মতিউর রহমান
আহমদুল কবির (১৯২৩-২০০৩)
‘দৈনিক সংবাদের’ কথা মনে হলেই আমাদের সেই শৈশব, কৈশোর ও যুবা বয়সের সময়গুলোর কথা মনে পড়ে যায়। একই সঙ্গে শৈশব থেকে যৌবনকালে আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তায় ও পরিবর্তনে বড়ো জগতের সন্ধান পেতে ‘দৈনিক সংবাদের’ ভূমিকা অনেক। আমাদের জীবনে যতটুকু সাফল্য তার সাথেও রয়েছে ‘দৈনিক সংবাদের’ গভীর সম্পর্ক। আরও বলা যায়, ‘দৈনিক সংবাদ’ চার দশক ধরে (’৫০-’৯০) এবং তারপরেও নানাভাবে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বিশেষ করে ষাটের দশক থেকেই ‘দৈনিক সংবাদের’ আহমদুল কবির, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, আলী আকসাদ ও বজলুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে নানাভাবে পরিচিত হয়েছি, তাদের সহযোগিতা পেয়েছি অনেক। সেই দিনগুলোর কথা সবসময় মনে পড়ে।
সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনবোধ তৈরি ও নানা জিজ্ঞাসার জবাব পেতে ‘দৈনিক সংবাদের’ ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ষাটের দশকের সংবাদে সাহিত্য সাময়িকীতে আমার কবিতা ও গদ্য ছাপা হয়েছে। আশির দশকে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি প্রায় চার বছর নিয়মিত কলাম লিখেছি প্রতি সোমবার। প্রায় একই সময়ে ‘দৈনিক সংবাদের’ প্রথম পৃষ্ঠায় আমার বেশ কিছু রিপোর্ট ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে।
এভাবেই ৪০/৫০ বছর ধরে ‘দৈনিক সংবাদের’ সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। সেজন্য ‘দৈনিক সংবাদের’ ৭৫তম বার্ষিকীতে এ কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায়, ‘দৈনিক সংবাদ’ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। এখন সে দিনগুলোর কথা মনে হলেই নতুন সাহস, নতুন প্রত্যয় জেগে ওঠে মনের গভীরে।
‘দৈনিক সংবাদের’ ৭৫তম বার্ষিকীতে দৈনিক সংবাদের প্রতি শুভেচ্ছা। একই সাথে ‘দৈনিক সংবাদের’ প্রতি কৃতজ্ঞতা। ‘দৈনিক সংবাদের’ আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্মরণ করে সম্পাদক আহমদুল কবিরকে স্মরণ করি। তাঁর মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমি একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলাম। সেটা পরে আমার বই ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা: কবিতা-গান-শিল্পের ঝরনাধারা’য় এটা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখাটিতে ‘দৈনিক সংবাদ’ নিয়ে আমার অনেক কথা, অনেক স্মৃতি রয়েছে।
স্মৃতিতে আহমদুল কবির
প্রগতির পতাকাবাহী একজন : আমরা তখন খুব ছোট। আমাদের বাসা ছিল ২৪০ নম্বর বংশালে। বাসা থেকে বের হলেই ‘দৈনিক সংবাদ’ অফিস। সংবাদ অফিস সেই ১৯৫০ সাল থেকে দীর্ঘদিন, প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই ছিল ২৬৩ নম্বর বংশালে। অফিসের গেটের পাশের দেয়ালে সাঁটানো থাকত আট পৃষ্ঠার ‘সংবাদ’।
আমরা বংশালের বাসা ছেড়ে চলে যাই ১৯৭৪ সালে। আশির দশকের শুরুতে আবার আমাদের ওই বাসাতেই সাপ্তাহিক ‘একতা’র অফিস করি। সেই অফিস চলে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত- এভাবেই চল্লিশ বছর ধরে আমাদের যাওয়া-আসা ছিল ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সামনে দিয়ে। আমি ১৯৫৩ সালে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই তৃতীয় শ্রেণিতে। সেই বয়স থেকে দেয়ালে সাঁটানো সংবাদ দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। খুব সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেয়ালে সাঁটানো সংবাদ কাগজ পড়তে চলে যেতাম। সেই দিনগুলোতে শুধু খেলার খবর পড়তাম। পেছনের পৃষ্ঠার বাঁ দিকে থাকত খেলার খবর। খেলার খবর পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে দেশের অন্যান্য খবর, সমাজ ও রাজনীতির খবর পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি, পড়তে শুরু করি। ধীরে ধীরে নতুন এক জগত, নতুন চিন্তায় প্রভাবিত হতে থাকি। পরে জেনেছিলাম, ১৯৫৪ সালে সংবাদ-এ আহমদুল কবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জহুর হোসেন চৌধুরী সম্পাদক হন।
মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালের নভেম্বর কি ডিসেম্বরে, তৎকালীন তরুণ বামপন্থী নেতা আনোয়ার জাহিদকে খুঁজতে সংবাদ অফিসে প্রথম যাই। এর আগেই তৎকালীন বামপন্থী যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ইমাদুল্লাহ স্মৃতি পাঠাগারের সদস্য হয়েছিলাম। সেই বছরের অক্টোবরে পাকিস্তানজুড়ে সামরিক শাসন জারি হলে ওই পাঠাগারটিও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমার কাছে পাঠাগারের ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইটি ছিল, একদিন সেটা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম সংবাদ অফিস দর্শন। সেই সংবাদ অফিসের একতলায় সাব এডিটর-রিপোর্টারদের ঘর, ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যাওয়া, সেখানে সম্পাদকীয় বিভাগের অফিস এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
সেই সময়ই দেশ সম্পর্কে, রাজনীতি নিয়ে আমাদের ভাবনা শুরু। ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর ঢাকা কলেজ থেকেই ছাত্ররাজনীতিতে আমাদের হাতেখড়ি। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তুমুল এক অভিঘাত চলছিল সারা দেশে। সারা দেশ, আমরা সবাই, নতুন এক চেতনায় জেগে উঠেছিলাম। সংবাদ-এ প্রতিদিন সেই উত্তাল দিনগুলোর খবর, ছবি সবই ছিল আমাদের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণার। এভাবেই সংবাদ হয়ে উঠেছিল আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী।
সেই বাষট্টির আন্দোলনের কিছু সময় পর থেকে রাজবন্দীরা জেল থেকে ছাড়া পেতে শুরু করেন। শহীদ ভাই, শহীদুল্লা কায়সার; রণেশদা, রণেশ দাশগুপ্ত; সন্তোষদা, সন্তোষ গুপ্তসহ অনেকে ছাড়া পান। তাঁরা একে একে আবার সংবাদ-এর কাজে যোগ দেন। আমাদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়, পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। ‘সংবাদ’-এর অফিসে যাতায়াত বেড়ে যায়। বলা যায়, বাসা থেকে যাওয়া-আসার পথে ‘সংবাদ’-এ ঢুকে পড়া আর কি! আমাদের নানা কাজের এক সহায়ক আস্তানায় পরিণত হয় সংবাদ অফিস। সেই ১৯৬৪ সালে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘সংবাদ’-এ। রণেশদার উৎসাহে একসঙ্গে তিনটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। সেই রোববারের সকালের আনন্দের স্পর্শ এখনো বুকের মধ্যে জাগ্রত রয়েছে। প্রথম গদ্য ছাপা হয় ১৯৬৯ সালে। এ রকমই চলে ’৬৬, ’৬৭, ’৬৯, ’৭০ এবং মহান ’৭১ পর্যন্ত। ‘সংবাদ অফিসকে’ অনেক সময় মনে হয়েছে বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য যোগাযোগকেন্দ্র। সত্যি তা-ই ছিল!
আসলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আহমদুল কবিরের কথা আমরা শুনতে থাকি; তাঁর সম্পর্কে জানতে পারি। সংবাদ-এর সঙ্গে তাঁর যুক্ততার কথা বুঝতে পারি। তখনো তাঁকে আমরা চিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে- ন্যাপের নেতা, কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, একজন প্রগতিকামী অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশেও দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি।
মনে পড়ে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে যে কার্যক্রম চলেছিল, সেটি আহমদুল কবিরের তোপখানার অফিসকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের কাছ থেকে পাকিস্তানের শুরুতে তাঁদের চরম কষ্টের দিনগুলোয় আহমদুল কবিরের সাহায্য-সহযোগিতার কথা শুনেছি। সে জন্য সবসময় তাঁর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল। কলকাতায় যতবার দেখা হয়েছে, রণেশদা সবসময় কবির ভাইয়ের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি, দাঙ্গা প্রতিরোধে তাঁর কথা গভীর ভালোবাসা নিয়ে বলতেন। পঁচাত্তরের পর রণেশদা কলকাতায় থেকে গেলে কবির ভাই একাধিকবার তাঁর কাছে গেছেন ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে।
ষাটের দশকে আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, তখন তাঁর সাহায্য আমরা পেয়েছি। একবার তাঁর মতিঝিলের অফিসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে যখন মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বের প্রভাবে পড়ে ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে যায়, তখন তিনি আবার দুই অংশের মধ্যে ঐক্য তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর বাসায় রাতের পর রাত বৈঠক হয়েছে দুই গ্রুপের নেতাদের মধ্যে। তিনি জেগে বসে থাকতেন।
ন্যাপের বৈঠক হয়েছে তাঁর বাসায়। তাঁর অফিস হয়ে উঠেছিল ন্যাপের আরেক কেন্দ্র। পাকিস্তানের ন্যাপের বড় নেতা খান আবদুল ওয়ালি খান, মাহমুদুল হক উসমানি প্রমুখ ঢাকায় এলে তাঁর বাসায় থেকেছেন, তাঁর বাসা হয়েছে তাঁদের কর্মস্থল।
মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালে ডেমরার ঘূর্ণিঝড়ের পর একবার সারা দিন তাঁর সঙ্গে নৌকায় ঘুরেছিলাম সারা এলাকা। তখন থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলেও ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। আশির দশকে তাঁর সঙ্গে প্রচুর সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে- কখনো দেশের চলমান রাজনীতি, যৌবনে কলকাতার অতীতের নানা ঘটনা বা সংবাদপত্র নিয়ে। অফিসে দুপুরে খেয়েছি একসঙ্গে- গ্রাম থেকে আনা সরিষার খাঁটি তেল কিংবা ঘি দিয়ে ভাত, নিরামিষ আর মাছ। বিকেল-সন্ধ্যায় আনন্দঘন সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। ১৯৯৩ সালে কয়েকজন মিলে কলকাতা হয়ে চেন্নাইয়ে সেমিনার উপলক্ষে গেলে একসঙ্গে আলোচনা সভা, নানা অনুষ্ঠান, গল্প-গুজবে মজার মজার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
এখানে সামান্য কথা বলে নিই, কবির ভাই ছিলেন এক সুপুরুষ। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় বুলগেরীয় চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছিল। ওই উৎসবে একটা ছবি ছিল ‘দ্য ডাইভারসন’, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছিল। বহুদিন আমরা বলতাম, ওই নায়ক তো একদম কবির ভাইয়ের মতো দেখতে।
১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি সোমবার সংবাদ-এ উপসম্পাদকীয় লিখেছি। প্রতি শনিবার লেখা নিয়ে বজলুর রহমানের সামনে হাজির হয়েছি- তাঁর সামনে বসে লেখার পরীক্ষা দিয়েছি প্রতি সপ্তাহে। বজলুর রহমান ও আহমদুল কবিরের উৎসাহে সে সময় সংবাদ-এ অনেক রিপোর্ট করেছি, অনেকের সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু, কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তসহ অনেকের সাক্ষাৎকার ‘সংবাদ’-এ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের সে সহযোগিতা সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আমার জন্য ভীষণ সহায়ক হয়েছিল।
‘সাপ্তাহিক একতা’য় সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করলেও ওই সব লেখালেখি আমার জন্য, আমার সাংবাদিক জীবনের জন্য বড় অর্জন, যা সামনে এগিয়ে চলার পাথেয় হয়ে রয়েছে। সে সময় তো আহমদুল কবির শুধু প্রকাশক নন, সংবাদ-এর সম্পাদকও।
‘সংবাদ’ সব সময়- সেই শৈশবে দেখা আমার সংবাদ, কৈশোর পেরিয়ে যুবা বয়সের উত্তাল তরঙ্গমালার দিনগুলোতে সংবাদ, আজ প্রৌঢ়ত্বের পর্যায়েও নতুন নতুন উপলব্ধি অর্জনে- নতুন নতুন দিক উন্মোচনে আমাদের সঙ্গে আছে। ‘সংবাদ’-এর হাত ধরেই আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি পাঁচ দশক ধরে। বাংলাদেশকে একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে আলোর পথের দিশারীর ভূমিকা পালন করেছে সংবাদ।
আহমদুল কবিরের নেতৃত্বে সত্তর আর আশির দশকে ‘সংবাদ’-এর জোরালো সাহসী ভূমিকার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। তবে এ প্রশ্নও কেউ কেউ করতে পারেন, সম্পাদক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে তিনি কতটুকু সফল হয়েছিলেন? তিনি সফল ছিলেন। তিনি ব্যর্থও হয়ে থাকতে পারেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে তাঁর নেতৃত্বে দৈনিক ‘সংবাদ’ সব সময়ই ছিল আমাদের স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পতাকা হয়ে। আমাদের সেই শৈশব থেকে আজ বৃদ্ধ বয়সের কাছাকাছি এসে এ কথা বলতে পারি, দৈনিক ‘সংবাদ’ থেকে আমাদের জীবন, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের জীবনসংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।
আহমদুল কবির রাজনীতিবিদ হিসেবে সফল হয়েছিলেন নাকি ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটা ইতিহাস বিচার করবে। তবে আমরা বলব, তিনি সফল হয়েছেন। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র আর প্রগতির পতাকাকে বহন করেছেন। এই পতাকাকে তিনি কোনো দিন ফেলে দেননি হাত থেকে; যেমনটা আমরা দেখেছি তাঁর সময়ের অনেক রাজনৈতিক সহযোগী বা নেতাদের ক্ষেত্রে। আমরা বলব, এখানেই আহমদুল কবির সফল- একজন সম্পাদক হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও।
আহমদুল কবিরের স্মৃতি স্থায়ী হোক। তাঁর প্রিয় সংবাদ সামনে এগিয়ে চলুক। বজলুর রহমান, আলতামাশ কবির প্রমুখের নেতৃত্ব ‘সংবাদ’-এর অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র আর প্রগতির পতাকাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলুক। তাঁদের পাশে থাকুন আমাদের শ্রদ্ধেয় লায়লা রহমান কবির।
[লেখাটি ২৫ নভেম্বর ২০০৪ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে আহমদুল কবিরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় পঠিত।] প্রকাশকাল: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, সংবাদ।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
আহমদুল কবির (১৯২৩-২০০৩)
মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
‘দৈনিক সংবাদের’ কথা মনে হলেই আমাদের সেই শৈশব, কৈশোর ও যুবা বয়সের সময়গুলোর কথা মনে পড়ে যায়। একই সঙ্গে শৈশব থেকে যৌবনকালে আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তায় ও পরিবর্তনে বড়ো জগতের সন্ধান পেতে ‘দৈনিক সংবাদের’ ভূমিকা অনেক। আমাদের জীবনে যতটুকু সাফল্য তার সাথেও রয়েছে ‘দৈনিক সংবাদের’ গভীর সম্পর্ক। আরও বলা যায়, ‘দৈনিক সংবাদ’ চার দশক ধরে (’৫০-’৯০) এবং তারপরেও নানাভাবে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বিশেষ করে ষাটের দশক থেকেই ‘দৈনিক সংবাদের’ আহমদুল কবির, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, আলী আকসাদ ও বজলুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে নানাভাবে পরিচিত হয়েছি, তাদের সহযোগিতা পেয়েছি অনেক। সেই দিনগুলোর কথা সবসময় মনে পড়ে।
সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনবোধ তৈরি ও নানা জিজ্ঞাসার জবাব পেতে ‘দৈনিক সংবাদের’ ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ষাটের দশকের সংবাদে সাহিত্য সাময়িকীতে আমার কবিতা ও গদ্য ছাপা হয়েছে। আশির দশকে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি প্রায় চার বছর নিয়মিত কলাম লিখেছি প্রতি সোমবার। প্রায় একই সময়ে ‘দৈনিক সংবাদের’ প্রথম পৃষ্ঠায় আমার বেশ কিছু রিপোর্ট ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে।
এভাবেই ৪০/৫০ বছর ধরে ‘দৈনিক সংবাদের’ সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। সেজন্য ‘দৈনিক সংবাদের’ ৭৫তম বার্ষিকীতে এ কথা নিদ্বির্ধায় বলা যায়, ‘দৈনিক সংবাদ’ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। এখন সে দিনগুলোর কথা মনে হলেই নতুন সাহস, নতুন প্রত্যয় জেগে ওঠে মনের গভীরে।
‘দৈনিক সংবাদের’ ৭৫তম বার্ষিকীতে দৈনিক সংবাদের প্রতি শুভেচ্ছা। একই সাথে ‘দৈনিক সংবাদের’ প্রতি কৃতজ্ঞতা। ‘দৈনিক সংবাদের’ আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্মরণ করে সম্পাদক আহমদুল কবিরকে স্মরণ করি। তাঁর মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমি একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলাম। সেটা পরে আমার বই ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা: কবিতা-গান-শিল্পের ঝরনাধারা’য় এটা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখাটিতে ‘দৈনিক সংবাদ’ নিয়ে আমার অনেক কথা, অনেক স্মৃতি রয়েছে।
স্মৃতিতে আহমদুল কবির
প্রগতির পতাকাবাহী একজন : আমরা তখন খুব ছোট। আমাদের বাসা ছিল ২৪০ নম্বর বংশালে। বাসা থেকে বের হলেই ‘দৈনিক সংবাদ’ অফিস। সংবাদ অফিস সেই ১৯৫০ সাল থেকে দীর্ঘদিন, প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই ছিল ২৬৩ নম্বর বংশালে। অফিসের গেটের পাশের দেয়ালে সাঁটানো থাকত আট পৃষ্ঠার ‘সংবাদ’।
আমরা বংশালের বাসা ছেড়ে চলে যাই ১৯৭৪ সালে। আশির দশকের শুরুতে আবার আমাদের ওই বাসাতেই সাপ্তাহিক ‘একতা’র অফিস করি। সেই অফিস চলে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত- এভাবেই চল্লিশ বছর ধরে আমাদের যাওয়া-আসা ছিল ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সামনে দিয়ে। আমি ১৯৫৩ সালে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই তৃতীয় শ্রেণিতে। সেই বয়স থেকে দেয়ালে সাঁটানো সংবাদ দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। খুব সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেয়ালে সাঁটানো সংবাদ কাগজ পড়তে চলে যেতাম। সেই দিনগুলোতে শুধু খেলার খবর পড়তাম। পেছনের পৃষ্ঠার বাঁ দিকে থাকত খেলার খবর। খেলার খবর পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে দেশের অন্যান্য খবর, সমাজ ও রাজনীতির খবর পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি, পড়তে শুরু করি। ধীরে ধীরে নতুন এক জগত, নতুন চিন্তায় প্রভাবিত হতে থাকি। পরে জেনেছিলাম, ১৯৫৪ সালে সংবাদ-এ আহমদুল কবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জহুর হোসেন চৌধুরী সম্পাদক হন।
মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালের নভেম্বর কি ডিসেম্বরে, তৎকালীন তরুণ বামপন্থী নেতা আনোয়ার জাহিদকে খুঁজতে সংবাদ অফিসে প্রথম যাই। এর আগেই তৎকালীন বামপন্থী যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ইমাদুল্লাহ স্মৃতি পাঠাগারের সদস্য হয়েছিলাম। সেই বছরের অক্টোবরে পাকিস্তানজুড়ে সামরিক শাসন জারি হলে ওই পাঠাগারটিও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমার কাছে পাঠাগারের ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইটি ছিল, একদিন সেটা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম সংবাদ অফিস দর্শন। সেই সংবাদ অফিসের একতলায় সাব এডিটর-রিপোর্টারদের ঘর, ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যাওয়া, সেখানে সম্পাদকীয় বিভাগের অফিস এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
সেই সময়ই দেশ সম্পর্কে, রাজনীতি নিয়ে আমাদের ভাবনা শুরু। ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর ঢাকা কলেজ থেকেই ছাত্ররাজনীতিতে আমাদের হাতেখড়ি। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তুমুল এক অভিঘাত চলছিল সারা দেশে। সারা দেশ, আমরা সবাই, নতুন এক চেতনায় জেগে উঠেছিলাম। সংবাদ-এ প্রতিদিন সেই উত্তাল দিনগুলোর খবর, ছবি সবই ছিল আমাদের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণার। এভাবেই সংবাদ হয়ে উঠেছিল আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী।
সেই বাষট্টির আন্দোলনের কিছু সময় পর থেকে রাজবন্দীরা জেল থেকে ছাড়া পেতে শুরু করেন। শহীদ ভাই, শহীদুল্লা কায়সার; রণেশদা, রণেশ দাশগুপ্ত; সন্তোষদা, সন্তোষ গুপ্তসহ অনেকে ছাড়া পান। তাঁরা একে একে আবার সংবাদ-এর কাজে যোগ দেন। আমাদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়, পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। ‘সংবাদ’-এর অফিসে যাতায়াত বেড়ে যায়। বলা যায়, বাসা থেকে যাওয়া-আসার পথে ‘সংবাদ’-এ ঢুকে পড়া আর কি! আমাদের নানা কাজের এক সহায়ক আস্তানায় পরিণত হয় সংবাদ অফিস। সেই ১৯৬৪ সালে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘সংবাদ’-এ। রণেশদার উৎসাহে একসঙ্গে তিনটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। সেই রোববারের সকালের আনন্দের স্পর্শ এখনো বুকের মধ্যে জাগ্রত রয়েছে। প্রথম গদ্য ছাপা হয় ১৯৬৯ সালে। এ রকমই চলে ’৬৬, ’৬৭, ’৬৯, ’৭০ এবং মহান ’৭১ পর্যন্ত। ‘সংবাদ অফিসকে’ অনেক সময় মনে হয়েছে বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য যোগাযোগকেন্দ্র। সত্যি তা-ই ছিল!
আসলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আহমদুল কবিরের কথা আমরা শুনতে থাকি; তাঁর সম্পর্কে জানতে পারি। সংবাদ-এর সঙ্গে তাঁর যুক্ততার কথা বুঝতে পারি। তখনো তাঁকে আমরা চিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে- ন্যাপের নেতা, কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, একজন প্রগতিকামী অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশেও দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি।
মনে পড়ে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে যে কার্যক্রম চলেছিল, সেটি আহমদুল কবিরের তোপখানার অফিসকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের কাছ থেকে পাকিস্তানের শুরুতে তাঁদের চরম কষ্টের দিনগুলোয় আহমদুল কবিরের সাহায্য-সহযোগিতার কথা শুনেছি। সে জন্য সবসময় তাঁর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল। কলকাতায় যতবার দেখা হয়েছে, রণেশদা সবসময় কবির ভাইয়ের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি, দাঙ্গা প্রতিরোধে তাঁর কথা গভীর ভালোবাসা নিয়ে বলতেন। পঁচাত্তরের পর রণেশদা কলকাতায় থেকে গেলে কবির ভাই একাধিকবার তাঁর কাছে গেছেন ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে।
ষাটের দশকে আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, তখন তাঁর সাহায্য আমরা পেয়েছি। একবার তাঁর মতিঝিলের অফিসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে যখন মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বের প্রভাবে পড়ে ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে যায়, তখন তিনি আবার দুই অংশের মধ্যে ঐক্য তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর বাসায় রাতের পর রাত বৈঠক হয়েছে দুই গ্রুপের নেতাদের মধ্যে। তিনি জেগে বসে থাকতেন।
ন্যাপের বৈঠক হয়েছে তাঁর বাসায়। তাঁর অফিস হয়ে উঠেছিল ন্যাপের আরেক কেন্দ্র। পাকিস্তানের ন্যাপের বড় নেতা খান আবদুল ওয়ালি খান, মাহমুদুল হক উসমানি প্রমুখ ঢাকায় এলে তাঁর বাসায় থেকেছেন, তাঁর বাসা হয়েছে তাঁদের কর্মস্থল।
মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালে ডেমরার ঘূর্ণিঝড়ের পর একবার সারা দিন তাঁর সঙ্গে নৌকায় ঘুরেছিলাম সারা এলাকা। তখন থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলেও ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। আশির দশকে তাঁর সঙ্গে প্রচুর সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে- কখনো দেশের চলমান রাজনীতি, যৌবনে কলকাতার অতীতের নানা ঘটনা বা সংবাদপত্র নিয়ে। অফিসে দুপুরে খেয়েছি একসঙ্গে- গ্রাম থেকে আনা সরিষার খাঁটি তেল কিংবা ঘি দিয়ে ভাত, নিরামিষ আর মাছ। বিকেল-সন্ধ্যায় আনন্দঘন সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। ১৯৯৩ সালে কয়েকজন মিলে কলকাতা হয়ে চেন্নাইয়ে সেমিনার উপলক্ষে গেলে একসঙ্গে আলোচনা সভা, নানা অনুষ্ঠান, গল্প-গুজবে মজার মজার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
এখানে সামান্য কথা বলে নিই, কবির ভাই ছিলেন এক সুপুরুষ। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় বুলগেরীয় চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছিল। ওই উৎসবে একটা ছবি ছিল ‘দ্য ডাইভারসন’, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছিল। বহুদিন আমরা বলতাম, ওই নায়ক তো একদম কবির ভাইয়ের মতো দেখতে।
১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি সোমবার সংবাদ-এ উপসম্পাদকীয় লিখেছি। প্রতি শনিবার লেখা নিয়ে বজলুর রহমানের সামনে হাজির হয়েছি- তাঁর সামনে বসে লেখার পরীক্ষা দিয়েছি প্রতি সপ্তাহে। বজলুর রহমান ও আহমদুল কবিরের উৎসাহে সে সময় সংবাদ-এ অনেক রিপোর্ট করেছি, অনেকের সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু, কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তসহ অনেকের সাক্ষাৎকার ‘সংবাদ’-এ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের সে সহযোগিতা সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আমার জন্য ভীষণ সহায়ক হয়েছিল।
‘সাপ্তাহিক একতা’য় সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করলেও ওই সব লেখালেখি আমার জন্য, আমার সাংবাদিক জীবনের জন্য বড় অর্জন, যা সামনে এগিয়ে চলার পাথেয় হয়ে রয়েছে। সে সময় তো আহমদুল কবির শুধু প্রকাশক নন, সংবাদ-এর সম্পাদকও।
‘সংবাদ’ সব সময়- সেই শৈশবে দেখা আমার সংবাদ, কৈশোর পেরিয়ে যুবা বয়সের উত্তাল তরঙ্গমালার দিনগুলোতে সংবাদ, আজ প্রৌঢ়ত্বের পর্যায়েও নতুন নতুন উপলব্ধি অর্জনে- নতুন নতুন দিক উন্মোচনে আমাদের সঙ্গে আছে। ‘সংবাদ’-এর হাত ধরেই আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি পাঁচ দশক ধরে। বাংলাদেশকে একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে আলোর পথের দিশারীর ভূমিকা পালন করেছে সংবাদ।
আহমদুল কবিরের নেতৃত্বে সত্তর আর আশির দশকে ‘সংবাদ’-এর জোরালো সাহসী ভূমিকার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। তবে এ প্রশ্নও কেউ কেউ করতে পারেন, সম্পাদক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে তিনি কতটুকু সফল হয়েছিলেন? তিনি সফল ছিলেন। তিনি ব্যর্থও হয়ে থাকতে পারেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবে তাঁর নেতৃত্বে দৈনিক ‘সংবাদ’ সব সময়ই ছিল আমাদের স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পতাকা হয়ে। আমাদের সেই শৈশব থেকে আজ বৃদ্ধ বয়সের কাছাকাছি এসে এ কথা বলতে পারি, দৈনিক ‘সংবাদ’ থেকে আমাদের জীবন, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের জীবনসংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।
আহমদুল কবির রাজনীতিবিদ হিসেবে সফল হয়েছিলেন নাকি ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটা ইতিহাস বিচার করবে। তবে আমরা বলব, তিনি সফল হয়েছেন। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র আর প্রগতির পতাকাকে বহন করেছেন। এই পতাকাকে তিনি কোনো দিন ফেলে দেননি হাত থেকে; যেমনটা আমরা দেখেছি তাঁর সময়ের অনেক রাজনৈতিক সহযোগী বা নেতাদের ক্ষেত্রে। আমরা বলব, এখানেই আহমদুল কবির সফল- একজন সম্পাদক হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও।
আহমদুল কবিরের স্মৃতি স্থায়ী হোক। তাঁর প্রিয় সংবাদ সামনে এগিয়ে চলুক। বজলুর রহমান, আলতামাশ কবির প্রমুখের নেতৃত্ব ‘সংবাদ’-এর অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র আর প্রগতির পতাকাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলুক। তাঁদের পাশে থাকুন আমাদের শ্রদ্ধেয় লায়লা রহমান কবির।
[লেখাটি ২৫ নভেম্বর ২০০৪ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে আহমদুল কবিরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় পঠিত।] প্রকাশকাল: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, সংবাদ।