ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীকে ওঠানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। সেখানে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে অন্যদেরও ভিড়-সংবাদ
নোয়াখালীর বেলাল হোসেন (৪৫) গত ২০ ফেব্রুয়ারি তার ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসা শেষে কয়েকদিন পর নোয়াখালীতে ফেরার জন্য ঢামেক হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গেলে সেখানকার সিন্ডিকেটের সদস্যরা ৬ হাজার টাকা চায়। বেলাল তখন নোয়াখালী থেকে আসা একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্যরা তাকে বলেন, বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স শুধু রোগীদের নামাতে পারে। তারা সেখান থেকে রোগী নিতে পারবে না।
ফোনে বেলাল তখন নোয়াখালীর একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বলেন, যিনি রোগী নিয়ে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসেন। সেই চালক নোয়াখালী যেতে বেলালের কাছে ৩ হাজার টাকা চান, যা ঢামেক সিন্ডিকেটের চাওয়া ভাড়ার অর্ধেক। কিন্তু সিন্ডিকেট বেলালকে শর্ত দেয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে তাদের ওই অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে হবে। জানতে চাইলে ওই চালক বলেন, ‘সিন্ডিকেটের সদস্যদের টাকা না দিলে আমাকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী নিতে দেয়া হবে না।’
আব্দুল ওয়াহিদ দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন স্ত্রী নিয়ে। দুই দিন বাদে মিলবে ছুটি। যেতে হবে অ্যাম্বুলেন্সে। তবে কিছুতেই মিলছে না ভাড়ার হিসাব। টাকার অভাবে আসার সময় বাসে এসে রোগী নিয়ে পড়তে হয়েছে বাড়তি বিড়ম্বনায়। এবার আর বিকল্প নেই। তার স্ত্রীর মেরুদ-ের হাড় বাঁকা। অপারেশন, স্ক্রু, ওষুধ, থাকা-খাওয়াসহ খরচ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া লাগবে ৯ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘মানুষ আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করেছে। তাই আমি আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পেরেছি। কিন্তু এখন অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফেরার মতো টাকা নেই। তাই বিপদে পড়ে গেলাম।’
* দ্বিগুণ ভাড়া আদায়
* অনেক সময় চিকিৎসা ব্যয়ের চাইতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বেশি
* অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের দুই সমিতি, প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতালেই সিন্ডিকেট
* রাজধানীতে বেসরকারি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অ্যাম্বুলেন্স
চিকিৎসা ব্যয় না ‘অ্যাম্বুলেন্স’ ভাড়া, কোনটা বেশি!
দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসা নেয়া ১০ জন রোগীর তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা গেছে, নিউরো, অর্থোপেডিকের মতো জটিল অপারেশনের পরেও চিকিৎসার যে ব্যয়, তার প্রায় ৬০ ভাগই গুনতে হয় আসা-যাওয়ার খরচে। মামুন হোসেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা করিয়েছেন। চিকিৎসা, ওষুধসহ খরচ ৮ হাজার টাকা। আর আসা-যাওয়ার খরচ ১২ হাজার টাকা।
এক রোগীর স্বজন বলেন, অপারেশন ও ওষুধসহ ১৭-১৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াই গেছে ১০ হাজার টাকার ওপরে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুর শহরে স্থানীয় চালকরা ঢাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ার ঘটনায় এক নবজাতকের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর নতুন করে অ্যাম্বুলেন্স চক্রের কথা আলোচনায় আসে।
ভোগান্তিতে রোগী ও স্বজন
ঢামেকে কথা হলো বাইরে থেকে আসা এক অ্যাম্বুলেন্সচালকের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘একজন রোগী নিয়ে এসেছি। আনার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু আমার অ্যাম্বুলেন্সে করে ফিরে যেতে দেয়া হয়নি।’
যদি ঢাকা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স একজন রোগীকে নিয়ে ঢাকার কোনো হাসপাতাল থেকে রাজশাহীতে যায়, সেই অ্যাম্বুলেন্সটিকে খালি ফিরতে হবে। আর যদি চালক সেখান থেকে কোনো রোগীকে ঢাকায় আনতে চায়, সেক্ষেত্রে সিন্ডিকেটকে কমিশন হিসেবে ভাড়ার অর্ধেক টাকা দিতে হবে। এটাই সিন্ডিকেটের নিয়ম। ফলে রোগীদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আরেক জেলার অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে খালি ফিরতে হয়। সেজন্যই তারা প্রথম ট্রিপ ধরার সময়ে যাওয়া-আসার ভাড়া ধরে দ্বিগুণ অর্থ নেয় বলে অভিযোগ। অ্যাম্বুলেন্স মালিক, চালক ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের ২টি সমিতিÑ বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি। সদস্য সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি বড়। তাদের সদস্য সংখ্যা ২ হাজার ৭০০। ২টি সংগঠনই সারাদেশের সব অ্যাম্বুলেন্সকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। বিভিন্ন জেলায় তাদের সিন্ডিকেট সেই জেলা ছাড়া অন্যান্য জেলার অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে রোগী নিয়ে যেতে দেয় না। কে, কোন রোগী নিতে পারবে, সে বিষয়ে সিন্ডিকেটের একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছে। সমিতির প্রতিটি হাসপাতালের ইউনিটের জন্য তা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সদস্যদের মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা পার্কিং ফি এবং মাসে ২০০ টাকা মেম্বারশিপ ফি দিতে হয়। একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনতে ২০-২২ লাখ টাকা লাগে। ফলে রোগীরা যদি ঢামেক হাসপাতালের বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে, সেক্ষেত্রে মালিকদের লোকসান হবে।’
শরীয়তপুরে শিশুর মৃত্যু
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুরে অ্যাম্বুলেন্সচালক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ঢাকা থেকে যাওয়া রোগী বহনকারী এক অ্যাম্বুলেন্স। ওই অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় অসুস্থ অবস্থায় এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে।
রোগীর স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর এলাকার নূর হোসেন সরদারের স্ত্রী রুমা বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে স্বজনরা তাকে জেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তবে বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অসুস্থ বোধ করায় চিকিৎসকে শিশুটিকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। নূর হোসেন তখন ঢাকা থেকে শরীয়তপুর যাওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্স ৫ হাজার টাকায় ভাড়া করেন।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলে গাড়িটির গতিরোধ করে স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্সচালক সবুজ দেওয়ান ও আবু তাহের দেওয়ান নামে দুই ব্যক্তি। তাদের দাবি তাদের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় যেতে দেয়া হবে না। একপর্যায়ে তারা ঢাকাগামী সেই অ্যাম্বুলেন্সচালকের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাবি কেড়ে নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে থাকে। এ সময় রোগীর স্বজনরা বাধা দিলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। এতে দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স আটক থাকায় শিশুটি সেখানেই মারা যায়।
অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সবুজ দেওয়ানকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বাবা তাহের দেওয়ান জেলা সিভিল সার্জনের গাড়ির চালক
রাজধানীতে সাড়ে ৪ হাজার ‘অ্যাম্বুলেন্স’
রাজধানীর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বেসরকারি ‘অ্যাম্বুলেন্স’ আছে বলে দুই মালিক সমিতির হিসাব। আগারগাঁওয়ের ষাট ফিট রোডে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। আবার হাসপাতালগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং নিয়ে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। মোট ভাড়ার ওপর ৫শ’-১ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন যায় ওই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের পকেটে।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স সেক্টরে কোনো নীতিমালা না থাকায় মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ছে।’ তবে রোগী বা মৃতদেহ জিম্মি করে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। তার কথা, ‘পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় আমরা কমিশন দিতে বাধ্য হই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে অ্যাম্বুলেন্স যাতায়াতের অনেক সময় লাগে। তাছাড়া সেতু ও ফেরির টোল দিতে হয়। অথচ অ্যাম্বুলেন্সের কাছ থেকে টোল নেয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু ইজারাদাররা এই নির্দেশনা মানছেন না। এর আর্থিক প্রভাব পড়ে রোগী বা তাদের স্বজনের ওপর।
ঢাকা মেডিকেলের পুরানো জরুরি বিভাগের সামনের জায়গাটা বলা যায় পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে ‘অ্যাম্বুলেন্স’। অ্যাম্বুলেন্স বললে ভুল হবে। কারণ এসব যানে অ্যাম্বুলেন্সে যেসব সুবিধা থাকা দরকার তা আছে কিনা সে নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কয়েকশ’ অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল কমপ্লেক্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অথচ কয়েক দিন ধরে ঘুরেও সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল লিখা কোনো অ্যাম্বুলেন্স চোখে পড়েনি।
সরকারি বিধি মোতাবেক প্রতিটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), অক্সিজেন সিলিন্ডার ও রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার সরঞ্জাম রাখা বাধ্যতামূলক। আর এসব সেবা পরিচালনার জন্য অ্যাম্বুলেন্সচালককে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হতে হবে। তবে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে এসব নিয়মের বালাই নেই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য বলেন, হাসপাতালে প্রতিটি ওয়ার্ডে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের লোকজন দর্শনার্থী সেজে ঘোরাফেরা করে। তারা যখন বুঝতে পারে যে ওই রোগী মারা যেতে পারে, তখন ওই রোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণ শুরু করে। পরবর্তীতে রোগী মারা গেলে লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের সন্ধান দেন। একে তো স্বজনের মৃত্যু, তার ওপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ বাড়ি নেয়া যায় ততই মঙ্গলÑ এ ধরনের চিন্তা থেকে চালকদের দাবিকৃত ভাড়ায় লাশ নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে স্বজনরা। হাসপাতালের সামনে অবস্থান করা অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সঙ্গে দরদাম করে কোনো লাভ হয় না। তারা প্রথমবার যে ভাড়া বলবে সেটাই ‘শেষ ভাড়া’। কারণ, আগের সিন্ডিকেট সদস্য অন্য চালকদের কাছে মৃত ব্যক্তির নাম ঠিকানা এবং কোথায় যাবে সব বলে দেয়। ফলে নতুন করে কোনো অ্যাম্বুলেন্স কম ভাড়ায় যেতে রাজি হবে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীকে ওঠানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। সেখানে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে অন্যদেরও ভিড়-সংবাদ
মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫
নোয়াখালীর বেলাল হোসেন (৪৫) গত ২০ ফেব্রুয়ারি তার ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসা শেষে কয়েকদিন পর নোয়াখালীতে ফেরার জন্য ঢামেক হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গেলে সেখানকার সিন্ডিকেটের সদস্যরা ৬ হাজার টাকা চায়। বেলাল তখন নোয়াখালী থেকে আসা একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে চাইলে সিন্ডিকেট সদস্যরা তাকে বলেন, বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স শুধু রোগীদের নামাতে পারে। তারা সেখান থেকে রোগী নিতে পারবে না।
ফোনে বেলাল তখন নোয়াখালীর একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বলেন, যিনি রোগী নিয়ে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসেন। সেই চালক নোয়াখালী যেতে বেলালের কাছে ৩ হাজার টাকা চান, যা ঢামেক সিন্ডিকেটের চাওয়া ভাড়ার অর্ধেক। কিন্তু সিন্ডিকেট বেলালকে শর্ত দেয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে তাদের ওই অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে হবে। জানতে চাইলে ওই চালক বলেন, ‘সিন্ডিকেটের সদস্যদের টাকা না দিলে আমাকে ঢামেক হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী নিতে দেয়া হবে না।’
আব্দুল ওয়াহিদ দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন স্ত্রী নিয়ে। দুই দিন বাদে মিলবে ছুটি। যেতে হবে অ্যাম্বুলেন্সে। তবে কিছুতেই মিলছে না ভাড়ার হিসাব। টাকার অভাবে আসার সময় বাসে এসে রোগী নিয়ে পড়তে হয়েছে বাড়তি বিড়ম্বনায়। এবার আর বিকল্প নেই। তার স্ত্রীর মেরুদ-ের হাড় বাঁকা। অপারেশন, স্ক্রু, ওষুধ, থাকা-খাওয়াসহ খরচ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া লাগবে ৯ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘মানুষ আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করেছে। তাই আমি আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পেরেছি। কিন্তু এখন অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফেরার মতো টাকা নেই। তাই বিপদে পড়ে গেলাম।’
* দ্বিগুণ ভাড়া আদায়
* অনেক সময় চিকিৎসা ব্যয়ের চাইতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বেশি
* অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের দুই সমিতি, প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতালেই সিন্ডিকেট
* রাজধানীতে বেসরকারি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অ্যাম্বুলেন্স
চিকিৎসা ব্যয় না ‘অ্যাম্বুলেন্স’ ভাড়া, কোনটা বেশি!
দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসা নেয়া ১০ জন রোগীর তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা গেছে, নিউরো, অর্থোপেডিকের মতো জটিল অপারেশনের পরেও চিকিৎসার যে ব্যয়, তার প্রায় ৬০ ভাগই গুনতে হয় আসা-যাওয়ার খরচে। মামুন হোসেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা করিয়েছেন। চিকিৎসা, ওষুধসহ খরচ ৮ হাজার টাকা। আর আসা-যাওয়ার খরচ ১২ হাজার টাকা।
এক রোগীর স্বজন বলেন, অপারেশন ও ওষুধসহ ১৭-১৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াই গেছে ১০ হাজার টাকার ওপরে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুর শহরে স্থানীয় চালকরা ঢাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ার ঘটনায় এক নবজাতকের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর নতুন করে অ্যাম্বুলেন্স চক্রের কথা আলোচনায় আসে।
ভোগান্তিতে রোগী ও স্বজন
ঢামেকে কথা হলো বাইরে থেকে আসা এক অ্যাম্বুলেন্সচালকের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘একজন রোগী নিয়ে এসেছি। আনার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু আমার অ্যাম্বুলেন্সে করে ফিরে যেতে দেয়া হয়নি।’
যদি ঢাকা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স একজন রোগীকে নিয়ে ঢাকার কোনো হাসপাতাল থেকে রাজশাহীতে যায়, সেই অ্যাম্বুলেন্সটিকে খালি ফিরতে হবে। আর যদি চালক সেখান থেকে কোনো রোগীকে ঢাকায় আনতে চায়, সেক্ষেত্রে সিন্ডিকেটকে কমিশন হিসেবে ভাড়ার অর্ধেক টাকা দিতে হবে। এটাই সিন্ডিকেটের নিয়ম। ফলে রোগীদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আরেক জেলার অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে খালি ফিরতে হয়। সেজন্যই তারা প্রথম ট্রিপ ধরার সময়ে যাওয়া-আসার ভাড়া ধরে দ্বিগুণ অর্থ নেয় বলে অভিযোগ। অ্যাম্বুলেন্স মালিক, চালক ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের ২টি সমিতিÑ বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি। সদস্য সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি বড়। তাদের সদস্য সংখ্যা ২ হাজার ৭০০। ২টি সংগঠনই সারাদেশের সব অ্যাম্বুলেন্সকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। বিভিন্ন জেলায় তাদের সিন্ডিকেট সেই জেলা ছাড়া অন্যান্য জেলার অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে রোগী নিয়ে যেতে দেয় না। কে, কোন রোগী নিতে পারবে, সে বিষয়ে সিন্ডিকেটের একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছে। সমিতির প্রতিটি হাসপাতালের ইউনিটের জন্য তা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সদস্যদের মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা পার্কিং ফি এবং মাসে ২০০ টাকা মেম্বারশিপ ফি দিতে হয়। একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনতে ২০-২২ লাখ টাকা লাগে। ফলে রোগীরা যদি ঢামেক হাসপাতালের বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে, সেক্ষেত্রে মালিকদের লোকসান হবে।’
শরীয়তপুরে শিশুর মৃত্যু
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুরে অ্যাম্বুলেন্সচালক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ঢাকা থেকে যাওয়া রোগী বহনকারী এক অ্যাম্বুলেন্স। ওই অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় অসুস্থ অবস্থায় এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে।
রোগীর স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর এলাকার নূর হোসেন সরদারের স্ত্রী রুমা বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে স্বজনরা তাকে জেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তবে বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অসুস্থ বোধ করায় চিকিৎসকে শিশুটিকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। নূর হোসেন তখন ঢাকা থেকে শরীয়তপুর যাওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্স ৫ হাজার টাকায় ভাড়া করেন।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলে গাড়িটির গতিরোধ করে স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্সচালক সবুজ দেওয়ান ও আবু তাহের দেওয়ান নামে দুই ব্যক্তি। তাদের দাবি তাদের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় যেতে দেয়া হবে না। একপর্যায়ে তারা ঢাকাগামী সেই অ্যাম্বুলেন্সচালকের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাবি কেড়ে নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে থাকে। এ সময় রোগীর স্বজনরা বাধা দিলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। এতে দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স আটক থাকায় শিশুটি সেখানেই মারা যায়।
অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সবুজ দেওয়ানকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বাবা তাহের দেওয়ান জেলা সিভিল সার্জনের গাড়ির চালক
রাজধানীতে সাড়ে ৪ হাজার ‘অ্যাম্বুলেন্স’
রাজধানীর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বেসরকারি ‘অ্যাম্বুলেন্স’ আছে বলে দুই মালিক সমিতির হিসাব। আগারগাঁওয়ের ষাট ফিট রোডে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। আবার হাসপাতালগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং নিয়ে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। মোট ভাড়ার ওপর ৫শ’-১ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন যায় ওই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের পকেটে।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স সেক্টরে কোনো নীতিমালা না থাকায় মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ছে।’ তবে রোগী বা মৃতদেহ জিম্মি করে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। তার কথা, ‘পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় আমরা কমিশন দিতে বাধ্য হই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে অ্যাম্বুলেন্স যাতায়াতের অনেক সময় লাগে। তাছাড়া সেতু ও ফেরির টোল দিতে হয়। অথচ অ্যাম্বুলেন্সের কাছ থেকে টোল নেয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু ইজারাদাররা এই নির্দেশনা মানছেন না। এর আর্থিক প্রভাব পড়ে রোগী বা তাদের স্বজনের ওপর।
ঢাকা মেডিকেলের পুরানো জরুরি বিভাগের সামনের জায়গাটা বলা যায় পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে ‘অ্যাম্বুলেন্স’। অ্যাম্বুলেন্স বললে ভুল হবে। কারণ এসব যানে অ্যাম্বুলেন্সে যেসব সুবিধা থাকা দরকার তা আছে কিনা সে নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কয়েকশ’ অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল কমপ্লেক্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অথচ কয়েক দিন ধরে ঘুরেও সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল লিখা কোনো অ্যাম্বুলেন্স চোখে পড়েনি।
সরকারি বিধি মোতাবেক প্রতিটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), অক্সিজেন সিলিন্ডার ও রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার সরঞ্জাম রাখা বাধ্যতামূলক। আর এসব সেবা পরিচালনার জন্য অ্যাম্বুলেন্সচালককে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হতে হবে। তবে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে এসব নিয়মের বালাই নেই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য বলেন, হাসপাতালে প্রতিটি ওয়ার্ডে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের লোকজন দর্শনার্থী সেজে ঘোরাফেরা করে। তারা যখন বুঝতে পারে যে ওই রোগী মারা যেতে পারে, তখন ওই রোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণ শুরু করে। পরবর্তীতে রোগী মারা গেলে লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের সন্ধান দেন। একে তো স্বজনের মৃত্যু, তার ওপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ বাড়ি নেয়া যায় ততই মঙ্গলÑ এ ধরনের চিন্তা থেকে চালকদের দাবিকৃত ভাড়ায় লাশ নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে স্বজনরা। হাসপাতালের সামনে অবস্থান করা অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সঙ্গে দরদাম করে কোনো লাভ হয় না। তারা প্রথমবার যে ভাড়া বলবে সেটাই ‘শেষ ভাড়া’। কারণ, আগের সিন্ডিকেট সদস্য অন্য চালকদের কাছে মৃত ব্যক্তির নাম ঠিকানা এবং কোথায় যাবে সব বলে দেয়। ফলে নতুন করে কোনো অ্যাম্বুলেন্স কম ভাড়ায় যেতে রাজি হবে না।