এমএ কবীর
এক.
জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন কোন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো ওকলাহোমায় তুলসা-গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করেন। গত ১ জুন ২০২১ মঙ্গলবার ওই পরিদর্শন শত বছরের পুরোনো গণহত্যার ঘটনার দায় মোচনের একটা চেষ্টা। পরিদর্শনকালে জো বাইডেন বলেন, বর্ণবাদী সহিংসতা ও শ্বেত আধিপত্যবাদের উত্তরাধিকার মার্কিন সমাজে আজও বিদ্যমান। তুলসার গ্রিনউড এলাকায় নৃশংস ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজন এবং নিহত ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে দেখা করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ সময় বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভালো-মন্দ সব বিষয় জানা দরকার। গণমুখী রাষ্ট্রও এগুলো স্বীকার করে নেয়।’ তিনি বলেন, চলতি বছরের (২০২১) ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে রক্তক্ষয়ী হামলা এবং গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কয়েকটি রাজ্যে ভোটাভুটি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা একই সমস্যার (বর্ণবাদী সহিংসতা) পুনরাবৃত্তি মাত্র। তিনি বলেন, গ্রিনউডে যা ঘটেছে তা ঘৃণাত্মক ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদি কর্মকা-। এমন কর্মকা- চলছে আজও।
দুঃখজনক অনেক স্মৃতি আছে মানবজাতির। কোন কোনটি আবার নিষ্ঠুর, পৈশাচিক এবং জঘন্য। যেমন ‘গণহত্যা’। গণহত্যা কারা করেছে, কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষ করেছে? তবে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ- মানুষই মানুষকে হত্যা করে।
পৃথিবীর সব মানচিত্রেই রোদেলা কোমল সকাল আছে, আছে বৃষ্টি বা বরফস্নাত নিবিড় রাত্রিও। প্রকৃতির এমন সুন্দর বাতাবরণে পৃথিবীর সক্ষম ব্যক্তিরা কি সভ্যতার গতিপথ নিয়ে ভাবতে পারেন না? ক্ষমতাবানরা কি গ্লানিমুক্ত হওয়ার জন্য আত্মসমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন না? গণহত্যার সব চিত্রই নিষ্ঠুর, নৃশংস, বীভৎস। ‘তুলসা গণহত্যাও’ এমন এক জিঘাংসার নাম। আমেরিকার ওকলাহোমায় তুলসার অবস্থান। ১৯২১ সালে তুলসায় শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের হত্যার শিকার হন শত শত কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনী। এক শ্বেতাঙ্গ নারীর ওপর একজন কৃষ্ণাঙ্গের হামলার অভিযোগে তুলসায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর গণহত্যা চালায় স্থানীয় শ্বেতাঙ্গরা। ১৯২১ সালের ৩১ মে এবং পয়লা জুন, মাত্র দু’দিনে গুলি করে হত্যা করা হয় তিনশ কৃষ্ণাঙ্গকে। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর, লুট করা হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওই ঘটনা আফ্রিকান-আমেরিকান কমিউনিটিকে একেবারে তছনছ করে দেয়। তবে যে অভিযোগে গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হয় তা কখনোই প্রমাণ হয়নি। সহিংসতা তথা গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি একজনকেও।
তুলসা গণহত্যার পেছনে যে ঘৃণা, উগ্রতা ও বর্ণবাদী জিঘাংসা সক্রিয় ছিল তা আজও বর্তমান রয়েছে আমাদের সভ্যতায়। যারা সভ্যতার শাসক তাদের প্রশ্রয়ে, প্রণোদনায় অনেক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কাজগুলো সংঘটিত হচ্ছে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, উইঘুর কিংবা মায়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটে রয়েছে এর বাস্তবতা। মায়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্রবাদিরা আগে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। আর এখন দমনপীড়ন ও হত্যাকা- চালাচ্ছে মায়ানমারের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ওপর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যা গৃহযুদ্ধের ঘনঘটা। আসলে মানুষ প্রকৃত মানুষ না হলে তার হাতে কেউ নিরাপদ নয়। কারণ মানুষগুলো ত্যাগ-তিতিক্ষার চেতনায় শুদ্ধ হয়নি বরং দম্ভ ও ক্ষুদ্র স্বার্থে দূষিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের কল্যাণে যে বিচার-বিবেচনা ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ প্রয়োজন তা তাদের অভিধানে নেই।
পৃথিবী, প্রকৃতি- সবই টিকে আছে ভারসাম্য গুণে। ব্যক্তি মানুষকেও এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার যে মানবিক বিবেচনা ও ন্যায়ের দৃষ্টি- সেখানে ধ্বস নেমেছে। ক্ষুদ্র মানুষ সম্পদ ও সমরাস্ত্রের দম্ভে এমন এক বিকৃত বাতাবরণ সৃষ্টি করে রেখেছে, যেখানে সুস্থ চিন্তা-চেতনার প্রবেশ নিষেধ। দাম্ভিক মানুষেরা এখন আর শুভ কিংবা মানবিক ভাবনার ধারক নন। এসব কৃত্রিম প্রভুরা আসল প্রভুকে ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন স্রষ্টার বাণী এবং দিকনির্দেশনাকেও। ফলে জলে-স্থলে এবং মানুষের জীবনযাপনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিপর্যয়। আর এই বিপর্যয় দাম্ভিক ও ক্ষমতাবান মানুষদের ভুল কাজের বিষফল। দাম্ভিক ও নিষ্ঠুর নেতাদের চরম পন্থার কারণে পৃথিবীর বহু দেশের সমাজে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। ফলে শান্তি ও সমৃদ্ধির বদলে নেমে এসেছে ভাঙন ও বিপর্যয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও।
দুই.
মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পাঁচ মাস পার হলো। ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এর আগে গ্রেপ্তার করা হয় নেত্রী অং সান সুচিসহ নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের। এর প্রতিবাদে আর গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু থেকে বিক্ষোভ করে আসছে দেশটির সাধারণ জনতা।
সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলা ও নিপীড়ন চলছেই। ফলে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধে। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে মায়ানমারে। টানা সামরিক সহিংসতার মুখে নিজেদের রক্ষা করতে বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। জান্তা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে গড়ে ওঠা ছায়া সরকার (ঐক্য সরকার) ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) মুখপাত্র সাসা সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, মায়ানমারের জনগণের এখন আর কোন উপায় নেই। জান্তা বাহিনীর নির্বিচার অভিযান, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যা মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটি মাত্র শুরু। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কোন গ্রামে যদি একজন পুরুষও থাকে তবু খুনিদের সামনে তারা মাথানত করবে না। ফলে পুরো দেশ এখন গৃহযুদ্ধের দিকেই হাঁটছে। ঐক্য সরকারও এখন জান্তার বিরুদ্ধে গড়ে তুলছে নিজস্ব বাহিনী। পৃথিবীতে গৃহযুদ্ধের যে ইতিহাস তাতে ভালো বার্তা নেই। মায়ানমারের জনগণের সামনে অপেক্ষা করছে ধ্বংস ও দুর্ভোগের দিন। তবে সবকিছুরই একটা পরিণতি আছে। যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে জনতার সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না।
তিন.
ফরিদ শেখ। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুর যার ঠিকানা। বয়স্ক একজন মানুষ, স্ট্রোকে নড়বড়ে। কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। চারতলা পৈতৃক বাড়ি। ভাগে পেয়েছেন চিলেকোঠা। সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকেন। ছিল একটি ছোট গেঞ্জি কারখানা। করোনা’র ১৭ মাসে সে কারখানা বন্ধ। মালিক হয়ে নিজে কাজ করেন অন্যের কারখানায়। বৃদ্ধ মানুষ, স্ট্রোকের রোগী, কাজ তেমনটা পারেন না, তবুও মালিক রেখেছেন সম্মান করে। সেই মালিক বুঝতে পেরেছেন একজন মালিকের শ্রমিক হওয়ার বেদনা। তবে নারায়ণগঞ্জ উপজেলা সদরের নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা সে বেদনা বোঝেননি।
ফরিদ শেখ ৩৩৩ এ কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছেন। নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা চারতলা বাড়ি দেখেই সহায়তার বিপরীতে শাস্তি দিয়ে দিলেন। বললেন, ফরিদ শেখকে উল্টো একশ মানুষকে সহায়তা দিতে হবে। বৃদ্ধ হতদরিদ্র ফরিদ শেখ প্রশাসনিক ক্ষমতার ভয়ে তার স্ত্রী, ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে, টাকা জোগাড় করলেন। তারপর নিজের ঘরের কোনে চোখ মুছতে বসে গেলেন। করলেন দুই দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা। আর বিপরীতে সেই নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন, বন্ধকের টাকায় কেনা সে সহায়তা প্রদানের ফটোসেশন করে। এই ঘটনার আরেক অনুঘটক ছিলেন, তিনি এলাকার ইউপি সদস্য, জনপ্রতিনিধি। সুতরাং তিনিও ক্ষমতাবান। তিনিই নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছিলেন ফরিদ শেখের চারতলা বাড়ি আছে। এক ক্ষমতাবান আরেক ক্ষমতাবানের ওপর নির্ভর করেছেন।
বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের নজর এড়ায়নি। এটাও অবশ্য ফরিদ শেখের সৌভাগ্য বলা যেতে পারে। কারণ গণমাধ্যমের দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা কমে এসেছে। অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। আবার কেউ কালো চশমা এঁটে থাকেন।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক বলেছেন, ফরিদ শেখের টাকা ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু কোথা থেকে দেয়া হবে? এটা তো রাষ্ট্রে ভুল নয়, সরকারেরও নয়, স্রেফ ব্যক্তির। তাহলে রাষ্ট্র বা সরকার এর দায় নেবে কেন? একটি গণমাধ্যম ফরিদ শেখকে উদ্ধৃত করেছে। ফরিদ শেখ বলছেন, ‘আমার মানসম্মান গেল তার ক্ষতিপূরণ কে দেব’। জুতা মেরে গরুদানের এই প্রক্রিয়াটা সত্যিই ভুক্তভোগীর জন্য যাতনার। যারা ক্ষমতাবান, যাদের সঙ্গতি আছে, ফরিদ শেখের মতন অবস্থায় পড়েননি, তারা তার যাতনাটা বুঝতে পারবেন না। একজন মধ্যবিত্ত মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত না হলে কারও কাছে হাত বাড়ায় না। বিপরীতে নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ ও নগদ টাকার দিকে হাত বাড়ান অনেক ক্ষমতাবানরাই। অথচ সেই টাকা এই ফরিদ শেখদেরই।
ফরিদ শেখ’রা নিগৃহীত হয়, তাদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হয়। তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সম্প্র্রতি এক মা সন্তানকে নিয়ে রেলের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক বাপ সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। এদের কথা কেউ মনে রাখে না। গণ ও সামাজিকমাধ্যম যদি ফরিদ শেখকে নিয়ে হইচই না করত তাহলে ফরিদ শেখও অলখে থেকে যেতেন। হয়তো এক সময়ে আত্মহননে সফলও হতেন।
[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]
এমএ কবীর
বুধবার, ২৮ জুলাই ২০২১
এক.
জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন কোন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো ওকলাহোমায় তুলসা-গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করেন। গত ১ জুন ২০২১ মঙ্গলবার ওই পরিদর্শন শত বছরের পুরোনো গণহত্যার ঘটনার দায় মোচনের একটা চেষ্টা। পরিদর্শনকালে জো বাইডেন বলেন, বর্ণবাদী সহিংসতা ও শ্বেত আধিপত্যবাদের উত্তরাধিকার মার্কিন সমাজে আজও বিদ্যমান। তুলসার গ্রিনউড এলাকায় নৃশংস ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজন এবং নিহত ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে দেখা করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ সময় বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভালো-মন্দ সব বিষয় জানা দরকার। গণমুখী রাষ্ট্রও এগুলো স্বীকার করে নেয়।’ তিনি বলেন, চলতি বছরের (২০২১) ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে রক্তক্ষয়ী হামলা এবং গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কয়েকটি রাজ্যে ভোটাভুটি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা একই সমস্যার (বর্ণবাদী সহিংসতা) পুনরাবৃত্তি মাত্র। তিনি বলেন, গ্রিনউডে যা ঘটেছে তা ঘৃণাত্মক ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদি কর্মকা-। এমন কর্মকা- চলছে আজও।
দুঃখজনক অনেক স্মৃতি আছে মানবজাতির। কোন কোনটি আবার নিষ্ঠুর, পৈশাচিক এবং জঘন্য। যেমন ‘গণহত্যা’। গণহত্যা কারা করেছে, কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষ করেছে? তবে এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ- মানুষই মানুষকে হত্যা করে।
পৃথিবীর সব মানচিত্রেই রোদেলা কোমল সকাল আছে, আছে বৃষ্টি বা বরফস্নাত নিবিড় রাত্রিও। প্রকৃতির এমন সুন্দর বাতাবরণে পৃথিবীর সক্ষম ব্যক্তিরা কি সভ্যতার গতিপথ নিয়ে ভাবতে পারেন না? ক্ষমতাবানরা কি গ্লানিমুক্ত হওয়ার জন্য আত্মসমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন না? গণহত্যার সব চিত্রই নিষ্ঠুর, নৃশংস, বীভৎস। ‘তুলসা গণহত্যাও’ এমন এক জিঘাংসার নাম। আমেরিকার ওকলাহোমায় তুলসার অবস্থান। ১৯২১ সালে তুলসায় শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের হত্যার শিকার হন শত শত কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনী। এক শ্বেতাঙ্গ নারীর ওপর একজন কৃষ্ণাঙ্গের হামলার অভিযোগে তুলসায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর গণহত্যা চালায় স্থানীয় শ্বেতাঙ্গরা। ১৯২১ সালের ৩১ মে এবং পয়লা জুন, মাত্র দু’দিনে গুলি করে হত্যা করা হয় তিনশ কৃষ্ণাঙ্গকে। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর, লুট করা হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওই ঘটনা আফ্রিকান-আমেরিকান কমিউনিটিকে একেবারে তছনছ করে দেয়। তবে যে অভিযোগে গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হয় তা কখনোই প্রমাণ হয়নি। সহিংসতা তথা গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি একজনকেও।
তুলসা গণহত্যার পেছনে যে ঘৃণা, উগ্রতা ও বর্ণবাদী জিঘাংসা সক্রিয় ছিল তা আজও বর্তমান রয়েছে আমাদের সভ্যতায়। যারা সভ্যতার শাসক তাদের প্রশ্রয়ে, প্রণোদনায় অনেক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কাজগুলো সংঘটিত হচ্ছে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, উইঘুর কিংবা মায়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটে রয়েছে এর বাস্তবতা। মায়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্রবাদিরা আগে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। আর এখন দমনপীড়ন ও হত্যাকা- চালাচ্ছে মায়ানমারের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ওপর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যা গৃহযুদ্ধের ঘনঘটা। আসলে মানুষ প্রকৃত মানুষ না হলে তার হাতে কেউ নিরাপদ নয়। কারণ মানুষগুলো ত্যাগ-তিতিক্ষার চেতনায় শুদ্ধ হয়নি বরং দম্ভ ও ক্ষুদ্র স্বার্থে দূষিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের কল্যাণে যে বিচার-বিবেচনা ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ প্রয়োজন তা তাদের অভিধানে নেই।
পৃথিবী, প্রকৃতি- সবই টিকে আছে ভারসাম্য গুণে। ব্যক্তি মানুষকেও এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার যে মানবিক বিবেচনা ও ন্যায়ের দৃষ্টি- সেখানে ধ্বস নেমেছে। ক্ষুদ্র মানুষ সম্পদ ও সমরাস্ত্রের দম্ভে এমন এক বিকৃত বাতাবরণ সৃষ্টি করে রেখেছে, যেখানে সুস্থ চিন্তা-চেতনার প্রবেশ নিষেধ। দাম্ভিক মানুষেরা এখন আর শুভ কিংবা মানবিক ভাবনার ধারক নন। এসব কৃত্রিম প্রভুরা আসল প্রভুকে ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন স্রষ্টার বাণী এবং দিকনির্দেশনাকেও। ফলে জলে-স্থলে এবং মানুষের জীবনযাপনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিপর্যয়। আর এই বিপর্যয় দাম্ভিক ও ক্ষমতাবান মানুষদের ভুল কাজের বিষফল। দাম্ভিক ও নিষ্ঠুর নেতাদের চরম পন্থার কারণে পৃথিবীর বহু দেশের সমাজে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। ফলে শান্তি ও সমৃদ্ধির বদলে নেমে এসেছে ভাঙন ও বিপর্যয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও।
দুই.
মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পাঁচ মাস পার হলো। ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এর আগে গ্রেপ্তার করা হয় নেত্রী অং সান সুচিসহ নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের। এর প্রতিবাদে আর গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু থেকে বিক্ষোভ করে আসছে দেশটির সাধারণ জনতা।
সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলা ও নিপীড়ন চলছেই। ফলে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধে। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে মায়ানমারে। টানা সামরিক সহিংসতার মুখে নিজেদের রক্ষা করতে বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। জান্তা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে গড়ে ওঠা ছায়া সরকার (ঐক্য সরকার) ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) মুখপাত্র সাসা সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, মায়ানমারের জনগণের এখন আর কোন উপায় নেই। জান্তা বাহিনীর নির্বিচার অভিযান, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যা মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটি মাত্র শুরু। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কোন গ্রামে যদি একজন পুরুষও থাকে তবু খুনিদের সামনে তারা মাথানত করবে না। ফলে পুরো দেশ এখন গৃহযুদ্ধের দিকেই হাঁটছে। ঐক্য সরকারও এখন জান্তার বিরুদ্ধে গড়ে তুলছে নিজস্ব বাহিনী। পৃথিবীতে গৃহযুদ্ধের যে ইতিহাস তাতে ভালো বার্তা নেই। মায়ানমারের জনগণের সামনে অপেক্ষা করছে ধ্বংস ও দুর্ভোগের দিন। তবে সবকিছুরই একটা পরিণতি আছে। যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে জনতার সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না।
তিন.
ফরিদ শেখ। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুর যার ঠিকানা। বয়স্ক একজন মানুষ, স্ট্রোকে নড়বড়ে। কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। চারতলা পৈতৃক বাড়ি। ভাগে পেয়েছেন চিলেকোঠা। সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকেন। ছিল একটি ছোট গেঞ্জি কারখানা। করোনা’র ১৭ মাসে সে কারখানা বন্ধ। মালিক হয়ে নিজে কাজ করেন অন্যের কারখানায়। বৃদ্ধ মানুষ, স্ট্রোকের রোগী, কাজ তেমনটা পারেন না, তবুও মালিক রেখেছেন সম্মান করে। সেই মালিক বুঝতে পেরেছেন একজন মালিকের শ্রমিক হওয়ার বেদনা। তবে নারায়ণগঞ্জ উপজেলা সদরের নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা সে বেদনা বোঝেননি।
ফরিদ শেখ ৩৩৩ এ কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছেন। নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা চারতলা বাড়ি দেখেই সহায়তার বিপরীতে শাস্তি দিয়ে দিলেন। বললেন, ফরিদ শেখকে উল্টো একশ মানুষকে সহায়তা দিতে হবে। বৃদ্ধ হতদরিদ্র ফরিদ শেখ প্রশাসনিক ক্ষমতার ভয়ে তার স্ত্রী, ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে, টাকা জোগাড় করলেন। তারপর নিজের ঘরের কোনে চোখ মুছতে বসে গেলেন। করলেন দুই দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা। আর বিপরীতে সেই নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন, বন্ধকের টাকায় কেনা সে সহায়তা প্রদানের ফটোসেশন করে। এই ঘটনার আরেক অনুঘটক ছিলেন, তিনি এলাকার ইউপি সদস্য, জনপ্রতিনিধি। সুতরাং তিনিও ক্ষমতাবান। তিনিই নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছিলেন ফরিদ শেখের চারতলা বাড়ি আছে। এক ক্ষমতাবান আরেক ক্ষমতাবানের ওপর নির্ভর করেছেন।
বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের নজর এড়ায়নি। এটাও অবশ্য ফরিদ শেখের সৌভাগ্য বলা যেতে পারে। কারণ গণমাধ্যমের দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা কমে এসেছে। অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। আবার কেউ কালো চশমা এঁটে থাকেন।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক বলেছেন, ফরিদ শেখের টাকা ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু কোথা থেকে দেয়া হবে? এটা তো রাষ্ট্রে ভুল নয়, সরকারেরও নয়, স্রেফ ব্যক্তির। তাহলে রাষ্ট্র বা সরকার এর দায় নেবে কেন? একটি গণমাধ্যম ফরিদ শেখকে উদ্ধৃত করেছে। ফরিদ শেখ বলছেন, ‘আমার মানসম্মান গেল তার ক্ষতিপূরণ কে দেব’। জুতা মেরে গরুদানের এই প্রক্রিয়াটা সত্যিই ভুক্তভোগীর জন্য যাতনার। যারা ক্ষমতাবান, যাদের সঙ্গতি আছে, ফরিদ শেখের মতন অবস্থায় পড়েননি, তারা তার যাতনাটা বুঝতে পারবেন না। একজন মধ্যবিত্ত মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত না হলে কারও কাছে হাত বাড়ায় না। বিপরীতে নির্লজ্জভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ ও নগদ টাকার দিকে হাত বাড়ান অনেক ক্ষমতাবানরাই। অথচ সেই টাকা এই ফরিদ শেখদেরই।
ফরিদ শেখ’রা নিগৃহীত হয়, তাদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হয়। তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সম্প্র্রতি এক মা সন্তানকে নিয়ে রেলের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক বাপ সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। এদের কথা কেউ মনে রাখে না। গণ ও সামাজিকমাধ্যম যদি ফরিদ শেখকে নিয়ে হইচই না করত তাহলে ফরিদ শেখও অলখে থেকে যেতেন। হয়তো এক সময়ে আত্মহননে সফলও হতেন।
[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]