ডোরিন চৌধুরি
১০ ডিসেম্বর উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যানরাইটস বা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ (ইউডিএইচআর) গৃহীত হওয়া উপলক্ষে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’ এ বছর দিবসটির ৭৪তম বার্ষিকী। এ বছরের উদযাপনের মাধ্যমে জাতিসংঘ আগামী বছর ৭৫তম বার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে একটি বছরব্যাপী প্রচারণাও শুরু করবে। যেখানে ইউডিএইচআরের প্রাসঙ্গিকতা, ঐতিহ্য এবং মানবাধিকারের জন্য নেয়া প্রচেষ্টা তুলে ধরা হবে।
দিবসটি সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা একসাথে সনদটি গ্রহণ করেছিল। এই সনদ গ্রহণের মাধ্যমে তারা ৭৪ বছর আগে বিশ্বব্যপী মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার নিয়েছিল। মহামারীর পর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এ বছর দিবসটিও বিশেষ তাৎপর্য রাখে। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর কেবলমাত্র রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক নীতি, ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদ, পশ্চিমা বিশ্বে বেড়ে যাওয়া জেনোফোবিয়া, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, কর্মক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এবং শ্রেণীবৈষম্য আমাদের মানবাধিকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এছাড়াও গৃহযুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ, নিষেধাজ্ঞা এবং অবরোধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক উল্টোযাত্রা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি একবিংশ শতাব্দীতে ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইড বা গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ দৃশ্যমান হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং জনতুষ্টিবাদের রাজনীতি আগের চেয়ে আরও ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে। ফলে সাদা চোখেই একটি পশ্চাৎপসরণ বা উল্টোযাত্রা দৃশ্যমান হয়েছে। জন হপকিন্স স্কলার ইয়াশা মাউঙ্কও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের এমন উল্টোযাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। লিবারেল বা উদারবাদী মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি আমাদের সমাজকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গণতন্ত্র যেমন পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতিরও তেমনি অবনতি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডানপন্থি রাজনীতি ফ্যাসিবাদকে ইন্ধন জোগাচ্ছে, বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশে। ‘শক্তিমান নেতার’ সংখ্যা বাড়ছে যারা জনপ্রিয়তা বাড়াতে জনতুষ্টবাদী নীতি নিচ্ছেন। সুপ্রিমেসি বা আধিপত্য যেমন বাড়ছে এর ফলে জেনোফোবিয়া এবং বর্ণবাদ হচ্ছে। সম্ভবত ইসলাম ধর্ম বিগত দুই দশক ধরে বেড়ে ওঠা জেনোফোবিয়ার সবচেয়ে খারাপ শিকার এই মুহূর্তে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন বা পশ্চিমা রাজনীতিতে ব্যবহৃত অভিবাসী-বিরোধী বক্তব্যের মতো আন্দোলনগুলোও দেখায় যে একটি বর্ণবাদী পশ্চিম ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, রাজনৈতিক সহিংসতা, দরিদ্র শ্রম অবস্থা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামোর কারণে গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণেও মানবাধিকারও অবনতি হচ্ছে। করোনা মহামারীর পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমশ আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের সংঘাত এবং পরবর্তীকালে দেয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঘোলাটে করে তুলছে এবং একটি জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, পণ্য সংকট এবং ক্রমহ্রাসমান বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বিশ্বব্যাপী নাগরিকদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন করছে প্রতিনিয়ত। পরাশক্তির দ্বন্দ্বেও মানবাধিকার একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সম্ভবত ইতিহাসে এটি একটি প্রথম ঘটনা, যেখানে মহান শক্তিগুলো তাদের দ্বন্দ্বে মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব এবং বাইডেনের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা পররাষ্ট্রনীতি এমন দাবির প্রমাণ করে। এ ধরনের রাজনীতি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
জাতিসংঘ একটি আইডিয়ালিস্ট বা আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠান; যা মাল্টিল্যাটেরালিজম বা বহুপাক্ষিকতার প্রচার করে। গোষ্ঠী রাজনীতি এবং পরাশক্তির দ্বন্দের বাইরে গিয়ে জাতিসংঘ তার সদস্যদের একত্রিত করে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে। বিগত সময়ে জাতিসংঘ চিহ্নিত করেছে যে আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতা গত কয়েক বছরে হুমকির মুখে পড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং, এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় তাই আমাদের ন্যায্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
জাতিসংঘের সকল সদস্য যেহেতু ইউডিএইচআর গ্রহণ করেছে, তাই আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সচেষ্ট হতেই হবে। একটি বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামো, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, জেনোফোবিয়া, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, সব ধরনের সংঘাত, সহিংসতা এবং ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতাকে হরণ করছে। দিনটি তাই বিশ্বের জন্য একটি ‘ওয়েক আপ কল’ বা সতর্ক বার্তাই পরিবেশন করবে।
বাংলাদেশ মাল্টিল্যাটেরালিজম বা বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী একটি দেশ। তাই ১৯৭৪ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রায় সব সংস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণ বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এটি মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য এবং ইউএনএইচসিআরের সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখছে।
গত পাঁচ বছর ধরে প্রায় ১২ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্যও অর্জন করেছে। দেশে নারী অধিকারের উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। উন্নতি হয়েছে শিশু অধিকারেও। সম্ভবত হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকার করা গত দশকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা আন্তঃলিঙ্গের মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের বহুদিনের দাবি- ভোটাধিকারও নিশ্চিত করেছে।
শিক্ষার হার বৃদ্ধিতেও সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়াও একটি জাতি হিসেবে বাঙালি তার আতিথেয়তার জন্য পরিচিত এবং বর্ণবাদ, জেনোফোবিয়া, আধিপত্য ইত্যাদির মতো প্রথম বিশ্বের অনেক সমস্যা থেকেও মুক্ত। তবুও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি রাজনৈতিক সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তন, নিম্নমানের শ্রম পরিস্থিতি এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি পুনরাবৃত্ত ঘটনা। একটি ব-দ্বীপ হিসেবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয় যা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। এছাড়াও দেশ দুর্নীতি, ঘুষ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে ভুগছে; যা মানবাধিকারেরও অবনতি ঘটায়।
মানবাধিকার সমুন্নত রাখা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটির জন্য সময় এবং প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং ঠিক এখানেই বিশ্ব সম্প্রদায়কে একত্রিত হওয়া উচিত। একবিংশ শতাব্দীতে, মানবাধিকারের ইউনিভার্সালিটি বা সার্বজনীনতা এবং ‘সবার জন্য মানবাধিকারের এক আকার’ ধারণাটিও একটি নতুন বিতর্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সরব বিরোধিতার কল্যাণে। উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে, জ্যাক ডনেলির মতো অনেক বিশিষ্ট পন্ডিতও এখন মানবাধিকারের সার্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। উদাহরণ স্বরূপ, সমকামিতার অধিকার কিংবা গর্ভপাত বিষয়ক অধিকারের আলোচনা হতে পারে, যার ধারণা ও গ্রহণযোগ্যতা সময়, স্থান এবং সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। এছাড়াও মহামারী, নয়া উদারবাদী আর্থিক কাঠামো, ইউক্রেন সংকট এবং পরবর্তী পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো আমাদের মানবাধিকারের সর্বজনীন সনদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে; যা রক্ষার্থে আমরা ৭৪ বছর আগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম। বর্তমান সমস্যা মোকাবেলায় বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে তার জন্য আমাদের মধ্যে বিরোধ ও ব্যবধান কমাতে হবে, সংলাপ শুরু করতে হবে এবং সমঝোতার পথ তৈরি করতে হবে।
আমাদের অবশ্যই বহুত্ব ও বহুপাক্ষিকতার পথ বেছে নিতে হবে। সেজন্য স্বার্থানুযায়ী মানবাধিকারের হস্তক্ষেপ ও রাজনীতিকরণ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। দিবসটি আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে কাজ করবে। এ উপলক্ষে আমাদের মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হবে- সেটাই আশা।
[লেখক : ডক্টরাল গবেষক, গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]
ডোরিন চৌধুরি
শুক্রবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২
১০ ডিসেম্বর উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যানরাইটস বা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ (ইউডিএইচআর) গৃহীত হওয়া উপলক্ষে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’ এ বছর দিবসটির ৭৪তম বার্ষিকী। এ বছরের উদযাপনের মাধ্যমে জাতিসংঘ আগামী বছর ৭৫তম বার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে একটি বছরব্যাপী প্রচারণাও শুরু করবে। যেখানে ইউডিএইচআরের প্রাসঙ্গিকতা, ঐতিহ্য এবং মানবাধিকারের জন্য নেয়া প্রচেষ্টা তুলে ধরা হবে।
দিবসটি সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা একসাথে সনদটি গ্রহণ করেছিল। এই সনদ গ্রহণের মাধ্যমে তারা ৭৪ বছর আগে বিশ্বব্যপী মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার নিয়েছিল। মহামারীর পর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এ বছর দিবসটিও বিশেষ তাৎপর্য রাখে। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর কেবলমাত্র রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক নীতি, ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদ, পশ্চিমা বিশ্বে বেড়ে যাওয়া জেনোফোবিয়া, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, কর্মক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এবং শ্রেণীবৈষম্য আমাদের মানবাধিকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এছাড়াও গৃহযুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ, নিষেধাজ্ঞা এবং অবরোধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক উল্টোযাত্রা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি একবিংশ শতাব্দীতে ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইড বা গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ দৃশ্যমান হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং জনতুষ্টিবাদের রাজনীতি আগের চেয়ে আরও ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে। ফলে সাদা চোখেই একটি পশ্চাৎপসরণ বা উল্টোযাত্রা দৃশ্যমান হয়েছে। জন হপকিন্স স্কলার ইয়াশা মাউঙ্কও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের এমন উল্টোযাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। লিবারেল বা উদারবাদী মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি আমাদের সমাজকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গণতন্ত্র যেমন পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতিরও তেমনি অবনতি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডানপন্থি রাজনীতি ফ্যাসিবাদকে ইন্ধন জোগাচ্ছে, বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশে। ‘শক্তিমান নেতার’ সংখ্যা বাড়ছে যারা জনপ্রিয়তা বাড়াতে জনতুষ্টবাদী নীতি নিচ্ছেন। সুপ্রিমেসি বা আধিপত্য যেমন বাড়ছে এর ফলে জেনোফোবিয়া এবং বর্ণবাদ হচ্ছে। সম্ভবত ইসলাম ধর্ম বিগত দুই দশক ধরে বেড়ে ওঠা জেনোফোবিয়ার সবচেয়ে খারাপ শিকার এই মুহূর্তে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন বা পশ্চিমা রাজনীতিতে ব্যবহৃত অভিবাসী-বিরোধী বক্তব্যের মতো আন্দোলনগুলোও দেখায় যে একটি বর্ণবাদী পশ্চিম ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, রাজনৈতিক সহিংসতা, দরিদ্র শ্রম অবস্থা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামোর কারণে গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণেও মানবাধিকারও অবনতি হচ্ছে। করোনা মহামারীর পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমশ আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের সংঘাত এবং পরবর্তীকালে দেয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঘোলাটে করে তুলছে এবং একটি জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, পণ্য সংকট এবং ক্রমহ্রাসমান বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বিশ্বব্যাপী নাগরিকদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন করছে প্রতিনিয়ত। পরাশক্তির দ্বন্দ্বেও মানবাধিকার একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সম্ভবত ইতিহাসে এটি একটি প্রথম ঘটনা, যেখানে মহান শক্তিগুলো তাদের দ্বন্দ্বে মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব এবং বাইডেনের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা পররাষ্ট্রনীতি এমন দাবির প্রমাণ করে। এ ধরনের রাজনীতি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
জাতিসংঘ একটি আইডিয়ালিস্ট বা আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠান; যা মাল্টিল্যাটেরালিজম বা বহুপাক্ষিকতার প্রচার করে। গোষ্ঠী রাজনীতি এবং পরাশক্তির দ্বন্দের বাইরে গিয়ে জাতিসংঘ তার সদস্যদের একত্রিত করে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে। বিগত সময়ে জাতিসংঘ চিহ্নিত করেছে যে আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতা গত কয়েক বছরে হুমকির মুখে পড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং, এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় তাই আমাদের ন্যায্য মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
জাতিসংঘের সকল সদস্য যেহেতু ইউডিএইচআর গ্রহণ করেছে, তাই আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সচেষ্ট হতেই হবে। একটি বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামো, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, জেনোফোবিয়া, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, সব ধরনের সংঘাত, সহিংসতা এবং ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতাকে হরণ করছে। দিনটি তাই বিশ্বের জন্য একটি ‘ওয়েক আপ কল’ বা সতর্ক বার্তাই পরিবেশন করবে।
বাংলাদেশ মাল্টিল্যাটেরালিজম বা বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী একটি দেশ। তাই ১৯৭৪ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রায় সব সংস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণ বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এটি মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য এবং ইউএনএইচসিআরের সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখছে।
গত পাঁচ বছর ধরে প্রায় ১২ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্যও অর্জন করেছে। দেশে নারী অধিকারের উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। উন্নতি হয়েছে শিশু অধিকারেও। সম্ভবত হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকার করা গত দশকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা আন্তঃলিঙ্গের মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের বহুদিনের দাবি- ভোটাধিকারও নিশ্চিত করেছে।
শিক্ষার হার বৃদ্ধিতেও সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়াও একটি জাতি হিসেবে বাঙালি তার আতিথেয়তার জন্য পরিচিত এবং বর্ণবাদ, জেনোফোবিয়া, আধিপত্য ইত্যাদির মতো প্রথম বিশ্বের অনেক সমস্যা থেকেও মুক্ত। তবুও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি রাজনৈতিক সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তন, নিম্নমানের শ্রম পরিস্থিতি এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি পুনরাবৃত্ত ঘটনা। একটি ব-দ্বীপ হিসেবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয় যা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। এছাড়াও দেশ দুর্নীতি, ঘুষ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে ভুগছে; যা মানবাধিকারেরও অবনতি ঘটায়।
মানবাধিকার সমুন্নত রাখা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটির জন্য সময় এবং প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং ঠিক এখানেই বিশ্ব সম্প্রদায়কে একত্রিত হওয়া উচিত। একবিংশ শতাব্দীতে, মানবাধিকারের ইউনিভার্সালিটি বা সার্বজনীনতা এবং ‘সবার জন্য মানবাধিকারের এক আকার’ ধারণাটিও একটি নতুন বিতর্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সরব বিরোধিতার কল্যাণে। উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে, জ্যাক ডনেলির মতো অনেক বিশিষ্ট পন্ডিতও এখন মানবাধিকারের সার্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। উদাহরণ স্বরূপ, সমকামিতার অধিকার কিংবা গর্ভপাত বিষয়ক অধিকারের আলোচনা হতে পারে, যার ধারণা ও গ্রহণযোগ্যতা সময়, স্থান এবং সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। এছাড়াও মহামারী, নয়া উদারবাদী আর্থিক কাঠামো, ইউক্রেন সংকট এবং পরবর্তী পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো আমাদের মানবাধিকারের সর্বজনীন সনদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে; যা রক্ষার্থে আমরা ৭৪ বছর আগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম। বর্তমান সমস্যা মোকাবেলায় বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে তার জন্য আমাদের মধ্যে বিরোধ ও ব্যবধান কমাতে হবে, সংলাপ শুরু করতে হবে এবং সমঝোতার পথ তৈরি করতে হবে।
আমাদের অবশ্যই বহুত্ব ও বহুপাক্ষিকতার পথ বেছে নিতে হবে। সেজন্য স্বার্থানুযায়ী মানবাধিকারের হস্তক্ষেপ ও রাজনীতিকরণ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। দিবসটি আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে কাজ করবে। এ উপলক্ষে আমাদের মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হবে- সেটাই আশা।
[লেখক : ডক্টরাল গবেষক, গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]