alt

উপ-সম্পাদকীয়

পানি কেন পণ্য?

এম এ কবীর

: বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশ্বকে সংঘাত এড়াতে এবং ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পানি সম্পদের পরিবর্তন ও সুরক্ষার জন্য জরুরি আহবান জানিয়েছেন। তিন দিনব্যাপী জাতিসংঘ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, পানি হলো ‘সবার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস’ এবং এটি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এজেন্ডার কেন্দ্রে থাকা প্রয়োজন।

পানির অপর নাম জীবন। শুধু মানুষ নয়, পানি ছাড়া কোনো প্রাণীই বেশিদিন বাঁচতে পারে না। তবে পানি যেমন জীবন বাঁচায়, সেই পানিই হতে পারে বড় বিপদের কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করলে জনগণের বর্তমান অসুখ-বিসুখের শতকরা ৭০ ভাগ কমে যাবে।

নাইজেরীয় এক লোক কবিতায় বলা হয়েছে-

‘রাজা ছাড়া মানুষ বাঁচে/মানুষ ছাড়া রাজ্য বাঁচে না।

প্রাণী ছাড়া ঘাস বাঁচে/ঘাস ছাড়া প্রাণী বাঁচে না।

মানুষ ছাড়া পানি বাঁচে/পানি ছাড়া প্রাণ বাঁচে না।’

বাংলাদেশে যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে বিপুল পানির চাহিদা তৈরির মাধ্যমে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার ভূ-উপরিস্থিত পানি দূষিত করছে। এছাড়া আছে ভবন-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে নদী, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। ইটের ভাটা, শিল্পবর্জ্য তো আছেই। এর পাশাপাশি আছে সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, কোথাও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে, কোথাও সড়ক পরিবহনের সুবিধার জন্য বাছবিচারহীনভাবে বাঁধ-কালভার্ট নির্মাণ। এগুলোর ফলে কোথাও নদীর অবাধ প্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও পানির প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে পানি, মাটি, অতঃপর মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে। শুধু দেশের ভেতর নয়, ভারতে নির্মিত বাঁধ এবং পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাও বাংলাদেশের জন্য হুমকি। ফারাক্কা বাঁধ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন, নদীর প্রবাহ, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র সবকিছুরই অপরিমেয় ক্ষতি করেছে। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলও এখন এর জন্য ক্ষতির শিকার। এর ওপর আবার টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। সম্প্রতি চীনও ব্রহ্মপুত্র নিয়ে যে বাঁধ পরিকল্পনা করছে, তা বাস্তবায়িত হলে ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারা বিশ্বেই বাঁধ একটি বড় বাণিজ্যিক তৎপরতা। শুধু বাঁধের কারণে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে আট কোটি মানুষ এখন উদ্বাস্তু।

বিশ্বব্যাপী পানি দূষণের একটি বড় কারণ যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা ও তার ব্যবহার। সমুদ্র, মহাকাশসহ বিভিন্ন স্থানে পারমাণবিক, রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা বা প্রয়োগ করতে গিয়ে কিংবা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বায়ুমন্ডল থেকে ভূগর্ভস্থ পর্যন্ত সবই বিপজ্জনক মাত্রায় দূষণের শিকার হচ্ছে। জাপানের ফুকুশিমায় তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনায়ই বায়ু, পানি, খাদ্য সবকিছুর ওপর যে ভয়াবহ প্রভাবের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাপী এগুলোর সম্ভাব্য বিপদ কল্পনা করাও কঠিন। বিষাক্ত অস্ত্রের সার্বক্ষণিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল কী হচ্ছে, তার বেশির ভাগই আমাদের অজানা। কেননা যারা এসবের জন্য দায়ী, প্রচারযন্ত্রের ওপরও তাদেরই নিয়ন্ত্রণ।

১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকেই উন্নয়নের নামে জগতের বাকি সবকিছু ব্যক্তিমালিকানা, বাণিজ্য আর মুনাফার কর্তৃত্বে আনার উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। খনিজ সম্পদ, সড়ক, রেলপথ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ শুধু নয়; ক্রমে পানিও এ আগ্রাসনের অধীনে যায়। এ কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো পানির বাণিজ্যিকীকরণেও অগ্রণী। ঋণের জালের বিশেষ শর্ত হিসেবে পানি ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে রূপান্তরের চাপ দিনে দিনে বেড়েছে। পানি-বাণিজ্যের উচ্চ মুনাফার সম্ভাবনায় এ খাতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগও তাই ক্রমবর্ধমান। এখন বিশ্বের তিনটি বৃহৎ পানি বহুজাতিক কোম্পানি হলো সুয়েজ, ভিওলিয়া ভিভেন্দি এবং আরডব্লিউই। কোক-পেপসি এবং যারা খাওয়ার পানি দখল করে পানীয়-বাণিজ্য করছে, তারাও এখন পানি-বাণিজ্যে প্রবেশ করেছে। জার্মান কয়লা কোম্পানি আরডব্লিউই, যাদের মুনাফা বাড়াতে পানিসম্পদ বিনষ্ট হয়, তারাও পানি-বাণিজ্য শুরু করেছে।

বেঁচে থাকার জন্য পানি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। শুধু পান করার জন্যই নয়, জগৎ টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্য সব খাদ্য উৎপাদনের জন্যও পানি অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতাই পানির দিকে কোম্পানির মুনাফার আকর্ষণ তৈরি করেছে। আর তাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিপদ বেড়েছে

বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী বলিভিয়া নব্বইয়ের দশকের শেষেই পানি বাণিজ্যিকীকরণ করার নীতি গ্রহণ করে। সেই মোতাবেক মার্কিন কোম্পানি বেখটেল বলিভিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর কোচাবাম্বার সব পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে। এমনকি বৃষ্টির পানিও তাদের কর্তৃত্বাধীন করা হয়। পানির দাম পরিশোধে ব্যর্থ হলে নাগরিকদের ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করারও অধিকার দেয়া হয় এ মার্কিন কোম্পানিকে। বলিভিয়ার গ্যাস নিয়েও এ রকম চুক্তি করা হয়। রাস্তায় প্রতিরোধ তৈরি করা ছাড়া তখন বলিভিয়ার জনগণের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। তারা তা-ই করেছে। ক্রমে পানি ও গ্যাস সম্পদ রক্ষার আন্দোলন বলিভিয়ায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর মধ্য দিয়ে পানির ওপর বলিভিয়ার সব নাগরিকের অধিকার, গ্যাসসম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা এখন স্বীকৃত। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবই বলছে, ১৯৯০-এর দশকে যত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যক্তি মালিকানার বাণিজ্যিক তৎপরতার আওতায় আনা হয়েছিল, তার ৮৪ ভাগ ২০০৭ পর্যন্ত টিকে ছিল, ২৪টি দেশ পানি ব্যবস্থার আবারও রাষ্ট্রীয়করণ করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষার সূত্রে দ্য ওয়াটার বিজনেস গ্রন্থ দেখাচ্ছে যে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পানির ওপর সুয়েজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পরই পানিদূষণ বৃদ্ধি পায়। মরক্কোর মানুষ কাসাব্লাঙ্কায় পানির দাম তিনগুণ বৃদ্ধির মধ্যেই বাণিজ্যিকীকরণের মর্ম বুঝতে পারে। আর্জেন্টিনার পানির কর্তৃত্বও পায় সুয়েজ কোম্পানি।

ফলে পানির দাম দ্বিগুণ হয়, কিন্তু এর গুণগতমানের অবনতি হয়। মানুষের প্রতিবাদে, বিল পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানোয় পরে কোম্পানি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একই কারণে ব্রিটেনেও পানির দাম বেড়ে যায়। পানির বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদে নিউজিল্যান্ডের মানুষকেও রাস্তায় নামতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও পানি বাণিজ্যিকীকরণে সুয়েজ কর্তৃত্ব পায়। কিছুদিনের মধ্যেই পানি এমন বিষাক্ত হয় যে, কলেরা মহামারি আকার নেয়ায় পানি-সংযোগ অনেক দিন বিচ্ছিন্ন থাকে। ইরাক ধ্বংসযজ্ঞের পর বেখটেল ও এসব কোম্পানির জন্য সোনায় সোহাগা হয়। এখন আর বিশুদ্ধ পানি পান ইরাকের মানুষের জন্য সহজ নয়। জীবন, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসা সবই এখন আগ্রাসী দখলদারদের কবলে। ঘানা ও উরুগুয়েও এই পথে গিয়েছিল, পরে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। ২০০৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে এ দুই দেশে পানির ব্যক্তি বাণিজ্যিকীকরণ নিষিদ্ধ হয়। নেদারল্যান্ডসও একই বছর সর্বজনের পানি সরবরাহ ব্যক্তিকরণ নিষিদ্ধ করে আইন পাস করে।

যত দিন যাচ্ছে, তত পানিদূষণ বাড়ছে; বোতল পানির বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। পানি সরবরাহের মূল ব্যবস্থাও নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার আয়োজন চলছে। ভিওলিয়া, সুয়েজসহ দেশি-বিদেশি পানি-বণিকেরা এখন নানাভাবে বাংলাদেশে হাজির হচ্ছে। অন্যদিকে দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিল। বাছবিচারহীন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প ভূগর্ভস্থ ও উপরিস্থ পানির জন্য একের পর এক বিপদ ডেকে আনছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খরা ও বন্যা পানির সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। জরুরিভিত্তিতে পানির সংকট নিরসনে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে নিরাপদ পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে ১৫ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে নারী ও স্কুলগামী মেয়েশিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি বিরূপ। বিশ্বব্যাংক বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় পানি উন্নয়নে অর্থায়নের উৎস হিসেবে তারা উদ্ভাবনী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই পানির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি পানি-সুরতি বিশ্বের জন্য তারা কাজ করছে। কিন্তু পানি নিয়ে ইতোমধ্যেই আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক জায়গায় কোন্দল শুরু হয়েছে। এ সংকট নিরসনে যদি এখনো সঠিক কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে এই কোন্দল পৃথিবীর বাকি অংশেও ছড়াবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিষয়টির ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

বেঁচে থাকার জন্য পানি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। শুধু পান করার জন্যই নয়, জগৎ টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্য সব খাদ্য উৎপাদনের জন্যও পানি অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতাই পানির দিকে কোম্পানির মুনাফার আকর্ষণ তৈরি করেছে। আর তাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিপদ বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- পানি প্রকৃতির অংশ, এটা কেউ তৈরি করেনি। এটি সর্বজনের। প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি সবার জন্মগত অধিকার। মানবসভ্যতা টিকে থাকতে হলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পানি কেন পণ্য?

এম এ কবীর

বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশ্বকে সংঘাত এড়াতে এবং ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পানি সম্পদের পরিবর্তন ও সুরক্ষার জন্য জরুরি আহবান জানিয়েছেন। তিন দিনব্যাপী জাতিসংঘ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, পানি হলো ‘সবার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস’ এবং এটি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এজেন্ডার কেন্দ্রে থাকা প্রয়োজন।

পানির অপর নাম জীবন। শুধু মানুষ নয়, পানি ছাড়া কোনো প্রাণীই বেশিদিন বাঁচতে পারে না। তবে পানি যেমন জীবন বাঁচায়, সেই পানিই হতে পারে বড় বিপদের কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করলে জনগণের বর্তমান অসুখ-বিসুখের শতকরা ৭০ ভাগ কমে যাবে।

নাইজেরীয় এক লোক কবিতায় বলা হয়েছে-

‘রাজা ছাড়া মানুষ বাঁচে/মানুষ ছাড়া রাজ্য বাঁচে না।

প্রাণী ছাড়া ঘাস বাঁচে/ঘাস ছাড়া প্রাণী বাঁচে না।

মানুষ ছাড়া পানি বাঁচে/পানি ছাড়া প্রাণ বাঁচে না।’

বাংলাদেশে যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে বিপুল পানির চাহিদা তৈরির মাধ্যমে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার ভূ-উপরিস্থিত পানি দূষিত করছে। এছাড়া আছে ভবন-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে নদী, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। ইটের ভাটা, শিল্পবর্জ্য তো আছেই। এর পাশাপাশি আছে সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, কোথাও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে, কোথাও সড়ক পরিবহনের সুবিধার জন্য বাছবিচারহীনভাবে বাঁধ-কালভার্ট নির্মাণ। এগুলোর ফলে কোথাও নদীর অবাধ প্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও পানির প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে পানি, মাটি, অতঃপর মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে। শুধু দেশের ভেতর নয়, ভারতে নির্মিত বাঁধ এবং পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাও বাংলাদেশের জন্য হুমকি। ফারাক্কা বাঁধ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন, নদীর প্রবাহ, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র সবকিছুরই অপরিমেয় ক্ষতি করেছে। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলও এখন এর জন্য ক্ষতির শিকার। এর ওপর আবার টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। সম্প্রতি চীনও ব্রহ্মপুত্র নিয়ে যে বাঁধ পরিকল্পনা করছে, তা বাস্তবায়িত হলে ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারা বিশ্বেই বাঁধ একটি বড় বাণিজ্যিক তৎপরতা। শুধু বাঁধের কারণে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে আট কোটি মানুষ এখন উদ্বাস্তু।

বিশ্বব্যাপী পানি দূষণের একটি বড় কারণ যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা ও তার ব্যবহার। সমুদ্র, মহাকাশসহ বিভিন্ন স্থানে পারমাণবিক, রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা বা প্রয়োগ করতে গিয়ে কিংবা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বায়ুমন্ডল থেকে ভূগর্ভস্থ পর্যন্ত সবই বিপজ্জনক মাত্রায় দূষণের শিকার হচ্ছে। জাপানের ফুকুশিমায় তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনায়ই বায়ু, পানি, খাদ্য সবকিছুর ওপর যে ভয়াবহ প্রভাবের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাপী এগুলোর সম্ভাব্য বিপদ কল্পনা করাও কঠিন। বিষাক্ত অস্ত্রের সার্বক্ষণিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল কী হচ্ছে, তার বেশির ভাগই আমাদের অজানা। কেননা যারা এসবের জন্য দায়ী, প্রচারযন্ত্রের ওপরও তাদেরই নিয়ন্ত্রণ।

১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকেই উন্নয়নের নামে জগতের বাকি সবকিছু ব্যক্তিমালিকানা, বাণিজ্য আর মুনাফার কর্তৃত্বে আনার উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। খনিজ সম্পদ, সড়ক, রেলপথ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ শুধু নয়; ক্রমে পানিও এ আগ্রাসনের অধীনে যায়। এ কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো পানির বাণিজ্যিকীকরণেও অগ্রণী। ঋণের জালের বিশেষ শর্ত হিসেবে পানি ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে রূপান্তরের চাপ দিনে দিনে বেড়েছে। পানি-বাণিজ্যের উচ্চ মুনাফার সম্ভাবনায় এ খাতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগও তাই ক্রমবর্ধমান। এখন বিশ্বের তিনটি বৃহৎ পানি বহুজাতিক কোম্পানি হলো সুয়েজ, ভিওলিয়া ভিভেন্দি এবং আরডব্লিউই। কোক-পেপসি এবং যারা খাওয়ার পানি দখল করে পানীয়-বাণিজ্য করছে, তারাও এখন পানি-বাণিজ্যে প্রবেশ করেছে। জার্মান কয়লা কোম্পানি আরডব্লিউই, যাদের মুনাফা বাড়াতে পানিসম্পদ বিনষ্ট হয়, তারাও পানি-বাণিজ্য শুরু করেছে।

বেঁচে থাকার জন্য পানি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। শুধু পান করার জন্যই নয়, জগৎ টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্য সব খাদ্য উৎপাদনের জন্যও পানি অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতাই পানির দিকে কোম্পানির মুনাফার আকর্ষণ তৈরি করেছে। আর তাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিপদ বেড়েছে

বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী বলিভিয়া নব্বইয়ের দশকের শেষেই পানি বাণিজ্যিকীকরণ করার নীতি গ্রহণ করে। সেই মোতাবেক মার্কিন কোম্পানি বেখটেল বলিভিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর কোচাবাম্বার সব পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে। এমনকি বৃষ্টির পানিও তাদের কর্তৃত্বাধীন করা হয়। পানির দাম পরিশোধে ব্যর্থ হলে নাগরিকদের ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করারও অধিকার দেয়া হয় এ মার্কিন কোম্পানিকে। বলিভিয়ার গ্যাস নিয়েও এ রকম চুক্তি করা হয়। রাস্তায় প্রতিরোধ তৈরি করা ছাড়া তখন বলিভিয়ার জনগণের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। তারা তা-ই করেছে। ক্রমে পানি ও গ্যাস সম্পদ রক্ষার আন্দোলন বলিভিয়ায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর মধ্য দিয়ে পানির ওপর বলিভিয়ার সব নাগরিকের অধিকার, গ্যাসসম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা এখন স্বীকৃত। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবই বলছে, ১৯৯০-এর দশকে যত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যক্তি মালিকানার বাণিজ্যিক তৎপরতার আওতায় আনা হয়েছিল, তার ৮৪ ভাগ ২০০৭ পর্যন্ত টিকে ছিল, ২৪টি দেশ পানি ব্যবস্থার আবারও রাষ্ট্রীয়করণ করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষার সূত্রে দ্য ওয়াটার বিজনেস গ্রন্থ দেখাচ্ছে যে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পানির ওপর সুয়েজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পরই পানিদূষণ বৃদ্ধি পায়। মরক্কোর মানুষ কাসাব্লাঙ্কায় পানির দাম তিনগুণ বৃদ্ধির মধ্যেই বাণিজ্যিকীকরণের মর্ম বুঝতে পারে। আর্জেন্টিনার পানির কর্তৃত্বও পায় সুয়েজ কোম্পানি।

ফলে পানির দাম দ্বিগুণ হয়, কিন্তু এর গুণগতমানের অবনতি হয়। মানুষের প্রতিবাদে, বিল পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানোয় পরে কোম্পানি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একই কারণে ব্রিটেনেও পানির দাম বেড়ে যায়। পানির বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদে নিউজিল্যান্ডের মানুষকেও রাস্তায় নামতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও পানি বাণিজ্যিকীকরণে সুয়েজ কর্তৃত্ব পায়। কিছুদিনের মধ্যেই পানি এমন বিষাক্ত হয় যে, কলেরা মহামারি আকার নেয়ায় পানি-সংযোগ অনেক দিন বিচ্ছিন্ন থাকে। ইরাক ধ্বংসযজ্ঞের পর বেখটেল ও এসব কোম্পানির জন্য সোনায় সোহাগা হয়। এখন আর বিশুদ্ধ পানি পান ইরাকের মানুষের জন্য সহজ নয়। জীবন, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসা সবই এখন আগ্রাসী দখলদারদের কবলে। ঘানা ও উরুগুয়েও এই পথে গিয়েছিল, পরে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। ২০০৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে এ দুই দেশে পানির ব্যক্তি বাণিজ্যিকীকরণ নিষিদ্ধ হয়। নেদারল্যান্ডসও একই বছর সর্বজনের পানি সরবরাহ ব্যক্তিকরণ নিষিদ্ধ করে আইন পাস করে।

যত দিন যাচ্ছে, তত পানিদূষণ বাড়ছে; বোতল পানির বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। পানি সরবরাহের মূল ব্যবস্থাও নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার আয়োজন চলছে। ভিওলিয়া, সুয়েজসহ দেশি-বিদেশি পানি-বণিকেরা এখন নানাভাবে বাংলাদেশে হাজির হচ্ছে। অন্যদিকে দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিল। বাছবিচারহীন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প ভূগর্ভস্থ ও উপরিস্থ পানির জন্য একের পর এক বিপদ ডেকে আনছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খরা ও বন্যা পানির সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। জরুরিভিত্তিতে পানির সংকট নিরসনে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে নিরাপদ পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে ১৫ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে নারী ও স্কুলগামী মেয়েশিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি বিরূপ। বিশ্বব্যাংক বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় পানি উন্নয়নে অর্থায়নের উৎস হিসেবে তারা উদ্ভাবনী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই পানির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি পানি-সুরতি বিশ্বের জন্য তারা কাজ করছে। কিন্তু পানি নিয়ে ইতোমধ্যেই আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক জায়গায় কোন্দল শুরু হয়েছে। এ সংকট নিরসনে যদি এখনো সঠিক কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে এই কোন্দল পৃথিবীর বাকি অংশেও ছড়াবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিষয়টির ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

বেঁচে থাকার জন্য পানি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। শুধু পান করার জন্যই নয়, জগৎ টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্য সব খাদ্য উৎপাদনের জন্যও পানি অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতাই পানির দিকে কোম্পানির মুনাফার আকর্ষণ তৈরি করেছে। আর তাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিপদ বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- পানি প্রকৃতির অংশ, এটা কেউ তৈরি করেনি। এটি সর্বজনের। প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি সবার জন্মগত অধিকার। মানবসভ্যতা টিকে থাকতে হলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top