পুলিশ সপ্তাহের মতবিনিময় সভায় বক্তারা পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন । বক্তারা বলেছেন, জনগণ প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চাইলেও রাজনৈতিক নেতারা কখনো তা চাননি। ১৯৩০ সাল থেকে দমন করাই ছিল পুলিশের কাজ। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এ জন্য পুলিশ সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ অডিটরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ: নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সব মহানগর পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শ্রমিকনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিনে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আগে সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বিকেলে আইজিপির সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা হয়।
নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পুলিশের সাবেক দুজন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বক্তব্য দেন।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা তার আলোচনায় বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। পুলিশকে একটি দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার।
নুরুল হুদা আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে রাজনীতিবিদেরা সবকিছুর পরিবর্তন করলেন কিন্তু দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করলেন না। অথচ সেগুলো যুগের দাবি ছিল। এর মানে হলো তখনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। তিনি বলেন, ‘এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমরা একাত্তরেও দেখিনি। আমাদের যে সংবিধান আছে, সেটি অপারেশনাল করতে হলে যেসব রুলস-রেগুলেশনগুলো পরিবর্তন করা দরকার ছিল, সেগুলো আমরা করলাম না। এর মানে আমাদের কথায় বৈপরীত্য রয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে যথাযথভাবে পেশাদার করতে চাননি।’
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, পুলিশ যে একরকম অদ্ভুত অবস্থায় আছে, তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে, এর কারণ অনুসন্ধানের মতো উদার চিন্তা থাকা উচিত। পুলিশ দলীয় পুলিশ হয়ে যায়, সেটা তো বাহ্যিক। কিন্তু ভেতরে সমস্যা আছে।
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, যাকে রাষ্ট্র বলা হয়, তার একটি শাখা হলো বলপ্রয়োগ। পুলিশ যেহেতু এই বলপ্রয়োগের কাজটি করে, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ কাজটি জনপ্রিয় নয়। তবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত রাষ্ট্র ছিল বা আছে, সব কটিতেই পুলিশ লাগে। পুলিশ কথার মধ্যেই রাষ্ট্র কথাটা লুকিয়ে আছে।
বিচারব্যবস্থার কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, সেখানে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করলে সেটা আদালতের হাতে চলে যায়। প্রায়ই আমরা পুলিশের থেকে শুনেছি, আমাদের দেশের ফৌজদারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা যায় না। আদালত জামিন দিয়ে দেন, অপরাধী মুক্ত হয়ে যায়। কোনো ক্ষেত্রে নিরপরাধ শাস্তি পায়, অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এটা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।
সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবাই স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতা দিলে ভালো লাগে না। তখন গোলামি ভালো লাগে। অনেকেই গোলামি করতে চায়। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য মন্ত্রীদের বাসায় গিয়ে গোলামি করতে চায়। এ দ্বিচারিতার অবসান হওয়া উচিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আইজিপি বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান। সমাপনী বক্তব্য দেন মতবিনিময় সভা-সংক্রান্ত উপকমিটির সভাপতি ও পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল।
মতবিনিময় সভায় স্বাধীন পুলিশ কমিশনের কাঠামো এবং রূপরেখা না থাকার বিষয়গুলোও উঠে আসে। সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত এবং ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ও ‘বিচার-বিশ্লেষণ’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিল।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, এগুলো সাত দিনেই তৈরি করা যায়। বর্তমান আইজিপিও সংস্কার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কমিশন কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছে। নিরীক্ষার কথা বললেই ভয়ের বিষয়। যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষারই দরকার হয়, তাহলে এই কমিশনের দরকার ছিল কি?
নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে একটি দানবীয় বাহিনী হিসেবে পরিণত করা হয়েছে। এই মনমানসিকতা কিন্তু সহজে যায় না। আর অন্যায় আদেশ যে পুলিশ শুনবে না, সে ক্ষেত্রে অবৈধ আদেশ না মানা পুলিশ সদস্যের সুরক্ষা কোথায়? পুলিশ কর্মকর্তারা যেভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন, এটা চিন্তাও করা যায় না। প্রচুর পরিমাণে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি এখনো যে হচ্ছে না, সেই নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সূচনা বক্তব্যে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ইতিবাচক হয়, যখন মানুষ দেখে এই বাহিনী কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করছে। ‘জনতার পুলিশ’ মানে শুধু একটি পরিচয় নয়, এটি একটি দর্শন, যা নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে জনমনে আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান গড়ে তোলে।
আইজিপি বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—অস্ত্র নয়, জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রকৃত শক্তি। পুলিশ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকে, তবে তারা ভয়ের প্রতীক নয়, বরং হয়ে ওঠে ভরসার আশ্রয়স্থল। তাই পুলিশ হতে হবে এমন, যারা জনগণের জন্য, জনগণের হয়ে, জনগণের পাশে থাকবে।’
সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে দেয় না। অতীতে দেখা গেছে, রাষ্ট্র কতটা নির্লজ্জ হলে, পুলিশ সদস্যদের পদক দেওয়ার কারণ হিসেবে বিরোধী দলকে দমন করার কথা উল্লেখ করা হয়।
তিনি বলেন, পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে। যারা আন্দোলনে যায়, তাদের কথাগুলো পুলিশকে বুঝতে হবে।
জাহেদ উর রহমান বলেন, এর আগে পুলিশ সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবি উঠত। ওই আইনে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। অথচ পুলিশই এই আইন বাতিল চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা করতে না পেরে এই আইনের প্রয়োগে কিছু শর্ত যুক্ত করার কথাও বলেছিল পুলিশ।
অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘জুলাইয়ে পুলিশের পোশাক ছিল আতঙ্কের। তাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো মানুষের অসহায়ত্ব আমরা দেখেছি। নতুন বাংলাদেশে পুলিশ যদি সত্যের পথে থাকে, তাহলে মানুষের কাছে তাদের আস্থার জায়গা তৈরি হবে।’ পুলিশকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
শিল্পপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। পুলিশে ঊর্ধ্বতন পদসহ বিভিন্ন পদে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে সেবার মানসিকতা তৈরি করা যাচ্ছে কি না, দেখতে হবে।
অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমরা পুলিশকে সেবক হয়ে উঠতে দিচ্ছি কি না, তা চিন্তা করতে হবে। বিরোধী দল দমনে পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সংস্কারের ক্ষেত্রে এগুলো বিবেচনায় না নিলে পুলিশ মানুষের পুলিশ হয়ে উঠতে পারবে না।’
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়বে।
সমাপনী বক্তব্যে পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান গোলাম রসুল বলেন, ‘আমরা জনতার মুখোমুখি থাকব না, পাশাপাশি থাকব। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই; জনগণের পুলিশ, সাধারণ মানুষের পুলিশ হতে চাই।’
মতবিনিময় সভায় দর্শক সারিতে আরও ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য (শিক্ষার্থী প্রতিনিধি) মো. জারিফ রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার আশফাক নিপুন, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।
মতবিনিময় সভায় অন্য বক্তারা বলেন, পুলিশ যেন আগামী দিনে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি না করে। ছিনতাই-ডাকাতিসহ প্রকৃত অপরাধের ঘটনা না লুকিয়ে পুলিশ যেন মামলা নেয়। অতীতের মতো পুলিশ যেন ‘মোরাল পুলিশিং’ না করে। বিভিন্ন মামলায় যেসব ব্যক্তিকে মিথ্যা আসামি করা হয়েছে, তাদের যেন হয়রানি করা না হয়। পুলিশ যেন এমন পরিবেশ তৈরি করে, যাতে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ নির্দ্বিধায় নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে পারে। সর্বোপরি পুলিশ যেন অপরাধীর জন্য আতঙ্কের কারণ হয় এবং নিরীহ মানুষের জন্য নিরাপদ হয়।
শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫
পুলিশ সপ্তাহের মতবিনিময় সভায় বক্তারা পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন । বক্তারা বলেছেন, জনগণ প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চাইলেও রাজনৈতিক নেতারা কখনো তা চাননি। ১৯৩০ সাল থেকে দমন করাই ছিল পুলিশের কাজ। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এ জন্য পুলিশ সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ অডিটরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ: নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সব মহানগর পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শ্রমিকনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সপ্তাহের শেষ দিনে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আগে সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বিকেলে আইজিপির সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা হয়।
নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পুলিশের সাবেক দুজন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বক্তব্য দেন।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা তার আলোচনায় বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। পুলিশকে একটি দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার।
নুরুল হুদা আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে রাজনীতিবিদেরা সবকিছুর পরিবর্তন করলেন কিন্তু দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করলেন না। অথচ সেগুলো যুগের দাবি ছিল। এর মানে হলো তখনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। তিনি বলেন, ‘এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমরা একাত্তরেও দেখিনি। আমাদের যে সংবিধান আছে, সেটি অপারেশনাল করতে হলে যেসব রুলস-রেগুলেশনগুলো পরিবর্তন করা দরকার ছিল, সেগুলো আমরা করলাম না। এর মানে আমাদের কথায় বৈপরীত্য রয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে যথাযথভাবে পেশাদার করতে চাননি।’
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, পুলিশ যে একরকম অদ্ভুত অবস্থায় আছে, তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে, এর কারণ অনুসন্ধানের মতো উদার চিন্তা থাকা উচিত। পুলিশ দলীয় পুলিশ হয়ে যায়, সেটা তো বাহ্যিক। কিন্তু ভেতরে সমস্যা আছে।
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, যাকে রাষ্ট্র বলা হয়, তার একটি শাখা হলো বলপ্রয়োগ। পুলিশ যেহেতু এই বলপ্রয়োগের কাজটি করে, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ কাজটি জনপ্রিয় নয়। তবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত রাষ্ট্র ছিল বা আছে, সব কটিতেই পুলিশ লাগে। পুলিশ কথার মধ্যেই রাষ্ট্র কথাটা লুকিয়ে আছে।
বিচারব্যবস্থার কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, সেখানে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করলে সেটা আদালতের হাতে চলে যায়। প্রায়ই আমরা পুলিশের থেকে শুনেছি, আমাদের দেশের ফৌজদারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা যায় না। আদালত জামিন দিয়ে দেন, অপরাধী মুক্ত হয়ে যায়। কোনো ক্ষেত্রে নিরপরাধ শাস্তি পায়, অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এটা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।
সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবাই স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতা দিলে ভালো লাগে না। তখন গোলামি ভালো লাগে। অনেকেই গোলামি করতে চায়। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য মন্ত্রীদের বাসায় গিয়ে গোলামি করতে চায়। এ দ্বিচারিতার অবসান হওয়া উচিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আইজিপি বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান। সমাপনী বক্তব্য দেন মতবিনিময় সভা-সংক্রান্ত উপকমিটির সভাপতি ও পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল।
মতবিনিময় সভায় স্বাধীন পুলিশ কমিশনের কাঠামো এবং রূপরেখা না থাকার বিষয়গুলোও উঠে আসে। সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত এবং ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ও ‘বিচার-বিশ্লেষণ’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিল।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, এগুলো সাত দিনেই তৈরি করা যায়। বর্তমান আইজিপিও সংস্কার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কমিশন কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছে। নিরীক্ষার কথা বললেই ভয়ের বিষয়। যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষারই দরকার হয়, তাহলে এই কমিশনের দরকার ছিল কি?
নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে একটি দানবীয় বাহিনী হিসেবে পরিণত করা হয়েছে। এই মনমানসিকতা কিন্তু সহজে যায় না। আর অন্যায় আদেশ যে পুলিশ শুনবে না, সে ক্ষেত্রে অবৈধ আদেশ না মানা পুলিশ সদস্যের সুরক্ষা কোথায়? পুলিশ কর্মকর্তারা যেভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন, এটা চিন্তাও করা যায় না। প্রচুর পরিমাণে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি এখনো যে হচ্ছে না, সেই নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সূচনা বক্তব্যে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ইতিবাচক হয়, যখন মানুষ দেখে এই বাহিনী কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করছে। ‘জনতার পুলিশ’ মানে শুধু একটি পরিচয় নয়, এটি একটি দর্শন, যা নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে জনমনে আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান গড়ে তোলে।
আইজিপি বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—অস্ত্র নয়, জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রকৃত শক্তি। পুলিশ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকে, তবে তারা ভয়ের প্রতীক নয়, বরং হয়ে ওঠে ভরসার আশ্রয়স্থল। তাই পুলিশ হতে হবে এমন, যারা জনগণের জন্য, জনগণের হয়ে, জনগণের পাশে থাকবে।’
সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে দেয় না। অতীতে দেখা গেছে, রাষ্ট্র কতটা নির্লজ্জ হলে, পুলিশ সদস্যদের পদক দেওয়ার কারণ হিসেবে বিরোধী দলকে দমন করার কথা উল্লেখ করা হয়।
তিনি বলেন, পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে। যারা আন্দোলনে যায়, তাদের কথাগুলো পুলিশকে বুঝতে হবে।
জাহেদ উর রহমান বলেন, এর আগে পুলিশ সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবি উঠত। ওই আইনে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। অথচ পুলিশই এই আইন বাতিল চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা করতে না পেরে এই আইনের প্রয়োগে কিছু শর্ত যুক্ত করার কথাও বলেছিল পুলিশ।
অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘জুলাইয়ে পুলিশের পোশাক ছিল আতঙ্কের। তাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো মানুষের অসহায়ত্ব আমরা দেখেছি। নতুন বাংলাদেশে পুলিশ যদি সত্যের পথে থাকে, তাহলে মানুষের কাছে তাদের আস্থার জায়গা তৈরি হবে।’ পুলিশকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
শিল্পপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। পুলিশে ঊর্ধ্বতন পদসহ বিভিন্ন পদে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে সেবার মানসিকতা তৈরি করা যাচ্ছে কি না, দেখতে হবে।
অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমরা পুলিশকে সেবক হয়ে উঠতে দিচ্ছি কি না, তা চিন্তা করতে হবে। বিরোধী দল দমনে পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সংস্কারের ক্ষেত্রে এগুলো বিবেচনায় না নিলে পুলিশ মানুষের পুলিশ হয়ে উঠতে পারবে না।’
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে পুলিশের ভাবমূর্তি বাড়বে।
সমাপনী বক্তব্যে পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান গোলাম রসুল বলেন, ‘আমরা জনতার মুখোমুখি থাকব না, পাশাপাশি থাকব। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই; জনগণের পুলিশ, সাধারণ মানুষের পুলিশ হতে চাই।’
মতবিনিময় সভায় দর্শক সারিতে আরও ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য (শিক্ষার্থী প্রতিনিধি) মো. জারিফ রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার আশফাক নিপুন, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।
মতবিনিময় সভায় অন্য বক্তারা বলেন, পুলিশ যেন আগামী দিনে নিরীহ মানুষের ওপর গুলি না করে। ছিনতাই-ডাকাতিসহ প্রকৃত অপরাধের ঘটনা না লুকিয়ে পুলিশ যেন মামলা নেয়। অতীতের মতো পুলিশ যেন ‘মোরাল পুলিশিং’ না করে। বিভিন্ন মামলায় যেসব ব্যক্তিকে মিথ্যা আসামি করা হয়েছে, তাদের যেন হয়রানি করা না হয়। পুলিশ যেন এমন পরিবেশ তৈরি করে, যাতে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ নির্দ্বিধায় নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে পারে। সর্বোপরি পুলিশ যেন অপরাধীর জন্য আতঙ্কের কারণ হয় এবং নিরীহ মানুষের জন্য নিরাপদ হয়।