alt

উপ-সম্পাদকীয়

মৃত্যুর ক্রন্দন নয়, ধ্বনিত হোক জীবনের স্পন্দন

রণেশ মৈত্র

: বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১

আক্রান্ত না হয়ে পারছে না বাঙালি। ২০২১-এর জুলাই থেকে করোনা আতঙ্কের ভয়াবহ একটি মাস। দৈনন্দিন মৃত্যের বিগত ২৬ জুলাই প্রায় ২৫০ তে এবং সংক্রমিতের সংখ্যা ১৫,০০০-এর ঊর্ধ্বে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। জানা সবারই, আতঙ্কিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে সবাইকে করোনার চলমান ঢেউ সামলাতে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আতঙ্ক তো পিছু ছাড়ছে না কারও। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই বড় হচ্ছে সংক্রমিতের সংখ্যাও নিত্যদিন বাড়ছে বিপুল গতিবেগ নিয়ে।

করোনার এই আক্রমণ নতুন নয়, দেড় দেড়টি বছর ধরে চলছে। এই দের বছরের মধ্যে এমন একটি দিনও কারও চোখে পড়েনি-যেদিন কেউ সংক্রমিত হননি- কারও মৃত্যু ঘটেনি। আবার এমন এমন মৃত্যু ঘটছেÑযা সমগ্র বাঙালি জাতির কাছেই দুঃসহ। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে হারালাম জনপ্রিয় শিল্পী ফকির আলমগীরকে। হারিয়ে যাওয়া বিশিষ্টজনদের তালিকা এতই দীর্ঘ যে সবার নাম উল্লেখ করতে গেলে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তার স্থান সংকুলান হবে না। শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, নার্স বিপুল সংখ্যায় হারিয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে, আমার মনে হয় যেন দেশটি আমাদের বুদ্ধিজীবীশূন্য হয়ে পড়েছে। আগামীতে বাঙালি জাতি যে বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানীগুণী মানুষের সংকটে পড়তে চলেছে-এক কথায় তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। তবু যারা বেঁচে আছেন-তারা সবাই বেঁচে থাকুন সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত দেহ নিয়ে। আজকের দিনে জাতির প্রার্থনা এটাই।

কিন্তু অশেষ অবদান সত্ত্বেও বাংলাদেশ তো শুধু বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং জ্ঞানীগুণীদের দেশ নয়, একমাত্র তাদের অবদানেই দেশটি টিকে আছে তাও ঠিক নয়। দেশকে প্রধানত: বাঁচিয়ে রেখেছেন কলিমউদ্দিন ছলিম জাতীয় নামধারী হত-দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা-যারা সংখ্যায় কয়েক কোটি।

আজ সেই গ্রামীণ মানুষদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না করোনা। ঈদের কারণে লক ডাউনের কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঈদযাত্র করে বিভিন্ন জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলগুলিতে ঈদ উদযাপন করতে আসার ফলে সংক্রমণের হার ও সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার ও সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতের বিরুদ্ধেই সরকার লকডাউন সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিল করা হয়েছিল। পরিণতিতে এখন কী গ্রাম, কী শহর-সর্বত্র করোনার মহামারি সর্বত্র কান্নার রোল।

এ কান্না থামাতে হবে। মৃত্যু ও সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও তা অনেক কমিয়ে আনা কমিয়ে আনা সম্ভব বিজ্ঞানের কল্যাণে। অবশ্য বিলম্বে হলেও এবং অসংখ্য মৃত্যু ও সংক্রমণের পরে বিগত ২৬ জুলাই মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপক হারে ভ্যাকসিনেসনের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন ৪,০০০ নতুন ডাক্তার ও ৪,০০০ নতুন নার্স নিয়োগ দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্যে তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতদিনের মধ্যে ওই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন, কতদিনে ওই ডাক্তার-নার্স নিয়োগ কামনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত পাঠাবেন বা গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া কত দিনে শেষ হবেÑতা বলা দুরূহ। তবে এটুকু মাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোন ইন্টারভিউ বা পরীক্ষা ছাড়াই এই নিয়োগ দেয়া হবে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি প্রধানমন্ত্রী বলার পরেই বুঝতে পারলেন যে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ভ্যাকসিনেশন প্রসারিত করা মানুষ বাঁচানোর স্বার্থে জরুরি প্রয়োজন? যদি তা না-ই বুঝতে পারেন তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ থেকে এই মুহূর্তেই তার পদত্যাগ করা উচিত বা তাকে পদচ্যুত করা উচিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার অযোগ্যতা করোনা সংক্রমণের শুরুর লগ্ন থেকেই দেখিয়ে আসবেন। সব মহলের অভিযোগ, স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয়ই হলো সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং মন্ত্রী স্বয়ং ওই দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন বলেও অভিযোগ পুরোনো।

দেড় বছর ধরে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দেশের নানা স্থানে অব্যাহত রয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটে উপযুক্ত পরিমাণ বরাদ্দ (কোন বিশেষ বরাদ্দ তো দূরের কথা) তিনি আনতে পারেননি। আবার বাজেটে যে বরাদ্দ বিগত অর্থবছরে হয়েছিল-তারও সিংহভাগ ব্যয়িত না হয়ে ফেরত দেয়া হয়েছে।

অথচ সর্বত্র সব সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, অক্সিজেন সংকট, করোনা চিকিৎসায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর মাত্রাধিক স্বল্পতা-জনিত সংকট, ৩৫টি জেলায় কোন আইসিইউ বেড নেই, অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই-এ কথা জেনেও (তিনি হয়তো খোঁজ নাও নিয়ে থাকতে পারেন) সেই জরুরি বিষয়গুলোতে অর্থব্যয় না করে বাজেটে পাওয়া বরাদ্দের একটি পয়সাও ফেরত যাওয়া কি ভাবা যায়?

ঈদযাত্রার জন্য ন্যূনতম সরকারি নির্দেশনাগুলো শিথিল না করে তা কঠোরতর করার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা মানুষ বাঁচানোর স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল। তা না করায় দেশটি বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে ততদিক মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর কবলে চলে পড়ছেন।

এইটুকু লিখতেই টেলিভিশনে চোখ বুলিয়ে জানলাম ২৭ জুলাই রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু ঘটেছে ২৫৮ জনের এবং ১৯,০০০ এর বেশি আক্রান্ত। এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে-মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে। জীবনরক্ষা করার যোগ্যতা সম্পন্ন একজন নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগের বিকল্প নেই।

তার সঙ্গে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব সরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে যথেষ্ট-সংখ্যক বেড, আইসিইউ অক্সিজেনের ব্যবস্থা এবং করোনা চিকিৎসায় প্রতিক্ষিত যথেষ্ট-সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থাও করতে হবে। একই সঙ্গে বয়স নির্বিশেষে, অন্তত ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সবার টিকার ব্যবস্থা গ্রহণ ও শহর গ্রাম নির্বিশেষে বাধ্যতামূলকভাবে সবার টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে উপযুক্ত সব নাগরিকের টিকাদান সম্পন্ন করা যায়। আর যত ব্যবস্থাই থাক-করোনার প্রতিরোধের এখন পর্যন্ত সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হলো টিকা।

আমাদের প্রচার যন্ত্রসমূহ দিবারাত্র (বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলো) মৃত্যুর ও আক্রান্তের খবর প্রচার করে মানুষের মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে-কিন্তু তারা যেসব দেশে করোনা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে সে সব দেশের মানুষ কীভাবে করোনা প্রতিরোধে সক্ষম হলেনÑতা দিব্যি প্রচার করতে পারে। পত্রিকাগুলোতে ওই প্রতিবেদন নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করলে আশাহত মানুষগুলো তা দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারে। বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী আমাদের দূতাবাসগুলোর প্রেস সচিব এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। বস্তুত আমরা যেভাবে করোনাকে ওয়াকওভার দিয়ে চলছি দ্রুত তার অবসান ঘটিয়ে বিশ্বের নানা দেশ করোনাবিরোধী সব লড়াই এর কাহিনী তুলে ধরলে মানুষের মনে তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটারসমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস রাখতে হবে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত

এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও দায়িত্ব রয়েছে। তিনি যদি আমাদের বিদেশি দূতাবাসগুলোকে এ ব্যাপারে সচেতন এবং সক্রিয় করে তুলতে পারেন তবে কাজ অনেকটা এগিয়ে যেতে পারে। এবারে গোরস্তান বা শ্মশানের নীরবতা ভাঙতে এবং মানুষের বেদনার্ত মনে সাহস সঞ্চার করে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে পারি।

একই সঙ্গে ৫ আগস্টের পর আরও দু’সপ্তাহ কঠোর লকডাউন বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ ঈদ ফেরত লাখো মানুষের করোনার যে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় গোটা আগস্ট মাস জুড়েই অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমরা অবশ্যই অনেকাশে সফল হতে পারব। দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস রাখতে হবে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মৃত্যুর ক্রন্দন নয়, ধ্বনিত হোক জীবনের স্পন্দন

রণেশ মৈত্র

বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১

আক্রান্ত না হয়ে পারছে না বাঙালি। ২০২১-এর জুলাই থেকে করোনা আতঙ্কের ভয়াবহ একটি মাস। দৈনন্দিন মৃত্যের বিগত ২৬ জুলাই প্রায় ২৫০ তে এবং সংক্রমিতের সংখ্যা ১৫,০০০-এর ঊর্ধ্বে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। জানা সবারই, আতঙ্কিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে সবাইকে করোনার চলমান ঢেউ সামলাতে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আতঙ্ক তো পিছু ছাড়ছে না কারও। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই বড় হচ্ছে সংক্রমিতের সংখ্যাও নিত্যদিন বাড়ছে বিপুল গতিবেগ নিয়ে।

করোনার এই আক্রমণ নতুন নয়, দেড় দেড়টি বছর ধরে চলছে। এই দের বছরের মধ্যে এমন একটি দিনও কারও চোখে পড়েনি-যেদিন কেউ সংক্রমিত হননি- কারও মৃত্যু ঘটেনি। আবার এমন এমন মৃত্যু ঘটছেÑযা সমগ্র বাঙালি জাতির কাছেই দুঃসহ। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে হারালাম জনপ্রিয় শিল্পী ফকির আলমগীরকে। হারিয়ে যাওয়া বিশিষ্টজনদের তালিকা এতই দীর্ঘ যে সবার নাম উল্লেখ করতে গেলে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তার স্থান সংকুলান হবে না। শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, নার্স বিপুল সংখ্যায় হারিয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে, আমার মনে হয় যেন দেশটি আমাদের বুদ্ধিজীবীশূন্য হয়ে পড়েছে। আগামীতে বাঙালি জাতি যে বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানীগুণী মানুষের সংকটে পড়তে চলেছে-এক কথায় তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। তবু যারা বেঁচে আছেন-তারা সবাই বেঁচে থাকুন সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত দেহ নিয়ে। আজকের দিনে জাতির প্রার্থনা এটাই।

কিন্তু অশেষ অবদান সত্ত্বেও বাংলাদেশ তো শুধু বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং জ্ঞানীগুণীদের দেশ নয়, একমাত্র তাদের অবদানেই দেশটি টিকে আছে তাও ঠিক নয়। দেশকে প্রধানত: বাঁচিয়ে রেখেছেন কলিমউদ্দিন ছলিম জাতীয় নামধারী হত-দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা-যারা সংখ্যায় কয়েক কোটি।

আজ সেই গ্রামীণ মানুষদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না করোনা। ঈদের কারণে লক ডাউনের কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঈদযাত্র করে বিভিন্ন জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলগুলিতে ঈদ উদযাপন করতে আসার ফলে সংক্রমণের হার ও সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার ও সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতের বিরুদ্ধেই সরকার লকডাউন সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিল করা হয়েছিল। পরিণতিতে এখন কী গ্রাম, কী শহর-সর্বত্র করোনার মহামারি সর্বত্র কান্নার রোল।

এ কান্না থামাতে হবে। মৃত্যু ও সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও তা অনেক কমিয়ে আনা কমিয়ে আনা সম্ভব বিজ্ঞানের কল্যাণে। অবশ্য বিলম্বে হলেও এবং অসংখ্য মৃত্যু ও সংক্রমণের পরে বিগত ২৬ জুলাই মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপক হারে ভ্যাকসিনেসনের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন ৪,০০০ নতুন ডাক্তার ও ৪,০০০ নতুন নার্স নিয়োগ দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্যে তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতদিনের মধ্যে ওই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন, কতদিনে ওই ডাক্তার-নার্স নিয়োগ কামনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত পাঠাবেন বা গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া কত দিনে শেষ হবেÑতা বলা দুরূহ। তবে এটুকু মাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোন ইন্টারভিউ বা পরীক্ষা ছাড়াই এই নিয়োগ দেয়া হবে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি প্রধানমন্ত্রী বলার পরেই বুঝতে পারলেন যে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ভ্যাকসিনেশন প্রসারিত করা মানুষ বাঁচানোর স্বার্থে জরুরি প্রয়োজন? যদি তা না-ই বুঝতে পারেন তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ থেকে এই মুহূর্তেই তার পদত্যাগ করা উচিত বা তাকে পদচ্যুত করা উচিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার অযোগ্যতা করোনা সংক্রমণের শুরুর লগ্ন থেকেই দেখিয়ে আসবেন। সব মহলের অভিযোগ, স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয়ই হলো সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং মন্ত্রী স্বয়ং ওই দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন বলেও অভিযোগ পুরোনো।

দেড় বছর ধরে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দেশের নানা স্থানে অব্যাহত রয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটে উপযুক্ত পরিমাণ বরাদ্দ (কোন বিশেষ বরাদ্দ তো দূরের কথা) তিনি আনতে পারেননি। আবার বাজেটে যে বরাদ্দ বিগত অর্থবছরে হয়েছিল-তারও সিংহভাগ ব্যয়িত না হয়ে ফেরত দেয়া হয়েছে।

অথচ সর্বত্র সব সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, অক্সিজেন সংকট, করোনা চিকিৎসায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর মাত্রাধিক স্বল্পতা-জনিত সংকট, ৩৫টি জেলায় কোন আইসিইউ বেড নেই, অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই-এ কথা জেনেও (তিনি হয়তো খোঁজ নাও নিয়ে থাকতে পারেন) সেই জরুরি বিষয়গুলোতে অর্থব্যয় না করে বাজেটে পাওয়া বরাদ্দের একটি পয়সাও ফেরত যাওয়া কি ভাবা যায়?

ঈদযাত্রার জন্য ন্যূনতম সরকারি নির্দেশনাগুলো শিথিল না করে তা কঠোরতর করার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা মানুষ বাঁচানোর স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল। তা না করায় দেশটি বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে ততদিক মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর কবলে চলে পড়ছেন।

এইটুকু লিখতেই টেলিভিশনে চোখ বুলিয়ে জানলাম ২৭ জুলাই রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু ঘটেছে ২৫৮ জনের এবং ১৯,০০০ এর বেশি আক্রান্ত। এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে-মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে। জীবনরক্ষা করার যোগ্যতা সম্পন্ন একজন নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগের বিকল্প নেই।

তার সঙ্গে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব সরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে যথেষ্ট-সংখ্যক বেড, আইসিইউ অক্সিজেনের ব্যবস্থা এবং করোনা চিকিৎসায় প্রতিক্ষিত যথেষ্ট-সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থাও করতে হবে। একই সঙ্গে বয়স নির্বিশেষে, অন্তত ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সবার টিকার ব্যবস্থা গ্রহণ ও শহর গ্রাম নির্বিশেষে বাধ্যতামূলকভাবে সবার টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে উপযুক্ত সব নাগরিকের টিকাদান সম্পন্ন করা যায়। আর যত ব্যবস্থাই থাক-করোনার প্রতিরোধের এখন পর্যন্ত সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হলো টিকা।

আমাদের প্রচার যন্ত্রসমূহ দিবারাত্র (বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলো) মৃত্যুর ও আক্রান্তের খবর প্রচার করে মানুষের মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে-কিন্তু তারা যেসব দেশে করোনা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে সে সব দেশের মানুষ কীভাবে করোনা প্রতিরোধে সক্ষম হলেনÑতা দিব্যি প্রচার করতে পারে। পত্রিকাগুলোতে ওই প্রতিবেদন নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করলে আশাহত মানুষগুলো তা দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারে। বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী আমাদের দূতাবাসগুলোর প্রেস সচিব এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। বস্তুত আমরা যেভাবে করোনাকে ওয়াকওভার দিয়ে চলছি দ্রুত তার অবসান ঘটিয়ে বিশ্বের নানা দেশ করোনাবিরোধী সব লড়াই এর কাহিনী তুলে ধরলে মানুষের মনে তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটারসমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস রাখতে হবে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত

এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও দায়িত্ব রয়েছে। তিনি যদি আমাদের বিদেশি দূতাবাসগুলোকে এ ব্যাপারে সচেতন এবং সক্রিয় করে তুলতে পারেন তবে কাজ অনেকটা এগিয়ে যেতে পারে। এবারে গোরস্তান বা শ্মশানের নীরবতা ভাঙতে এবং মানুষের বেদনার্ত মনে সাহস সঞ্চার করে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে পারি।

একই সঙ্গে ৫ আগস্টের পর আরও দু’সপ্তাহ কঠোর লকডাউন বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ ঈদ ফেরত লাখো মানুষের করোনার যে ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় গোটা আগস্ট মাস জুড়েই অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমরা অবশ্যই অনেকাশে সফল হতে পারব। দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস রাখতে হবে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

back to top