এস এম জাহাঙ্গীর আলম
জাতীয় সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলেও মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা সাত লাখ ৮৬ হাজার ৬৫। এদের কাছে কত টাকা আছে, তা প্রকাশ করা হলো না কেন? অতীতেও জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। শুধু গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত জুন শেষে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকাণ। বিদেশি ব্যাংকের ২ হাজার ৯৭০ কোটি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে, তার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৭৭।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ খেলাপি। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাংকগুলোর জন্য খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা হলেও সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয় খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। এই ঋণ আদায়ে তারা ব্যর্থ হয়েছেন, যার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। খেলাপি ঋণের হিসাব অর্থনীতিতে থাকে না। এছাড়াও এর বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ফলে একদিকে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়, অন্যদিকে বড় অংকের এই টাকা অর্থনীতিতে রি-সাইকেল করা যায় না। ফলে অর্থনীতি চাপে পড়ে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ ‘অর্থনীতির শত্রু’। ঋণখেলাপের মামলাজট দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে অবশ্যই এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ বাড়ার লাগাম টানতে হবে। দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, এটা সত্য যে মামলার পক্ষগণের অনাগ্রহের কারণে এডিআর পদ্ধতির সফল প্রয়োগ হচ্ছে না। বাছবিচার ছাড়া রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী স্বার্থে ঋণ বিতরণের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন। এর পেছনে থাকে প্রভাবশালী চক্র। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনেক ঋণ প্রদান করা হয় বলে এর বড় একটি অংশ খেলাপি হয়। নাম-ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠান, ভুয়া নামে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে; যার ফলে অনেক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালকের মতে, ব্যাংকিং খাতের ‘গভীর ক্ষত’ খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে আন্তরিকতার প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়েছেণ। বারবার ছাড় বা সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও তারা অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। আর যারা নানা কারণে ব্যবসায় লোকসান দিয়েছে বা অনিচ্ছাকৃত কারণে খেলাপি হয়েছে তাদের বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানির সম্পদ, জমি বিক্রি করে হলেও আদায় করা উচিত। দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক।
কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সরকারের মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। তবে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৭ দশমিক ৯০ শতাংশই খেলাপি। অবশ্য গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে উঠে এসেছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরের অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
খেলাপি ঋণে শীর্ষ দশে থাকা জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, নূরজাহানসহ অন্যান্য গ্রুপ মিলে হাতিয়ে নিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক তো আছেই।
অতীতেও জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি
গ্রাহকদের কাছে ব্যাংক ঋণ হলো ঋণ অর্থায়নের একটি প্রধান উৎস। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট সম্পত্তির অধিকাংশ অংশই ঋণ সম্পত্তি। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে ভালো ঋণসমূহই হলো লাভজনক সম্পত্তি। আর খারাপ ঋণ ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি বহন করে। অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংকসমূহ তার মূলধন বিনিয়োগ করে বিভিন্ন ব্যবসা ও ব্যক্তিদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে বেশি আয় গ্রহণ করতে চাইলে ব্যাংককে বেশি ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। ব্যাংকসমূহ ইচ্ছাকৃতভাবে মন্দ ঋণ তৈরি করে না।
বিভিন্নকারণে ঋণসমূহ মন্দ ঋণে পরিণত হয়। যেমন- অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন বা ফার্মের নিজস্ব প্রয়োগগত অবস্থার পরিবর্তনের কারণে। যেসব ব্যাংক তার ঋণ পোর্টফোলিওতে বৈচিত্রতা রাখে না, সেসব ব্যাংকের নিজস্ব কিছু ঝুঁকি থাকে যা অন্য ব্যাংকের থাকে না। একটি দেশে ব্যাংকের সংখ্যাও অনেক থাকে এবং এদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বিদ্যমান থাকে। ব্যাংকিং ব্যবসায়ে ঋণের প্রতিযোগিতার প্রবণতা তৈরি হওয়ার দরুণ ব্যাংকসমূহ বিভিন্ন ধরণের ঋণের ধারণা প্রবর্তন করে ও ঋণ গ্রহীতাদের বিভিন্ন ধরনের উন্নত সেবার সুযোগ তৈরি করে। সেই সঙ্গে এটাও পরিলক্ষিত হয় যে, ব্যাংকসমূহের এসেট কোয়ালিটি ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে।
ব্যাংকের পরিচালন পর্ষদ ঋণ প্রক্রিয়াতে তিনটি কাজ নির্ধারণ করে থাকে। ব্যবসা উন্নয়ন বা বিকাশ হলো ব্যাংকের সেবাসমূহের সব তথ্য বর্তমান ও সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। যখন একজন ক্রেতা ঋণের জন্য অনুরোধ করে, ব্যাংক কর্মকর্তা প্রাপ্ত সব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখে যে- এ ঋণটি ব্যাংকের ঝুঁকি আয়ের লক্ষ্যের সঙ্গে মিলছে কিনা। ঋণ কর্মকর্তা বিশ্লেষণের রিপোর্ট মূল্যায়ন করে এবং কোন ভুল থাকলে, বাদ দিতে হলে বা যোগ করা হলে, আলোচনা করেন বিশ্লেষকের সঙ্গে। ঋণ পুনঃমূল্যায়নের প্রচেষ্টা করা হয় ঋণ ঝুঁকি কমানোর জন্য, সমস্যা ঋণগুলো পরিচালনা করার জন্য এবং ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ঋণগ্রহীতাদের সম্পত্তি নগদে পরিণত করার জন্য। আসল কথা হলো যে, ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা না নিয়ে খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে লাভ কী?
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]
এস এম জাহাঙ্গীর আলম
শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
জাতীয় সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলেও মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা সাত লাখ ৮৬ হাজার ৬৫। এদের কাছে কত টাকা আছে, তা প্রকাশ করা হলো না কেন? অতীতেও জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। শুধু গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত জুন শেষে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকাণ। বিদেশি ব্যাংকের ২ হাজার ৯৭০ কোটি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে, তার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৭৭।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ খেলাপি। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাংকগুলোর জন্য খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা হলেও সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয় খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। এই ঋণ আদায়ে তারা ব্যর্থ হয়েছেন, যার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। খেলাপি ঋণের হিসাব অর্থনীতিতে থাকে না। এছাড়াও এর বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ফলে একদিকে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়, অন্যদিকে বড় অংকের এই টাকা অর্থনীতিতে রি-সাইকেল করা যায় না। ফলে অর্থনীতি চাপে পড়ে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ ‘অর্থনীতির শত্রু’। ঋণখেলাপের মামলাজট দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে অবশ্যই এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ বাড়ার লাগাম টানতে হবে। দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, এটা সত্য যে মামলার পক্ষগণের অনাগ্রহের কারণে এডিআর পদ্ধতির সফল প্রয়োগ হচ্ছে না। বাছবিচার ছাড়া রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী স্বার্থে ঋণ বিতরণের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন। এর পেছনে থাকে প্রভাবশালী চক্র। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনেক ঋণ প্রদান করা হয় বলে এর বড় একটি অংশ খেলাপি হয়। নাম-ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠান, ভুয়া নামে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে; যার ফলে অনেক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালকের মতে, ব্যাংকিং খাতের ‘গভীর ক্ষত’ খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে আন্তরিকতার প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়েছেণ। বারবার ছাড় বা সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও তারা অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। আর যারা নানা কারণে ব্যবসায় লোকসান দিয়েছে বা অনিচ্ছাকৃত কারণে খেলাপি হয়েছে তাদের বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানির সম্পদ, জমি বিক্রি করে হলেও আদায় করা উচিত। দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক।
কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সরকারের মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। তবে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৭ দশমিক ৯০ শতাংশই খেলাপি। অবশ্য গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে উঠে এসেছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরের অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
খেলাপি ঋণে শীর্ষ দশে থাকা জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, নূরজাহানসহ অন্যান্য গ্রুপ মিলে হাতিয়ে নিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক তো আছেই।
অতীতেও জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি
গ্রাহকদের কাছে ব্যাংক ঋণ হলো ঋণ অর্থায়নের একটি প্রধান উৎস। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট সম্পত্তির অধিকাংশ অংশই ঋণ সম্পত্তি। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে ভালো ঋণসমূহই হলো লাভজনক সম্পত্তি। আর খারাপ ঋণ ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি বহন করে। অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংকসমূহ তার মূলধন বিনিয়োগ করে বিভিন্ন ব্যবসা ও ব্যক্তিদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে বেশি আয় গ্রহণ করতে চাইলে ব্যাংককে বেশি ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। ব্যাংকসমূহ ইচ্ছাকৃতভাবে মন্দ ঋণ তৈরি করে না।
বিভিন্নকারণে ঋণসমূহ মন্দ ঋণে পরিণত হয়। যেমন- অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন বা ফার্মের নিজস্ব প্রয়োগগত অবস্থার পরিবর্তনের কারণে। যেসব ব্যাংক তার ঋণ পোর্টফোলিওতে বৈচিত্রতা রাখে না, সেসব ব্যাংকের নিজস্ব কিছু ঝুঁকি থাকে যা অন্য ব্যাংকের থাকে না। একটি দেশে ব্যাংকের সংখ্যাও অনেক থাকে এবং এদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বিদ্যমান থাকে। ব্যাংকিং ব্যবসায়ে ঋণের প্রতিযোগিতার প্রবণতা তৈরি হওয়ার দরুণ ব্যাংকসমূহ বিভিন্ন ধরণের ঋণের ধারণা প্রবর্তন করে ও ঋণ গ্রহীতাদের বিভিন্ন ধরনের উন্নত সেবার সুযোগ তৈরি করে। সেই সঙ্গে এটাও পরিলক্ষিত হয় যে, ব্যাংকসমূহের এসেট কোয়ালিটি ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে।
ব্যাংকের পরিচালন পর্ষদ ঋণ প্রক্রিয়াতে তিনটি কাজ নির্ধারণ করে থাকে। ব্যবসা উন্নয়ন বা বিকাশ হলো ব্যাংকের সেবাসমূহের সব তথ্য বর্তমান ও সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। যখন একজন ক্রেতা ঋণের জন্য অনুরোধ করে, ব্যাংক কর্মকর্তা প্রাপ্ত সব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখে যে- এ ঋণটি ব্যাংকের ঝুঁকি আয়ের লক্ষ্যের সঙ্গে মিলছে কিনা। ঋণ কর্মকর্তা বিশ্লেষণের রিপোর্ট মূল্যায়ন করে এবং কোন ভুল থাকলে, বাদ দিতে হলে বা যোগ করা হলে, আলোচনা করেন বিশ্লেষকের সঙ্গে। ঋণ পুনঃমূল্যায়নের প্রচেষ্টা করা হয় ঋণ ঝুঁকি কমানোর জন্য, সমস্যা ঋণগুলো পরিচালনা করার জন্য এবং ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ঋণগ্রহীতাদের সম্পত্তি নগদে পরিণত করার জন্য। আসল কথা হলো যে, ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা না নিয়ে খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে লাভ কী?
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]