alt

উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইন জুয়াকে শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব

এম এম তানজিমুল হক

: রোববার, ০৯ এপ্রিল ২০২৩

অনলাইন জুয়া শহরাঞ্চল থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলে বিস্মৃত একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশি ও বিদেশি ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একাধিক সিন্ডিকেট দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সময়ের জন্য ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল, এটি বোধগম্য যে এ দেশের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ব্রিটিশ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যার মধ্যে তাদের জুয়া খেলার উপায়ও রয়েছে।

ল ইনসাইডারের তথ্যমতে, ইন্টারনেটকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা জেনেশুনে কোনো বাজি ব্যবসায় জড়িত থাকে, তখন এটি অনলাইন জুয়া হিসেবে বিবেচিত হবে। অনলাইন জুয়া আইনের নিয়ম দেশভেদে পরিবর্তিত হয় এবং সেগুলো কিছুক্ষেত্রে অস্পষ্ট থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনলাইন জুয়াবিষয়ক এমন কোনো আইন এখনো হয়নি।

যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা মুসলিম, সেহেতু ঘোড়দৌড় ব্যতীত সব প্রকার জুয়া খেলা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। এসব আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো জুয়া খেলা চলছে। বাংলাদেশে জুয়া খেলার কোনো অবকাঠামোগত অস্তিত্ব নেই এবং বাংলাদেশে আইনত অনুমোদিত কোনো ক্যাসিনো নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম, খেলাধুলা, ক্লাব, ক্যাফে, রেস্তোরাঁয় জুয়া খেলার ব্যবস্থা বিদ্যমান।

জুয়াসংক্রান্ত আইন

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিচারিকভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়। এই অনুচ্ছেদটি শুধু রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয় এবং দেশে জুয়া খেলাকে নিরুৎসাহিত করে।

বাংলাদেশে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ প্রচলিত রয়েছে। আইনটিতে ধারা ১ক সন্নিবেশ করার মাধ্যমে ১৯৭২ সালে অন্য অনেক আইনের মতো ১৮৬৭ সালের আইনটি গ্রহণের সময় ঘোড়দৌড়ের ওপর বাজি ধরাকে বৈধতা দেয়া হয়। এজন্য ১৯২২ সালের বিনোদন ট্যাক্স আইনে বেটিং ট্যাক্স এখনো বহাল আছে।

১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের দুইবার সংশোধন করার মাধ্যমে দেশের সব মহানগর এলাকা প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর আওতামুক্ত করা হয়। এর ফলে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর ধারা ১ অনুয়ায়ী দেশের মহানগরীগুলোতে জুয়া খেলার পথ খুলে যায়।

প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ এ ‘কমন গেমিং হাউজ’ সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ধারা ৩ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাস কারাদন্ড অথবা ২০০ টাকা অর্থদন্ড এবং ৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদন্ড। আবার, ধারা ১১ অনুসারে রাস্তায় পাখি বা প্রাণী দিয়ে জুয়া খেলার সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ডসহ ৫০ টাকা অর্থদন্ড করার বিধান রয়েছে।

১৯১৩ সালে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর ধারা ১১ক সন্নিবেশিত করা হয়। ধারাটিতে বলা রয়েছে যে, যে সবাই খেলায় দক্ষতা প্রয়োজন, সেখানে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।

আমাদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে জুয়াকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বৈধতা দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সীমিতভাবে জুয়া বৈধ। ২০১৬ সালে জুয়া থেকে মালয়েশিয়ার রাজস্ব আয় হয় ১৮০৫.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালে ভারতের ল কমিশনকে বেটিং আইনের আওতায় আনা যায় কিনা, খতিয়ে দেখতে নির্দেশনা দেন। বিচারপতি বি এস চৌহানের নেতৃত্বাধীন কমিশন লাইসেন্সিংসহ ২১টি শর্তে জুয়া ও ক্যাসিনোকে বৈধতা দিতে রাজ্যগুলোর জন্য একটি উপযুক্ত মডেল আইন তৈরির সপক্ষে মত দেয়।

২০১৩ সালে নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ক্লাবে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট নামে জুয়া খেলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বাধীন একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৪ সালের ১৮ জুন ওই চ্যালেঞ্জের রায় প্রকাশ করেন। রায়ে বলা হয়, অর্থ দিয়ে সব খেলাই অবৈধ। সেই অর্থে জুয়া ও গেমস সমার্থক। সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, হাইকোর্টের এই নির্দেশনাই বর্তমানের প্রচলিত আইন।

আইনের অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতা

ক্যাসিনো ও জুয়াসংক্রান্ত দেশের প্রচলিত আইনগুলোর বেশির ভাগই অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬৭ সালে প্রকাশ্য জুয়া আইন প্রণয়ন করা হলেও ইতিহাসের কোনো সময়ই এই আইনটি সমগ্র ভারতের জন্য কার্যকরী ছিল না। এই আইনটি সব সময় নির্দিষ্ট কিছু রাজ্যের জন্য কার্যকর ছিল। আইনটির নামে জুয়া উল্লেখ থাকলেও আইনের কোথাও জুয়ার সংজ্ঞা দেয়া নেই। আইনটির ধারা ১ক অনুসারে লটারি বৈধ। কিন্তু লটারির কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি।

আইনটিতে অনলাইন জুয়া সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জুয়া খেলার ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। তাই অনলাইনে জুয়া খেলার বিভিন্ন মাধ্যম আইনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।

বাংলাদেশে এখনো কোনো স্থানীয় মোবাইল বা অনলাইনভিত্তিক ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বিদেশি বিভিন্ন জুয়া খেলার ওয়েবসাইট এবং মোবাইল ক্যাসিনো গেম ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশি জুয়াড়িদের মধ্যে মোবাইল স্লট, মোবাইল পোকার, মোবাইল রুলেট এবং মোবাইল ব্ল্যাকজ্যাক মোবাইল ক্যাসিনো গেমগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়া বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো, অনলাইন স্পোর্টস বেটিং, অনলাইন লটারি প্রচলিত রয়েছে। এগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে অনলাইন মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য ফিয়াট কারেন্সি বেশ জনপ্রিয়। অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রেও ফিয়াট কারেন্সি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের জুয়াড়িরা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে থাকে।

এসব অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কর দেয়ার কোনো বিধান নেই। তাই এই জুয়া থেকে যে পরিমাণ অর্থই একজন জিতুক না কেন, সে সরকারকে কোনো ধরনের কর না দিয়েই সেগুলো তুলে নিতে পারবে। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থের এই ব্যাপক এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশ ক্যাসিনোর মতো বিষয়ে যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ আইন করেছে। বাংলাদেশের জুয়াসম্পর্কিত বিধানগুলো যুগোপযোগী নয়। পাশাপাশি আধুনিক যুগের বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার মাধ্যমগুলো এসব বিধানের আওতাভুক্ত নয়

মহানগরে জুয়া বৈধ করার যৌক্তিকতা

১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ সংশোধনের মাধ্যমে সব মহানগরকে এ আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। যার দরুণ দেশের মহানগরীগুলোতে জুয়া খেলার পথ খুলে যায়।

সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমি তখন (১৯৭৬) সরকারে ছিলাম না। তবে মনে হচ্ছে, মহানগর এলাকায় পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে কিছু হোটেলে জুয়া ও পানীয়ের সুবিধা বজায় রাখতে ওই সংশোধনী আনা দরকার মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ওই সংশোধনী সত্ত্বেও মহানগর এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ক্লাব বা ক্যাসিনো বসানোর সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’

এ বিষয়ে বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আইনের প্রশ্নের চেয়েও বড় হলো, ইনডোর গেমসের নামে আন্ডার ওয়ার্ল্ড তৈরি হচ্ছে। এটা আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার জন্য ভয়ংকর। আজ যা চলছে, সেটা ১৯৭৬ সালে কল্পনা করা যায়নি।’

অনলাইন জুয়ার বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের সঙ্গে বেট উইনার নামের একটি অনলাইন স্পোর্টস বেটিং নিউজ সাইটের চুক্তি হয়। সাকিব আল হাসান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে বেট উইনার নিউজের প্রচারণাও করেন। এজন্য সাকিব আল হাসান অনেক সমালোচনার শিকার হন। চুক্তি বাতিল না করলে সাকিবের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই সম্পর্ক থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। এরপর বেট উইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন সাকিব আল হাসান।

আবার, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের বেসরকারি টিভি চ্যানেল টি-স্পোর্টসে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন দুজন আইনজীবী। নোটিশে বলা হয়, বিগত ২০ নভেম্বর ২০২২ ইং তারিখে কাতারে শুরু হওয়া ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথমদিন থেকেই টিভি চ্যানেল টি-স্পোর্টস Fastest 4G Banglalink Presents LIVE THE GAME Powered By 1XBAT Sporting Lines নামক অনুষ্ঠানে এবং বিজ্ঞাপন আকারে বিভিন্ন সময়ে জুয়ার সাইট 1XBATSPORTING.COM-এর বিজ্ঞাপন ও লোগো প্রচার করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ এবং খেলোয়াড়রা ব্যাপকভাবে জুয়া খেলার প্রতি প্রভাবিত হতে পারে। নোটিশে আরো উল্লেখ করা হয় যে, এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের ফলে প্রচলিত আইন ভঙ্গের পাশাপাশি বিদেশে অর্থপাচারসহ নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তদারক ও নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য কয়েকটি অন্তর্বর্তী নির্দেশনা ও রুল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এর ফলে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ ও তা অপসারণে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর বেঞ্চ।

সম্প্রতি, ওয়েব সিরিজ ও ইউটিউব ভিডিওতে অবৈধ অনলাইনভিত্তিক জুয়ার সাইটের প্রচারণার অভিযোগে প্রত্যয় হিরন, রায়হান ও হামিদ নামের তিন ইউটিউবারকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অপরাধ ইউনিটের উপকমিশনার তারেক বিন রশিদ বলেন, ‘প্রত্যয় হিরনের ‘আজাইরা লিমিটেড’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ‘বদমাইশ পোলাপাইন’ নামে ওয়েব সিরিজের চতুর্থ মৌসুমের সব পর্বে অবৈধ জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন।’ ওয়ানএক্সবেট, ক্রিকেক্সসহ অবৈধ কয়েকটি জুয়ার সাইটের প্রচার করার জন্য তারা প্রতি পর্বে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পেতেন। এমন অনেক ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে বেটিং সাইটের প্রচারণা করা হয়ে থাকে।

জুয়া আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশ ক্যাসিনোর মতো বিষয়ে যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ আইন করেছে। বাংলাদেশের জুয়া সম্পর্কিত বিধানগুলো যুগোপযোগী নয়। পাশাপাশি আধুনিক যুগের বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার মাধ্যমগুলো এসব বিধানের আওতাভুক্ত নয়। ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইন ব্রিটিশরা করেছিল তাদের উপনিবেশগুলোর জন্য। তারা এই আইন বহুকাল আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছে। ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইন যুগোপযোগী করা হবে কিনা, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এ নিয়ে আমরা চিন্তা ভাবনা করছি।’

সম্প্রতি নরসিংদী জেলা প্রশাসক ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সম্পর্কিত বিষয়াবলিতে বিদ্যমান প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর কিছু বিধান যুগোপযোগী ও স্পষ্টকরণের মাধ্যমে অনলাইন প্ল্যাটফরম ও ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার জুয়া খেলা শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব করেন। ওই প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয় ১৮৬৭ সালের আইনে অনলাইন প্ল্যাটফরম ও ডিভাইসের মাধ্যমে জুয়া খেলা সম্পর্কিত কোনো বিধান না থাকার ফলে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।

এছাড়া আইনের ৩ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাস কারাদন্ড অথবা ২০০ টাকা অর্থদন্ড, ৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদন্ড এবং ১১ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ডসহ ৫০ টাকা অর্থদন্ড করার বিধান রয়েছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জুয়াড়িরা জুয়া থেকে যে লাভ করে তা শাস্তির সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। যখন জুয়াড়িরা জুয়া খেলে লাখ লাখ টাকা জিততে পারে, তখন তাদের কাছে ১০০-২০০ টাকা জরিমানা দেয়া খুব একটা বড় কথা না।

উপরন্তু, এই আইনে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ফলস্বরূপ, গেমিং হাউজ হিসেবে অনলাইন জুয়া খেলার সাইটগুলোর সংজ্ঞা অনির্ধারিত রয়ে গেছে। যেহেতু প্রায় সব অনলাইন জুয়া সাইট বিদেশিভিত্তিক, সেগুলো বাংলাদেশি আইনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। ফলস্বরূপ, অনলাইন জুয়াড়িরা সহজেই শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে এবং শাস্তি খুব কম হওয়ায় তারা শাস্তিকে ভয় পায় না।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নরসিংদী জেলা প্রশাসকের প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুপারিশে বলা হয়, আইনের ৩ ধারা সংশোধন করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমকে জুয়ার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। আইনের বিভিন্ন ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদন্ডসহ ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদানের বিধান করা যেতে পারে।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক আর আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জুয়ার বিলোপ অবাস্তব, এটা সমাধান দেবে না। অপ্রিয় বাস্তবতা মেনেই রাষ্ট্র যৌনপল্লীকে আইনের আওতায় এনেছে। এখানেও লাইসেন্সিং, করারোপ ইত্যাদির মাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।’

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের প্রসার জুয়া খেলার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। জুয়া খেলা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশে সঠিক আইনগত নীতি এবং এসব নীতি বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা প্রয়োজন। এজন্য জুয়া নিয়ন্ত্রণের একটি পৃথক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের প্রবর্তন করা যেতে পারে।

সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

[লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইন জুয়াকে শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব

এম এম তানজিমুল হক

রোববার, ০৯ এপ্রিল ২০২৩

অনলাইন জুয়া শহরাঞ্চল থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলে বিস্মৃত একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশি ও বিদেশি ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একাধিক সিন্ডিকেট দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সময়ের জন্য ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল, এটি বোধগম্য যে এ দেশের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ব্রিটিশ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যার মধ্যে তাদের জুয়া খেলার উপায়ও রয়েছে।

ল ইনসাইডারের তথ্যমতে, ইন্টারনেটকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা জেনেশুনে কোনো বাজি ব্যবসায় জড়িত থাকে, তখন এটি অনলাইন জুয়া হিসেবে বিবেচিত হবে। অনলাইন জুয়া আইনের নিয়ম দেশভেদে পরিবর্তিত হয় এবং সেগুলো কিছুক্ষেত্রে অস্পষ্ট থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনলাইন জুয়াবিষয়ক এমন কোনো আইন এখনো হয়নি।

যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা মুসলিম, সেহেতু ঘোড়দৌড় ব্যতীত সব প্রকার জুয়া খেলা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। এসব আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো জুয়া খেলা চলছে। বাংলাদেশে জুয়া খেলার কোনো অবকাঠামোগত অস্তিত্ব নেই এবং বাংলাদেশে আইনত অনুমোদিত কোনো ক্যাসিনো নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম, খেলাধুলা, ক্লাব, ক্যাফে, রেস্তোরাঁয় জুয়া খেলার ব্যবস্থা বিদ্যমান।

জুয়াসংক্রান্ত আইন

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিচারিকভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়। এই অনুচ্ছেদটি শুধু রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয় এবং দেশে জুয়া খেলাকে নিরুৎসাহিত করে।

বাংলাদেশে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ প্রচলিত রয়েছে। আইনটিতে ধারা ১ক সন্নিবেশ করার মাধ্যমে ১৯৭২ সালে অন্য অনেক আইনের মতো ১৮৬৭ সালের আইনটি গ্রহণের সময় ঘোড়দৌড়ের ওপর বাজি ধরাকে বৈধতা দেয়া হয়। এজন্য ১৯২২ সালের বিনোদন ট্যাক্স আইনে বেটিং ট্যাক্স এখনো বহাল আছে।

১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের দুইবার সংশোধন করার মাধ্যমে দেশের সব মহানগর এলাকা প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর আওতামুক্ত করা হয়। এর ফলে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর ধারা ১ অনুয়ায়ী দেশের মহানগরীগুলোতে জুয়া খেলার পথ খুলে যায়।

প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ এ ‘কমন গেমিং হাউজ’ সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ধারা ৩ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাস কারাদন্ড অথবা ২০০ টাকা অর্থদন্ড এবং ৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদন্ড। আবার, ধারা ১১ অনুসারে রাস্তায় পাখি বা প্রাণী দিয়ে জুয়া খেলার সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ডসহ ৫০ টাকা অর্থদন্ড করার বিধান রয়েছে।

১৯১৩ সালে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর ধারা ১১ক সন্নিবেশিত করা হয়। ধারাটিতে বলা রয়েছে যে, যে সবাই খেলায় দক্ষতা প্রয়োজন, সেখানে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।

আমাদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে জুয়াকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বৈধতা দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সীমিতভাবে জুয়া বৈধ। ২০১৬ সালে জুয়া থেকে মালয়েশিয়ার রাজস্ব আয় হয় ১৮০৫.২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালে ভারতের ল কমিশনকে বেটিং আইনের আওতায় আনা যায় কিনা, খতিয়ে দেখতে নির্দেশনা দেন। বিচারপতি বি এস চৌহানের নেতৃত্বাধীন কমিশন লাইসেন্সিংসহ ২১টি শর্তে জুয়া ও ক্যাসিনোকে বৈধতা দিতে রাজ্যগুলোর জন্য একটি উপযুক্ত মডেল আইন তৈরির সপক্ষে মত দেয়।

২০১৩ সালে নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ক্লাবে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট নামে জুয়া খেলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বাধীন একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৪ সালের ১৮ জুন ওই চ্যালেঞ্জের রায় প্রকাশ করেন। রায়ে বলা হয়, অর্থ দিয়ে সব খেলাই অবৈধ। সেই অর্থে জুয়া ও গেমস সমার্থক। সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, হাইকোর্টের এই নির্দেশনাই বর্তমানের প্রচলিত আইন।

আইনের অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতা

ক্যাসিনো ও জুয়াসংক্রান্ত দেশের প্রচলিত আইনগুলোর বেশির ভাগই অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬৭ সালে প্রকাশ্য জুয়া আইন প্রণয়ন করা হলেও ইতিহাসের কোনো সময়ই এই আইনটি সমগ্র ভারতের জন্য কার্যকরী ছিল না। এই আইনটি সব সময় নির্দিষ্ট কিছু রাজ্যের জন্য কার্যকর ছিল। আইনটির নামে জুয়া উল্লেখ থাকলেও আইনের কোথাও জুয়ার সংজ্ঞা দেয়া নেই। আইনটির ধারা ১ক অনুসারে লটারি বৈধ। কিন্তু লটারির কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি।

আইনটিতে অনলাইন জুয়া সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জুয়া খেলার ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। তাই অনলাইনে জুয়া খেলার বিভিন্ন মাধ্যম আইনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।

বাংলাদেশে এখনো কোনো স্থানীয় মোবাইল বা অনলাইনভিত্তিক ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বিদেশি বিভিন্ন জুয়া খেলার ওয়েবসাইট এবং মোবাইল ক্যাসিনো গেম ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশি জুয়াড়িদের মধ্যে মোবাইল স্লট, মোবাইল পোকার, মোবাইল রুলেট এবং মোবাইল ব্ল্যাকজ্যাক মোবাইল ক্যাসিনো গেমগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়া বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো, অনলাইন স্পোর্টস বেটিং, অনলাইন লটারি প্রচলিত রয়েছে। এগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে অনলাইন মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য ফিয়াট কারেন্সি বেশ জনপ্রিয়। অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রেও ফিয়াট কারেন্সি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের জুয়াড়িরা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে থাকে।

এসব অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কর দেয়ার কোনো বিধান নেই। তাই এই জুয়া থেকে যে পরিমাণ অর্থই একজন জিতুক না কেন, সে সরকারকে কোনো ধরনের কর না দিয়েই সেগুলো তুলে নিতে পারবে। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থের এই ব্যাপক এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশ ক্যাসিনোর মতো বিষয়ে যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ আইন করেছে। বাংলাদেশের জুয়াসম্পর্কিত বিধানগুলো যুগোপযোগী নয়। পাশাপাশি আধুনিক যুগের বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার মাধ্যমগুলো এসব বিধানের আওতাভুক্ত নয়

মহানগরে জুয়া বৈধ করার যৌক্তিকতা

১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ সংশোধনের মাধ্যমে সব মহানগরকে এ আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। যার দরুণ দেশের মহানগরীগুলোতে জুয়া খেলার পথ খুলে যায়।

সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমি তখন (১৯৭৬) সরকারে ছিলাম না। তবে মনে হচ্ছে, মহানগর এলাকায় পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে কিছু হোটেলে জুয়া ও পানীয়ের সুবিধা বজায় রাখতে ওই সংশোধনী আনা দরকার মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ওই সংশোধনী সত্ত্বেও মহানগর এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ক্লাব বা ক্যাসিনো বসানোর সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’

এ বিষয়ে বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আইনের প্রশ্নের চেয়েও বড় হলো, ইনডোর গেমসের নামে আন্ডার ওয়ার্ল্ড তৈরি হচ্ছে। এটা আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার জন্য ভয়ংকর। আজ যা চলছে, সেটা ১৯৭৬ সালে কল্পনা করা যায়নি।’

অনলাইন জুয়ার বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের সঙ্গে বেট উইনার নামের একটি অনলাইন স্পোর্টস বেটিং নিউজ সাইটের চুক্তি হয়। সাকিব আল হাসান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে বেট উইনার নিউজের প্রচারণাও করেন। এজন্য সাকিব আল হাসান অনেক সমালোচনার শিকার হন। চুক্তি বাতিল না করলে সাকিবের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই সম্পর্ক থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। এরপর বেট উইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন সাকিব আল হাসান।

আবার, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের বেসরকারি টিভি চ্যানেল টি-স্পোর্টসে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন দুজন আইনজীবী। নোটিশে বলা হয়, বিগত ২০ নভেম্বর ২০২২ ইং তারিখে কাতারে শুরু হওয়া ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথমদিন থেকেই টিভি চ্যানেল টি-স্পোর্টস Fastest 4G Banglalink Presents LIVE THE GAME Powered By 1XBAT Sporting Lines নামক অনুষ্ঠানে এবং বিজ্ঞাপন আকারে বিভিন্ন সময়ে জুয়ার সাইট 1XBATSPORTING.COM-এর বিজ্ঞাপন ও লোগো প্রচার করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ এবং খেলোয়াড়রা ব্যাপকভাবে জুয়া খেলার প্রতি প্রভাবিত হতে পারে। নোটিশে আরো উল্লেখ করা হয় যে, এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের ফলে প্রচলিত আইন ভঙ্গের পাশাপাশি বিদেশে অর্থপাচারসহ নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

এসব ঘটনার ক্ষেত্রে তদারক ও নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য কয়েকটি অন্তর্বর্তী নির্দেশনা ও রুল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এর ফলে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ ও তা অপসারণে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর বেঞ্চ।

সম্প্রতি, ওয়েব সিরিজ ও ইউটিউব ভিডিওতে অবৈধ অনলাইনভিত্তিক জুয়ার সাইটের প্রচারণার অভিযোগে প্রত্যয় হিরন, রায়হান ও হামিদ নামের তিন ইউটিউবারকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অপরাধ ইউনিটের উপকমিশনার তারেক বিন রশিদ বলেন, ‘প্রত্যয় হিরনের ‘আজাইরা লিমিটেড’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ‘বদমাইশ পোলাপাইন’ নামে ওয়েব সিরিজের চতুর্থ মৌসুমের সব পর্বে অবৈধ জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন।’ ওয়ানএক্সবেট, ক্রিকেক্সসহ অবৈধ কয়েকটি জুয়ার সাইটের প্রচার করার জন্য তারা প্রতি পর্বে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পেতেন। এমন অনেক ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে বেটিং সাইটের প্রচারণা করা হয়ে থাকে।

জুয়া আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশ ক্যাসিনোর মতো বিষয়ে যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ আইন করেছে। বাংলাদেশের জুয়া সম্পর্কিত বিধানগুলো যুগোপযোগী নয়। পাশাপাশি আধুনিক যুগের বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার মাধ্যমগুলো এসব বিধানের আওতাভুক্ত নয়। ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইন ব্রিটিশরা করেছিল তাদের উপনিবেশগুলোর জন্য। তারা এই আইন বহুকাল আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছে। ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইন যুগোপযোগী করা হবে কিনা, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এ নিয়ে আমরা চিন্তা ভাবনা করছি।’

সম্প্রতি নরসিংদী জেলা প্রশাসক ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সম্পর্কিত বিষয়াবলিতে বিদ্যমান প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর কিছু বিধান যুগোপযোগী ও স্পষ্টকরণের মাধ্যমে অনলাইন প্ল্যাটফরম ও ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার জুয়া খেলা শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব করেন। ওই প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয় ১৮৬৭ সালের আইনে অনলাইন প্ল্যাটফরম ও ডিভাইসের মাধ্যমে জুয়া খেলা সম্পর্কিত কোনো বিধান না থাকার ফলে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।

এছাড়া আইনের ৩ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাস কারাদন্ড অথবা ২০০ টাকা অর্থদন্ড, ৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদন্ড এবং ১১ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদন্ডসহ ৫০ টাকা অর্থদন্ড করার বিধান রয়েছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জুয়াড়িরা জুয়া থেকে যে লাভ করে তা শাস্তির সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। যখন জুয়াড়িরা জুয়া খেলে লাখ লাখ টাকা জিততে পারে, তখন তাদের কাছে ১০০-২০০ টাকা জরিমানা দেয়া খুব একটা বড় কথা না।

উপরন্তু, এই আইনে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ফলস্বরূপ, গেমিং হাউজ হিসেবে অনলাইন জুয়া খেলার সাইটগুলোর সংজ্ঞা অনির্ধারিত রয়ে গেছে। যেহেতু প্রায় সব অনলাইন জুয়া সাইট বিদেশিভিত্তিক, সেগুলো বাংলাদেশি আইনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। ফলস্বরূপ, অনলাইন জুয়াড়িরা সহজেই শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে এবং শাস্তি খুব কম হওয়ায় তারা শাস্তিকে ভয় পায় না।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নরসিংদী জেলা প্রশাসকের প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুপারিশে বলা হয়, আইনের ৩ ধারা সংশোধন করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমকে জুয়ার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। আইনের বিভিন্ন ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদন্ডসহ ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদানের বিধান করা যেতে পারে।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক আর আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জুয়ার বিলোপ অবাস্তব, এটা সমাধান দেবে না। অপ্রিয় বাস্তবতা মেনেই রাষ্ট্র যৌনপল্লীকে আইনের আওতায় এনেছে। এখানেও লাইসেন্সিং, করারোপ ইত্যাদির মাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।’

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের প্রসার জুয়া খেলার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। জুয়া খেলা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশে সঠিক আইনগত নীতি এবং এসব নীতি বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা প্রয়োজন। এজন্য জুয়া নিয়ন্ত্রণের একটি পৃথক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের প্রবর্তন করা যেতে পারে।

সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

[লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী]

back to top