সামসুজ্জামান
গ্রামাঞ্চলে শীত আসে এক ভিন্ন আমেজে। খেজুর গাছের রস থেকে গুড় বানানোর সময় গুড় খাওয়ার জন্য শিশুদের হুড়োহুড়ি, হাতে কলারপাতা নিয়ে বসে থাকা সৃষ্টি করে এক অপরূপ দৃশ্য। পাতা হাতে বসে থাকা প্রতীক্ষার পালা যেন শেষ হতে চায় না। অবশেষে বাঁশের তৈরি একরকম চাঁচ দিয়ে গুড় খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করে অপেক্ষামান শিশুরা।
যশোরে একসময় ২০-৩০ ফুট লম্বা মাথায় ঝাঁকড়া চুলের মতো পাতা, সারা শরীরের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত খেজুর গাছ। রাস্তার দুপাশ, জমির আইল মাঠঘাট এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে ছিল না খেঁজুর গাছের উপস্থিতি। অনেকে বিঘা বিঘা জমিতে খেজুর গাছ লাগাত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। বছরের একটা মৌসুম অর্থাৎ শীতকাল এলেই বেড়ে যেত এ গাছের কদর। গাছিরা দা, টোং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত গাছ পরিষ্কার করার কাজে। একটি খেজুর গাছে রস আনতে একজন গাছিকে কমপক্ষে পাঁচবার উঠতে হয় গাছটিতে। প্রথমে খেজুর গাছের পাতা পরিষ্কার করতে হয়, অনেকটা বাবড়ি চুল ছাটার মতো। এরপর গাছের গায়ে লম্বা হয়ে যাওয়া কাটাগুলো পরিষ্কার করা। তারপর ‘চাঁচ দেয়া’। খিল লাগানো এবং ভাড় টাঙানো পর্যন্ত গাছিকে তদারকি করতে হয়।
যশোর জেলার এ চেনা রূপ এখন হারিয়ে যাচ্ছে। গাছি দুভাবে গাছ তদারকি করত। টাকার বিনিময়ে না হয় গুড়ের ভাগা হিসেবে। জেলার ৮টি উপজেলায় যে খেজুর গাছ ছিল তিন দশক আগেও তা এখন এক চতুর্থাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বন্যা এবং মাছের ঘেরের স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণেও মরে গেছে অনেক গাছ। বিভিন্ন কারণে খেজুর গাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। যে সামান্য গাছের অস্তিত্ব এখনও আছে তা থেকে উৎপাদিত রসে গুড় ও পাটালি বানিয়ে গাছির খরচ সংকুলান করা দায় হয়ে পড়ে। ফলে রস-গুড়-পাটালির দাম বেড়ে আকাশচুম্বি হয়ে গেছে। শীত মৌসুমের শুরুতে ইতোমধ্যে গাছি তার প্রক্রিয়া শেষ করে রস নামানো শুরু করেছে। এখানে এখন প্রতি ভাড় রস ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটালি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা। গুড় প্রতি ভাড় (৯ কেজি) ১৭০০-১৮০০ টাকায়।
একসময় যশোরের গুড়ের খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। শীতকালে বিশেষত যারা খেজুর বাগান বাণিজ্যক ভিত্তিতে করতেন ফরিদপুরের ব্যবসায়ীরা সেই বাগান কিনে নিত টাকার বিনিময়ে। বাগানের মধ্যে তাঁবু লাগিয়ে পুরো শীত মৌসুম কাটাত। তৈরি করত বিভিন্ন ধরনের পাটালি এবং গুড়। এ পণ্য রপ্তানি হতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর অন্যতম বাজার ছিল নোয়াখালী, ভোলা। সেখানকার জেলেরা মাছ শিকার করতে যাওয়ার সময় ভাড় ভাড় গুড় নিয়ে বের হতো। তাদের দীর্ঘ দিন সমুদ্রে থাকতে হতো বলে তারা এ ব্যবস্থা নিত। সে সময় নদীপথেই গুড় পাটালি যেত।
তখন হরিহর নদীতে বড় বড় নৌকা এবং বার্জ চলাচল করতে পারত। এখন নাব্য হারিয়ে সে নদী ¯্রােতহীন হয়ে পড়েছে। এখন যশোর জেলায় যে পরিমাণ গুড়, পাটালি এখানে তৈরি হয় তা আঞ্চলিক চাহিদাও পূরণ করতে পারে না। ফলে দেশের বিভিন্নস্থানে রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু যশোর নয় সারাদেশের ঐতিহ্য এই যশোরের গুড় পাটালি এখন বিলীন হওয়ার পথে। যেকোন মূল্যে একে ধরে রাখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে কৃষকের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এ শিল্পকে বাঁচাতে। শুধু গাছিদের নিয়ে মতবিনিময়ে আশানুরূপ সুফল আসবে না। সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষি বিভাগকে এ কাজের অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক হারে চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। প্রণোদনা দিতে হবে কৃষকদের চারা রোপণের জন্য। এমন সহযোগিতা পেলে কৃষক অবশ্যই উৎসাহিত হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’-এর সুনামও অক্ষুণœ থাকবে।
[লেখক: ব্যাবসায়ী]
সামসুজ্জামান
বুধবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২২
গ্রামাঞ্চলে শীত আসে এক ভিন্ন আমেজে। খেজুর গাছের রস থেকে গুড় বানানোর সময় গুড় খাওয়ার জন্য শিশুদের হুড়োহুড়ি, হাতে কলারপাতা নিয়ে বসে থাকা সৃষ্টি করে এক অপরূপ দৃশ্য। পাতা হাতে বসে থাকা প্রতীক্ষার পালা যেন শেষ হতে চায় না। অবশেষে বাঁশের তৈরি একরকম চাঁচ দিয়ে গুড় খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করে অপেক্ষামান শিশুরা।
যশোরে একসময় ২০-৩০ ফুট লম্বা মাথায় ঝাঁকড়া চুলের মতো পাতা, সারা শরীরের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত খেজুর গাছ। রাস্তার দুপাশ, জমির আইল মাঠঘাট এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে ছিল না খেঁজুর গাছের উপস্থিতি। অনেকে বিঘা বিঘা জমিতে খেজুর গাছ লাগাত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। বছরের একটা মৌসুম অর্থাৎ শীতকাল এলেই বেড়ে যেত এ গাছের কদর। গাছিরা দা, টোং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত গাছ পরিষ্কার করার কাজে। একটি খেজুর গাছে রস আনতে একজন গাছিকে কমপক্ষে পাঁচবার উঠতে হয় গাছটিতে। প্রথমে খেজুর গাছের পাতা পরিষ্কার করতে হয়, অনেকটা বাবড়ি চুল ছাটার মতো। এরপর গাছের গায়ে লম্বা হয়ে যাওয়া কাটাগুলো পরিষ্কার করা। তারপর ‘চাঁচ দেয়া’। খিল লাগানো এবং ভাড় টাঙানো পর্যন্ত গাছিকে তদারকি করতে হয়।
যশোর জেলার এ চেনা রূপ এখন হারিয়ে যাচ্ছে। গাছি দুভাবে গাছ তদারকি করত। টাকার বিনিময়ে না হয় গুড়ের ভাগা হিসেবে। জেলার ৮টি উপজেলায় যে খেজুর গাছ ছিল তিন দশক আগেও তা এখন এক চতুর্থাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বন্যা এবং মাছের ঘেরের স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণেও মরে গেছে অনেক গাছ। বিভিন্ন কারণে খেজুর গাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। যে সামান্য গাছের অস্তিত্ব এখনও আছে তা থেকে উৎপাদিত রসে গুড় ও পাটালি বানিয়ে গাছির খরচ সংকুলান করা দায় হয়ে পড়ে। ফলে রস-গুড়-পাটালির দাম বেড়ে আকাশচুম্বি হয়ে গেছে। শীত মৌসুমের শুরুতে ইতোমধ্যে গাছি তার প্রক্রিয়া শেষ করে রস নামানো শুরু করেছে। এখানে এখন প্রতি ভাড় রস ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটালি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা। গুড় প্রতি ভাড় (৯ কেজি) ১৭০০-১৮০০ টাকায়।
একসময় যশোরের গুড়ের খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। শীতকালে বিশেষত যারা খেজুর বাগান বাণিজ্যক ভিত্তিতে করতেন ফরিদপুরের ব্যবসায়ীরা সেই বাগান কিনে নিত টাকার বিনিময়ে। বাগানের মধ্যে তাঁবু লাগিয়ে পুরো শীত মৌসুম কাটাত। তৈরি করত বিভিন্ন ধরনের পাটালি এবং গুড়। এ পণ্য রপ্তানি হতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর অন্যতম বাজার ছিল নোয়াখালী, ভোলা। সেখানকার জেলেরা মাছ শিকার করতে যাওয়ার সময় ভাড় ভাড় গুড় নিয়ে বের হতো। তাদের দীর্ঘ দিন সমুদ্রে থাকতে হতো বলে তারা এ ব্যবস্থা নিত। সে সময় নদীপথেই গুড় পাটালি যেত।
তখন হরিহর নদীতে বড় বড় নৌকা এবং বার্জ চলাচল করতে পারত। এখন নাব্য হারিয়ে সে নদী ¯্রােতহীন হয়ে পড়েছে। এখন যশোর জেলায় যে পরিমাণ গুড়, পাটালি এখানে তৈরি হয় তা আঞ্চলিক চাহিদাও পূরণ করতে পারে না। ফলে দেশের বিভিন্নস্থানে রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু যশোর নয় সারাদেশের ঐতিহ্য এই যশোরের গুড় পাটালি এখন বিলীন হওয়ার পথে। যেকোন মূল্যে একে ধরে রাখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে কৃষকের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এ শিল্পকে বাঁচাতে। শুধু গাছিদের নিয়ে মতবিনিময়ে আশানুরূপ সুফল আসবে না। সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। প্রয়োজনে কৃষি বিভাগকে এ কাজের অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক হারে চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। প্রণোদনা দিতে হবে কৃষকদের চারা রোপণের জন্য। এমন সহযোগিতা পেলে কৃষক অবশ্যই উৎসাহিত হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’-এর সুনামও অক্ষুণœ থাকবে।
[লেখক: ব্যাবসায়ী]