিময়, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতা, বুদ্ধিগত উৎকর্ষতা, মানবতা, আলোকিত মানব সমাজ গড়ার মূলমন্ত্র এহেন সমস্যাকে লাগব করতে সমর্থ হবে বলে বিশ্বাস। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার তথা পারমাণবিক জুয়া খেলা ভবিষ্যৎ সুখ-সমৃদ্ধি বিশ্বব্যাপি শান্তির নববার্তা, আলোকময় ভুবনকে নরকে পরিণত করবে। নিঃসন্দেহে বিচারহীনতা তার সংস্কৃতি, যুদ্ধপরাধী, যুদ্ধবন্ধি বেড়ে যাবে। অসংখ্য বিয়োগান্তক হৃদয় বিদারক ঘটনার মহাপুঞ্জিভূতকরণ হবে। বিশ্ব মাঝে বেড়ে যাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব শান্তি ভূলুণ্ঠিত হবে। পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা যতো বৃদ্ধি পাচ্ছে, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভবনা এবং আনুষাঙ্গিক ধ্বংসযজ্ঞের আশংখা ঘনীভূত হচ্ছে। অকল্পণীয় , অপূরণীয় ক্ষতির মহাপ্লাবনে সভ্যতা বিলুপ্তি তথা মানবকূলের বিপন্নতার বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ। পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে যে তেজস্ক্রীয় বিকীরণ এবং তেজস্ক্রীয় ধুলিকণা ছড়িয়ে পড়লে আকাশ-বাতাস তেজস্ক্রীয় দূষণে দূষিত হবে। তাতে মানব জাতির এই ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। যুদ্ধাস্ত্রের জায়গা দখল করে নিয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। ভারী পরমাণুু বিভাজিত হয়ে নানা উপায়ে অবলম্বনে তৈরি হয়েছে পারমাণবিক বোমা। রসায়ন শাস্ত্রকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে বিস্ফোরক বোমা এবং পরবর্তীতে স্নায়ু গ্যাস। প্রাণিবিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সাধন করে সৃষ্টি হয়েছে জীবাণু অস্ত্র। যন্ত্র প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে কামান, যুদ্ধট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ। পারমাণবিক পরীক্ষা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলে সৃষ্টি তেজস্ক্রিয় বিকিরণে মানব প্রজাতির জিনগত সমস্যা তৈরি হবে। মানবমৃত্যু, দৈহিক বিকৃতি, মানসিক বিবৃতি, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা কোনোভাবেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। যেকোন যুদ্ধ সামাজিক, প্রকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে জীববৈচিত্র্য, বিলুপ্তি, প্রজাতি ধ্বংস, সাধন করে, অধিকারকে খর্ব করে। শোষিত বঞ্চিত, নিপীড়িত বাসযোগ্যহীনতা, জুলুম-নির্যাতন, পাশবিকতা, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুমন্ত্রণার ওপর পারমাণবিক তেজস্ক্রীয় বিকিকরণের প্রভাব পরিসংখ্যানিক, গাণিতিক হিসাব দ্বারা ক্ষতির পরিমাপ কোনোভাবেই নিরূপন করা সম্ভব নয়। আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে ভবিষ্যতের একজন মানুষের মৃত্যু হয়। একটি শিশুও যদি বিকালঙ্গের শিকার হয়, তাহলে সে অপরাধ হবে ক্ষমার অযোগ্য। বিশ্বের সব মানুষ স্বস্তিতে বাঁচতে চায়। সুন্দর-সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার সবারই আছে। যুদ্ধাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ গবেষণার আনুষাঙ্গিক কর্মকান্ডে, যুদ্ধের কৌশলের রূপরেখা প্রণয়নে আগে-পরে যে অর্থ, সম্পদ,জান-মাল, ইজ্জত আব্রু, মানব সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যয়, সময়, মেধা, শ্রম, সৃজনশীলতা, প্রগতিরচিন্তা, শিল্প সাহিত্য চর্চায় যে আপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হয় সেটির বিকল্প কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবার নয়।

স্বদেশ প্রেম জাতীয়বাদের জন্ম দেয়। এটি একটি অনুভূতি, মহৎ গুণ। কিন্তু উগ্র জাতীয়বাদ যেমন আন্তর্জাতিকতাবাদের অংশ কোনোভাবেই হতে পারে না তেমনি প্রেম- প্রীতিহীন মানবিক মূল্যবোধহীনতা অন্যের প্রতি সহমর্মিতা সম্প্রীতিহীন, সংযমহীনতা জাতিগত দাঙ্গা, অরাজনীতিকরণ, সমরনীতিবর্হিভূত, সীমান্তে সুরক্ষাহীনতা, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত কর্মকান্ড হিংসা বিদ্বেষের বিষবাষ্প মরণাস্ত্রের পাহাড় জাতিগত বিভেদের দেয়ালে সুবিশাল প্রাচীর তৈরি করেই চলছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে সোচ্চার হতে হবে। মানব মুক্তির লক্ষ্যে শান্তির অমোঘ বাণী প্রচার করতে হবে স্ব-স্ব জায়গা থেকে বিশ্ব শান্তি কোন অবান্তর কল্পনা নয়। এই অসুস্থতা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা, মানবতা চর্চা, মূল্যবোধ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দরকে লালন পালন। শান্তির বাণী পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। মানব ধর্ম পরম ধর্ম। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। বিশ্ববাসীর প্রতি উদাও আহ্বান জানাচ্ছি। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বকে রক্ষার আওয়াজ তুলতে হবে। এভাবে- ‘আর যুদ্ধ নয়।/ আর নয় মায়েদের কান্না/ রক্ত কি, ধ্বংস কি, যুদ্ধ-আর না,/ আর না।’ সত্য, ন্যায়, সুন্দর সাম্য, মৈত্রী, অন্তর আত্মার বিকাশ প্রস্ফুটিত হোক। সত্য-শিক্ষা ও সত্যের সন্ধান করার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বমানবতার অতন্ত্র প্রহরী হয়ে বিশ্বপ্রেমের মূলমন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত হলে মানবতার জয় হবে।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা ]

back to top