চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সেবা ও বেসরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা।
আজ (১৫ সেপ্টেম্বর) বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তিনটি খসড়া আইন পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে দাঁড়িয়ে তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হন।
তাদের বক্তব্যে প্রশ্ন উঠে আসে, চিকিৎসকরা কেন রাজনীতি করবে? প্রশ্ন উঠেছে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়েও। বেসরকরি হাসপাতালগুলোয় রোগী চিকিৎসার বিল দিতে না পারায় আটকে রাখে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
পরে সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের অনেক সদস্যই মন্ত্রীকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করেন পাশ থেকে।
আজ বুধবার সংসদে ‘মেডিকেল ডিগ্রিস (রিপিল) বিল-২০২১’ এবং ‘মেডিকেল কলেজ (গভর্নিং বডিস) (রিপিল) বিল-২০২১’ পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, “বিএনপি করে গিয়েছিল ড্যাব, আওয়ামী লীগ এসে করেছে স্বাচিপ। সেক্ষেত্রে আমরা কী কারণে বসে থাকছি? এই আইনের মধ্যে যদি উনি আনতেন, যে ডাক্তাররা এবং বৈজ্ঞানিকরা রাজনীতি করতে পারবে না, তাহলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেটা আনা হয় নাই।
“ডাক্তাররা যদি এই দেশে রাজনীতি করে, তাহলে আমরা কি করব? আমাদের কাজটা কী? উনারা চলে আসুক রাজনীতি করতে। যারা ভালো ছাত্র তারা ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করে তাহলে আমরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছি।”
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, “বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বেহাল দশা, দেশের পঞ্চশ বছর অতিক্রম করেছি, আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারি নাই। যারা আজকে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত, তারাই আজকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছে।”
তিনি বলেন, “এতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এইগুলো মানসম্মত? আজকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যারা শিক্ষা অর্জন করছে, তারা কয়জন বিসিএসে টিকছে? ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?”
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, “দেশ যায় কোন দিকে, মানুষের সমস্যা যায় কোন দিকে, মানুষ কোন বিষয় নিয়ে সাফার করছে, আর আমরা আলোচনা করছি কী? অদ্ভুত লাগে! করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে কতগুলো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেছে সেই খবর কী আমাদের কাছে আছে? করোনাকালে হাতে গোনা কিছু রিপোর্ট আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনায় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “অনেকে প্রাণে হয়ত বেঁচে গেছে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। জমানো টাকা শেষ হওয়া থেকে শুরু করে বিরাট ঋণের জালে আটকা পড়েছে বহু মানুষ। করোনার আগে যেখানে মধ্যবিত্ত ছিল ৭০ শতাংশ, সেখানে মধ্যবিত্ত নেমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। দরিদ্র মানুষ যেখানে ছিল ২০ শতাংশ, সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। করোনাকাল বলে হয়ত এ ব্যাপারে মিডিয়ার কিছুটা মনযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেলে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ইতিহাস কিন্তু নতুন কিছু নয়।”
বিএনপির মোশারফ হোসেন বলেন, “চিকিৎসকরা রাজনীতি করছেন। আমরা রাজনীতি করি রাজনীতিবিদের জায়গায় থাকব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার জায়গায় থাকবে। ডাক্তাররা ডাক্তারদের জায়গায় থাকবে। সেই জায়গাগুলোকে রিপেয়ার করা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো- তারা কিছু যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে টাকা রোজগারের একটি পথ খুলে নিয়েছে, সেখানে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।”
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “অ্যাডমিন ক্যাডারের লোক, জজ বা পুলিশ ক্যাডারের লোক তারা তো চাকরি করে প্রাইভেট কোনো বিষয়ে কনসালটেন্সি তারা করতে পারবেন না। ডাক্তার সাহেবরা কেন বিসিএস অফিসার হয়ে ডিউটির পর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে? সেক্ষেত্রে তার যে মূল কাজ সেটা ঠিক থাকে না। এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা।
“মন্ত্রীকে বলব, যদি উপকার করতে চান, তাহলে ডাক্তার সাহেবদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা আপনারা দয়া করে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। জনগণের পয়সা দিয়ে তাদের বেতন দেবেন, তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন, এটা আমরা করতে পারি না। ভর্তির জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কয়েক লাখ টাকা নেয় আন-অফিশিয়ালি। অন্যায়ভাবে এত টাকা নিচ্ছে।”
মুজিবুল হক এই বিল আনার চেয়ে ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে’ মন্তব্য করে বলেন, “টিকা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু করতে পারেনি। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে একটি রোডম্যাপ হয়েছে। সবক্ষেত্রে কেন প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে?”
একটি কমিটি করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার জন্য খরচের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি তোলেন এই সংসদ সদস্য।
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, “বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। টেকনোলজিস্টের ব্যাপক সংকট। ২০২০ সালের পরীক্ষার ফলাফল এখনও দেওয়া হয়নি। অনেক মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক এয়ারপোর্টে পিসিআর ল্যাব দিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পরও প্রবাসীদের ঘেরাও করতে হয়েছে।”
তবে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকরা সুযোগ সুবিধায় ‘অনেক পিছিয়ে আছেন’ মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা ক্যাডার সার্ভিস করতে হবে। আলাদা পে স্ট্রাকচার করতে হবে। তাহলে তাদের বেসরকারি প্র্যাকটিস বন্ধ করা যাবে। অথবা সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করতে হবে। ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে সেবা আদায় করা যাবে না। তাদের মোটিভেট করতে হবে।”
জবাব দিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দেশের প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ হবে। সেটা পর্যায়ক্রমে হবে। সে অনুযায়ী ৩৮টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সব জেলায় হয়ে হবে।”
তিনি বলেন, “ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। স্বাচিপ, বিএমএ রয়েছে। রাজনীতিতো সকলেই করতে পারে। প্রকৌশলী, আইনজীবীরা রাজনীতি করতে পারে। সে অনুযায়ী চিকিৎসকরা অ্যাসোসিয়েশন করলে, তাতে কোনো দোষ বা অন্যায় দেখি না। তারাতো সেবা দিচ্ছে।
“বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনার সেবা দিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসা ফি নির্ধারণে আমরা বৈঠক করছি। আশা করি সেটার সমাধান হবে। বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবেন। আর বিমানবন্দর জায়গা দেবে। আমরা শুধু কারিগরি সহযোগিতা দেব। আমরা শুনেছি দুই একদিনের মধ্যে বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হবে।”
স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি হয়েছে দাবি করে জাহিদ মালেক বলেন, “করোনার সময় কেউ বাইরে যেতে পারেননি। সবাই দেশেই ছিলেন। কোভিড, নন-কোভিড সব চিকিৎসা দেশে হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায় হাসপাতালের অবস্থা ভালো।”
সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন সমালোচনার জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “মাননীয় সদস্যদের ধন্যবাদ। উনারা বেশ এনার্জি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন। চালিয়ে যান, আমিও চালিয়ে যাব আপনাদের সাথে। কাজেই কোনো অসুবিধা হবে না। আপনারা দোষ ত্রুটি খুঁজে পাবেনই। সমুদ্রের মধ্যে দুই বালতি ময়লা ফেললে সমুদ্র নষ্ট হয়ে যাবে না, পানি নষ্ট হয়ে যাবে না।”
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারের সময়ে আমরা কী করেছি স্বাস্থ্যখাতে আর আপনারা কী করেছেন এ বিষয়টি একটু তুলে ধরতে চাই জনগণের সামনে।
“আমরা জানি আপনারা কী বলতে পারেন। তাই আজকে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। সারাদিন লাগবে। কমিউনিটি ক্লিনিক ১৪ হাজার ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, যেখানে ৩০ রকমের ওষুধ ফ্রি দেওয়া হত। স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। আপনারা এসে ওটাকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটা হলো স্বাস্থ্যসেবায় আপনাদের ব্যবস্থা।”
অন্যদিকে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “আপনাদের সময় কী হয়েছে আমরা জানি না।”
সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা এ সময় টেবিল চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন’।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী পরে বলেন, “আপনাদের সময় দুর্নীতির কারণে মানুষ মারা গেছে, গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আমরাতো উন্নয়ন করে পুরস্কার পেয়েছি। আর আপনারা পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। আমরা আর কিছু বলতে চাই না। আপনাদের বিষয়ে বলতে গেলে আমার সময় শেষ হয়ে যাবে। আজকে পার্লামেন্টে জমছে ভালো। আপনারা কথা বলবেন আমরাও কথার উত্তর দেব।”
পরে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বলেন, “বিএনপির সময় কি কোনো হাসপাতালে ৩৮ লাখ টাকা দিয়ে পর্দা কেনা হয়েছিল? এই ধরনের কোনো ঘটনা আছে? আজকে গত দশ বছরে যে হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ব্যবস্থা আছে?”
তিনি বলেন, “পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, উনি তথ্য দিতে পারবেন যে কত লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়েছে? এই কথাগুলো আলোচনায় নিয়ে আসেন। এই কথাগুলোর যদি সদুত্তর দিতে পারেন, তাহলে আমি মনে করবৃ।”
বিএনপির এই সাংসদ বলেন, “আজকে সরকার দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়াচ্ছেন যে বিএনপি চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। আজকে আমরা লজ্জায় এই গত ১২ বছরে ১০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে এই বিষয়গুলো অহেতুক দোষারোপ না করে আমরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। গণতন্ত্রের যে সঙ্কট চলছে, গণতন্ত্রের যে সঙ্কট দাঁড়িয়ে গেছে, এই সঙ্কট থেকে আমরা কীভাবে বেরিয়ে আসব, মানুষের ভোটাধিকার আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, এই সঙ্কটগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি।”
পরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট বিল পাসের প্রক্রিয়ার সময় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা আবারও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকা-ের সমালোচনা করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “আমি সমালোচনা পছন্দ করি। কারণ এটা আমাকে শক্তিশালী করে। এই সমালোচনা অবশ্যই সঠিক হতে হবে।”
বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সেবা ও বেসরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা।
আজ (১৫ সেপ্টেম্বর) বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তিনটি খসড়া আইন পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে দাঁড়িয়ে তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর হন।
তাদের বক্তব্যে প্রশ্ন উঠে আসে, চিকিৎসকরা কেন রাজনীতি করবে? প্রশ্ন উঠেছে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়েও। বেসরকরি হাসপাতালগুলোয় রোগী চিকিৎসার বিল দিতে না পারায় আটকে রাখে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
পরে সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের অনেক সদস্যই মন্ত্রীকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করেন পাশ থেকে।
আজ বুধবার সংসদে ‘মেডিকেল ডিগ্রিস (রিপিল) বিল-২০২১’ এবং ‘মেডিকেল কলেজ (গভর্নিং বডিস) (রিপিল) বিল-২০২১’ পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, “বিএনপি করে গিয়েছিল ড্যাব, আওয়ামী লীগ এসে করেছে স্বাচিপ। সেক্ষেত্রে আমরা কী কারণে বসে থাকছি? এই আইনের মধ্যে যদি উনি আনতেন, যে ডাক্তাররা এবং বৈজ্ঞানিকরা রাজনীতি করতে পারবে না, তাহলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেটা আনা হয় নাই।
“ডাক্তাররা যদি এই দেশে রাজনীতি করে, তাহলে আমরা কি করব? আমাদের কাজটা কী? উনারা চলে আসুক রাজনীতি করতে। যারা ভালো ছাত্র তারা ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করে তাহলে আমরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছি।”
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, “বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বেহাল দশা, দেশের পঞ্চশ বছর অতিক্রম করেছি, আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারি নাই। যারা আজকে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত, তারাই আজকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছে।”
তিনি বলেন, “এতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এইগুলো মানসম্মত? আজকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যারা শিক্ষা অর্জন করছে, তারা কয়জন বিসিএসে টিকছে? ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?”
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, “দেশ যায় কোন দিকে, মানুষের সমস্যা যায় কোন দিকে, মানুষ কোন বিষয় নিয়ে সাফার করছে, আর আমরা আলোচনা করছি কী? অদ্ভুত লাগে! করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে কতগুলো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেছে সেই খবর কী আমাদের কাছে আছে? করোনাকালে হাতে গোনা কিছু রিপোর্ট আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনায় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “অনেকে প্রাণে হয়ত বেঁচে গেছে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। জমানো টাকা শেষ হওয়া থেকে শুরু করে বিরাট ঋণের জালে আটকা পড়েছে বহু মানুষ। করোনার আগে যেখানে মধ্যবিত্ত ছিল ৭০ শতাংশ, সেখানে মধ্যবিত্ত নেমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। দরিদ্র মানুষ যেখানে ছিল ২০ শতাংশ, সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। করোনাকাল বলে হয়ত এ ব্যাপারে মিডিয়ার কিছুটা মনযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেলে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ইতিহাস কিন্তু নতুন কিছু নয়।”
বিএনপির মোশারফ হোসেন বলেন, “চিকিৎসকরা রাজনীতি করছেন। আমরা রাজনীতি করি রাজনীতিবিদের জায়গায় থাকব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার জায়গায় থাকবে। ডাক্তাররা ডাক্তারদের জায়গায় থাকবে। সেই জায়গাগুলোকে রিপেয়ার করা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো- তারা কিছু যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে টাকা রোজগারের একটি পথ খুলে নিয়েছে, সেখানে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।”
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “অ্যাডমিন ক্যাডারের লোক, জজ বা পুলিশ ক্যাডারের লোক তারা তো চাকরি করে প্রাইভেট কোনো বিষয়ে কনসালটেন্সি তারা করতে পারবেন না। ডাক্তার সাহেবরা কেন বিসিএস অফিসার হয়ে ডিউটির পর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে? সেক্ষেত্রে তার যে মূল কাজ সেটা ঠিক থাকে না। এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা।
“মন্ত্রীকে বলব, যদি উপকার করতে চান, তাহলে ডাক্তার সাহেবদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা আপনারা দয়া করে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। জনগণের পয়সা দিয়ে তাদের বেতন দেবেন, তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন, এটা আমরা করতে পারি না। ভর্তির জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কয়েক লাখ টাকা নেয় আন-অফিশিয়ালি। অন্যায়ভাবে এত টাকা নিচ্ছে।”
মুজিবুল হক এই বিল আনার চেয়ে ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে’ মন্তব্য করে বলেন, “টিকা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু করতে পারেনি। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে একটি রোডম্যাপ হয়েছে। সবক্ষেত্রে কেন প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে?”
একটি কমিটি করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার জন্য খরচের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি তোলেন এই সংসদ সদস্য।
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, “বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। টেকনোলজিস্টের ব্যাপক সংকট। ২০২০ সালের পরীক্ষার ফলাফল এখনও দেওয়া হয়নি। অনেক মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক এয়ারপোর্টে পিসিআর ল্যাব দিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পরও প্রবাসীদের ঘেরাও করতে হয়েছে।”
তবে সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকরা সুযোগ সুবিধায় ‘অনেক পিছিয়ে আছেন’ মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা ক্যাডার সার্ভিস করতে হবে। আলাদা পে স্ট্রাকচার করতে হবে। তাহলে তাদের বেসরকারি প্র্যাকটিস বন্ধ করা যাবে। অথবা সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করতে হবে। ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে সেবা আদায় করা যাবে না। তাদের মোটিভেট করতে হবে।”
জবাব দিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দেশের প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ হবে। সেটা পর্যায়ক্রমে হবে। সে অনুযায়ী ৩৮টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সব জেলায় হয়ে হবে।”
তিনি বলেন, “ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। স্বাচিপ, বিএমএ রয়েছে। রাজনীতিতো সকলেই করতে পারে। প্রকৌশলী, আইনজীবীরা রাজনীতি করতে পারে। সে অনুযায়ী চিকিৎসকরা অ্যাসোসিয়েশন করলে, তাতে কোনো দোষ বা অন্যায় দেখি না। তারাতো সেবা দিচ্ছে।
“বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনার সেবা দিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসা ফি নির্ধারণে আমরা বৈঠক করছি। আশা করি সেটার সমাধান হবে। বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবেন। আর বিমানবন্দর জায়গা দেবে। আমরা শুধু কারিগরি সহযোগিতা দেব। আমরা শুনেছি দুই একদিনের মধ্যে বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হবে।”
স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি হয়েছে দাবি করে জাহিদ মালেক বলেন, “করোনার সময় কেউ বাইরে যেতে পারেননি। সবাই দেশেই ছিলেন। কোভিড, নন-কোভিড সব চিকিৎসা দেশে হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায় হাসপাতালের অবস্থা ভালো।”
সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন সমালোচনার জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “মাননীয় সদস্যদের ধন্যবাদ। উনারা বেশ এনার্জি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন। চালিয়ে যান, আমিও চালিয়ে যাব আপনাদের সাথে। কাজেই কোনো অসুবিধা হবে না। আপনারা দোষ ত্রুটি খুঁজে পাবেনই। সমুদ্রের মধ্যে দুই বালতি ময়লা ফেললে সমুদ্র নষ্ট হয়ে যাবে না, পানি নষ্ট হয়ে যাবে না।”
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারের সময়ে আমরা কী করেছি স্বাস্থ্যখাতে আর আপনারা কী করেছেন এ বিষয়টি একটু তুলে ধরতে চাই জনগণের সামনে।
“আমরা জানি আপনারা কী বলতে পারেন। তাই আজকে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। সারাদিন লাগবে। কমিউনিটি ক্লিনিক ১৪ হাজার ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, যেখানে ৩০ রকমের ওষুধ ফ্রি দেওয়া হত। স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। আপনারা এসে ওটাকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটা হলো স্বাস্থ্যসেবায় আপনাদের ব্যবস্থা।”
অন্যদিকে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “আপনাদের সময় কী হয়েছে আমরা জানি না।”
সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা এ সময় টেবিল চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন’।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী পরে বলেন, “আপনাদের সময় দুর্নীতির কারণে মানুষ মারা গেছে, গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আমরাতো উন্নয়ন করে পুরস্কার পেয়েছি। আর আপনারা পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। আমরা আর কিছু বলতে চাই না। আপনাদের বিষয়ে বলতে গেলে আমার সময় শেষ হয়ে যাবে। আজকে পার্লামেন্টে জমছে ভালো। আপনারা কথা বলবেন আমরাও কথার উত্তর দেব।”
পরে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বলেন, “বিএনপির সময় কি কোনো হাসপাতালে ৩৮ লাখ টাকা দিয়ে পর্দা কেনা হয়েছিল? এই ধরনের কোনো ঘটনা আছে? আজকে গত দশ বছরে যে হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ব্যবস্থা আছে?”
তিনি বলেন, “পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, উনি তথ্য দিতে পারবেন যে কত লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়েছে? এই কথাগুলো আলোচনায় নিয়ে আসেন। এই কথাগুলোর যদি সদুত্তর দিতে পারেন, তাহলে আমি মনে করবৃ।”
বিএনপির এই সাংসদ বলেন, “আজকে সরকার দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়াচ্ছেন যে বিএনপি চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। আজকে আমরা লজ্জায় এই গত ১২ বছরে ১০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে এই বিষয়গুলো অহেতুক দোষারোপ না করে আমরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। গণতন্ত্রের যে সঙ্কট চলছে, গণতন্ত্রের যে সঙ্কট দাঁড়িয়ে গেছে, এই সঙ্কট থেকে আমরা কীভাবে বেরিয়ে আসব, মানুষের ভোটাধিকার আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, এই সঙ্কটগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি।”
পরে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট বিল পাসের প্রক্রিয়ার সময় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা আবারও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকা-ের সমালোচনা করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “আমি সমালোচনা পছন্দ করি। কারণ এটা আমাকে শক্তিশালী করে। এই সমালোচনা অবশ্যই সঠিক হতে হবে।”