শামিম বিন ওমর ফারুক
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তর দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত এটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এ দেশে আত্মপ্রকাশ করে। যার ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সস্প্রসারিত হয় এবং এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আয় বৃদ্ধি পায় ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসে। খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা অন্য যে কোন বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত হলো পোশাক শিল্প। কিন্তু সস্প্রতি সংকটের মুখে এ পোশাক শিল্প। বিশ্বজুড়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং পোস্ট কোভিডের ধাক্কায় টালমাটাল অর্থনীতিতে নতুন মাথাব্যথার কারণ হতে যাচ্ছে এই তৈরিকৃত পোশাক শিল্প। এর মূল কারণ হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় গ্রাহক এসব দেশের বাজারে গত দুই মাসে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ। এমন তথ্য জানিয়েছেন পোশাক শিল্প রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম সংগঠন বিজিএমইএ। এসব বাজারে রপ্তানির জন্য পাইপলাইনে থাকা পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহারণ খুচরা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের পণ্যেও ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া। ইউরোপে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় ক্রেতাদের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান। যার ফলে বিষয়টি মাথাব্যথার কারণ বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিও যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের ঘাটতিও পোশাক শিল্প সংকটের প্রধান কারণ। চলমান সংকট কাটাতে রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ধারিত উৎসে কর ১ শতাংশ বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ। এর আগে জাতীয় বাজেটের ২২-২৩ অর্থবছরে এই কর দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে কারখানাগুলোতে অব্যাহত বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ চেয়েছে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে রপ্তানি পরিস্থিতি ত্বরান্বিত করার জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াগুলো আরও সহজ করা জরুরি বলে মনে করেছেন তারা।
অর্থনীতিতে এর প্রভাব : তৈরি পোশাক শিল্পের সস্প্রসারণ বাংলাদেশের সমাজে একদিকে যেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তেমনি এর সংকটে অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও এই শিল্পের সাথে জড়িত ২২ লাখ নারী শ্রমিকের জীবনযাত্রার লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারী শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই খাতের সম্প্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে অর্থনীতি আরও বেগবান হচ্ছে। কিন্তু সস্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সংকটের কারণে অর্থনীতিতে এর বড় প্রভাব পড়েছে।
পোশাক অর্ডার বাতিল হওয়ায় অনেক পোশাক কর্মী তাদের একমাত্র সহায় সস্বল চাকরিটি হারান। অনেক পোশাক কারখানা কোন পূর্ব সর্তকর্তা ছাড়াই তাদের শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করেন। পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটস এবং ওয়ার্র্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম (ডব্লিউআরসি) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এক মিলিয়নেরও বেশি পোশাক শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে। ফলে অর্থনীতিতে এক বড় ধরনের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে।
পোশাক শিল্প দেশের শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ৪০ লক্ষ শ্রমিককে উৎপাদনশীল কাজে অর্ন্তভুক্ত করে দারিদ্র বিমোচনে অবদান রাখছে। এ শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। পোশাকের চাহিদা কোনদিনই কমবে না। বর্তমানে বিশ্বে এ পণ্যের বাজার ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। চীন একাই ১৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫.৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অংশ ৫.৪ শতাংশ (২৪.৪৯ বিলিয়ন ডলার)।
প্রথমদিকে যেনতেনভাবে কারখানা গড়ে উঠেছে। শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, পৃথক গার্মেন্টস ভিলেজ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের গুরুত্ব পায়নি। উপেক্ষিত হয়েছে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, দক্ষতা ও গবেষণা। ফলে আজও শুধু টিকে থাকার চেষ্টাই চলছে। আসলে উন্নয়ন ঘটে একটি ভিশনকে সামনে রেখে। উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি উদ্ভাবন, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, শ্রমিক মালিকের সস্পর্ক উন্নয়ন শুধু এই শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্যই নয় বরং গোটা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি।
[লেখক : শিক্ষার্থী, মানবসস্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
শামিম বিন ওমর ফারুক
বুধবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২২
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তর দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত এটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এ দেশে আত্মপ্রকাশ করে। যার ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সস্প্রসারিত হয় এবং এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আয় বৃদ্ধি পায় ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসে। খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাত।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা অন্য যে কোন বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত হলো পোশাক শিল্প। কিন্তু সস্প্রতি সংকটের মুখে এ পোশাক শিল্প। বিশ্বজুড়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং পোস্ট কোভিডের ধাক্কায় টালমাটাল অর্থনীতিতে নতুন মাথাব্যথার কারণ হতে যাচ্ছে এই তৈরিকৃত পোশাক শিল্প। এর মূল কারণ হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় গ্রাহক এসব দেশের বাজারে গত দুই মাসে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ। এমন তথ্য জানিয়েছেন পোশাক শিল্প রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম সংগঠন বিজিএমইএ। এসব বাজারে রপ্তানির জন্য পাইপলাইনে থাকা পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহারণ খুচরা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের পণ্যেও ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া। ইউরোপে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় ক্রেতাদের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান। যার ফলে বিষয়টি মাথাব্যথার কারণ বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিও যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের ঘাটতিও পোশাক শিল্প সংকটের প্রধান কারণ। চলমান সংকট কাটাতে রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ধারিত উৎসে কর ১ শতাংশ বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ। এর আগে জাতীয় বাজেটের ২২-২৩ অর্থবছরে এই কর দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে কারখানাগুলোতে অব্যাহত বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ চেয়েছে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে রপ্তানি পরিস্থিতি ত্বরান্বিত করার জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াগুলো আরও সহজ করা জরুরি বলে মনে করেছেন তারা।
অর্থনীতিতে এর প্রভাব : তৈরি পোশাক শিল্পের সস্প্রসারণ বাংলাদেশের সমাজে একদিকে যেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তেমনি এর সংকটে অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও এই শিল্পের সাথে জড়িত ২২ লাখ নারী শ্রমিকের জীবনযাত্রার লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারী শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই খাতের সম্প্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে অর্থনীতি আরও বেগবান হচ্ছে। কিন্তু সস্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সংকটের কারণে অর্থনীতিতে এর বড় প্রভাব পড়েছে।
পোশাক অর্ডার বাতিল হওয়ায় অনেক পোশাক কর্মী তাদের একমাত্র সহায় সস্বল চাকরিটি হারান। অনেক পোশাক কারখানা কোন পূর্ব সর্তকর্তা ছাড়াই তাদের শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করেন। পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটস এবং ওয়ার্র্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম (ডব্লিউআরসি) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এক মিলিয়নেরও বেশি পোশাক শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে। ফলে অর্থনীতিতে এক বড় ধরনের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে।
পোশাক শিল্প দেশের শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ৪০ লক্ষ শ্রমিককে উৎপাদনশীল কাজে অর্ন্তভুক্ত করে দারিদ্র বিমোচনে অবদান রাখছে। এ শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। পোশাকের চাহিদা কোনদিনই কমবে না। বর্তমানে বিশ্বে এ পণ্যের বাজার ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। চীন একাই ১৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫.৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অংশ ৫.৪ শতাংশ (২৪.৪৯ বিলিয়ন ডলার)।
প্রথমদিকে যেনতেনভাবে কারখানা গড়ে উঠেছে। শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, পৃথক গার্মেন্টস ভিলেজ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের গুরুত্ব পায়নি। উপেক্ষিত হয়েছে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, দক্ষতা ও গবেষণা। ফলে আজও শুধু টিকে থাকার চেষ্টাই চলছে। আসলে উন্নয়ন ঘটে একটি ভিশনকে সামনে রেখে। উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি উদ্ভাবন, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, শ্রমিক মালিকের সস্পর্ক উন্নয়ন শুধু এই শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্যই নয় বরং গোটা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি।
[লেখক : শিক্ষার্থী, মানবসস্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]