alt

উপ-সম্পাদকীয়

পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন

দেবাহুতি চক্রবর্তী

: রোববার, ০১ আগস্ট ২০২১

পদ্মা নদীর সঙ্গে আবহমানকালের বাংলার ইতিহাস-ভূগোল-অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি জড়িত। বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এই পদ্মা বিশেষ স্থানজুড়ে আছে। রাজবাড়ী জেলারও অবিচ্ছিন্ন সত্তা এই পদ্মা। প্রমত্তা পদ্মা ক্রমশ নানাভাবে তার গভীরতা হারিয়েছে। সম্ভবত ফারাক্কা বাঁধ তার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরেও গোয়ালন্দ-আরিচা ছিল ঢাকা যাওয়ার নৌপথ। কয়েক বছরের মধ্যে সেই পথের দূরত্ব কমে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট চালু হয়। আশি দশকের প্রথম থেকেই পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য ড্রেজিং জোরদার করার বিষয়ে কথা শোনা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী কতটা হয়েছে বা হয়নি আমার জানা নেই। রাজবাড়ী জেলা পদ্মার ভাঙনের দৃশ্যমান শিকার হয়েছে সেও অনেক দিন আগে থেকেই।

রাজবাড়ী চিরকালই বন্যাপ্রবণ আর নদীভাঙন কবলিত এলাকা। ১৯৮৭-৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা পরবর্তীতে ফরিদপুর-বরিশাল এফসিডি প্রকল্প রাজবাড়ী ইউনিটের আওতায় ৪৫ কিমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রথম তৈরি হয়। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৪ থেকে নদীর গতিপথ ও মারফোলজ্যিকাল পরিবর্তনের ফলে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। ২০০৭ সালে ৯২৫ মিটার নদীতীর সম্পূর্ণভাবে নদীগর্ভে বিলীন হয়। হাজার হাজার পরিবার ভূমিহীন হয় এবং সরকারি বেসরকারি বহু অবকাঠামো নদীগ্রাসে হারিয়ে যায়। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে রাজবাড়ী। সেই সময় রাজবাড়ীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ অনেক বেশি উদ্বিগ্ন এবং বিষয়টি সুরাহায় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টিতে যথেষ্ট তৎপর ছিল। সমস্যাটিকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবনার বিপরীতে জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট অর্থ সংযোজন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরিকল্পনা সুনির্ণয় এবং অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান অনেকে।

এ গুরুত্বগুলো ক্রমেই কমে আসতে থাকে। বছর বছর ভাঙন বাড়ে। নদী যত কাছে আসছে প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগীরা ছাড়া ততই যেন বৃহৎ জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজের নিস্পৃহতা বাড়ছে। অপরিকল্পিত বালু ব্যবসা, অগণিত বালুর চাতাল, বালুবাহী বার্জের আনাগোনা, আর নানাবিধ মাসোহারা-উৎকোচ-উপহারের মাঝ দিয়ে কিছু কিছু ব্যক্তি, সরকারি-বেসরকারি কর্তাব্যক্তি-কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতার অবিশ্বাস্য উত্থান হয়েছে মর্মে লোকমুখে শোনা যায়।

২০১৬ সালে এ অঞ্চলের ভাঙন ঠেকানোর জন্য নদী শাসনের নকশা অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করে। খুলনা শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠান এ কাজে ঠিকাদারি পায় মর্মে জানা যায়। প্রথমে ৭৬ কোটি টাকার এবং ২০১৮ থেকে ৩৭৬ কোটি টাকার কাজ চলতি বছরের ৩১ মে শেষ হয় বলে স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চলতি জুলাই মাসের মধ্যভাগ থেকেই এলাকায় এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ২৭ জুলাই থেকে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। শহর রক্ষা বাঁধ সংলগ্ন ৩০০ মিটার এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। মিজানপুর, বরাট বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়ে উঠছে। ভাঙনের স্থায়ী সংরক্ষণের নামে যে কাজগুলো এতদিন ধরে হয়েছে তা চোখের সামনে ধসে যাচ্ছে। একের পর এক সিসি ব্লকের সারি মুহূর্তের মাঝে নদীর আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। পাড়ের মানুষদের নানা ধরনের বক্তব্য আর অভিযোগ রয়েছে এ সদ্যসমাপ্ত প্রকল্পের কাজ নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে-নিয়মিত অপরিকল্পিত বালু ব্যবসা নিয়ে। এসব অভিযোগ আমলে নেওয়ার মত কে কোথায় আছে জানা নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাজার হাজার বালুর বস্তা নদীতে ফেলে ভাঙন ঠেকানোর জন্য খুব তৎপরতা দেখাচ্ছে। সাময়িক হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকল্প কাজে কোনো গাফলতি বা ত্রুটির কথা অস্বীকার করেন। ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলতে চান যে, ২০১৬ সালে যে ডিজাইন করা হয় সেই ডিজাইন অনুযায়ী ২০২১ অবধি কাজ হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নদীর উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা হতে পারে। আরও বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে, হবে এবং তার জন্য টাকা অনুমোদন ও প্রাপ্তির জন্য তাদের চেষ্টা চলছে। আমাদের প্রশাসন ও বিভিন্ন নেতারা বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন বলেও বিভিন্ন খবরে প্রকাশ হচ্ছে।

অতঃপর এ পর্যায়ে আবার আশ্বস্ত হওয়া সাধারণের দায়িত্বে পড়ে। নদীশাসন কঠিন কাজ। তারপর সে নদী যদি পদ্মা হয়; কিন্তু এই পদ্মা নদীকে বাগে এনেই পদ্মা ব্রিজ প্রায় সম্পন্ন হতে চলেছে। দেশের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজবাড়ীর নিকটতম ফরিদপুরে অবস্থিত। বিশাল আর মনোরম অবকাঠামো নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিষ্ঠানটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে নেই বছর ত্রিশ হলো। স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান; কিন্তু দেশে নদীর নাব্য, গতিপ্রকৃতি, তীর সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে নিয়মিত গবেষণালব্ধ ফলাফল কী শুধু ফাইলবন্দী করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য? নাকি পাউবিকে মতামত দিয়ে সময়ে সময়ে সহযোগিতা করা তাদের দায়িত্ব? পাউবিও কী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ চেয়েছে? নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ যারা নদীর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও কম নয়। কখনো কি সেসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে? পানি উন্নয়ন বোর্ড সেক্ষেত্রে সরেজমিন কাজ চলার সময় নদীর পরিবর্তিত গতি প্রকৃতির ওপর কোন লক্ষ্য না রেখেই বিশাল অংকের টাকা শুধুই কী স্রোতে ভাসিয়েছে? আমাদের দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শুধুই কী ডিজাইন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল তুলে নেওয়া? টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ীও পাউবি নকশা পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু পারল না কেন? এই এত কেনর উত্তর পাওয়া কঠিন। নদীপাড়ের মানুষদের বা সাধারণ জনগণের বিশ্বাস শত শত কোটি টাকার কাজ গুণগত মানেও সঠিক হয়নি। এবং যে অংকের টাকা বরাদ্দ ছিল তার খরচও সঠিকভাবে হয়নি। ড্রেজিংয়ের বিষয়ে মানুষ নিয়তই প্রশ্ন তুলেছে। খরার সময় বাদ দিয়ে বর্ষা ঋতুতেই রাস্তাঘাট, নদীনালার কাজ বেশি হওয়াটা আমাদের দেশের রীতি বটে। যেহেতু বাজেট বরাদ্দ হয় জুন মাসে।

কথা তারপরেও থেকে যায়। নদীভাঙন থেকে রাজবাড়ীকে বাঁচানোর প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব যাদেরই থাকুক, তা তদারকির দায়িত্ব জেলার সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিরা এড়িয়ে যেতে পারেন কি? যে অ-বিজ্ঞানসম্মত বালু ব্যবসা নদীভাঙনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? নদীভাঙন প্রতিরোধে এই বড় অংকের বরাদ্দকৃত টাকার বিনিময়ে রাজবাড়ী কী পেল বা পেতে যাচ্ছে-তা দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের কী নেই? নদীর বাৎসরিক ভাঙনের স্বরূপ নির্ণয় এবং সঠিকভাবে তদারকি থাকলে দায়সারা কাজ সেরে ঠিকাদার বিল বুঝে নেওয়ার জন্য উৎসাহী হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশের দুর্ভাগ্য এমনতর নমুনাই সর্বক্ষেত্রে। এসব অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ; যা থেকে বেরোনো কঠিন।

নদীর নাব্য, গতিপ্রকৃতি, তীর সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে নিয়মিত গবেষণালব্ধ ফলাফল কী শুধু ফাইলবন্দী করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য? নাকি পাউবোকে মতামত দিয়ে সময়ে সময়ে সহযোগিতা করা তাদের দায়িত্ব? পাউবোও কী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ চেয়েছে? নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ যারা নদীর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও কম নয়। কখনও কি সেসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে?

আসলে এই ভাঙন এখন যেভাবে বালুর বস্তা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা চলছে এর কার্যকারিতা সাময়িক। কিন্তু সার্বিকভাবে রাজবাড়ী জেলার মানুষের দুর্ভোগ কতদিনের আর কতদূর অবধি তা কেউ জানে না। ২০০৮ সালে শহর রক্ষা বাঁধ থেকে নদীর দূরত্ব ছিল ৫৫০ মিটার। এখন শুধু ৫০ মিটারের অনেক কম সেই দূরত্ব। ‘আজ ফাটলের ভেতর থেকে ভয়াবহ জলের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ... ক্রুদ্ধ, উন্মত্ত এবং ক্ষুধার্ত জল মাটি খাওয়ার জন্য মাটির দিক এগিয়ে আসছে। ভয়ে মাটি কাঁপছে, মাটি কাঁদছে। ... আর সেই ভয়ার্ত মাটির পাশে সত্যিই আজ বিপন্ন রাজবাড়ী।’

[লেখক : আইনজীবী]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন

দেবাহুতি চক্রবর্তী

রোববার, ০১ আগস্ট ২০২১

পদ্মা নদীর সঙ্গে আবহমানকালের বাংলার ইতিহাস-ভূগোল-অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি জড়িত। বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এই পদ্মা বিশেষ স্থানজুড়ে আছে। রাজবাড়ী জেলারও অবিচ্ছিন্ন সত্তা এই পদ্মা। প্রমত্তা পদ্মা ক্রমশ নানাভাবে তার গভীরতা হারিয়েছে। সম্ভবত ফারাক্কা বাঁধ তার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরেও গোয়ালন্দ-আরিচা ছিল ঢাকা যাওয়ার নৌপথ। কয়েক বছরের মধ্যে সেই পথের দূরত্ব কমে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট চালু হয়। আশি দশকের প্রথম থেকেই পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য ড্রেজিং জোরদার করার বিষয়ে কথা শোনা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী কতটা হয়েছে বা হয়নি আমার জানা নেই। রাজবাড়ী জেলা পদ্মার ভাঙনের দৃশ্যমান শিকার হয়েছে সেও অনেক দিন আগে থেকেই।

রাজবাড়ী চিরকালই বন্যাপ্রবণ আর নদীভাঙন কবলিত এলাকা। ১৯৮৭-৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা পরবর্তীতে ফরিদপুর-বরিশাল এফসিডি প্রকল্প রাজবাড়ী ইউনিটের আওতায় ৪৫ কিমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রথম তৈরি হয়। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৪ থেকে নদীর গতিপথ ও মারফোলজ্যিকাল পরিবর্তনের ফলে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। ২০০৭ সালে ৯২৫ মিটার নদীতীর সম্পূর্ণভাবে নদীগর্ভে বিলীন হয়। হাজার হাজার পরিবার ভূমিহীন হয় এবং সরকারি বেসরকারি বহু অবকাঠামো নদীগ্রাসে হারিয়ে যায়। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে রাজবাড়ী। সেই সময় রাজবাড়ীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ অনেক বেশি উদ্বিগ্ন এবং বিষয়টি সুরাহায় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টিতে যথেষ্ট তৎপর ছিল। সমস্যাটিকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবনার বিপরীতে জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট অর্থ সংযোজন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরিকল্পনা সুনির্ণয় এবং অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান অনেকে।

এ গুরুত্বগুলো ক্রমেই কমে আসতে থাকে। বছর বছর ভাঙন বাড়ে। নদী যত কাছে আসছে প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগীরা ছাড়া ততই যেন বৃহৎ জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজের নিস্পৃহতা বাড়ছে। অপরিকল্পিত বালু ব্যবসা, অগণিত বালুর চাতাল, বালুবাহী বার্জের আনাগোনা, আর নানাবিধ মাসোহারা-উৎকোচ-উপহারের মাঝ দিয়ে কিছু কিছু ব্যক্তি, সরকারি-বেসরকারি কর্তাব্যক্তি-কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতার অবিশ্বাস্য উত্থান হয়েছে মর্মে লোকমুখে শোনা যায়।

২০১৬ সালে এ অঞ্চলের ভাঙন ঠেকানোর জন্য নদী শাসনের নকশা অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করে। খুলনা শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠান এ কাজে ঠিকাদারি পায় মর্মে জানা যায়। প্রথমে ৭৬ কোটি টাকার এবং ২০১৮ থেকে ৩৭৬ কোটি টাকার কাজ চলতি বছরের ৩১ মে শেষ হয় বলে স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চলতি জুলাই মাসের মধ্যভাগ থেকেই এলাকায় এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ২৭ জুলাই থেকে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। শহর রক্ষা বাঁধ সংলগ্ন ৩০০ মিটার এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। মিজানপুর, বরাট বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়ে উঠছে। ভাঙনের স্থায়ী সংরক্ষণের নামে যে কাজগুলো এতদিন ধরে হয়েছে তা চোখের সামনে ধসে যাচ্ছে। একের পর এক সিসি ব্লকের সারি মুহূর্তের মাঝে নদীর আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। পাড়ের মানুষদের নানা ধরনের বক্তব্য আর অভিযোগ রয়েছে এ সদ্যসমাপ্ত প্রকল্পের কাজ নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে-নিয়মিত অপরিকল্পিত বালু ব্যবসা নিয়ে। এসব অভিযোগ আমলে নেওয়ার মত কে কোথায় আছে জানা নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাজার হাজার বালুর বস্তা নদীতে ফেলে ভাঙন ঠেকানোর জন্য খুব তৎপরতা দেখাচ্ছে। সাময়িক হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকল্প কাজে কোনো গাফলতি বা ত্রুটির কথা অস্বীকার করেন। ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলতে চান যে, ২০১৬ সালে যে ডিজাইন করা হয় সেই ডিজাইন অনুযায়ী ২০২১ অবধি কাজ হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নদীর উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা হতে পারে। আরও বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে, হবে এবং তার জন্য টাকা অনুমোদন ও প্রাপ্তির জন্য তাদের চেষ্টা চলছে। আমাদের প্রশাসন ও বিভিন্ন নেতারা বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন বলেও বিভিন্ন খবরে প্রকাশ হচ্ছে।

অতঃপর এ পর্যায়ে আবার আশ্বস্ত হওয়া সাধারণের দায়িত্বে পড়ে। নদীশাসন কঠিন কাজ। তারপর সে নদী যদি পদ্মা হয়; কিন্তু এই পদ্মা নদীকে বাগে এনেই পদ্মা ব্রিজ প্রায় সম্পন্ন হতে চলেছে। দেশের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজবাড়ীর নিকটতম ফরিদপুরে অবস্থিত। বিশাল আর মনোরম অবকাঠামো নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিষ্ঠানটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে নেই বছর ত্রিশ হলো। স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান; কিন্তু দেশে নদীর নাব্য, গতিপ্রকৃতি, তীর সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে নিয়মিত গবেষণালব্ধ ফলাফল কী শুধু ফাইলবন্দী করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য? নাকি পাউবিকে মতামত দিয়ে সময়ে সময়ে সহযোগিতা করা তাদের দায়িত্ব? পাউবিও কী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ চেয়েছে? নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ যারা নদীর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও কম নয়। কখনো কি সেসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে? পানি উন্নয়ন বোর্ড সেক্ষেত্রে সরেজমিন কাজ চলার সময় নদীর পরিবর্তিত গতি প্রকৃতির ওপর কোন লক্ষ্য না রেখেই বিশাল অংকের টাকা শুধুই কী স্রোতে ভাসিয়েছে? আমাদের দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শুধুই কী ডিজাইন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল তুলে নেওয়া? টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ীও পাউবি নকশা পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু পারল না কেন? এই এত কেনর উত্তর পাওয়া কঠিন। নদীপাড়ের মানুষদের বা সাধারণ জনগণের বিশ্বাস শত শত কোটি টাকার কাজ গুণগত মানেও সঠিক হয়নি। এবং যে অংকের টাকা বরাদ্দ ছিল তার খরচও সঠিকভাবে হয়নি। ড্রেজিংয়ের বিষয়ে মানুষ নিয়তই প্রশ্ন তুলেছে। খরার সময় বাদ দিয়ে বর্ষা ঋতুতেই রাস্তাঘাট, নদীনালার কাজ বেশি হওয়াটা আমাদের দেশের রীতি বটে। যেহেতু বাজেট বরাদ্দ হয় জুন মাসে।

কথা তারপরেও থেকে যায়। নদীভাঙন থেকে রাজবাড়ীকে বাঁচানোর প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব যাদেরই থাকুক, তা তদারকির দায়িত্ব জেলার সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিরা এড়িয়ে যেতে পারেন কি? যে অ-বিজ্ঞানসম্মত বালু ব্যবসা নদীভাঙনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? নদীভাঙন প্রতিরোধে এই বড় অংকের বরাদ্দকৃত টাকার বিনিময়ে রাজবাড়ী কী পেল বা পেতে যাচ্ছে-তা দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের কী নেই? নদীর বাৎসরিক ভাঙনের স্বরূপ নির্ণয় এবং সঠিকভাবে তদারকি থাকলে দায়সারা কাজ সেরে ঠিকাদার বিল বুঝে নেওয়ার জন্য উৎসাহী হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশের দুর্ভাগ্য এমনতর নমুনাই সর্বক্ষেত্রে। এসব অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ; যা থেকে বেরোনো কঠিন।

নদীর নাব্য, গতিপ্রকৃতি, তীর সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে নিয়মিত গবেষণালব্ধ ফলাফল কী শুধু ফাইলবন্দী করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য? নাকি পাউবোকে মতামত দিয়ে সময়ে সময়ে সহযোগিতা করা তাদের দায়িত্ব? পাউবোও কী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ চেয়েছে? নদীপাড়ের সাধারণ মানুষ যারা নদীর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও কম নয়। কখনও কি সেসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে?

আসলে এই ভাঙন এখন যেভাবে বালুর বস্তা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা চলছে এর কার্যকারিতা সাময়িক। কিন্তু সার্বিকভাবে রাজবাড়ী জেলার মানুষের দুর্ভোগ কতদিনের আর কতদূর অবধি তা কেউ জানে না। ২০০৮ সালে শহর রক্ষা বাঁধ থেকে নদীর দূরত্ব ছিল ৫৫০ মিটার। এখন শুধু ৫০ মিটারের অনেক কম সেই দূরত্ব। ‘আজ ফাটলের ভেতর থেকে ভয়াবহ জলের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ... ক্রুদ্ধ, উন্মত্ত এবং ক্ষুধার্ত জল মাটি খাওয়ার জন্য মাটির দিক এগিয়ে আসছে। ভয়ে মাটি কাঁপছে, মাটি কাঁদছে। ... আর সেই ভয়ার্ত মাটির পাশে সত্যিই আজ বিপন্ন রাজবাড়ী।’

[লেখক : আইনজীবী]

back to top