alt

জাতীয়

অনিশ্চয়তার দোলাচলে অর্থনীতি, কোন পথে আগামীর বাজেট?

রেজাউল করিম : রোববার, ০১ জুন ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তার’ কারণে অর্থবছরের শেষে এসেও অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তা কাটেনি। অর্থনীতির কয়েকটি সূচক একটু চাঙ্গা থাকলেও অধিকাংশ সূচক তলানিতে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্নমুখী বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণে ভাটা, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি, রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, কয়েকটি ব্যাংকের করুণ অবস্থা অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপের মধ্যে রেখেছে। শুধু কিছুটা আশার আলো জ্বেলে রেখেছে রেমিট্যান্স।

রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত

নানামুখী সংকটে রপ্তানি খাত

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে শুরু করেছে

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে সুখবর নেই

বিদেশি ঋণ কমেছে কিন্তু পরিশোধে চাপ বেড়েছে

এডিপি বাস্তবায়ন দেড় দশকে সর্বনিম্ন

ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক, কিছু ব্যাংক একীভূত হচ্ছে

রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ

এক বছরে কর্মসংস্থানের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে

এখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটেনি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন হচ্ছে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-। তলানিতে নেমে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে এবং রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’ কতটা কাটবে, তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। মানুষ যে যখন যেভাবে মনে করছে আন্দোলনে নেমে পড়ছে। রাস্তাঘাট ব্লক করছে। কর্মবিরতি পালন করছে। এতে দেশের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আন্দোলন যৌক্তিক কারণে হোক বা অযৌক্তিক কারণে হোক দেশের যা ক্ষতি সেটা তো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেটের সময়ই অর্থনীতিতে সংকট চলছিল। মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলে দিয়েছিল। তারপর থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত

কয়েক মাস ধরে এই সূচকের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখা, বিদেশি দায়-দেনা মেটানো ও দেশে আসা বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও সহায়তার সঙ্গে রেমিট্যান্স যুক্ত হয়ে এখন রিজার্ভ যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে বড় ধরনের ঝুঁকি না থাকার কথাই অর্থনীতিবিদরা বলছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৩ দিনেই এক বিলিয়ন ডলার যোগ হওয়ায় ৩০ এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভ ১৯ মাস পর ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। সে সময় রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ২২ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। ২৪ মের তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ রয়েছে সাড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো, যা আগের অর্থবছরের ওই দিনে ছিল সাড়ে ১৮ বিলিয়নের খানিকটা বেশি।

সবশেষ দুই মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর প্রবাসী আয় আসে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে এ দুই মাসেই। মার্চে রোজার ঈদকে ঘিরে প্রবাসীরা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই অংক একক মাসের হিসাবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

নানামুখী সংকটে রপ্তানি খাত

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর তৈরি পোশাক খাত শ্রমিক আন্দোলন, নৈরাজ্য, কারখানা বন্ধের মতো বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। এর ফলে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হলেও দেখা যায়, মাঝারি ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্থবছরের বেশিরভাগ সময় ধরেই ছিল। মনে করা হচ্ছিল, পোশাক খাতে সস্তা শ্রমের সঙ্গে গুণগত মান ধরে রাখার ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তাতে খুব সহজে ভাটা পড়বে না।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবেই পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, স্থল বাণিজ্যে বিধিনিষেধের ফলে রপ্তানিতে সে ধারা বদলে গিয়ে হতাশা তৈরি করেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১০ মাসের মধ্যে এপ্রিলে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় দেখেছে দেশ। এ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০১ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে রপ্তানি আয় কমে প্রায় ১২৪ কোটি ডলার। গত মার্চ মাসে রপ্তানি আয় হয় ৪২৫ কোটি ডলার।

চলতি অর্থবছরে এর আগে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় ছিল গত সেপ্টেম্বরে। সে মাসে এ খাত থেকে আয় ৩৫২ কোটি ডলার। এপ্রিলে পোশাক খাতে আয় ‘সামান্য’ বেড়েছে। সে মাসে রপ্তানি আয় হয় ২৩৯ কোটি ডলার মার্চে যা ছিল ২৩৮ কোটি ডলার।

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে শুরু করেছে

দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের নাম মূল্যস্ফীতি। দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল। তবে ২৬ মাস পর এপ্রিলে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি দেখেছে বাংলাদেশ। সে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এটা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পর সবচেয়ে কম।

এ তথ্য আশা দেখালেও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কমার ধারা কতদিন থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ এর আগে ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও পরের মাসেই তা বেড়ে যায়। দেশে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা চলছে তাতে দরিদ্র মানুষের জীবনমান তলানিতে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অবশ্য বলছেন, চলতি বছরের শেষের দিকে দেশে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগস্টের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে, জুনে ৮ শতাংশে। আর এ বছর শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে।’

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে সুখবর নেই

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশি হোক বা বিদেশিই হোক, বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিশ্চয়তা প্রয়োজন। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেন। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তাই বিনিয়োগও ঠেকেছে তলানিতে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৪৯ কোটি ৪ লাখ ডলার নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যা আগের কয়েক অর্থবছরের হিসেবে অর্ধেকরও কম। গত অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪১ কোটি ডলার।

বিদেশি ঋণ কমেছে কিন্তু পরিশোধে চাপ বেড়েছে

বিদেশি ঋণ ছাড়ের অবস্থা ভালো নয়। অর্থবছরের নয় মাস শেষেও বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড়ে নেতিবাচক ধারা চলছে। ঋণের প্রতিশ্রুতিও মিলেছে কম। এ সময় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ দেশে ঋণের অর্থ না এলেও আগের ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে বিদেশি অর্থায়ন মিলেছে ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ ও অনুদান কমেছে ১৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।

পাশাপাশি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতিও কমেছে। এ সময়ে প্রতিশ্রুতি মিলেছে ৩০০ কোটি ৫২ লাখ ডলারের যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে সাড়ে ৫৮ শতাংশ।

এডিপি বাস্তবায়ন দেড় দশকে সর্বনিম্ন

অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেয়া প্রকল্প যাচাই-বাছাই শুরু করে। অনেক প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। অনেক প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয়। এ অবস্থায় অর্থবছরের ১০ মাস ধরেই এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি চলছিল। এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সংশোধিত এডিপির ব্যয় হয়েছে ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ হার ছিল ৪৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে বাস্তবায়নের এ হার গত দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের তথ্য খোলা মাধ্যমে রাখেনি সরকার। সেই তথ্য মিললে বাস্তবায়নের এ হার আরও বেশি সময়ের মধ্যে কম হওয়ার শঙ্কা থাকছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্পে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আমার মনে হয় সেসব প্রকল্প আগে শেষ করা দরকার। কারণ সেগুলো পড়ে থেকে যত সময় যাবে তত সেটার ব্যয় বাড়তে থাকবে।’

ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক, কিছু ব্যাংক একীভূত হচ্ছে

কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও কিছু ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নিজেই বলেছেন, ‘কিছু ব্যাংককে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে।’ এই অবস্থায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও অর্থ ছাপিয়ে সরাসরি ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দিয়েছে, যদিও তা না করার কথা বলা হয়েছিল।

তারল্য সংকট কাটাতে ২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেয়। তখন আহসান মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।’ এ তারল্য সহায়তা দেয়ার ঘটনাই বলে দেয়, এ খাতে এখনও শঙ্কা কাটেনি। এর মধ্যেই ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা বলেছেন গভর্নর।

রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ

জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা আর রাজনৈতিক ডামাডোলে সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির ধারায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়েও বিনিয়োগ অস্থিরতা ও অর্থনীতির মন্দার মধ্যে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের এখনও তিন মাসের রাজস্ব আহরণের তথ্য বাকি থাকায়, এক লাখ কোটির মত ঘাটতি হয়ে যেতে পারে বলেই শঙ্কা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর কর্মকর্তাদের। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, চলতি অর্থবছরের পরিস্থিতি বিবেচনায় ৪ লাখ কোটি টাকা আদায় করতে পারলেই সেটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হবে।

সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে প্রথমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি করে, যা আগে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্য পূরণে এনবিআর প্রতিমাসের জন্য আলাদা লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এতে দেখা গেছে, জুলাই-মার্চ শেষে লক্ষ্যের চেয়ে রাজস্ব আদায় পিছিয়ে আছে ৬৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

এর মধ্যেই এনবিআরকে দুই ভাগ করা নিয়ে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। সরকারের অধ্যাদেশ জারি করার পরপর আন্দোলন শুরু করেন এনবিআর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই ইস্যুর এখনও সুরাহা হয়নি। তাই এই খাতের ভবিষ্যৎও শঙ্কাজনক।

এক বছরে কর্মসংস্থানের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে

দেশে বেকারত্ব আরও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯তম আইসিএলএস অনুযায়ী দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ১৩তম আইসিএলএসে ডিসেম্বর শেষে দেশের বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে ১৯তম আইসিএলএস অনুযায়ী দেশের বেকার জনগোষ্ঠী বেড়ে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৪ লাখ।

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ১৩তম আইসিএলএসে ডিসেম্বর শেষে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এই পুরনো হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা বর্তমানে ২৬ লাখ ১০ হাজার। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার।

বেকারত্ব বাড়ার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে। এসব বেকার মানুষদের কর্মসংস্থানের উপর জোর দেয়ার তাগিদ দেন তারা।

ছবি

ঈদুল আজহার পাঁচ জামাত বায়তুল মোকাররমে, প্রথমটি সকাল ৭টায়

ছবি

এক দিনে ২৬৪ বিচারককে রদবদল

ছবি

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী ঐক্য ফোরামের প্রেস ব্রিফিং-সংগৃহীত

ছবি

সিনহা হত্যা: ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড, ৬ জনের যাবজ্জীবন বহাল

জুলাই আন্দোলন: ১৯ ডাক্তারকে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ

শেষ হলো হজ ফ্লাইট, সৌদি পৌঁছেছেন ৮৭১৫৭ হজযাত্রী

দূরত্ব যেটুকু আছে, ঘুচে যাবে: আশা প্রধান উপদেষ্টার

ছবি

‘এ সুযোগ হারাব না’, রাজনৈতিক ঐকমত্যে জোর প্রধান উপদেষ্টার

আমিনুলের মনোনয়ন চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে ফারুকের রিট

ছবি

চাকরি সংশোধনী অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আজও সচিবালয়ে বিক্ষোভ

ছবি

মেননের ৫ দিনের রিমান্ড, নতুন মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক ওসি হাসান

ছবি

আজ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করবেন অর্থ উপদেষ্টা

ছবি

সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড, ছয় আসামির যাবজ্জীবনও বহাল

ছবি

অভিযোগ আমলে নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল, হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

সেনা ও পুলিশ পাহারায় নিজ কার্যালয়ে ফিরলেন এনবিআর চেয়ারম্যান

জামায়াতের নিবন্ধনের অবৈধতার রায় বাতিল করলো আপিল বিভাগ

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের ‘অপপ্রয়োগের’ আশঙ্কা দেখছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির

জড়িতদের শনাক্তে বৈষম্যবিরোধী ও বিএনপি নেতাদের সহায়তা চাইলো সেনাবাহিনী

চট্টগ্রামে নারীকে লাথি মারা সাবেক শিবির কর্মী অবশেষে গ্রেপ্তার

ছবি

কুমিল্লায় ঘূর্ণিঝড়ে বৈদ্যুতিক লাইন বিপর্যস্ত, ৬০ ঘণ্টায়ও বিদ্যুৎ চালু করা যায়নি

সারাদেশে বিশেষ অভিযানে আরও গ্রেপ্তার ১১৯০

সিলেটে টিলা ধসে একই পরিবারের ৪ জন নিহত

নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে নগদে অভিযান

ছবি

‘তথ্য আপা’দের যমুনামুখী মিছিল, প্রিজন ভ্যানে ‘সরিয়ে নিলো’ পুলিশ

২১ আগস্ট হামলা: রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানি ১ জুলাই

‘উৎপাদন কেন্দ্র’ গড়তে চীনা বিনিয়োগ চাইলেন ইউনূস

দুই দিন বিরতি দিয়ে ফের নগর ভবনে ইশরাক সমর্থকদের বিক্ষোভ

ছবি

ঈদ এলেই ভাড়া বাড়ে, এবারও বেড়েছে, কোথাও ‘দ্বিগুণ’

ছবি

সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের অধ্যাদেশে ত্রুটির কথা স্বীকার করলেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

ছবি

বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে রূপান্তরের লক্ষ্যে চীনা বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

ছবি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে ককটেল সদৃশ বস্তুর বিস্ফোরণ

ছবি

জামায়াতের নিবন্ধনের অবৈধতা বাতিল করলো আপিল বিভাগ

নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আপিলের রায় রোববার

বিশেষ অভিযানে সারাদেশে গ্রেপ্তার ৯০০

স্রোতে ডুবে খাগড়াছড়ি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩ জনের মৃত্যু

ছবি

ভালুকার রসালো কাঁঠাল যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়

tab

জাতীয়

অনিশ্চয়তার দোলাচলে অর্থনীতি, কোন পথে আগামীর বাজেট?

রেজাউল করিম

রোববার, ০১ জুন ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তার’ কারণে অর্থবছরের শেষে এসেও অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তা কাটেনি। অর্থনীতির কয়েকটি সূচক একটু চাঙ্গা থাকলেও অধিকাংশ সূচক তলানিতে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্নমুখী বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণে ভাটা, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি, রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, কয়েকটি ব্যাংকের করুণ অবস্থা অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপের মধ্যে রেখেছে। শুধু কিছুটা আশার আলো জ্বেলে রেখেছে রেমিট্যান্স।

রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত

নানামুখী সংকটে রপ্তানি খাত

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে শুরু করেছে

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে সুখবর নেই

বিদেশি ঋণ কমেছে কিন্তু পরিশোধে চাপ বেড়েছে

এডিপি বাস্তবায়ন দেড় দশকে সর্বনিম্ন

ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক, কিছু ব্যাংক একীভূত হচ্ছে

রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ

এক বছরে কর্মসংস্থানের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে

এখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটেনি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন হচ্ছে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-। তলানিতে নেমে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে এবং রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’ কতটা কাটবে, তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। মানুষ যে যখন যেভাবে মনে করছে আন্দোলনে নেমে পড়ছে। রাস্তাঘাট ব্লক করছে। কর্মবিরতি পালন করছে। এতে দেশের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আন্দোলন যৌক্তিক কারণে হোক বা অযৌক্তিক কারণে হোক দেশের যা ক্ষতি সেটা তো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেটের সময়ই অর্থনীতিতে সংকট চলছিল। মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলে দিয়েছিল। তারপর থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত

কয়েক মাস ধরে এই সূচকের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখা, বিদেশি দায়-দেনা মেটানো ও দেশে আসা বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও সহায়তার সঙ্গে রেমিট্যান্স যুক্ত হয়ে এখন রিজার্ভ যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে বড় ধরনের ঝুঁকি না থাকার কথাই অর্থনীতিবিদরা বলছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৩ দিনেই এক বিলিয়ন ডলার যোগ হওয়ায় ৩০ এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভ ১৯ মাস পর ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। সে সময় রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ২২ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। ২৪ মের তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ রয়েছে সাড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো, যা আগের অর্থবছরের ওই দিনে ছিল সাড়ে ১৮ বিলিয়নের খানিকটা বেশি।

সবশেষ দুই মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর প্রবাসী আয় আসে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে এ দুই মাসেই। মার্চে রোজার ঈদকে ঘিরে প্রবাসীরা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই অংক একক মাসের হিসাবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

নানামুখী সংকটে রপ্তানি খাত

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর তৈরি পোশাক খাত শ্রমিক আন্দোলন, নৈরাজ্য, কারখানা বন্ধের মতো বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। এর ফলে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হলেও দেখা যায়, মাঝারি ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্থবছরের বেশিরভাগ সময় ধরেই ছিল। মনে করা হচ্ছিল, পোশাক খাতে সস্তা শ্রমের সঙ্গে গুণগত মান ধরে রাখার ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তাতে খুব সহজে ভাটা পড়বে না।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবেই পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, স্থল বাণিজ্যে বিধিনিষেধের ফলে রপ্তানিতে সে ধারা বদলে গিয়ে হতাশা তৈরি করেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১০ মাসের মধ্যে এপ্রিলে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় দেখেছে দেশ। এ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০১ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে রপ্তানি আয় কমে প্রায় ১২৪ কোটি ডলার। গত মার্চ মাসে রপ্তানি আয় হয় ৪২৫ কোটি ডলার।

চলতি অর্থবছরে এর আগে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় ছিল গত সেপ্টেম্বরে। সে মাসে এ খাত থেকে আয় ৩৫২ কোটি ডলার। এপ্রিলে পোশাক খাতে আয় ‘সামান্য’ বেড়েছে। সে মাসে রপ্তানি আয় হয় ২৩৯ কোটি ডলার মার্চে যা ছিল ২৩৮ কোটি ডলার।

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে শুরু করেছে

দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের নাম মূল্যস্ফীতি। দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল। তবে ২৬ মাস পর এপ্রিলে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি দেখেছে বাংলাদেশ। সে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এটা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পর সবচেয়ে কম।

এ তথ্য আশা দেখালেও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কমার ধারা কতদিন থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ এর আগে ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও পরের মাসেই তা বেড়ে যায়। দেশে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা চলছে তাতে দরিদ্র মানুষের জীবনমান তলানিতে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অবশ্য বলছেন, চলতি বছরের শেষের দিকে দেশে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগস্টের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে, জুনে ৮ শতাংশে। আর এ বছর শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে।’

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে সুখবর নেই

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশি হোক বা বিদেশিই হোক, বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিশ্চয়তা প্রয়োজন। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেন। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তাই বিনিয়োগও ঠেকেছে তলানিতে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৪৯ কোটি ৪ লাখ ডলার নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যা আগের কয়েক অর্থবছরের হিসেবে অর্ধেকরও কম। গত অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪১ কোটি ডলার।

বিদেশি ঋণ কমেছে কিন্তু পরিশোধে চাপ বেড়েছে

বিদেশি ঋণ ছাড়ের অবস্থা ভালো নয়। অর্থবছরের নয় মাস শেষেও বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড়ে নেতিবাচক ধারা চলছে। ঋণের প্রতিশ্রুতিও মিলেছে কম। এ সময় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ দেশে ঋণের অর্থ না এলেও আগের ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে বিদেশি অর্থায়ন মিলেছে ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ ও অনুদান কমেছে ১৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।

পাশাপাশি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতিও কমেছে। এ সময়ে প্রতিশ্রুতি মিলেছে ৩০০ কোটি ৫২ লাখ ডলারের যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে সাড়ে ৫৮ শতাংশ।

এডিপি বাস্তবায়ন দেড় দশকে সর্বনিম্ন

অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেয়া প্রকল্প যাচাই-বাছাই শুরু করে। অনেক প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। অনেক প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয়। এ অবস্থায় অর্থবছরের ১০ মাস ধরেই এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি চলছিল। এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সংশোধিত এডিপির ব্যয় হয়েছে ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ হার ছিল ৪৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে বাস্তবায়নের এ হার গত দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের তথ্য খোলা মাধ্যমে রাখেনি সরকার। সেই তথ্য মিললে বাস্তবায়নের এ হার আরও বেশি সময়ের মধ্যে কম হওয়ার শঙ্কা থাকছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্পে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আমার মনে হয় সেসব প্রকল্প আগে শেষ করা দরকার। কারণ সেগুলো পড়ে থেকে যত সময় যাবে তত সেটার ব্যয় বাড়তে থাকবে।’

ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক, কিছু ব্যাংক একীভূত হচ্ছে

কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও কিছু ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নিজেই বলেছেন, ‘কিছু ব্যাংককে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে।’ এই অবস্থায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও অর্থ ছাপিয়ে সরাসরি ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দিয়েছে, যদিও তা না করার কথা বলা হয়েছিল।

তারল্য সংকট কাটাতে ২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেয়। তখন আহসান মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।’ এ তারল্য সহায়তা দেয়ার ঘটনাই বলে দেয়, এ খাতে এখনও শঙ্কা কাটেনি। এর মধ্যেই ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা বলেছেন গভর্নর।

রাজস্ব আহরণে ঘাটতি, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ

জুলাই-আগস্টের অস্থিরতা আর রাজনৈতিক ডামাডোলে সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির ধারায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়েও বিনিয়োগ অস্থিরতা ও অর্থনীতির মন্দার মধ্যে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের এখনও তিন মাসের রাজস্ব আহরণের তথ্য বাকি থাকায়, এক লাখ কোটির মত ঘাটতি হয়ে যেতে পারে বলেই শঙ্কা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর কর্মকর্তাদের। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, চলতি অর্থবছরের পরিস্থিতি বিবেচনায় ৪ লাখ কোটি টাকা আদায় করতে পারলেই সেটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হবে।

সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে প্রথমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি করে, যা আগে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্য পূরণে এনবিআর প্রতিমাসের জন্য আলাদা লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এতে দেখা গেছে, জুলাই-মার্চ শেষে লক্ষ্যের চেয়ে রাজস্ব আদায় পিছিয়ে আছে ৬৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

এর মধ্যেই এনবিআরকে দুই ভাগ করা নিয়ে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। সরকারের অধ্যাদেশ জারি করার পরপর আন্দোলন শুরু করেন এনবিআর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই ইস্যুর এখনও সুরাহা হয়নি। তাই এই খাতের ভবিষ্যৎও শঙ্কাজনক।

এক বছরে কর্মসংস্থানের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে

দেশে বেকারত্ব আরও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯তম আইসিএলএস অনুযায়ী দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ১৩তম আইসিএলএসে ডিসেম্বর শেষে দেশের বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে ১৯তম আইসিএলএস অনুযায়ী দেশের বেকার জনগোষ্ঠী বেড়ে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৪ লাখ।

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ১৩তম আইসিএলএসে ডিসেম্বর শেষে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এই পুরনো হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা বর্তমানে ২৬ লাখ ১০ হাজার। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার।

বেকারত্ব বাড়ার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে। এসব বেকার মানুষদের কর্মসংস্থানের উপর জোর দেয়ার তাগিদ দেন তারা।

back to top