alt

উত্তাল চল্লিশে দেশ বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?

এম. এম. আকাশ

: মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৯৪৭ সালে র‌্যাডক্লিফ সাহেব পাঞ্জাব ও বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিতে মানচিত্রে রেখা টেনে বিভক্ত করে দেন দুটি ভাগে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অংশটির নাম হয় পাকিস্তান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত অংশটির নাম হয় ভারত। এওও সবার জানা আছে যে সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা চেয়েছিলেন যে, ভারত উপমহাদেশ যাতে ঐক্যবদ্ধ উপমহাদেশ হিসাবে না থেকে বিভক্ত ও যুদ্ধমান দেশ হিসাবে থাকে। তাদের স্বার্থ ছিল এই বিভক্তিতে। কারণ তাহলে উভয় দেশই দুর্বল থাকবে ও সহজে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত বা নয়া-ঔপনবিশিক শাসনের জালে আবদ্ধ করে রাখা যাবে। এই পরিকল্পনার গোপন সরকারি নাম হচ্ছে “Divide and Rule” র‌্যাড ক্লিফের লাইন দেশকে বিভক্ত করলেও মানুষকে বিভক্ত করতে পারেনি। তাই এখনো অমর্ত্য সেন বলেন, বাড়ি আমার মানিকগঞ্জ, মানুষ হয়েছি কলকাতায়। আর বদরুদ্দীন উমর বলেন, জন্ম ও শৈশব বর্ধমানে। কিন্তু বাংলাদেশ আমাকে উপেক্ষা করে আর পশ্চিমবঙ্গ আমাকে সমাদর করে। এরপরে অনেক ঐতিহাসিক বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দেশভাগের সময় বাংলা ভাগের যে দুঃসহ বেদনা ও সাম্প্রদায়িক ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত দূর হয় নি। এখনো অতীত “পূর্ব পাকিস্তান” বা বর্তমান “বাংলাদেশের” জনগণের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক বেদনা ও চেতনার অবশেষ রয়ে গেছে। “পূর্ব পাকিস্তান” আমলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি গোড়া থেকেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলতো। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করে ভাষা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব-বাংলার (তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান) প্রায় এক কোটি মানুষকে ওপার বাংলার বাঙালি হিন্দুরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৯ মাস অসীম ধৈর্য সহকারে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের আন্তর্জাতিক মিত্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। শত্রু হিসাবে কাজ করেছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসর আমেরিকা ও চীন। তখন অনেকের কাছে মনে হয়েছিল “হিন্দু-মুসলমান” বিভেদ সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুর দাঙ্গা ও মানসিক দূরত্ব হয়তো আর ভবিষ্যতে স্বাধীনতা

উত্তর বাংলাদেশে থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশ হবে অসম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমরা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ভূতের পুনরাবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ’৭২ সালে যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্রের মূলনীতিসহ সংবিধান রচনা করেছিলেন তা তারা রক্ষা করতে পারেননি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে সি.আই.এ ও দেশের ভেতরে তাদের দক্ষিণপন্থী মিত্ররা এবং সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী মেজর মিলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তারপর হত্যাকারীদের আংশিক বিচার সম্পন্ন হলেও, ৭২-এর সংবিধান আর অক্ষত থাকেনি। পরবর্তীতে দক্ষিণপন্থী আওয়ামী নেতা মুশতাক, সামরিক জেনারেল জিয়া ও এরশাদেরও হাত ঘুরে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেছিলেন। কিন্তু “ধর্ম নিরপেক্ষতার” মূল নীতি ও “গণতন্ত্র” দুইই বঙ্গবন্ধুর কন্যার শাসনামলেও বিসর্জিত অবস্থাতেই থেকে যায়। উরন্তু বিভিন্ন সময় নির্বাচনে জেতার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির ভোটের জন্য তাদেরকে নানা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর রেমিট্যান্সও দেশে আসা শুরু করে। কিন্তু স্বৈরশাসন বা রাজাকার উভয়কে প্রশ্রয় দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। এখন নতুন করে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ওপারে পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে আশ্রয় নিলেও আগস্ট অভ্যুত্থানে ১৮০০ ব্যক্তির (আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, শ্রমিক-ছাত্র-পুলিশ ইত্যাদি সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত) হত্যার অভিযোগ ও অসংখ্য মামলার খড়গ এখনো ঝুলছে তাদের প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনার স্কন্ধে। এই বিচার না করে এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা হবে না। যদিও আওয়ামী পক্ষের দাবি আগস্ট মাসে এখানে বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় “Colour Revolution” হয়েছে এবং/অথবা “Meticulous Design” ছিল- কিন্তু তা কতটুকু সত্য সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইয়ের জন্যই এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটি সুষ্ঠু তদন্ত, নিরপেক্ষ ট্রায়াল ও ন্যায়বিচার। কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আমরা বসবাস করি- যার মূলে রয়েছে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ও ভাষা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার কি সেই শক্তি আছে যাতে সে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবেই আবার “অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে?

মাঠে আওয়মী লীগ এখন নেই। আজকের বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বি.এন.পি। মুক্তিযুদ্ধকে তারা অস্বীকার করে না ঠিকই, কিন্তু তাদের ঘোষিত মতাদর্শ হচ্ছে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”। অনেকে মনে করেন যে এই মতাদর্শগত ভিত্তিটি হচ্ছে শেরে বাংলা ফজলুল হক প্রস্তাবিত ১৯৪০-এর দশকের লাহোর প্রস্তাবের অনুরূপ, যেখানে দেশ ভাগের প্রস্তাবে ছিল ভারতের “মুসলিম অধ্যুষিত (প্রধানতঃ)” এলাকাগুলি নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। সেই প্রস্তাব কার্যকরী হলে ১৯৪৭ সালেই পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে গঠিত হতো “মুসলিম বাংলা” নামে একটি পৃথক রাষ্ট্র। পাকিস্তান ও ভারত এই দুটি রাষ্ট্রও তখনই জন্ম নিত। এইভাবে ভারতবর্ষে হয়তো তখনই ৩টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতো। মনে হয় এখনকার আগস্ট অভ্যুত্থানের আঁতেলিকুচুয়াল নেতারাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ১৯৪৭ সালের এই “স্বাধীন মুসলিম বাংলার” কথাই সমর্থন করতে চান এবং সে জন্যই হয়তো “১৯৪৭-এর ধর্মভিত্তিক স্বাধীনতাকে” “১৯৭১-এর ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীনতার” বিপরীতে স্থাপন করতে পছন্দ করেন। তাদের সংগে কিছু বামপন্থীও আজকাল এ কথা বলেন যে “কমিউনিস্টরাও তো ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ বিভাগ বা পূর্ব পাকিস্তানকে মেনে নিয়েছিলেন। যদিও এ দাবি সর্বাংশে সত্য নয়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শক্তিকে অস্বীকার করে উত্তাল চল্লিশে কমিউনিস্টরা স্লোগান দিয়েছিলেন “লাখো ইনসান ভুখা হায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়”- কিন্তু প্রবল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরেও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু জামিদার কর্তৃক নিপীড়িত মুসলিম কৃষক এবং প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া অনগ্রসর মুসলিম মধ্যবিত্তরা মুসলিম লীগকেই তখন সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি শেরে বাংলা ফজলুল হকও তার কৃষক প্রজা পার্টি ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগেই যোগ দেন। পাকিস্তানকে তখন ঐ কৃষক ও মধ্যবিত্তরা দেখেছেন নিজেদের অর্থৈেনতিক বিকাশের এক দুর্লভ সুযোগ হিসাবে। তাই ব্রিটিশ শুধু নয়, হিন্দু অগ্রসর শ্রেণিকেও নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন তখন তারা দেখেছিলেন। তবে এর মধ্যেও মানতেই হবে যে, বামপন্থীদের নেতৃত্বে টংক/নানকার/তেভাগা আন্দোলনগুলি হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়েই সংগঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর অবশ্য এগুলি আর টিঁকে থাকেনি। এটা ঠিক যে পাকিস্তান হওয়ার পর কিন্তু সম্পত্তিবান শ্রেণির বেশিরভাগটাই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে চলে যায় তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গে। অনেক সাধারণ হিন্দুরাও দেশত্যাগ করেন। এমনকি মাত্র শ-খানেক মাটি আঁকড়ে থাকা অমুসলমান কমিউনিস্টরা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিরও ১২০০০ সদস্যের অধিকাংশ সদস্যই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বস্তুত পাশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী কালে যে বিশাল বাম প্রগতিশীল সংস্কৃতির স্ফুরণ আমরা দেখতে পাই সেখানেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া বিপ্লবীদের বিশাল অবদান আমরা খুঁজলে পাব। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, অমর্ত্য সেন- এঁদের কথা, যাঁরা প্রত্যেকেই হয়তো দেশ ভাগ না হলে এদেশেই থেকে যেতেন।

যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি। আমি সংবাদের ৭৪ বছর পূর্তির এই লেখাটি যখন লেখার সিদ্ধান্ত নিই তখন আমার হাতে দৈনিক সংবাদেরই এপ্রিল ৬, ১৯৮৯ তারিখের সংখ্যাটি রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হারুনর রশীদ পাঠিয়ে দেন। তাতে লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ে গৃহীত তাঁর পি.এইচ.ডি পি অধিসন্দর্ভ “দ্য ফোর-শ্যাডোয়িং অফ বাংলা দেশ: বেঙ্গল মুসলিম লীগ এ্যান্ড মুসলিম পলিটিক্স”-এর উপর আমার একটি দীর্ঘ পুস্তক সমালেচনা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে “বাংগালী মুসলমানের” আজন্ম লালিত একটি “ডিলেমার” কথা তুলে ধরা হয়েছিল। যেই ভাষায় এটা তখন উল্লেখ করা হয়েছিল সেটি একটু দীর্ঘ হলেও আজো প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। আমি লেখকের থিসিসের নানাদিক আলোচনার পর এক জায়গায় লিখেছিলাম, “লেখক আলোচ্য গ্রন্থে ফজলুল হকের দোদুল্যমানতাকে নানাভাবে চিত্রিত করে এক জায়গায় সিদ্ধান্তের আকারে বলেছেন-

“Indeed Fazlul Huq was the most effective representative of the Bengal Muslim Community in the sense that he reflected their terrible dilemma accurately and successfully, a dilemma which could not be resolved until one course (Pakistan) was exhausted and Bangladesh created.” (and perhaps not even then?,পৃঃ৩৪৩ )

অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়- কী ছিল সেই ডিলেমা? লেখক উত্তরে বলেছেন, যে ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদানের পরেও কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যেও অনেকেই স্বতন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারাটিকে ধরে রাখার প্রয়াস বজায় রেখেছিলেন। এখানে আবুল হাশিম ও তার অনুসারীদের বোঝানো হয়েছে। এরা মুসলিম লীগে যোগ দিলেও এরা তাদের কৃষক মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়েই তাতে যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্তরাও ছিল উঠতি ধনী পাট চাষীদেরই সন্তান। তাই তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত ধরনের “জাতীয়তাবাদ”। তারা জিন্নাহর মতো ভারতবর্ষে সকল মুসলমানই এক জাতি- একথায় বিশ্বাস করতেন না। ধর্মভিত্তিক Two Nation Theory-তে তাদের বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আবার পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষি হিন্দু মুসলমানদের একত্রে একটি জাতি হিসাবে বিবেচনা করতেও তারা শ্রেণিগত কারণে রাজি ছিলেন না। তারা ভাবতেন বাঙালি মুসলমানরা এক স্বতন্ত্র জাতি। এটা ঠিক, ধর্ম ভিত্তিক জাতি ছিল না আবার পুরোপুরি ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিও সেটা ছিল না। ছিল শ্রেণি পার্থক্য-সঞ্জাত এক কঠিন বাস্তবতার সাময়িক প্রতিফলন ছাত্র। তবে লেখকের প্রশ্ন হচ্ছে তা কি সাময়িক না কি আত্যন্তিক (Intrinsic)। আর এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে লেখকের মতে এটা ছিল সাময়িক- আত্যন্তিক নয়। তাই “পূর্ব পাকিস্তান” হয়ে যাওয়ার পর মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুললিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপের জন্ম হয়। এই সমস্ত ঘটনাগুলিই দ্রুত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কবর দিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিকে পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক-জনতাকে ধাবিত করেছিল। পরবর্তীতে মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু এখন ইতিহসকে আবার পেছন দিকে টানা হচ্ছে, যদিও বর্তমানে এক ধরনের সমঝোতায় বাংলাদেশবাসী পৌঁছেছেন- যার মর্মবাণী হচ্ছে, জাতি হিসাবে আমরা বাঙালি; তবে আমরা ভারতীয় বাঙালি নই। আমরা বাংলাদেশি বাঙালি। কিন্তু এর এক ধাপ উপরে উঠে আমাদের আজ বলা দরকার আমরা সকল প্রকার ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধেও থাকবো। বাংলার গ্রামবাসীর যে আবহমান ধর্ম নিরপেক্ষ লোকজ সংস্কৃতি রয়েছে- তা সমাজে প্রসারিত করে আমাদের আজকের পরিচয় হবে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ আউল-বাউলের দেশ বাংলাদেশের বাঙালি জাতি। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। এখানে অন্য পাহাড়ি জাতিরাও রয়েছেন। এখানে সকল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে আমরা সহজ কথায়-বার্তায়-মমতায় জড়িয়ে ধরি, দেই সকলকে তার প্রাপ্য মানসিক মর্যাদা, স্বীকৃতি ও প্রীতিবন্ধন। বাঙালি জাতির নানা বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আন্তরিক-সামাজিক সম্প্রীতির বৈশিষ্ট্যকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশকে সামনে রেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

“বাংলাদেশের ইতিহাস খ-তার ইতিহাস। পূর্বঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বারেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না। তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। এতকাল আমাদের বাঙালি বলা হযেছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বঙ্গে থাকি। শাসনকর্তারা বাংলা প্রদেশের অংশ-প্রত্যংশ অন্য প্রদেশে জুড়ে দিয়েছেন, কিন্তু ভাষাটাকে ছেঁটে ফেলতে পারেননি।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “বাংলাভাষা পরিচয়”, রবীন্দ্র রচনাবলী-৩, পুনর্মুদ্রণ; কলিকাতা, ১৯৫৭, পৃঃ ৫৫৯-৭৮, উদ্ধৃত হয়েছে, আনিসুজ্জামান, বাঙালি ও বাংলাদেশ, শব্দগ্রন্থন প্রকাশনালয়, কলকাতা, কার্তিক, ১৪২৪, ২য় মুদ্রণ পৃ: ১৬।)

ছবি

গাছপাথরের সময়

ছবি

সন্তোষ গুপ্ত : এক বিরল ব্যক্তিত্ব

ছবি

সংস্কৃতি কি বাঁচাবে আমাদের?

ছবি

স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা নারীর সংখ্যালঘু-দশার শেষ কোথায়?

ছবি

পার্বত্য আদিবাসী সংস্কৃতির ভেতর-বাহির

ছবি

বিশ্বসেরা বিাশ্ববিদ্যালয়ে কাব্যচর্চা

ছবি

গণমাধ্যমের হাল-হকিকত

ছবি

গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য মুক্ত ভাবনার সুরক্ষা

ছবি

সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ জহুর হোসেন চৌধুরী

ছবি

জন্মেজয় দৈনিক সংবাদ যেন সফল হয় সর্প নিধনে

ছবি

পঁচাত্তর বছরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ

ছবি

গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

গণমানুষের সংগ্রামের প্রগতিশীল মুখপত্র

ছবি

দৈনিক সংবাদের সাথেই বেড়ে উঠেছি

সংবাদ থাকুক সংবাদ-এর মতোই

ক্ষমতার হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই

tab

উত্তাল চল্লিশে দেশ বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?

এম. এম. আকাশ

মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৯৪৭ সালে র‌্যাডক্লিফ সাহেব পাঞ্জাব ও বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিতে মানচিত্রে রেখা টেনে বিভক্ত করে দেন দুটি ভাগে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অংশটির নাম হয় পাকিস্তান ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত অংশটির নাম হয় ভারত। এওও সবার জানা আছে যে সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা চেয়েছিলেন যে, ভারত উপমহাদেশ যাতে ঐক্যবদ্ধ উপমহাদেশ হিসাবে না থেকে বিভক্ত ও যুদ্ধমান দেশ হিসাবে থাকে। তাদের স্বার্থ ছিল এই বিভক্তিতে। কারণ তাহলে উভয় দেশই দুর্বল থাকবে ও সহজে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত বা নয়া-ঔপনবিশিক শাসনের জালে আবদ্ধ করে রাখা যাবে। এই পরিকল্পনার গোপন সরকারি নাম হচ্ছে “Divide and Rule” র‌্যাড ক্লিফের লাইন দেশকে বিভক্ত করলেও মানুষকে বিভক্ত করতে পারেনি। তাই এখনো অমর্ত্য সেন বলেন, বাড়ি আমার মানিকগঞ্জ, মানুষ হয়েছি কলকাতায়। আর বদরুদ্দীন উমর বলেন, জন্ম ও শৈশব বর্ধমানে। কিন্তু বাংলাদেশ আমাকে উপেক্ষা করে আর পশ্চিমবঙ্গ আমাকে সমাদর করে। এরপরে অনেক ঐতিহাসিক বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দেশভাগের সময় বাংলা ভাগের যে দুঃসহ বেদনা ও সাম্প্রদায়িক ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত দূর হয় নি। এখনো অতীত “পূর্ব পাকিস্তান” বা বর্তমান “বাংলাদেশের” জনগণের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক বেদনা ও চেতনার অবশেষ রয়ে গেছে। “পূর্ব পাকিস্তান” আমলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি গোড়া থেকেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলতো। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করে ভাষা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব-বাংলার (তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান) প্রায় এক কোটি মানুষকে ওপার বাংলার বাঙালি হিন্দুরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৯ মাস অসীম ধৈর্য সহকারে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের আন্তর্জাতিক মিত্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। শত্রু হিসাবে কাজ করেছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসর আমেরিকা ও চীন। তখন অনেকের কাছে মনে হয়েছিল “হিন্দু-মুসলমান” বিভেদ সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুর দাঙ্গা ও মানসিক দূরত্ব হয়তো আর ভবিষ্যতে স্বাধীনতা

উত্তর বাংলাদেশে থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশ হবে অসম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমরা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ভূতের পুনরাবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ’৭২ সালে যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্রের মূলনীতিসহ সংবিধান রচনা করেছিলেন তা তারা রক্ষা করতে পারেননি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে সি.আই.এ ও দেশের ভেতরে তাদের দক্ষিণপন্থী মিত্ররা এবং সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী মেজর মিলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তারপর হত্যাকারীদের আংশিক বিচার সম্পন্ন হলেও, ৭২-এর সংবিধান আর অক্ষত থাকেনি। পরবর্তীতে দক্ষিণপন্থী আওয়ামী নেতা মুশতাক, সামরিক জেনারেল জিয়া ও এরশাদেরও হাত ঘুরে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেছিলেন। কিন্তু “ধর্ম নিরপেক্ষতার” মূল নীতি ও “গণতন্ত্র” দুইই বঙ্গবন্ধুর কন্যার শাসনামলেও বিসর্জিত অবস্থাতেই থেকে যায়। উরন্তু বিভিন্ন সময় নির্বাচনে জেতার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির ভোটের জন্য তাদেরকে নানা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর রেমিট্যান্সও দেশে আসা শুরু করে। কিন্তু স্বৈরশাসন বা রাজাকার উভয়কে প্রশ্রয় দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। এখন নতুন করে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ওপারে পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে আশ্রয় নিলেও আগস্ট অভ্যুত্থানে ১৮০০ ব্যক্তির (আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, শ্রমিক-ছাত্র-পুলিশ ইত্যাদি সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত) হত্যার অভিযোগ ও অসংখ্য মামলার খড়গ এখনো ঝুলছে তাদের প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনার স্কন্ধে। এই বিচার না করে এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা হবে না। যদিও আওয়ামী পক্ষের দাবি আগস্ট মাসে এখানে বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় “Colour Revolution” হয়েছে এবং/অথবা “Meticulous Design” ছিল- কিন্তু তা কতটুকু সত্য সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইয়ের জন্যই এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটি সুষ্ঠু তদন্ত, নিরপেক্ষ ট্রায়াল ও ন্যায়বিচার। কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আমরা বসবাস করি- যার মূলে রয়েছে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ও ভাষা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার কি সেই শক্তি আছে যাতে সে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবেই আবার “অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে?

মাঠে আওয়মী লীগ এখন নেই। আজকের বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বি.এন.পি। মুক্তিযুদ্ধকে তারা অস্বীকার করে না ঠিকই, কিন্তু তাদের ঘোষিত মতাদর্শ হচ্ছে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”। অনেকে মনে করেন যে এই মতাদর্শগত ভিত্তিটি হচ্ছে শেরে বাংলা ফজলুল হক প্রস্তাবিত ১৯৪০-এর দশকের লাহোর প্রস্তাবের অনুরূপ, যেখানে দেশ ভাগের প্রস্তাবে ছিল ভারতের “মুসলিম অধ্যুষিত (প্রধানতঃ)” এলাকাগুলি নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। সেই প্রস্তাব কার্যকরী হলে ১৯৪৭ সালেই পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে গঠিত হতো “মুসলিম বাংলা” নামে একটি পৃথক রাষ্ট্র। পাকিস্তান ও ভারত এই দুটি রাষ্ট্রও তখনই জন্ম নিত। এইভাবে ভারতবর্ষে হয়তো তখনই ৩টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতো। মনে হয় এখনকার আগস্ট অভ্যুত্থানের আঁতেলিকুচুয়াল নেতারাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ১৯৪৭ সালের এই “স্বাধীন মুসলিম বাংলার” কথাই সমর্থন করতে চান এবং সে জন্যই হয়তো “১৯৪৭-এর ধর্মভিত্তিক স্বাধীনতাকে” “১৯৭১-এর ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীনতার” বিপরীতে স্থাপন করতে পছন্দ করেন। তাদের সংগে কিছু বামপন্থীও আজকাল এ কথা বলেন যে “কমিউনিস্টরাও তো ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ বিভাগ বা পূর্ব পাকিস্তানকে মেনে নিয়েছিলেন। যদিও এ দাবি সর্বাংশে সত্য নয়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শক্তিকে অস্বীকার করে উত্তাল চল্লিশে কমিউনিস্টরা স্লোগান দিয়েছিলেন “লাখো ইনসান ভুখা হায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়”- কিন্তু প্রবল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরেও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু জামিদার কর্তৃক নিপীড়িত মুসলিম কৃষক এবং প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া অনগ্রসর মুসলিম মধ্যবিত্তরা মুসলিম লীগকেই তখন সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি শেরে বাংলা ফজলুল হকও তার কৃষক প্রজা পার্টি ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগেই যোগ দেন। পাকিস্তানকে তখন ঐ কৃষক ও মধ্যবিত্তরা দেখেছেন নিজেদের অর্থৈেনতিক বিকাশের এক দুর্লভ সুযোগ হিসাবে। তাই ব্রিটিশ শুধু নয়, হিন্দু অগ্রসর শ্রেণিকেও নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন তখন তারা দেখেছিলেন। তবে এর মধ্যেও মানতেই হবে যে, বামপন্থীদের নেতৃত্বে টংক/নানকার/তেভাগা আন্দোলনগুলি হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়েই সংগঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর অবশ্য এগুলি আর টিঁকে থাকেনি। এটা ঠিক যে পাকিস্তান হওয়ার পর কিন্তু সম্পত্তিবান শ্রেণির বেশিরভাগটাই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে চলে যায় তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গে। অনেক সাধারণ হিন্দুরাও দেশত্যাগ করেন। এমনকি মাত্র শ-খানেক মাটি আঁকড়ে থাকা অমুসলমান কমিউনিস্টরা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিরও ১২০০০ সদস্যের অধিকাংশ সদস্যই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বস্তুত পাশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী কালে যে বিশাল বাম প্রগতিশীল সংস্কৃতির স্ফুরণ আমরা দেখতে পাই সেখানেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া বিপ্লবীদের বিশাল অবদান আমরা খুঁজলে পাব। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, অমর্ত্য সেন- এঁদের কথা, যাঁরা প্রত্যেকেই হয়তো দেশ ভাগ না হলে এদেশেই থেকে যেতেন।

যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি। আমি সংবাদের ৭৪ বছর পূর্তির এই লেখাটি যখন লেখার সিদ্ধান্ত নিই তখন আমার হাতে দৈনিক সংবাদেরই এপ্রিল ৬, ১৯৮৯ তারিখের সংখ্যাটি রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হারুনর রশীদ পাঠিয়ে দেন। তাতে লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ে গৃহীত তাঁর পি.এইচ.ডি পি অধিসন্দর্ভ “দ্য ফোর-শ্যাডোয়িং অফ বাংলা দেশ: বেঙ্গল মুসলিম লীগ এ্যান্ড মুসলিম পলিটিক্স”-এর উপর আমার একটি দীর্ঘ পুস্তক সমালেচনা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে “বাংগালী মুসলমানের” আজন্ম লালিত একটি “ডিলেমার” কথা তুলে ধরা হয়েছিল। যেই ভাষায় এটা তখন উল্লেখ করা হয়েছিল সেটি একটু দীর্ঘ হলেও আজো প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। আমি লেখকের থিসিসের নানাদিক আলোচনার পর এক জায়গায় লিখেছিলাম, “লেখক আলোচ্য গ্রন্থে ফজলুল হকের দোদুল্যমানতাকে নানাভাবে চিত্রিত করে এক জায়গায় সিদ্ধান্তের আকারে বলেছেন-

“Indeed Fazlul Huq was the most effective representative of the Bengal Muslim Community in the sense that he reflected their terrible dilemma accurately and successfully, a dilemma which could not be resolved until one course (Pakistan) was exhausted and Bangladesh created.” (and perhaps not even then?,পৃঃ৩৪৩ )

অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়- কী ছিল সেই ডিলেমা? লেখক উত্তরে বলেছেন, যে ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদানের পরেও কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যেও অনেকেই স্বতন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারাটিকে ধরে রাখার প্রয়াস বজায় রেখেছিলেন। এখানে আবুল হাশিম ও তার অনুসারীদের বোঝানো হয়েছে। এরা মুসলিম লীগে যোগ দিলেও এরা তাদের কৃষক মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়েই তাতে যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্তরাও ছিল উঠতি ধনী পাট চাষীদেরই সন্তান। তাই তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত ধরনের “জাতীয়তাবাদ”। তারা জিন্নাহর মতো ভারতবর্ষে সকল মুসলমানই এক জাতি- একথায় বিশ্বাস করতেন না। ধর্মভিত্তিক Two Nation Theory-তে তাদের বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আবার পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষি হিন্দু মুসলমানদের একত্রে একটি জাতি হিসাবে বিবেচনা করতেও তারা শ্রেণিগত কারণে রাজি ছিলেন না। তারা ভাবতেন বাঙালি মুসলমানরা এক স্বতন্ত্র জাতি। এটা ঠিক, ধর্ম ভিত্তিক জাতি ছিল না আবার পুরোপুরি ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিও সেটা ছিল না। ছিল শ্রেণি পার্থক্য-সঞ্জাত এক কঠিন বাস্তবতার সাময়িক প্রতিফলন ছাত্র। তবে লেখকের প্রশ্ন হচ্ছে তা কি সাময়িক না কি আত্যন্তিক (Intrinsic)। আর এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে লেখকের মতে এটা ছিল সাময়িক- আত্যন্তিক নয়। তাই “পূর্ব পাকিস্তান” হয়ে যাওয়ার পর মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুললিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপের জন্ম হয়। এই সমস্ত ঘটনাগুলিই দ্রুত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কবর দিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিকে পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক-জনতাকে ধাবিত করেছিল। পরবর্তীতে মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু এখন ইতিহসকে আবার পেছন দিকে টানা হচ্ছে, যদিও বর্তমানে এক ধরনের সমঝোতায় বাংলাদেশবাসী পৌঁছেছেন- যার মর্মবাণী হচ্ছে, জাতি হিসাবে আমরা বাঙালি; তবে আমরা ভারতীয় বাঙালি নই। আমরা বাংলাদেশি বাঙালি। কিন্তু এর এক ধাপ উপরে উঠে আমাদের আজ বলা দরকার আমরা সকল প্রকার ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধেও থাকবো। বাংলার গ্রামবাসীর যে আবহমান ধর্ম নিরপেক্ষ লোকজ সংস্কৃতি রয়েছে- তা সমাজে প্রসারিত করে আমাদের আজকের পরিচয় হবে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ আউল-বাউলের দেশ বাংলাদেশের বাঙালি জাতি। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। এখানে অন্য পাহাড়ি জাতিরাও রয়েছেন। এখানে সকল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে আমরা সহজ কথায়-বার্তায়-মমতায় জড়িয়ে ধরি, দেই সকলকে তার প্রাপ্য মানসিক মর্যাদা, স্বীকৃতি ও প্রীতিবন্ধন। বাঙালি জাতির নানা বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আন্তরিক-সামাজিক সম্প্রীতির বৈশিষ্ট্যকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশকে সামনে রেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

“বাংলাদেশের ইতিহাস খ-তার ইতিহাস। পূর্বঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বারেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না। তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। এতকাল আমাদের বাঙালি বলা হযেছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বঙ্গে থাকি। শাসনকর্তারা বাংলা প্রদেশের অংশ-প্রত্যংশ অন্য প্রদেশে জুড়ে দিয়েছেন, কিন্তু ভাষাটাকে ছেঁটে ফেলতে পারেননি।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “বাংলাভাষা পরিচয়”, রবীন্দ্র রচনাবলী-৩, পুনর্মুদ্রণ; কলিকাতা, ১৯৫৭, পৃঃ ৫৫৯-৭৮, উদ্ধৃত হয়েছে, আনিসুজ্জামান, বাঙালি ও বাংলাদেশ, শব্দগ্রন্থন প্রকাশনালয়, কলকাতা, কার্তিক, ১৪২৪, ২য় মুদ্রণ পৃ: ১৬।)

back to top