মিহির কুমার রায়
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ; যা বিগত পাঁচ অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় সবচেয়ে কম। অর্থাৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের গতি কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটেছে এডিপি বাস্তবায়নেএবং প্রকল্প বিন্যাসের মাধ্যমে অর্থছাড়ে সতর্কতাকে যথার্থ বলছেন অর্থনীতিবদিরা। কারণ অর্থবছরের শুরুতেই সরকার বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সব উন্নয়ন প্রকল্প তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে অর্থায়ন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনেকেই বলছেন বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রকল্প ব্যয় কামনোর সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিল এবং বৈদেশিক সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিলে রিজার্ভের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক হবে যদিও এডিপি বাস্তবায়ন কমলে প্রবৃদ্ধিও কমতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই ।
সরকারের ব্যয় কমানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানো হয়েছে, যার ফলে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে বিধায় সরকারের কৃচ্ছ্র কর্মসূচি ও আমদানি হ্রাসের কারণে এডিপি কিছুটা কমেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে অর্থবছরের শুরুতেই এডিপিতে থাকা ১ হাজার ৩৭২টি প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা সজিয়ে ছিল সরকার। এসব প্রকল্প এ, বি, এবং সি- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছিল; যার মধ্যে এ ক্যাটাগরিতে থাকা ৬৪৬ প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থ আগের মতোই ব্যয় হবে, তবে বি ক্যাটাগরিতে থাকা ৬৩৬ প্রকল্পের বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হবে অর্থাৎ প্রকল্পের গতি কমিয়ে আনা হয়েছিল। আর সি ক্যাটাগরিতে থাকা ৮১টি প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ স্থগিত করা হয়েছিল। ফলে কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে সাত শতাধিক প্রকল্পের কাজে বরাদ্দ ও গতি কমিয়ে আনা হয়েছিল; যার প্রভাব মিলেছে এডিপি বাস্তবায়নের প্রতিবেদনে।
গত ৫০ বছরের প্রকল্পের বাস্তবায়ন রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র নির্বাচনের বছর ছাড়া কোন বছরই ৮০ ভাগের বেশি এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়ে আসছে। চলমান বছরটি বর্তমান সরকারের বিদায়ী বছর এবং এ বছরে সরকার এডিপি বাস্তবায়নের পূর্ণ বছর হিসেবে পাবে; যা আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) ছয় মাস সময় পাবে। কারণ আগামী বছরের জানুয়ারিতে দেশে সংসদীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে সরকার পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৌশলগতভাবে বছরটির গুরুত্ব অপরিসীম।
বৈশ্বিক কারণে সরকার ব্যয়ের ব্যাপারে সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য, যা সাম্প্রতিক মুদ্রানীতিতে উল্লেখিত হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি তিনটি ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মানে নিম্নমুখীর প্রবণতা ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে; যা অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত করে যাচ্ছে। এ কারণে সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে বেড়েছে সরকারের ঋণনির্ভরতা। বৈদেশিক মুদ্রা আয়, রাজস্ব বাড়ানো ও ভর্তুকি কমানোর মাধ্যমেই এ চাপ কমানো সম্ভব।
এখানে উল্লেখ্য, চলতি (২০২২-২০২৩) অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় রাজস্ব আদায়ে দেখা যায় প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১৫ হাজার ১১২ কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি ঋণের চাপ কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তবে কর আহরণ বাড়াতে যে ধরনের সংস্কার দরকার তা এখনো করা হয়নি। রাজস্ব খাতে কার্যকর সংস্কার ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। একে তো এডিপিতে বরাদ্দ কম, তারপর সরকারের রক্ষণশীল মুদ্রানীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারের অত্যধিক লোননির্ভরতা ইত্যাদি সার্বিক পরিস্থিতির জন্য কিছুটা স্পর্শকাতর বিধায় আগামী ছয় মাসে (জানুযারি-জুন) উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) ৭৬ শতাংশ প্রচলিত আর্থিক কাঠামোতে কিভাবে ব্যয়িত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করলেও বাজেটভুক্ত উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয়িত করতে সরকার নিরুৎসাহিত করেননি। এখন শুধু প্রয়োজন দক্ষতার সাথে প্রকল্প বাস্তবাযনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চলা; যা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কারণ এ উন্নয়ন বাজেট বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট বাস্তবায়ন; যদিও আগামী (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত সময় পাবে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার। তাই প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংন্থা একযুগে সরকারি নির্দেশনা মেনে এগিয়ে আসবে উন্নয়নের অংশীদার হয়ে- এ আশাই রইল।
[লেখক : ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]
মিহির কুমার রায়
রোববার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ; যা বিগত পাঁচ অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় সবচেয়ে কম। অর্থাৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের গতি কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটেছে এডিপি বাস্তবায়নেএবং প্রকল্প বিন্যাসের মাধ্যমে অর্থছাড়ে সতর্কতাকে যথার্থ বলছেন অর্থনীতিবদিরা। কারণ অর্থবছরের শুরুতেই সরকার বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সব উন্নয়ন প্রকল্প তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে অর্থায়ন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনেকেই বলছেন বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রকল্প ব্যয় কামনোর সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিল এবং বৈদেশিক সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিলে রিজার্ভের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক হবে যদিও এডিপি বাস্তবায়ন কমলে প্রবৃদ্ধিও কমতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই ।
সরকারের ব্যয় কমানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানো হয়েছে, যার ফলে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে বিধায় সরকারের কৃচ্ছ্র কর্মসূচি ও আমদানি হ্রাসের কারণে এডিপি কিছুটা কমেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে অর্থবছরের শুরুতেই এডিপিতে থাকা ১ হাজার ৩৭২টি প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা সজিয়ে ছিল সরকার। এসব প্রকল্প এ, বি, এবং সি- এই তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছিল; যার মধ্যে এ ক্যাটাগরিতে থাকা ৬৪৬ প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থ আগের মতোই ব্যয় হবে, তবে বি ক্যাটাগরিতে থাকা ৬৩৬ প্রকল্পের বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হবে অর্থাৎ প্রকল্পের গতি কমিয়ে আনা হয়েছিল। আর সি ক্যাটাগরিতে থাকা ৮১টি প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ স্থগিত করা হয়েছিল। ফলে কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে সাত শতাধিক প্রকল্পের কাজে বরাদ্দ ও গতি কমিয়ে আনা হয়েছিল; যার প্রভাব মিলেছে এডিপি বাস্তবায়নের প্রতিবেদনে।
গত ৫০ বছরের প্রকল্পের বাস্তবায়ন রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র নির্বাচনের বছর ছাড়া কোন বছরই ৮০ ভাগের বেশি এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়ে আসছে। চলমান বছরটি বর্তমান সরকারের বিদায়ী বছর এবং এ বছরে সরকার এডিপি বাস্তবায়নের পূর্ণ বছর হিসেবে পাবে; যা আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) ছয় মাস সময় পাবে। কারণ আগামী বছরের জানুয়ারিতে দেশে সংসদীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে সরকার পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৌশলগতভাবে বছরটির গুরুত্ব অপরিসীম।
বৈশ্বিক কারণে সরকার ব্যয়ের ব্যাপারে সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য, যা সাম্প্রতিক মুদ্রানীতিতে উল্লেখিত হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি তিনটি ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মানে নিম্নমুখীর প্রবণতা ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে; যা অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত করে যাচ্ছে। এ কারণে সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে বেড়েছে সরকারের ঋণনির্ভরতা। বৈদেশিক মুদ্রা আয়, রাজস্ব বাড়ানো ও ভর্তুকি কমানোর মাধ্যমেই এ চাপ কমানো সম্ভব।
এখানে উল্লেখ্য, চলতি (২০২২-২০২৩) অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় রাজস্ব আদায়ে দেখা যায় প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১৫ হাজার ১১২ কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি ঋণের চাপ কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তবে কর আহরণ বাড়াতে যে ধরনের সংস্কার দরকার তা এখনো করা হয়নি। রাজস্ব খাতে কার্যকর সংস্কার ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। একে তো এডিপিতে বরাদ্দ কম, তারপর সরকারের রক্ষণশীল মুদ্রানীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারের অত্যধিক লোননির্ভরতা ইত্যাদি সার্বিক পরিস্থিতির জন্য কিছুটা স্পর্শকাতর বিধায় আগামী ছয় মাসে (জানুযারি-জুন) উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) ৭৬ শতাংশ প্রচলিত আর্থিক কাঠামোতে কিভাবে ব্যয়িত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করলেও বাজেটভুক্ত উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয়িত করতে সরকার নিরুৎসাহিত করেননি। এখন শুধু প্রয়োজন দক্ষতার সাথে প্রকল্প বাস্তবাযনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চলা; যা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কারণ এ উন্নয়ন বাজেট বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট বাস্তবায়ন; যদিও আগামী (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত সময় পাবে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার। তাই প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংন্থা একযুগে সরকারি নির্দেশনা মেনে এগিয়ে আসবে উন্নয়নের অংশীদার হয়ে- এ আশাই রইল।
[লেখক : ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]