alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাপলুডু খেলার অবসান চাই

শেখর ভট্টাচার্য

: বুধবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
image

সত্তরের দশকের শেষ আর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তখন নিয়মিত কলাম লিখেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গাছপাথর ছদ্মনামে। সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়গুলোর অসাধারণ বিশ্লেষণ। বৈঠকি ঢংয়ে অনন্য সুন্দর গল্প বলে যান দরবার-ই-জহুর ছদ্মনাম দিয়ে প্রবাদ প্রতীম সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী। ‘হৃৎ কলমের টানে’ লিখেন সৈয়দ শামসুল হক। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে শিল্প সাহিত্যের অনন্য সাধারণ বিশ্লেষণ, বাঙালির মন ও মননের কথা। তরুণ বয়সি যারা লেখালেখি করেন, দুনিয়ার তাবৎ সাহিত্য সংস্কৃতির তথ্য যারা তাদের হাতের মুঠোয় রাখতে চান; বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আলোচনায় নতুন তথ্য দিয়ে যারা মাত করে দিতে চান; তারা গোগ্রাসে ‘হৃৎ কলমের টানে’ পড়েন।

মনে আছে কী অসাধারণ বিতর্ক, শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথের ট্রেজেডির উপকরণ নিয়ে দুই সৈয়দের মধ্যে। সৈয়দ শামসুল হক ম্যাকবেথের আলোকে একটি অনন্য সাধারণ নাটক লিখেন ‘ঈর্ষা’। সেই নাটকের কুশীলবদের নিয়ে, তাদের চরিত্রের ভেতরে বহমান অনুভূতিগুলো নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করেন দুই সৈয়দ। এক সৈয়দ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তরুণ অধ্যাপক, লেখালেখি শুরু করেছেন, তিনি সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম; আরেক সৈয়দ তখন সুপ্রতিষ্ঠিত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কী যে রুচিসম্মত বিশ্লেষণ, তত্ত্ব, তথ্য নিয়ে লড়াই, আমাদের মতো তরুণরা গোগ্রাসে গিলি সব অজানা তথ্য ও বিশ্লেষণ। অরুচিকর, মর্যাদাহানি ঘটে এরকম কোনো কথা নেই। পাঠক ‘হৃৎ কলমের টানে’ পড়ে সমৃদ্ধ হয়, ঋদ্ধ হয়। আহা তরুণ বয়সে, এগুলো আমাদের জন্য ছিল অসাধারণ প্রাপ্তি।

মূলত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি আফসোসের কথা মনে হতেই এমন স্মৃতি অবচেতন মন থেকে উঠে এলো। সংবাদ-এর সেই স্বর্ণ প্রসবনী সময় নিয়ে আর একদিন লেখার ইচ্ছা আছে। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় প্রায়ই একটি হতাশার কথা শুনতে পেতাম। তা হলো তরুণদের সামনে কোনো অনুসরণ করার মতো নায়ক নেই। আছে শুধু খলনায়ক। তার এই হতাশা বারবার উচ্চারিত হতো। সামনে এগিয়ে যেতে হলে তরুণদের সামনে, অনুসরণ করার মতো আদর্শ ধারণ করার মতো নায়ক থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট। এর মধ্যে জেলের ভেতরে ঢুকে নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, জাতীয় চার নেতাকে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। সারা জাতি থথর করে কাঁপছে। শূন্যতা বিরাজ করছে, বাঙালির হৃদয়ের গহীনে। এই শূন্যতাকে জাতির জন্য, জাতীয় জীবনের জন্য ‘শোকসভার’ মতো পরিবেশের মনে করতেন অনেক কবি।

বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধে, সে অঙ্গীকার থেকে জাতির দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার জন্য নানা আয়োজন সামরিক সরকারের নেতাদের। এরকম, দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল নেতৃতের, সেই নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন একজন জননায়কের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, সবচেয়ে জোরগলায় যিনি জাতীয় নায়কের জন্য রোদন করতেন, উচ্চস্বরে কথা বলতেন তিনি হলেন আজকের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। দম বন্ধ করা এরকম পরিবেশে তরুণরাও ধীরে ধীরে তা অনুভব করা শুরু করলো। সেই অনুভব তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি।

বৈষম্য নিরসনের রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে পুঁজির অর্থনীতির স্বাদ আমরা যেদিন পেয়েছি, সেদিন থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা কোলে তুলে নিয়ছি। আমরা প্রশ্রয় দিয়েছি পেশিশক্তিকে। ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীদের ধরে নিয়ে আমরা পেশির রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এ কাজগুলো শুরু করেছিলেন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে দল গঠন করে যারা রাজনীতির আসরে স্থায়ী আসন লাভ করতে চেয়েছিলেন তারা। তাদের গণভিত্তিকে মজবুত করার জন্য অছাত্রদের ছাত্র বানিয়ে, তাদের প্রকৃত ছাত্রদের নেতা পর্যন্ত বানানো হয়েছিল। সামরিক আমলা, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি, এমনকি জেলা শহরের চেম্বারের নেতাদের ও রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়। ধীরে ধীরে রাজনীতি স্থানচ্যুত হতে থাকে, রাজনীতি চলে যায় ব্যবসায়ী, আমলাদের হাতে। দেশজুড়ে ওই যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়, সে সিন্ডিকেট ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে। যা আজ ও প্রক্রিয়া মেনে এগিয়ে যাচ্ছে।

সামরিক শাসন জাতির ঘাড় থেকে নেমেছে কিন্তু সে আমলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও রয়ে গেছে। এখনও সে আমলের মতো সংসদে আইন প্রণয়ন হয়। প্রশ্ন হলো, কার জন্য কে আইন প্রণয়ন করেন। ব্যবসায়ীরা যদি, ব্যংক ঋণের সুদের হার নিয়ে আইন তৈরি করেন সে আইন কি জনবান্ধব হতে পারে। আমাদের সাংসদরা ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, পরিবহন মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার প্রোফাইল সমৃদ্ধ সাংসদ কোথায়। বড় বড় করপোরেট হাউসগুলোর মালিক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই আছেন সংসদ সদস্য। সাংসদদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তৃণমূল রাজনীতি করে প্রক্রিয়ার মধ্যে বেড়ে ওঠা সংসদ সদস্যদের সংখ্যা এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাজনীতির প্রক্রিয়াকে আমরা গলাটিপে মেরে ফেলছি। তৃণমূলের ত্যাগী নেতারা এখন জানেন, তাদের ধাপে ধাপে সামনের দিকে এগোনোর পথ নেই। সামনের দিকের পিলারগুলো সব বিক্রি হয়ে গেছে অথবা হতে যাচ্ছে।

এই যে কেনা-বেচার রাজনীতি, তারই বাই প্রোডাক্ট হলো- টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা থেকে শুরু করে সবাই বহমান অপকর্ম কিংবা অপতৎপরতা। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের নামে এগুলো করা খুব সহজ। প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রতারক ব্যবসায়ীরা সবাই অপকর্ম করে থাকেন রাজনীতির নামে, রাজনৈতিক দলের নামে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা আছেন সর্বাগ্রে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যে কোন পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ানোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো দেশে, মৃতের সংখ্যা বাড়লে ‘কাফনের কাপড়’ কিংবা ‘চিতার খড়ির’ দাম বাড়িয়ে দিতে আমাদের ব্যবসায়ীরা একটুও কুণ্ঠাবোধ করেন না। মিডিয়া এবং প্রশাসন যখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল; তখন বস্তি পুড়িয়ে দালানের ব্যবসার আয়োজন করতে ও দ্বিধা নেই আমাদের ক্ষমতার কারিগরদের। এরকম অপকর্মগুলো আমাদের সবাই অর্জনকে ক্রমান্বয়ে ধুসর করে দিচ্ছে। সিস্টেম বা নিয়মের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে টেকসই করার প্রতিযোগিতায় আমরা উল্টো পথে হাঁটার কৌশল অবলম্বন করছি।

সাপলুডু খেলা অনেক হয়েছে, যে খেলায় ভাগ্যবানরা জয়লাভ করে; আমরা চাই, মাটি থেকে উঠে আসা নেতাদের শাসন। যে শাসনে দিন শেষে মানুষরাই বিজয়ী হয়

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আমরা আসলে রাজনীতিকে হত্যা করেছি। রাজনীতিকে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদেরও ধীরে ধীরে সাইড লাইনের দিকে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। এরকম করে যদি শেষ পর্যন্ত রাজনীতি নির্বাসনে চলে যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের আবার অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে। সাপলুডু খেলার মতো, একবার দ্রুত এগোবো, আর একবার শূন্যের ঘরে প্রত্যাবর্তন ঘটবে। রাজনীতির মাঠে পেছনের খেলোয়াড় হবেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক আমলা, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি এবং সামনে খেলবেন মুরগি মিলন, সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, সাহেদ, সাবরিনা কিংবা এরকম নামের অনেকে। সামনে যারা খেলবে প্রয়োজনে তারা খুব সক্রিয় হবেন আবার প্রয়োজনে তাদের সরে যেতে হবে। তাদের থাকা না থাকা আসলে নির্ধারণ করবেন পেছন থেকে যারা সুতা ধরে থাকবেন তাদের ওপর।

টুঙ্গিপাড়ার মতো গহীন গ্রাম থেকে উঠে এসে শেখ মুজিবুর রহমান, ধীরে ধীরে মুজিবুর, শেখ মুজিব, শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন সে রকম প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে হবে। যে প্রক্রিয়া জন্ম দেয় শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে নয়, আমরা পাই তার পার্শ্বনায়ক তাজউদ্দীনের মতো বিশ্বস্ত নেতাদের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার সাহসী নেতৃত্বে সব বোঝা মাথায় তুলে নিচ্ছেন। আমরা তার আশপাশে চাই জাতীয় চার নেতার মতো মানুষদের। আমরা চাই মুজাফফর আহম্মেদ, মনি সিংহ, মওলানা ভাসানীসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দল থেকে এসে দলীয় সংকীর্ণতা ভুলে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যেসব নেতারা তাদের মতো নেতাদের তারাই আসলে জননায়ক। এরকম মানুষের নেতৃত্ব কার্যকর হবে তখন, যখন রাজনীতি চলবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আর রাজনীতির স্টিয়ারিং হুইল থাকবে রাজনীতি যারা করেন তাদের হাতে। রাজনৈতিক নেতাদের সামনে রেখে আমরা আর আমলাদের ছদ্মশাসন চাই না। সাপলুডু খেলা অনেক হয়েছে, যে খেলায় ভাগ্যবানরা জয়লাভ করে; আমরা চাই, মাটি থেকে উঠে আসা নেতাদের শাসন। যে শাসনে দিন শেষে মানুষরাই বিজয়ী হয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাপলুডু খেলার অবসান চাই

শেখর ভট্টাচার্য

image

বুধবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

সত্তরের দশকের শেষ আর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তখন নিয়মিত কলাম লিখেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গাছপাথর ছদ্মনামে। সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়গুলোর অসাধারণ বিশ্লেষণ। বৈঠকি ঢংয়ে অনন্য সুন্দর গল্প বলে যান দরবার-ই-জহুর ছদ্মনাম দিয়ে প্রবাদ প্রতীম সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী। ‘হৃৎ কলমের টানে’ লিখেন সৈয়দ শামসুল হক। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে শিল্প সাহিত্যের অনন্য সাধারণ বিশ্লেষণ, বাঙালির মন ও মননের কথা। তরুণ বয়সি যারা লেখালেখি করেন, দুনিয়ার তাবৎ সাহিত্য সংস্কৃতির তথ্য যারা তাদের হাতের মুঠোয় রাখতে চান; বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আলোচনায় নতুন তথ্য দিয়ে যারা মাত করে দিতে চান; তারা গোগ্রাসে ‘হৃৎ কলমের টানে’ পড়েন।

মনে আছে কী অসাধারণ বিতর্ক, শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথের ট্রেজেডির উপকরণ নিয়ে দুই সৈয়দের মধ্যে। সৈয়দ শামসুল হক ম্যাকবেথের আলোকে একটি অনন্য সাধারণ নাটক লিখেন ‘ঈর্ষা’। সেই নাটকের কুশীলবদের নিয়ে, তাদের চরিত্রের ভেতরে বহমান অনুভূতিগুলো নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করেন দুই সৈয়দ। এক সৈয়দ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তরুণ অধ্যাপক, লেখালেখি শুরু করেছেন, তিনি সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম; আরেক সৈয়দ তখন সুপ্রতিষ্ঠিত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কী যে রুচিসম্মত বিশ্লেষণ, তত্ত্ব, তথ্য নিয়ে লড়াই, আমাদের মতো তরুণরা গোগ্রাসে গিলি সব অজানা তথ্য ও বিশ্লেষণ। অরুচিকর, মর্যাদাহানি ঘটে এরকম কোনো কথা নেই। পাঠক ‘হৃৎ কলমের টানে’ পড়ে সমৃদ্ধ হয়, ঋদ্ধ হয়। আহা তরুণ বয়সে, এগুলো আমাদের জন্য ছিল অসাধারণ প্রাপ্তি।

মূলত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি আফসোসের কথা মনে হতেই এমন স্মৃতি অবচেতন মন থেকে উঠে এলো। সংবাদ-এর সেই স্বর্ণ প্রসবনী সময় নিয়ে আর একদিন লেখার ইচ্ছা আছে। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় প্রায়ই একটি হতাশার কথা শুনতে পেতাম। তা হলো তরুণদের সামনে কোনো অনুসরণ করার মতো নায়ক নেই। আছে শুধু খলনায়ক। তার এই হতাশা বারবার উচ্চারিত হতো। সামনে এগিয়ে যেতে হলে তরুণদের সামনে, অনুসরণ করার মতো আদর্শ ধারণ করার মতো নায়ক থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট। এর মধ্যে জেলের ভেতরে ঢুকে নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, জাতীয় চার নেতাকে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। সারা জাতি থথর করে কাঁপছে। শূন্যতা বিরাজ করছে, বাঙালির হৃদয়ের গহীনে। এই শূন্যতাকে জাতির জন্য, জাতীয় জীবনের জন্য ‘শোকসভার’ মতো পরিবেশের মনে করতেন অনেক কবি।

বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধে, সে অঙ্গীকার থেকে জাতির দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার জন্য নানা আয়োজন সামরিক সরকারের নেতাদের। এরকম, দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল নেতৃতের, সেই নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন একজন জননায়কের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, সবচেয়ে জোরগলায় যিনি জাতীয় নায়কের জন্য রোদন করতেন, উচ্চস্বরে কথা বলতেন তিনি হলেন আজকের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। দম বন্ধ করা এরকম পরিবেশে তরুণরাও ধীরে ধীরে তা অনুভব করা শুরু করলো। সেই অনুভব তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি।

বৈষম্য নিরসনের রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে পুঁজির অর্থনীতির স্বাদ আমরা যেদিন পেয়েছি, সেদিন থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা কোলে তুলে নিয়ছি। আমরা প্রশ্রয় দিয়েছি পেশিশক্তিকে। ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীদের ধরে নিয়ে আমরা পেশির রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এ কাজগুলো শুরু করেছিলেন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে দল গঠন করে যারা রাজনীতির আসরে স্থায়ী আসন লাভ করতে চেয়েছিলেন তারা। তাদের গণভিত্তিকে মজবুত করার জন্য অছাত্রদের ছাত্র বানিয়ে, তাদের প্রকৃত ছাত্রদের নেতা পর্যন্ত বানানো হয়েছিল। সামরিক আমলা, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি, এমনকি জেলা শহরের চেম্বারের নেতাদের ও রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়। ধীরে ধীরে রাজনীতি স্থানচ্যুত হতে থাকে, রাজনীতি চলে যায় ব্যবসায়ী, আমলাদের হাতে। দেশজুড়ে ওই যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়, সে সিন্ডিকেট ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে। যা আজ ও প্রক্রিয়া মেনে এগিয়ে যাচ্ছে।

সামরিক শাসন জাতির ঘাড় থেকে নেমেছে কিন্তু সে আমলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও রয়ে গেছে। এখনও সে আমলের মতো সংসদে আইন প্রণয়ন হয়। প্রশ্ন হলো, কার জন্য কে আইন প্রণয়ন করেন। ব্যবসায়ীরা যদি, ব্যংক ঋণের সুদের হার নিয়ে আইন তৈরি করেন সে আইন কি জনবান্ধব হতে পারে। আমাদের সাংসদরা ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, পরিবহন মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার প্রোফাইল সমৃদ্ধ সাংসদ কোথায়। বড় বড় করপোরেট হাউসগুলোর মালিক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই আছেন সংসদ সদস্য। সাংসদদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তৃণমূল রাজনীতি করে প্রক্রিয়ার মধ্যে বেড়ে ওঠা সংসদ সদস্যদের সংখ্যা এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাজনীতির প্রক্রিয়াকে আমরা গলাটিপে মেরে ফেলছি। তৃণমূলের ত্যাগী নেতারা এখন জানেন, তাদের ধাপে ধাপে সামনের দিকে এগোনোর পথ নেই। সামনের দিকের পিলারগুলো সব বিক্রি হয়ে গেছে অথবা হতে যাচ্ছে।

এই যে কেনা-বেচার রাজনীতি, তারই বাই প্রোডাক্ট হলো- টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা থেকে শুরু করে সবাই বহমান অপকর্ম কিংবা অপতৎপরতা। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের নামে এগুলো করা খুব সহজ। প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রতারক ব্যবসায়ীরা সবাই অপকর্ম করে থাকেন রাজনীতির নামে, রাজনৈতিক দলের নামে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা আছেন সর্বাগ্রে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যে কোন পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ানোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো দেশে, মৃতের সংখ্যা বাড়লে ‘কাফনের কাপড়’ কিংবা ‘চিতার খড়ির’ দাম বাড়িয়ে দিতে আমাদের ব্যবসায়ীরা একটুও কুণ্ঠাবোধ করেন না। মিডিয়া এবং প্রশাসন যখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল; তখন বস্তি পুড়িয়ে দালানের ব্যবসার আয়োজন করতে ও দ্বিধা নেই আমাদের ক্ষমতার কারিগরদের। এরকম অপকর্মগুলো আমাদের সবাই অর্জনকে ক্রমান্বয়ে ধুসর করে দিচ্ছে। সিস্টেম বা নিয়মের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে টেকসই করার প্রতিযোগিতায় আমরা উল্টো পথে হাঁটার কৌশল অবলম্বন করছি।

সাপলুডু খেলা অনেক হয়েছে, যে খেলায় ভাগ্যবানরা জয়লাভ করে; আমরা চাই, মাটি থেকে উঠে আসা নেতাদের শাসন। যে শাসনে দিন শেষে মানুষরাই বিজয়ী হয়

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আমরা আসলে রাজনীতিকে হত্যা করেছি। রাজনীতিকে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদেরও ধীরে ধীরে সাইড লাইনের দিকে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। এরকম করে যদি শেষ পর্যন্ত রাজনীতি নির্বাসনে চলে যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের আবার অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে। সাপলুডু খেলার মতো, একবার দ্রুত এগোবো, আর একবার শূন্যের ঘরে প্রত্যাবর্তন ঘটবে। রাজনীতির মাঠে পেছনের খেলোয়াড় হবেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক আমলা, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি এবং সামনে খেলবেন মুরগি মিলন, সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, সাহেদ, সাবরিনা কিংবা এরকম নামের অনেকে। সামনে যারা খেলবে প্রয়োজনে তারা খুব সক্রিয় হবেন আবার প্রয়োজনে তাদের সরে যেতে হবে। তাদের থাকা না থাকা আসলে নির্ধারণ করবেন পেছন থেকে যারা সুতা ধরে থাকবেন তাদের ওপর।

টুঙ্গিপাড়ার মতো গহীন গ্রাম থেকে উঠে এসে শেখ মুজিবুর রহমান, ধীরে ধীরে মুজিবুর, শেখ মুজিব, শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন সে রকম প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে হবে। যে প্রক্রিয়া জন্ম দেয় শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে নয়, আমরা পাই তার পার্শ্বনায়ক তাজউদ্দীনের মতো বিশ্বস্ত নেতাদের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার সাহসী নেতৃত্বে সব বোঝা মাথায় তুলে নিচ্ছেন। আমরা তার আশপাশে চাই জাতীয় চার নেতার মতো মানুষদের। আমরা চাই মুজাফফর আহম্মেদ, মনি সিংহ, মওলানা ভাসানীসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দল থেকে এসে দলীয় সংকীর্ণতা ভুলে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যেসব নেতারা তাদের মতো নেতাদের তারাই আসলে জননায়ক। এরকম মানুষের নেতৃত্ব কার্যকর হবে তখন, যখন রাজনীতি চলবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আর রাজনীতির স্টিয়ারিং হুইল থাকবে রাজনীতি যারা করেন তাদের হাতে। রাজনৈতিক নেতাদের সামনে রেখে আমরা আর আমলাদের ছদ্মশাসন চাই না। সাপলুডু খেলা অনেক হয়েছে, যে খেলায় ভাগ্যবানরা জয়লাভ করে; আমরা চাই, মাটি থেকে উঠে আসা নেতাদের শাসন। যে শাসনে দিন শেষে মানুষরাই বিজয়ী হয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top