নাজমুল হুদা খান
পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময় সংক্রামক রোগের মহামারী কিংবা অতিমারীর তাণ্ডবে অনেক সময় অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়; কিন্তু অসংক্রামক রোগেই মৃত্যু ঘটে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ মৃত্যুর হার প্রায় ৭৪% উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচ ধরনের অসংক্রামক রোগকে এ বিশ্বের সিংহভাগ মৃত্যু ও অসুস্থতার কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এর মধ্যে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও মানসিক রোগ অন্যতম। প্রতি বছর ৪ কোটিরও বেশি মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, যার অর্ধেকই এশিয়ার দেশগুলোতে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে, যার মধ্যে অর্ধেকই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ক্যান্সারের রোগী বাড়ছে দেড় লাখের বেশি; মারা যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, অথচ একটু সচেতনতাই প্রায় অর্ধেক মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ফলপ্রসূ প্রতিরোধ, দ্রুততম সময়ে এ রোগ নির্নয় ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হয়। ২০২২-২০২৪ সাল পর্যন্ত এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছেÑ ‘আসুন ক্যান্সার সেবায় বৈষম্য দূর করি।’
মানুষের শরীর প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে গঠিত। এদের সমন্বিত শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্র পরিচালিত হয়। একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এদের কার্যক্রম, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও তিরোধান ঘটে। শারীরবৃত্তীয় সাধারণ প্রক্রিয়ার বাইরে অনাকাক্সিক্ষত কারণে যদি শরীরের কোন অংশ বা অঙ্গের কোষসমূহের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয়; তাহলেই ক্যান্সারের উৎপত্তি ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্যান্সার উৎপাদক উপাদানের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ভাইরাস জীবাণু যথা- হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস প্রভৃতি; এসবেস্টস, তামাক, আর্সেনিক, আলফাটক্সিন, অতিবেগুনি রশ্মি, আয়ানাইজিং বিকিরণ ইত্যাদি অন্যতম। অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল খাবার, ধূমপান, মাদক দ্রব্য গ্রহণ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা প্রভৃতি ক্যান্সারের ঝুঁকির অন্যতম কারণ।
ক্যান্সার নারী-পুরুষের জন্য সমভাবে ঝুঁকির কারণ হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে নারীদের ঝুঁকি বেশি বলে গবেষণা ও বিভিন্ন জরিপে প্রতীয়মান হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ক্যান্সার আক্রান্তের ৫৯.৫ শতাংশই নারী। বিএসএমএমইউ পরিচালিত এ জরিপে ২১ হাজার ১৭৫টি নমুনা পরীক্ষায় ক্যান্সার চিহ্নিতদের মধ্যে এ গবেষণা চালানো হয়। নারীদের প্রধান ক্যান্সারের মধ্যে ২৩ শতাংশ স্তন, ২১.৫ শতাংশ জরায়ু মুখ ও মুখ গহ্বরে ৯ শতাংশ উল্লেখযোগ্য। অপর এক গবেষণায় উঠে এসেছে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ১৭ শতাংশ ব্রেস্ট ক্যান্সার, ১৬ শতাংশ জরায়ু ও জরায়ু মুখ, ১২ শতাংশ খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
জরায়ুর মুখ বা সারভাইক্যাল ক্যান্সারেই বাংলাদেশে ১২ হাজারেরও অধিক নারী আক্রান্ত হচ্ছে- এর মধ্যে মৃত্যুর হার পঞ্চাশ শতাংশ।
দেশের স্ত্রীরোগ ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণের মতে নারীদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রবনতা দিন দিন বেড়ে চলছে। বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি নারী বিভিন্নভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব নারীদের অধিকাংশেরই এ বিষয়ে অজ্ঞতা ও অবহেলা রয়েছে। ব্রেস্ট বা জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক নারীই বুঝতে পারেন না যে, তারা এ ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। যখন জানতে পারেন, তখন রোগটির একেবারে শেষ পর্যায়ে। উপরন্তু নারীরা প্রায়শই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না কিংবা হওয়ার সুযোগটি পান না। সামাজিক রক্ষণশীলতা বা বিভিন্ন কুসংস্কারের কারণে স্তন বা জরায়ু মুখের অস্বাভাবিক উপসর্গের বিষয়টি নারীরা গোপন রাখেন।
নারীদের ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। দেরিতে সন্তান গ্রহণ, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, খাবার দাবারে শাকসবজি ও ফলমূলের থেকে চর্বি বা প্রোটিন জাতীয় খাবারের আধিক্য এবং অতিরিক্ত ওজন নারীদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা হরমোন ইনজেকশনও ক্যান্সারের উৎপত্তির অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষকরা মত পেশ করেন। বয়সও নারীদের ক্যান্সার আক্রান্তের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বৃদ্ধি, বিশেষ করে ৫০ ঊর্ধ্ব নারীদের এ ঝুঁকির মাত্রা বেশি। এছাড়া ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, অবিবাহিতা বা সন্তানহীনা নারী, অধিক বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ, কম বয়সে মাসিক শুরু ও বেশি বয়সে বন্ধ হওয়াকেও ক্যান্সারের ঝুঁকি হিসেবে আখ্যায়িত করেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের প্রতি ৮ জন নারীর একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার শীর্ষে। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যু হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। স্তন ক্যান্সারের প্রধানতম কারণের মধ্যে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক নারী স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, বেশি বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ, বুকের দুধ না পান করানো, দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ, কম বয়সে মাসিক হওয়া বা ৫০ বছরের অধিক বয়সে মাসিক বন্ধ হওয়া, খাদ্যে অতিরিক্ত চর্বি গ্রহণ, ধূমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্যে আসক্তি ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদি অন্যতম।
স্তন ক্যান্সারের পর জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অবস্থান। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ লাখ নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে ; মৃত্যুবরণ করছে অর্ধেকেরও বেশি। আমাদের দেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১০ হাজারেরও বেশি নারী। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ১৬-১৮ এবং অরক্ষিত যৌন সংগম জরায়ু মুখে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ২০ বছরের কম ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক নারীদের এ ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি কম। তবে ৩৫-৫৫ বছর বয়সিরা এ ব্যাধিতে আক্রান্তের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বের অনেক দেশে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নারীদের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নিউজিল্যান্ডসহ আটাশটি দেশে এ ধারা লক্ষ্য করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞগণের মতে নারীদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, সিগারেট ও মদ্যপানে আসক্তি, দূষিত পরিবেশে কাজ করা প্রভৃতি ক্যান্সারের ঝুঁকির উপাদান হিসেবে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অনেকে ধূমপান না করলেও পান এবং পানের সঙ্গে জর্দ্দা, সাদা পাতা এ ধরনের তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি সেবন করে থাকেন। এসবও তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। একই কারণে মুখ গহ্বরেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বছরে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এর পেছনে বৈশ্বিক বাৎসরিক চিকিৎসা ব্যয় দেড় ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ সচেতনতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নতির মাধ্যমে পঞ্চাশভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধ ও মৃত্যু হ্রাস করা সম্ভব। সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে দূরারোগ্য ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ২০৩০ সালে দ্বিগুণে পরিণত হবে।
সাধারণত প্রাথমিকভাবে ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ ধরতে না পারা কিংবা সঠিক সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা না নেয়া বা পাওয়া ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রধান কারণ। সাধারণত শরীরের ওজন কমে যাওয়া দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে ফুসফুসে কাশি হওয়া, পায়খানা প্রসাব বা মাসিকের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, গলা বসে যাওয়া বা দীর্ঘ দিন যাবৎ মাঝে মাঝে জ্বর আসা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত। স্তন ও জরায়ু মুখে কান্সারের নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ রয়েছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবারই অবগত থাকা উচিত।
আমাদের দেশে কত নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত তার প্রকৃত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ওপর নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত কিমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে এ কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে।
বর্তমানে মাত্র দুই শতাধিক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সারা দেশের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। সারাদেশে সরকারি ১০টি এবং বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালের মাধ্যমে এ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। তবে ক্যান্সার রোগীদের ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও নার্সসহ দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি তিন স্তরের পরিকল্পনাধীন খাতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথম স্তরে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ক্যান্সার সেন্টার; দ্বিতীয় ধাপে প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজে এবং তৃতীয় স্তরে প্রতিটি জেলা শহরে ক্যান্সার সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ সহজলভ্য করা হয়েছে।
পরিবার, সমাজ ও দেশ মাতৃকার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে নারীদের ভূমিকা এখন গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত ব্যস্ততা ও বিভিন্ন স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এজন্য জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নারীরা এখনো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেমন কাজকর্ম করছে; তেমনি খাবার দাবারে ভেজাল, ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি সেবনের হারও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব কারণে নারীদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ব্যাপারে নারীদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত বাস্তবসম্মত শারীরিক ব্যায়ামে উৎসাহিত করতে হবে, ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি পরিহারে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলেই ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেকাংশে সাফল্য আসবে এবং ক্যান্সারে আক্রান্তদের সিংহভাগ মৃত্যু রোধ সম্ভব।
[লেখক : সাবেক সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা]
নাজমুল হুদা খান
শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময় সংক্রামক রোগের মহামারী কিংবা অতিমারীর তাণ্ডবে অনেক সময় অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়; কিন্তু অসংক্রামক রোগেই মৃত্যু ঘটে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ মৃত্যুর হার প্রায় ৭৪% উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচ ধরনের অসংক্রামক রোগকে এ বিশ্বের সিংহভাগ মৃত্যু ও অসুস্থতার কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এর মধ্যে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও মানসিক রোগ অন্যতম। প্রতি বছর ৪ কোটিরও বেশি মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, যার অর্ধেকই এশিয়ার দেশগুলোতে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে, যার মধ্যে অর্ধেকই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ক্যান্সারের রোগী বাড়ছে দেড় লাখের বেশি; মারা যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, অথচ একটু সচেতনতাই প্রায় অর্ধেক মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ফলপ্রসূ প্রতিরোধ, দ্রুততম সময়ে এ রোগ নির্নয় ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হয়। ২০২২-২০২৪ সাল পর্যন্ত এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছেÑ ‘আসুন ক্যান্সার সেবায় বৈষম্য দূর করি।’
মানুষের শরীর প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে গঠিত। এদের সমন্বিত শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্র পরিচালিত হয়। একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এদের কার্যক্রম, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও তিরোধান ঘটে। শারীরবৃত্তীয় সাধারণ প্রক্রিয়ার বাইরে অনাকাক্সিক্ষত কারণে যদি শরীরের কোন অংশ বা অঙ্গের কোষসমূহের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয়; তাহলেই ক্যান্সারের উৎপত্তি ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্যান্সার উৎপাদক উপাদানের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ভাইরাস জীবাণু যথা- হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস প্রভৃতি; এসবেস্টস, তামাক, আর্সেনিক, আলফাটক্সিন, অতিবেগুনি রশ্মি, আয়ানাইজিং বিকিরণ ইত্যাদি অন্যতম। অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল খাবার, ধূমপান, মাদক দ্রব্য গ্রহণ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা প্রভৃতি ক্যান্সারের ঝুঁকির অন্যতম কারণ।
ক্যান্সার নারী-পুরুষের জন্য সমভাবে ঝুঁকির কারণ হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে নারীদের ঝুঁকি বেশি বলে গবেষণা ও বিভিন্ন জরিপে প্রতীয়মান হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ক্যান্সার আক্রান্তের ৫৯.৫ শতাংশই নারী। বিএসএমএমইউ পরিচালিত এ জরিপে ২১ হাজার ১৭৫টি নমুনা পরীক্ষায় ক্যান্সার চিহ্নিতদের মধ্যে এ গবেষণা চালানো হয়। নারীদের প্রধান ক্যান্সারের মধ্যে ২৩ শতাংশ স্তন, ২১.৫ শতাংশ জরায়ু মুখ ও মুখ গহ্বরে ৯ শতাংশ উল্লেখযোগ্য। অপর এক গবেষণায় উঠে এসেছে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ১৭ শতাংশ ব্রেস্ট ক্যান্সার, ১৬ শতাংশ জরায়ু ও জরায়ু মুখ, ১২ শতাংশ খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
জরায়ুর মুখ বা সারভাইক্যাল ক্যান্সারেই বাংলাদেশে ১২ হাজারেরও অধিক নারী আক্রান্ত হচ্ছে- এর মধ্যে মৃত্যুর হার পঞ্চাশ শতাংশ।
দেশের স্ত্রীরোগ ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণের মতে নারীদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রবনতা দিন দিন বেড়ে চলছে। বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি নারী বিভিন্নভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব নারীদের অধিকাংশেরই এ বিষয়ে অজ্ঞতা ও অবহেলা রয়েছে। ব্রেস্ট বা জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক নারীই বুঝতে পারেন না যে, তারা এ ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। যখন জানতে পারেন, তখন রোগটির একেবারে শেষ পর্যায়ে। উপরন্তু নারীরা প্রায়শই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না কিংবা হওয়ার সুযোগটি পান না। সামাজিক রক্ষণশীলতা বা বিভিন্ন কুসংস্কারের কারণে স্তন বা জরায়ু মুখের অস্বাভাবিক উপসর্গের বিষয়টি নারীরা গোপন রাখেন।
নারীদের ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। দেরিতে সন্তান গ্রহণ, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, খাবার দাবারে শাকসবজি ও ফলমূলের থেকে চর্বি বা প্রোটিন জাতীয় খাবারের আধিক্য এবং অতিরিক্ত ওজন নারীদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা হরমোন ইনজেকশনও ক্যান্সারের উৎপত্তির অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষকরা মত পেশ করেন। বয়সও নারীদের ক্যান্সার আক্রান্তের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বৃদ্ধি, বিশেষ করে ৫০ ঊর্ধ্ব নারীদের এ ঝুঁকির মাত্রা বেশি। এছাড়া ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, অবিবাহিতা বা সন্তানহীনা নারী, অধিক বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ, কম বয়সে মাসিক শুরু ও বেশি বয়সে বন্ধ হওয়াকেও ক্যান্সারের ঝুঁকি হিসেবে আখ্যায়িত করেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের প্রতি ৮ জন নারীর একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার শীর্ষে। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যু হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। স্তন ক্যান্সারের প্রধানতম কারণের মধ্যে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক নারী স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, বেশি বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ, বুকের দুধ না পান করানো, দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ, কম বয়সে মাসিক হওয়া বা ৫০ বছরের অধিক বয়সে মাসিক বন্ধ হওয়া, খাদ্যে অতিরিক্ত চর্বি গ্রহণ, ধূমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্যে আসক্তি ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদি অন্যতম।
স্তন ক্যান্সারের পর জরায়ু মুখের ক্যান্সারের অবস্থান। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ লাখ নারী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে ; মৃত্যুবরণ করছে অর্ধেকেরও বেশি। আমাদের দেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১০ হাজারেরও বেশি নারী। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ১৬-১৮ এবং অরক্ষিত যৌন সংগম জরায়ু মুখে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ২০ বছরের কম ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক নারীদের এ ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি কম। তবে ৩৫-৫৫ বছর বয়সিরা এ ব্যাধিতে আক্রান্তের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বের অনেক দেশে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নারীদের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, নিউজিল্যান্ডসহ আটাশটি দেশে এ ধারা লক্ষ্য করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞগণের মতে নারীদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, সিগারেট ও মদ্যপানে আসক্তি, দূষিত পরিবেশে কাজ করা প্রভৃতি ক্যান্সারের ঝুঁকির উপাদান হিসেবে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। অনেকে ধূমপান না করলেও পান এবং পানের সঙ্গে জর্দ্দা, সাদা পাতা এ ধরনের তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি সেবন করে থাকেন। এসবও তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। একই কারণে মুখ গহ্বরেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বছরে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এর পেছনে বৈশ্বিক বাৎসরিক চিকিৎসা ব্যয় দেড় ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ সচেতনতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নতির মাধ্যমে পঞ্চাশভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধ ও মৃত্যু হ্রাস করা সম্ভব। সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে দূরারোগ্য ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ২০৩০ সালে দ্বিগুণে পরিণত হবে।
সাধারণত প্রাথমিকভাবে ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ ধরতে না পারা কিংবা সঠিক সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা না নেয়া বা পাওয়া ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রধান কারণ। সাধারণত শরীরের ওজন কমে যাওয়া দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে ফুসফুসে কাশি হওয়া, পায়খানা প্রসাব বা মাসিকের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, গলা বসে যাওয়া বা দীর্ঘ দিন যাবৎ মাঝে মাঝে জ্বর আসা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত। স্তন ও জরায়ু মুখে কান্সারের নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ রয়েছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবারই অবগত থাকা উচিত।
আমাদের দেশে কত নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত তার প্রকৃত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ওপর নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত কিমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে এ কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে।
বর্তমানে মাত্র দুই শতাধিক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সারা দেশের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। সারাদেশে সরকারি ১০টি এবং বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালের মাধ্যমে এ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। তবে ক্যান্সার রোগীদের ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও নার্সসহ দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি তিন স্তরের পরিকল্পনাধীন খাতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথম স্তরে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ক্যান্সার সেন্টার; দ্বিতীয় ধাপে প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজে এবং তৃতীয় স্তরে প্রতিটি জেলা শহরে ক্যান্সার সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ সহজলভ্য করা হয়েছে।
পরিবার, সমাজ ও দেশ মাতৃকার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে নারীদের ভূমিকা এখন গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত ব্যস্ততা ও বিভিন্ন স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এজন্য জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নারীরা এখনো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেমন কাজকর্ম করছে; তেমনি খাবার দাবারে ভেজাল, ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি সেবনের হারও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব কারণে নারীদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ব্যাপারে নারীদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত বাস্তবসম্মত শারীরিক ব্যায়ামে উৎসাহিত করতে হবে, ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি পরিহারে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলেই ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেকাংশে সাফল্য আসবে এবং ক্যান্সারে আক্রান্তদের সিংহভাগ মৃত্যু রোধ সম্ভব।
[লেখক : সাবেক সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা]