পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর আজ
বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। একক কোনো ঘটনায় এত সামরিক কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের ইতিপূর্বে পৃথিবীর আর কোথাও না ঘটায় আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন ফেলেছিল এটি। অথচ এত বছরেও অন্ধকারেই রয়ে গেছে হত্যার আসল রহস্য। অধরাই রয়ে গেছে নেপথ্যেও যড়যন্ত্রকারীরা। এমনকি দীর্ঘ সময়েও হত্যাকারীদেরও বিচার নিশ্চিত হয়নি। ধুঁকছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটিও। তবে, পটপরিবর্তনের পর বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠন হওয়ায় সত্য উন্মোচনে আশার আলো দেখছেন ‘শহিদদের’ স্বজনরা। কমিশনের তদন্ত শেষ হওয়ার পর সেটি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তারা।
পাশাপাশি ‘শহিদদের’ স্বজনদের অভিযোগ করেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যের পরিকল্পনকারী ও খলনায়কদের রক্ষা করতে মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। অথচ পুরো হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে- তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, মির্জা আযম, তোরাফ আলীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানেরা। যাদের অনেকেই বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের দেশে ফেরত এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিও জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন ‘শহিদদের’ পরিবার। পাশাপাশি ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ এটি তদন্ত করে হত্যাযজ্ঞের নীলনকশার সঙ্গে জড়িতদের নাম ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। পাশাপাশি তাদের তদন্তের ক্ষেত্রে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি, সামরিক বাহিনী, র?্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, ডিজিএফআই, এনএসআই, হুকুমদাতা, সামরিক অপারেশনে বাধাদানকারী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিদেশি সংশ্লিষ্টতা এবং একই সঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তদন্তের বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনে’র সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। তদন্ত শেষ হলে গোটা জাতি এ বিষয়ে জানতে পারবে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের যারা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। যেহেতু ঘটনাটি কমিশন তদন্ত করছে এই নেপথ্যের খলনায়কদের যেন জাতির সামনে আনা হয়। আমরা ইতোমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছি। তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাবা-মাকে এভাবে নির্মমভাবে হারানোর ট্রমা থেকে বের হতে পারি না এখনো। এখনও ভেঙে পড়ি। বাবা-মায়ের স্মৃতিগুলো মনে আগলে বেঁচে আছি। এমন নির্মম ও বর্বরতার ঘটনা আর কারো জীবনে না আসুক।
এ ঘটনায় নির্মমভাবে নিহত কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী মেহরিন ফেরদৌসী বলেন, আমাদের তিনটি চাওয়া ছিল। ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করা, দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা ও শহীদদের মর্যাদা। দিনটিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় আমরা আনন্দিত। তবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে- তাদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে ষড়যন্ত্র করেছে- তাদের বিচারের আওতায় সর্বাত্মক গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা শহিদ হয়েছেন তাদের সবার পরিবারই ২৫ ফেব্রুয়ারিকে বিশেষভাবে পালন করে। এজন্য সম্প্রতি আমরা ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’ করেছি। আজ মঙ্গলবার সকালে আমরা বনানী সামরিক কবরস্থানে গিয়ে পুষ্পস্তাবক অর্পণ করে ‘শহীদদের’ শ্রদ্ধা জানাবো। এরপর রাওয়া ক্লাবে একটি শোকসভা করা হবে। পরে মিরপুর-২ নম্বরের একটি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার স্বামী সবসময় আমার সঙ্গে থাকেন। আমি সবাইকে বলি আমাকে অর্ধেক মেহরিন অর্ধেক মুজিব হিসেবে দেখতে। এভাবেই বেঁচে থাকবো আমৃত্যু।
নিহত কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে আইনজীবী সাকিব রহমান বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের প্রাণের দাবি। যেহেতু সম্প্রতি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় কোনো বিচারিক ত্রুটি ছিল না, সেহেতু আমরা চাইব হত্যা মামলার আসামিদের যেন জামিন দেয়া না হয়। পাশাপাশি নেপথ্য নায়কদের আইনের আনা হয়। জানা গেছে, ‘২০০৯ সালের এই দিনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল কিছু বিপথগামী সৈনিক। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) (তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর) সদরদপ্তরে তারা ধ্বংসলীলা চালায়। তাদের সেই উন্মত্ততার শিকার হয়ে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং নারী, শিশুসহ আরও ১৭ জন।’ ঘটনার দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিডিআর দরবার হলে বার্ষিক (দরবার) নির্ধারিত সভায় বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একদল বিদ্রোহী সৈনিক তাদের মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। মহাপরিচালকসহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের পরিবারকে জিম্মি করে। পিলখানার চারটি মূল ফটকই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকে তারা। জন্ম নেয় ইতিহাসের এক বীভৎস অধ্যায়ের। টানা ৩৬ ঘণ্টা পর এই বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও ততক্ষণে বিদ্রোহী সৈনিকেরা কেড়ে নেয় ৫৭ জন দক্ষ সেনা কর্মকর্তার জীবন। পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরও ২২৮ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। তবে হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। ফলে হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে, হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। এদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম একপ্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ, যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়। এ ছাড়া বিজিবির নিজস্ব আইনে ৫৭টি মামলার বিচার শেষে সারাদেশে ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিডিআর গ্রেপ্তার জওয়ানদের নিরপরাধ বলে দাবি করেন তাদের স্বজনেরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ কারাগারের অস্থায়ী আদালতে ঢাকার বিশেষ ট্রাইবুন্যাল-২-এর বিচারক ইব্রাহীম মিয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জামিন শুনানি শেষে বিস্ফোরক মামলার আসামিদের জামিনে মুক্তির আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, যারা বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল নেই, তারা জামিনে মুক্তি পাবেন। একইভাবে হত্যা মামলায় এরই মধ্যে যাদের সাজাভোগ সম্পন্ন হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি উচ্চ আদালতে আপিল না থাকে, তাহলে তারাও মুক্ত হবেন। তবে কতজন মুক্তি পাচ্ছেন, তা আদেশের দিন নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। শর্তাবলি পর্যালোচনা করে গত ২২ জানুয়ারি ১৭৮ জনের জামিননামা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। পরদিন ২৩ জানুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় জামিন পেয়ে ১৬ বছর পর কারামুক্ত হন ১৭৮ জন সাবেক বিডিআর সদস্য। সম্প্রতি রাজধানীর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির এক আলোচনায় অ্যাটর্নি জেনালে অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের কবর রচনা করে নৈরাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিডিআরের পোশাক পরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অংশ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আমরা জাতির সূর্যসন্তানদের হারিয়েছি। তাদের হারানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভিতকে আঘাত করা হয়েছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর আজ
সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। একক কোনো ঘটনায় এত সামরিক কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের ইতিপূর্বে পৃথিবীর আর কোথাও না ঘটায় আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন ফেলেছিল এটি। অথচ এত বছরেও অন্ধকারেই রয়ে গেছে হত্যার আসল রহস্য। অধরাই রয়ে গেছে নেপথ্যেও যড়যন্ত্রকারীরা। এমনকি দীর্ঘ সময়েও হত্যাকারীদেরও বিচার নিশ্চিত হয়নি। ধুঁকছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটিও। তবে, পটপরিবর্তনের পর বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠন হওয়ায় সত্য উন্মোচনে আশার আলো দেখছেন ‘শহিদদের’ স্বজনরা। কমিশনের তদন্ত শেষ হওয়ার পর সেটি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তারা।
পাশাপাশি ‘শহিদদের’ স্বজনদের অভিযোগ করেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যের পরিকল্পনকারী ও খলনায়কদের রক্ষা করতে মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। অথচ পুরো হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে- তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, মির্জা আযম, তোরাফ আলীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানেরা। যাদের অনেকেই বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের দেশে ফেরত এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিও জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন ‘শহিদদের’ পরিবার। পাশাপাশি ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ এটি তদন্ত করে হত্যাযজ্ঞের নীলনকশার সঙ্গে জড়িতদের নাম ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। পাশাপাশি তাদের তদন্তের ক্ষেত্রে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি, সামরিক বাহিনী, র?্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, ডিজিএফআই, এনএসআই, হুকুমদাতা, সামরিক অপারেশনে বাধাদানকারী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিদেশি সংশ্লিষ্টতা এবং একই সঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তদন্তের বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনে’র সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। তদন্ত শেষ হলে গোটা জাতি এ বিষয়ে জানতে পারবে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের যারা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। যেহেতু ঘটনাটি কমিশন তদন্ত করছে এই নেপথ্যের খলনায়কদের যেন জাতির সামনে আনা হয়। আমরা ইতোমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছি। তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাবা-মাকে এভাবে নির্মমভাবে হারানোর ট্রমা থেকে বের হতে পারি না এখনো। এখনও ভেঙে পড়ি। বাবা-মায়ের স্মৃতিগুলো মনে আগলে বেঁচে আছি। এমন নির্মম ও বর্বরতার ঘটনা আর কারো জীবনে না আসুক।
এ ঘটনায় নির্মমভাবে নিহত কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী মেহরিন ফেরদৌসী বলেন, আমাদের তিনটি চাওয়া ছিল। ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করা, দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা ও শহীদদের মর্যাদা। দিনটিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় আমরা আনন্দিত। তবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে- তাদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে ষড়যন্ত্র করেছে- তাদের বিচারের আওতায় সর্বাত্মক গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা শহিদ হয়েছেন তাদের সবার পরিবারই ২৫ ফেব্রুয়ারিকে বিশেষভাবে পালন করে। এজন্য সম্প্রতি আমরা ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’ করেছি। আজ মঙ্গলবার সকালে আমরা বনানী সামরিক কবরস্থানে গিয়ে পুষ্পস্তাবক অর্পণ করে ‘শহীদদের’ শ্রদ্ধা জানাবো। এরপর রাওয়া ক্লাবে একটি শোকসভা করা হবে। পরে মিরপুর-২ নম্বরের একটি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার স্বামী সবসময় আমার সঙ্গে থাকেন। আমি সবাইকে বলি আমাকে অর্ধেক মেহরিন অর্ধেক মুজিব হিসেবে দেখতে। এভাবেই বেঁচে থাকবো আমৃত্যু।
নিহত কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে আইনজীবী সাকিব রহমান বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের প্রাণের দাবি। যেহেতু সম্প্রতি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় কোনো বিচারিক ত্রুটি ছিল না, সেহেতু আমরা চাইব হত্যা মামলার আসামিদের যেন জামিন দেয়া না হয়। পাশাপাশি নেপথ্য নায়কদের আইনের আনা হয়। জানা গেছে, ‘২০০৯ সালের এই দিনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল কিছু বিপথগামী সৈনিক। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) (তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর) সদরদপ্তরে তারা ধ্বংসলীলা চালায়। তাদের সেই উন্মত্ততার শিকার হয়ে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং নারী, শিশুসহ আরও ১৭ জন।’ ঘটনার দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিডিআর দরবার হলে বার্ষিক (দরবার) নির্ধারিত সভায় বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একদল বিদ্রোহী সৈনিক তাদের মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। মহাপরিচালকসহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের পরিবারকে জিম্মি করে। পিলখানার চারটি মূল ফটকই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকে তারা। জন্ম নেয় ইতিহাসের এক বীভৎস অধ্যায়ের। টানা ৩৬ ঘণ্টা পর এই বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও ততক্ষণে বিদ্রোহী সৈনিকেরা কেড়ে নেয় ৫৭ জন দক্ষ সেনা কর্মকর্তার জীবন। পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরও ২২৮ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। তবে হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। ফলে হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে, হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। এদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম একপ্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ, যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়। এ ছাড়া বিজিবির নিজস্ব আইনে ৫৭টি মামলার বিচার শেষে সারাদেশে ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিডিআর গ্রেপ্তার জওয়ানদের নিরপরাধ বলে দাবি করেন তাদের স্বজনেরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ কারাগারের অস্থায়ী আদালতে ঢাকার বিশেষ ট্রাইবুন্যাল-২-এর বিচারক ইব্রাহীম মিয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জামিন শুনানি শেষে বিস্ফোরক মামলার আসামিদের জামিনে মুক্তির আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, যারা বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল নেই, তারা জামিনে মুক্তি পাবেন। একইভাবে হত্যা মামলায় এরই মধ্যে যাদের সাজাভোগ সম্পন্ন হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি উচ্চ আদালতে আপিল না থাকে, তাহলে তারাও মুক্ত হবেন। তবে কতজন মুক্তি পাচ্ছেন, তা আদেশের দিন নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। শর্তাবলি পর্যালোচনা করে গত ২২ জানুয়ারি ১৭৮ জনের জামিননামা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। পরদিন ২৩ জানুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় জামিন পেয়ে ১৬ বছর পর কারামুক্ত হন ১৭৮ জন সাবেক বিডিআর সদস্য। সম্প্রতি রাজধানীর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির এক আলোচনায় অ্যাটর্নি জেনালে অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের কবর রচনা করে নৈরাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিডিআরের পোশাক পরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অংশ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আমরা জাতির সূর্যসন্তানদের হারিয়েছি। তাদের হারানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভিতকে আঘাত করা হয়েছে।