রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনি জটিলতা আপাতত কাটল।
রোববার (১ জুন) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ আজ রোববার এ রায় দেন। এর আগে ১৪ মে দলটির করা আপিলের শুনানি শেষে রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়েছিল।
২০০৯ সালে সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ জন ব্যক্তি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রদত্ত নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামি নিয়মিত লিভ টু আপিল করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ইসি প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন, কারণ সেদিন আপিলকারীর পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। পরে ‘ডিসমিসড ফর ডিফল্ট’ আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য জামায়াত পক্ষ থেকে আবেদন জানালে ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর তা গ্রহণ করে আপিল পুনরুজ্জীবিত করেন আদালত।
এরপর গত ৩ ডিসেম্বর শুরু হয় জামায়াতের আপিল শুনানি। কয়েক ধাপে শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন নির্ধারিত ছিল।
অবশেষে আজ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ২০১৩ সালের রায় বাতিল করে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার আদেশ প্রত্যাহার করেন।
সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
রায়ে আদালত বলেছে, দলটির ক্ষেত্রে পেন্ডিং (অনিষ্পন্ন) রেজিস্ট্রেশন ইস্যু এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থেকে থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট (বিচারগত ও আইনগত) পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায়ের পর এক ফেইসবুক পোস্টে শুকরিয়া জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। নির্বাচন কমিশন যেন দ্রুত নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়, সেজন্য আল্লাহর ‘সাহায্য’ চেয়েছেন তিনি।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় (রুল অ্যাবসলিউট বা যথাযথ) দিয়েছিলো হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ।
তবে আজকের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, তা ন্যায়সংগত হয়নি। গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দেওয়া রায় ও আদেশ বাতিল করা হলো।
‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক নিয়ে প্রত্যাহার আবেদন মঞ্জুর
২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ফুল কোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে বা কোনো নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বরাদ্দ করা যাবে না। আর যদি বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে তা বাতিল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবসহসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে চিঠি পাঠানোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তাতে বলা হয় কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।
এরপর ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা আরও সংশোধন করা হয়, যাতে ৬৪টি প্রতীকের তালিকা রয়েছে। এতে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক বাদ দেয়া হয়।
ফুল কোর্ট সভার ওই সিদ্ধান্ত বাতিল বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী গত ১২ মে আপিল বিভাগে আবেদন দাখিল করে। দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিলের সঙ্গে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। গত ১২ মে করা আবেদনটি প্রত্যাহার চেয়ে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিকারে নির্বাচন কমিশনের প্রতি পর্যবেক্ষণ চেয়ে গত ১৪ মে একটি আবেদন দেয় জামায়াতে ইসলামী।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, প্রত্যাহার আবেদন মঞ্জুর করা হলো, কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই।
প্রতীক নিয়ে কী বলছেন জামায়াতের আইনজীবীরা
রায়ের পর আপিলকারীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন এবং অন্য যে ইস্যু নির্বাচন কমিশনের সামনে আসবে, সেগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি করে সে বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে ‘অন্য ইস্যু বলতে প্রতীক’ বোঝানো হয়েছে।
শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পেল এবং প্রতীকের বিষয়টিও নির্বাচন কমিশনের সামনে পাঠানো হলো অন্য ইস্যু হিসেবে। সংক্ষিপ্ত আদেশ চেয়েছি। সংক্ষিপ্ত আদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছে নিয়ে যাব। কমিশন অতি দ্রুত নিবন্ধন ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বুঝিয়ে দেবে বলে প্রত্যাশা করি।’
জামায়াতে ইসলামীর অতীত
উপমহাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট গোড়াপত্তন জামায়াতে ইসলামীর, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। আর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরারাধে সহায়তা করা ও প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়ার অভিযোগ আছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পায় জামায়াত।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোট করে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল জামায়াত। সেবার তারা দুটি আসন পায়।
সেই সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে জামায়াতের অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই
যুদ্ধাপরাধ অর্থাৎ হত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় আওয়ামী লীগের সময়ে।
জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। আপিল নিষ্পত্তির আগে হাসপাতালে গোলাম আযমের মৃত্যু হয়।
নিবন্ধন বাতিল যে কারণে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতে ইসলামীও দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন।
তাতে বলা হয়, চার কারণে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন পেতে পারে না।
প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেইসঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না।
দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল।
তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না।
চতুর্থত, কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে- তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।
ওই রিটের পর ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট রুল জারি করে। রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।
কবে নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন করে জামায়াত। গঠনতন্ত্র থেকে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রসুল প্রদর্শিত’ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়।
রোববার, ০১ জুন ২০২৫
রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনি জটিলতা আপাতত কাটল।
রোববার (১ জুন) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ আজ রোববার এ রায় দেন। এর আগে ১৪ মে দলটির করা আপিলের শুনানি শেষে রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়েছিল।
২০০৯ সালে সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ জন ব্যক্তি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রদত্ত নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামি নিয়মিত লিভ টু আপিল করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ইসি প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন, কারণ সেদিন আপিলকারীর পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। পরে ‘ডিসমিসড ফর ডিফল্ট’ আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য জামায়াত পক্ষ থেকে আবেদন জানালে ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর তা গ্রহণ করে আপিল পুনরুজ্জীবিত করেন আদালত।
এরপর গত ৩ ডিসেম্বর শুরু হয় জামায়াতের আপিল শুনানি। কয়েক ধাপে শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন নির্ধারিত ছিল।
অবশেষে আজ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ২০১৩ সালের রায় বাতিল করে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার আদেশ প্রত্যাহার করেন।
সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
রায়ে আদালত বলেছে, দলটির ক্ষেত্রে পেন্ডিং (অনিষ্পন্ন) রেজিস্ট্রেশন ইস্যু এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থেকে থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট (বিচারগত ও আইনগত) পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায়ের পর এক ফেইসবুক পোস্টে শুকরিয়া জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। নির্বাচন কমিশন যেন দ্রুত নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়, সেজন্য আল্লাহর ‘সাহায্য’ চেয়েছেন তিনি।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় (রুল অ্যাবসলিউট বা যথাযথ) দিয়েছিলো হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ।
তবে আজকের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, তা ন্যায়সংগত হয়নি। গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দেওয়া রায় ও আদেশ বাতিল করা হলো।
‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক নিয়ে প্রত্যাহার আবেদন মঞ্জুর
২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ফুল কোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে বা কোনো নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বরাদ্দ করা যাবে না। আর যদি বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে তা বাতিল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবসহসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে চিঠি পাঠানোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তাতে বলা হয় কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।
এরপর ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা আরও সংশোধন করা হয়, যাতে ৬৪টি প্রতীকের তালিকা রয়েছে। এতে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক বাদ দেয়া হয়।
ফুল কোর্ট সভার ওই সিদ্ধান্ত বাতিল বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী গত ১২ মে আপিল বিভাগে আবেদন দাখিল করে। দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিলের সঙ্গে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। গত ১২ মে করা আবেদনটি প্রত্যাহার চেয়ে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিকারে নির্বাচন কমিশনের প্রতি পর্যবেক্ষণ চেয়ে গত ১৪ মে একটি আবেদন দেয় জামায়াতে ইসলামী।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, প্রত্যাহার আবেদন মঞ্জুর করা হলো, কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই।
প্রতীক নিয়ে কী বলছেন জামায়াতের আইনজীবীরা
রায়ের পর আপিলকারীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন এবং অন্য যে ইস্যু নির্বাচন কমিশনের সামনে আসবে, সেগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি করে সে বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে ‘অন্য ইস্যু বলতে প্রতীক’ বোঝানো হয়েছে।
শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পেল এবং প্রতীকের বিষয়টিও নির্বাচন কমিশনের সামনে পাঠানো হলো অন্য ইস্যু হিসেবে। সংক্ষিপ্ত আদেশ চেয়েছি। সংক্ষিপ্ত আদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছে নিয়ে যাব। কমিশন অতি দ্রুত নিবন্ধন ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বুঝিয়ে দেবে বলে প্রত্যাশা করি।’
জামায়াতে ইসলামীর অতীত
উপমহাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট গোড়াপত্তন জামায়াতে ইসলামীর, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। আর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরারাধে সহায়তা করা ও প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়ার অভিযোগ আছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পায় জামায়াত।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোট করে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল জামায়াত। সেবার তারা দুটি আসন পায়।
সেই সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে জামায়াতের অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই
যুদ্ধাপরাধ অর্থাৎ হত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় আওয়ামী লীগের সময়ে।
জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। আপিল নিষ্পত্তির আগে হাসপাতালে গোলাম আযমের মৃত্যু হয়।
নিবন্ধন বাতিল যে কারণে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতে ইসলামীও দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন।
তাতে বলা হয়, চার কারণে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন পেতে পারে না।
প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেইসঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না।
দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল।
তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না।
চতুর্থত, কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে- তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।
ওই রিটের পর ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট রুল জারি করে। রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।
কবে নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন করে জামায়াত। গঠনতন্ত্র থেকে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রসুল প্রদর্শিত’ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়।