নিশীথ রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যখন রক্তের স্রোত বয়ে যায়, তখন নিরবতা ভেদ করে লেখা হচ্ছিল ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়। সময়টা ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে সর্বত্র। ধ্বংস, আতঙ্ক আর কান্নায় প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে অসংখ্য জীবন। সেই সময়েই রাবির বধ্যভূমি সাক্ষী হয় এক নিঃশব্দ বিপ্লবীর রক্তাক্ত যাত্রাপথের।
বহুবার আবেদন করেছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার সামনে হাজির হয়েছে ঘুষের দেয়াল। আত্মসম্মান ছিল তার একমাত্র পুঁজি। তাই মাথা নত করেননি। যার ফলে আজও তার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গেটের পাশে একটি ছোট চায়ের দোকান চালান মকবুল হোসেন। প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী সেখানে আসে, আড্ডা দেয়, চা খায়। কিন্তু তারা জানে না এই দোকানদারই একদিন মৃত্যুকে হার মানিয়ে ফিরেছিলেন রক্তাক্ত বধ্যভূমি থেকে
তিনি মকবুল হোসেন। পেশায় ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিফোন অফিস সহকারী। কিন্তু সময় তাকে পরিণত করে এক গোপন মুক্তিযোদ্ধায়। বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক অধ্যাপকের উৎসাহে তিনি যুক্ত হন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের দায়িত্বে। নিভৃতে, নিঃশব্দে, জীবন বাজি রেখে তিনি পাঠাতেন খবর। রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে হয়ে উঠেন স্বাধীনতার এক নীরব কা-ারি।
কিন্তু সব গোপনই চিরকাল গোপন থাকে না। ১৭ আগস্ট ১৯৭১, বিকেলবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট থেকে পাক হানাদার বাহিনী তাকে ধরে ফেলে। নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বধ্যভূমিতে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেন, একে একে গলাকাটা হচ্ছে নিরীহ মানুষদের। এক সময় আসে তার পালাও। গলার গভীরে ছুরি চালায় হানাদাররা। রক্তে ভেসে যায় শরীর। অচেতন দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় সীমান্তঘেঁষা একটি খালে।
কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মকবুল হোসেন। পরদিন যখন তার জ্ঞান ফেরে, চারদিকে ছড়িয়ে শতাধিক লাশ। বুকভরা বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেন অজানার দিকে। ভাগ্য সহায়, টহলরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সামনে পড়ে যান। তারা তাকে সীমান্ত পার করে নিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা। মৃত্যুর মুখ থেকে টেনে আনা হয় এক সম্ভাবনাময় প্রাণ।
দেশ স্বাধীন হয়। মকবুল হোসেন ফিরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ছুটে যান নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে গিয়েই জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন তার বাবা। জীবিকার তাগিদে আবার ফিরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু করেন ক্যাফেটেরিয়ায় ওয়ার্ড বয়ের কাজ। এরপর প্রহরীর দায়িত্বও পালন করেন বিভিন্ন হলে।
কিন্তু দুঃখ তাকে পিছু ছাড়ে না। কয়েক বছরের মধ্যে স্ত্রী মারা যান। এরপর বড় ছেলের অকাল মৃত্যু হয়। যিনি পড়তেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। একে একে নেমে আসে জীবনের নির্মম ধস। শরীরের গলার ক্ষত তখনো রয়ে যায়, কিন্তু গভীরতর ক্ষত জমে ওঠে হৃদয়ে।
সেই মানুষ বহুবার আবেদন করেছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার সামনে হাজির হয়েছে ঘুষের দেয়াল। আত্মসম্মান ছিল তার একমাত্র পুঁজি। তাই মাথা নত করেননি। যর ফলে আজও তার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গেটের পাশে একটি ছোট চায়ের দোকান চালান মকবুল হোসেন। প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী সেখানে আসে, আড্ডা দেয়, চা খায়। কিন্তু তারা জানে না এই দোকানদারই একদিন মৃত্যুকে হার মানিয়ে ফিরেছিলেন রক্তাক্ত বধ্যভূমি থেকে।
মকবুল হোসেন বলেন, ‘গলা কেটে ফেলা হয়েছিল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি দেশের জন্য। আজ কেউ জানতে চায় না আমি কে ছিলাম, শুধু জিজ্ঞেস করে, চায়ের দাম কত?’
চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেন, আর চোখে জমে থাকে এক প্রশ্ন ‘এই দেশ কি তার ত্যাগকে মনে রাখবে?’
এই প্রশ্ন শুধু মকবুল হোসেনের নয় এটা হাজারো অবহেলিত বীরের, যাদের রক্তে গড়া এই স্বাধীনতা, কিন্তু যাদের নাম নেই কোনো স্মৃতিসৌধে।
মকবুল হোসেন এক জীবন্ত স্মারক। তিনি কেবল ইতিহাস নন তিনি আমাদের বিবেকের আয়নাও। হয়তো একদিন রাষ্ট্র তার কাছে ক্ষমা চাইবে, অথবা... চায়ের কাপে জমে থাকা চিনি গলেই মিশে যাবে তার বিস্মৃত ত্যাগের গল্পে।
সময়ের সঙ্গে মানুষ ভুলে যায়। মকবুল হোসেন হয়তো একদিন আর থাকবেন না। কিন্তু তার এত মানুষ না থাকলে, স্বাধীনতার বয়ানও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
রোববার, ২২ জুন ২০২৫
নিশীথ রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যখন রক্তের স্রোত বয়ে যায়, তখন নিরবতা ভেদ করে লেখা হচ্ছিল ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়। সময়টা ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে সর্বত্র। ধ্বংস, আতঙ্ক আর কান্নায় প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে অসংখ্য জীবন। সেই সময়েই রাবির বধ্যভূমি সাক্ষী হয় এক নিঃশব্দ বিপ্লবীর রক্তাক্ত যাত্রাপথের।
বহুবার আবেদন করেছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার সামনে হাজির হয়েছে ঘুষের দেয়াল। আত্মসম্মান ছিল তার একমাত্র পুঁজি। তাই মাথা নত করেননি। যার ফলে আজও তার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গেটের পাশে একটি ছোট চায়ের দোকান চালান মকবুল হোসেন। প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী সেখানে আসে, আড্ডা দেয়, চা খায়। কিন্তু তারা জানে না এই দোকানদারই একদিন মৃত্যুকে হার মানিয়ে ফিরেছিলেন রক্তাক্ত বধ্যভূমি থেকে
তিনি মকবুল হোসেন। পেশায় ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিফোন অফিস সহকারী। কিন্তু সময় তাকে পরিণত করে এক গোপন মুক্তিযোদ্ধায়। বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক অধ্যাপকের উৎসাহে তিনি যুক্ত হন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের দায়িত্বে। নিভৃতে, নিঃশব্দে, জীবন বাজি রেখে তিনি পাঠাতেন খবর। রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে হয়ে উঠেন স্বাধীনতার এক নীরব কা-ারি।
কিন্তু সব গোপনই চিরকাল গোপন থাকে না। ১৭ আগস্ট ১৯৭১, বিকেলবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট থেকে পাক হানাদার বাহিনী তাকে ধরে ফেলে। নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বধ্যভূমিতে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেন, একে একে গলাকাটা হচ্ছে নিরীহ মানুষদের। এক সময় আসে তার পালাও। গলার গভীরে ছুরি চালায় হানাদাররা। রক্তে ভেসে যায় শরীর। অচেতন দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় সীমান্তঘেঁষা একটি খালে।
কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মকবুল হোসেন। পরদিন যখন তার জ্ঞান ফেরে, চারদিকে ছড়িয়ে শতাধিক লাশ। বুকভরা বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেন অজানার দিকে। ভাগ্য সহায়, টহলরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সামনে পড়ে যান। তারা তাকে সীমান্ত পার করে নিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা। মৃত্যুর মুখ থেকে টেনে আনা হয় এক সম্ভাবনাময় প্রাণ।
দেশ স্বাধীন হয়। মকবুল হোসেন ফিরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ছুটে যান নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে গিয়েই জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন তার বাবা। জীবিকার তাগিদে আবার ফিরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু করেন ক্যাফেটেরিয়ায় ওয়ার্ড বয়ের কাজ। এরপর প্রহরীর দায়িত্বও পালন করেন বিভিন্ন হলে।
কিন্তু দুঃখ তাকে পিছু ছাড়ে না। কয়েক বছরের মধ্যে স্ত্রী মারা যান। এরপর বড় ছেলের অকাল মৃত্যু হয়। যিনি পড়তেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। একে একে নেমে আসে জীবনের নির্মম ধস। শরীরের গলার ক্ষত তখনো রয়ে যায়, কিন্তু গভীরতর ক্ষত জমে ওঠে হৃদয়ে।
সেই মানুষ বহুবার আবেদন করেছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার সামনে হাজির হয়েছে ঘুষের দেয়াল। আত্মসম্মান ছিল তার একমাত্র পুঁজি। তাই মাথা নত করেননি। যর ফলে আজও তার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গেটের পাশে একটি ছোট চায়ের দোকান চালান মকবুল হোসেন। প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী সেখানে আসে, আড্ডা দেয়, চা খায়। কিন্তু তারা জানে না এই দোকানদারই একদিন মৃত্যুকে হার মানিয়ে ফিরেছিলেন রক্তাক্ত বধ্যভূমি থেকে।
মকবুল হোসেন বলেন, ‘গলা কেটে ফেলা হয়েছিল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি দেশের জন্য। আজ কেউ জানতে চায় না আমি কে ছিলাম, শুধু জিজ্ঞেস করে, চায়ের দাম কত?’
চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেন, আর চোখে জমে থাকে এক প্রশ্ন ‘এই দেশ কি তার ত্যাগকে মনে রাখবে?’
এই প্রশ্ন শুধু মকবুল হোসেনের নয় এটা হাজারো অবহেলিত বীরের, যাদের রক্তে গড়া এই স্বাধীনতা, কিন্তু যাদের নাম নেই কোনো স্মৃতিসৌধে।
মকবুল হোসেন এক জীবন্ত স্মারক। তিনি কেবল ইতিহাস নন তিনি আমাদের বিবেকের আয়নাও। হয়তো একদিন রাষ্ট্র তার কাছে ক্ষমা চাইবে, অথবা... চায়ের কাপে জমে থাকা চিনি গলেই মিশে যাবে তার বিস্মৃত ত্যাগের গল্পে।
সময়ের সঙ্গে মানুষ ভুলে যায়। মকবুল হোসেন হয়তো একদিন আর থাকবেন না। কিন্তু তার এত মানুষ না থাকলে, স্বাধীনতার বয়ানও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।