alt

উপ-সম্পাদকীয়

করোনায় বেড়েছে অভিশপ্ত বাল্যবিয়ে : প্রসঙ্গ জন্মনিবন্ধন

শরীফ উদ্দিন

: বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১

বাল্যবিয়ে হয়েছে, এ কথা প্রমাণের জন্য বর বা কনের বয়স শনাক্তকরণ প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে সরকারি বিধি মোতাবেক জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। একটি শিশু জন্ম নেয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর নাম নিবন্ধন করাতে হয়। ২০০৪ সালে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন পাস করা হয়েছে, যা অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা ২ মাস বিনাশ্রম জেল, আবার জেল জরিমানা দুটোই হতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে চাপ কম এবং সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ কম। বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে অনেকের পড়াশোনা প্রাইমারি পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার ফলে তাদের একাডেমিক সার্টিফিকেট থাকে না। ফলে অভিভাবকরা তাদের ইচ্ছে মতো বর বা কনের বয়স বাড়িয়ে কাবিননামায় উল্লেখ করছে।

২০১৭ সালে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিয়ে বলতে ওই বিয়েকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে বর এবং কনে উভয়ই শিশু। অর্থাৎ অপরিণত বয়সে যে বিয়ে সম্পন্ন হয় তা বাল্যবিয়ে। এ ধরনের বিয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো-বর পরিণত বয়সী কিন্তু কনে অপরিণত বয়সী। অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে বর-কনে উভয়েই অপরিণত বয়সী হয়। এ আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ বিয়ের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোন পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোন নারী”। অর্থাৎ বর কনে উভয়েরই বা একজনের বয়স বিয়ের জন্য নির্ধারিত আইনের চেয়ে কম হলে, তা আইনের চোখে বাল্যবিয়ে বলে চিহ্নিত হবে।

এ আইনে বয়স প্রমাণের দলিলের বিষয়ে বলা হয়েছে, বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক নারী বা পুরুষ বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট অথবা পাসপোর্ট আইনগত দলিল হিসেবে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে।

বাল্যবিয়ে এখনও বাংলাদেশের একটি অভিশাপ। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন নারীরা শিক্ষিত হয়ে উঠছে তখন একটা অংশ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বাল্যবিয়ের শিকার। বিভিন্ন কারণে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে অভিভাবকরা বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক মানুষ প্রবাসী হওয়ায় সন্তানের দুশ্চিন্তা এবং নিরাপত্তার কারণে অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। এমনকি অভিভাবকের রুমমেড বা পছন্দসই প্রবাসী পাত্রের হাতে ফোনে বা সরাসরি কমরয়সী নিজ সন্তানকে বিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া বর্তমানে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ে চরম আকারে বেড়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার তথা আইন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ সমূহ কোন কাজে আসছে না। কাজে আসছে না কোন ধরনের সামাজিক সচেতনতা বা গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণা। এক্ষেত্রে সমাজপতি, স্থানীয় ইউপি সদস্য, মসজিদের ইমাম, মা-বাবাও সম্পৃক্ত থাকে, ফলে কোনভাবেই বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে জেনে শুনে বুঝেই বাল্যবিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অথচ দেশের প্রচলিত আইনে বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বিশ্বের যে কয়টি দেশে বাল্যবিয়ের হার বেশি এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ইউনিসেফের তথ্য মতে, দেশের ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই, আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগে, যা দুই দশক ধরে এই হার অপরিবর্তিত রয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্বনেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গাল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বাল্যবিয়েকে শূন্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারীর বাল্যবিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন।

বাল্যবিয়ের জন্য শিক্ষা, ¯¦াস্থ্য, পুষ্টি থেকে বঞ্চিত কিশোরীর একটা বড় অংশই বিয়ের পর পরই গর্ভধারণ করে। গর্ভধারণের অন্যতম কারণ হলো, সন্তান জন্মদানের জন্য পারিবারিক আকাক্সক্ষার চাপ এবং অন্যদিকে নব বিবাহিত কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সম্যকজ্ঞানের অভাব। যার ফলে কন্যাশিশুদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

গত বছর ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্ল্যান বাংলাদেশের সহায়তায় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় বাল্যবিয়ে নিয়ে জরিপ চালায়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালীন সাত মাসে দেশের ২১ জেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে ৫০.৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ এবং ১.৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভের প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বাল্যবিয়ের ফলে ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীদের মধ্যে ৩৪.২ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এদিকে সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। অকাল গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ৪৯ শতাংশ নারী লকডাউনে নিজেদের অনিরাপদ মনে করেছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ‘বাল্যবিয়ের ফলে দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতায় ভোগে প্রতি ঘণ্টায় গর্ভবতী মা মারা যায় ৩ জন। অপরিণত বয়সে বিয়ের কারণে নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জরায়ু ক্যান্সারে ভোগে। কেননা এই মেয়েদের জরায়ু মুখের কোষ পরিপক্ব হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে যৌন মিলন করতে হয়। এতে কোষগুলোতে বিভিন্ন ইনফেকশন হয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলে এবং যার ফলাফল পরিণত বয়সে দেখা যায়।

কিন্তু আমরা জানি প্রজন্ম লাভের মাধ্যমে জীবনের জয়গান, আনন্দ-খুশির বার্তা নিয়ে আসে। অথচ বাল্যবিয়ের ফলে তা প্রকারান্তরে হয়ে ওঠে মৃত্যুর বিকৃত উৎসবে। অল্প বয়সে সন্তান ধারণের পরিণতি সুদূর প্রসারী এবং সঙ্গতকারণেই তা মারাত্মক। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টি চাহিদা অতিরিক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। সন্তানসম্ভবা অধিকাংশ নারীই অতিরিক্ত খাবার ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না। রক্তশূন্যতায় ভোগে। গর্ভকালে মায়েদের ওজন স্বাভাবিকভাবে ১০ কেজি বাড়ার কথা থাকলেও, তথ্য মোতাবেক আমাদের দেশে তা বাড়ে মাত্র পাঁচ কেজি। স্বল্প ওজনের শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকার ফলে প্রতি বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ শিশু মৃত্যুবরণ করে। আর যারা ঠিকে থাকে তারা অনেকটা পঙ্গুত্ব ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হয়। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী চার বছরের নিচে ছেলেদের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ কন্যাশিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগে যা কিশোরী বয়সে চলমান থাকে। ফিট্যাল প্রোগ্রামিং এর ধারণা মতে, ‘যে মা পুষ্ট নয় এবং অপরিণত বয়সের কারণে মায়ের শারীরিক অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো যথাযথভাবে বৃদ্ধি ঘটেনি, সে নিজেই একজন শিশু অথচ সে তার শরীরে আরও একজন শিশুকে ধারণ করছে, লালন করছে এবং পালন করছে। যা সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার।

বাল্যবিয়ের পেছনে অনেকগুলো কারণও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো: দ্ররিদ্রতা, সচেতনতার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, অজ্ঞতা, কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক প্রথা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ইত্যাদি। এ সব কারণে আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের হার ক্রমান্বয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেড়েই চলেছে।

শিশু জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গেই জন্মনিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে এবং এ জন্মনিবন্ধন দিয়েই টিকাকার্ড, স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে হবে এবং বিয়ের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে

তবে উল্লিখিত কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে অনেকেই দারিদ্র্যকেই চিহ্নিত করেন। দারিদ্র্য যেহেতু মানুষের সব চাহিদাগুলোকে কারারুদ্ধ করে ফেলে, সেহেতু মানুষ তখন প্রয়োজনের কাছে সব আইনকে জলাঞ্জলি দেয়। একদিকে চরম দরিদ্রতার কষাঘাত, অপরদিকে অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক পরিবারেই কন্যাশিশুকে বাড়তি বোঝা হিসেবে, পরিবারের দায় হিসেবে মনে করেন। তারা মনে করেন কন্যাশিশু পড়াশোনা করে আয় রোজগার করলেও তা তাদের পরিবারের কাজে লাগবে না। এজন্য তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাদের বিশ্বাস, বিয়ের বয়স যত বাড়বে যৌতুকের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষার অভাবও বাল্যবিয়ের একটি অন্যতম কারণ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছালেও নারী শিক্ষার সুযোগ বা পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। এর ফলে বাল্যবিয়ের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও পরিবারের সম্মান রাখার দায়, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলে এসিড- সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয়, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় বখাটের দ্বারা যত্রতত্র ইভটিজিং এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদির কারণেই অভিভাবকরা তড়িঘড়ি করে কমবয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।

করোনাকালে দারিদ্র বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যদের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করতে না পারার বিষয় বাল্যবিয়ের বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। করোনাকালে বাল্যবিয়ের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, আয়-উপার্জন হ্রাস, বিদ্যমান সামাজিক নিয়ম-বিশ্বাস, লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ইত্যাদি। এদিকে করোনাকালে অনেক প্রবাসী অবিবাহিত যুবক দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের বিয়ে করছেন।

বাল্যবিয়ে এখনও বাংলাদেশের জন্য একটি সমস্যাবহুল বিষয়। এর ফলে সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের নানা ধরনের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। অনেকে মনে করেন বাল্যবিয়ের জন্য দরিদ্রতা, শিক্ষার অভাব, নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা, বখাটেদের উৎপাত, মোবাইলের অপব্যবহারই দায়ী। দারিদ্র্য যেহেতু মানুষের সব মৌলিক চাহিদাগুলোকে কারারুদ্ধ করে ফেলে, সেহেতু মানুষ তখন প্রয়োজনের কাছে সব আইনকে জলাঞ্জলি দেয়। একদিকে চরম দরিদ্রতার কষাঘাত, অপর দিখে অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক পরিবারই কন্যা শিশুকে বাড়তি বোঝা হিসেবে, পরিবারের দায় হিসাবে মনে করে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, মোবাইলে ছবি উঠিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় আজকাল অনেক অভিভাবক পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় এবং তড়িঘড়ি করে কম বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অথচ এর ফলে অভিভাবকরা দুটি ভুল করেন। প্রথমত বাল্যবিয়ে দেয়া, দ্বিতীয়ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই পাত্রস্থ করা। পরিণামে অপাত্রে মেয়েটিকে বিয়ে দেয়ার ফলে দুদিক থেকেই বিপত্তি।

জন্মনিবন্ধন এবং বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম, শিক্ষক, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমামরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। শিশু জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গেই জন্মনিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে এবং এ জন্মনিবন্ধন দিয়েই টিকাকার্ড, স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে হবে এবং বিয়ের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

করোনায় বেড়েছে অভিশপ্ত বাল্যবিয়ে : প্রসঙ্গ জন্মনিবন্ধন

শরীফ উদ্দিন

বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১

বাল্যবিয়ে হয়েছে, এ কথা প্রমাণের জন্য বর বা কনের বয়স শনাক্তকরণ প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে সরকারি বিধি মোতাবেক জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। একটি শিশু জন্ম নেয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর নাম নিবন্ধন করাতে হয়। ২০০৪ সালে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন পাস করা হয়েছে, যা অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা ২ মাস বিনাশ্রম জেল, আবার জেল জরিমানা দুটোই হতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে চাপ কম এবং সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ কম। বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে অনেকের পড়াশোনা প্রাইমারি পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার ফলে তাদের একাডেমিক সার্টিফিকেট থাকে না। ফলে অভিভাবকরা তাদের ইচ্ছে মতো বর বা কনের বয়স বাড়িয়ে কাবিননামায় উল্লেখ করছে।

২০১৭ সালে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিয়ে বলতে ওই বিয়েকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে বর এবং কনে উভয়ই শিশু। অর্থাৎ অপরিণত বয়সে যে বিয়ে সম্পন্ন হয় তা বাল্যবিয়ে। এ ধরনের বিয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো-বর পরিণত বয়সী কিন্তু কনে অপরিণত বয়সী। অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে বর-কনে উভয়েই অপরিণত বয়সী হয়। এ আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ বিয়ের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোন পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোন নারী”। অর্থাৎ বর কনে উভয়েরই বা একজনের বয়স বিয়ের জন্য নির্ধারিত আইনের চেয়ে কম হলে, তা আইনের চোখে বাল্যবিয়ে বলে চিহ্নিত হবে।

এ আইনে বয়স প্রমাণের দলিলের বিষয়ে বলা হয়েছে, বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক নারী বা পুরুষ বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট অথবা পাসপোর্ট আইনগত দলিল হিসেবে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে।

বাল্যবিয়ে এখনও বাংলাদেশের একটি অভিশাপ। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন নারীরা শিক্ষিত হয়ে উঠছে তখন একটা অংশ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বাল্যবিয়ের শিকার। বিভিন্ন কারণে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে অভিভাবকরা বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক মানুষ প্রবাসী হওয়ায় সন্তানের দুশ্চিন্তা এবং নিরাপত্তার কারণে অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। এমনকি অভিভাবকের রুমমেড বা পছন্দসই প্রবাসী পাত্রের হাতে ফোনে বা সরাসরি কমরয়সী নিজ সন্তানকে বিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া বর্তমানে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ে চরম আকারে বেড়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার তথা আইন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ সমূহ কোন কাজে আসছে না। কাজে আসছে না কোন ধরনের সামাজিক সচেতনতা বা গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণা। এক্ষেত্রে সমাজপতি, স্থানীয় ইউপি সদস্য, মসজিদের ইমাম, মা-বাবাও সম্পৃক্ত থাকে, ফলে কোনভাবেই বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে জেনে শুনে বুঝেই বাল্যবিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অথচ দেশের প্রচলিত আইনে বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বিশ্বের যে কয়টি দেশে বাল্যবিয়ের হার বেশি এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ইউনিসেফের তথ্য মতে, দেশের ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই, আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগে, যা দুই দশক ধরে এই হার অপরিবর্তিত রয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্বনেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গাল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বাল্যবিয়েকে শূন্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারীর বাল্যবিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন।

বাল্যবিয়ের জন্য শিক্ষা, ¯¦াস্থ্য, পুষ্টি থেকে বঞ্চিত কিশোরীর একটা বড় অংশই বিয়ের পর পরই গর্ভধারণ করে। গর্ভধারণের অন্যতম কারণ হলো, সন্তান জন্মদানের জন্য পারিবারিক আকাক্সক্ষার চাপ এবং অন্যদিকে নব বিবাহিত কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সম্যকজ্ঞানের অভাব। যার ফলে কন্যাশিশুদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

গত বছর ইউনিসেফ, ইউএনএফপি ও প্ল্যান বাংলাদেশের সহায়তায় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় বাল্যবিয়ে নিয়ে জরিপ চালায়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালীন সাত মাসে দেশের ২১ জেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে ৫০.৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ এবং ১.৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভের প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বাল্যবিয়ের ফলে ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীদের মধ্যে ৩৪.২ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এদিকে সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। অকাল গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ৪৯ শতাংশ নারী লকডাউনে নিজেদের অনিরাপদ মনে করেছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ‘বাল্যবিয়ের ফলে দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতায় ভোগে প্রতি ঘণ্টায় গর্ভবতী মা মারা যায় ৩ জন। অপরিণত বয়সে বিয়ের কারণে নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জরায়ু ক্যান্সারে ভোগে। কেননা এই মেয়েদের জরায়ু মুখের কোষ পরিপক্ব হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে যৌন মিলন করতে হয়। এতে কোষগুলোতে বিভিন্ন ইনফেকশন হয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলে এবং যার ফলাফল পরিণত বয়সে দেখা যায়।

কিন্তু আমরা জানি প্রজন্ম লাভের মাধ্যমে জীবনের জয়গান, আনন্দ-খুশির বার্তা নিয়ে আসে। অথচ বাল্যবিয়ের ফলে তা প্রকারান্তরে হয়ে ওঠে মৃত্যুর বিকৃত উৎসবে। অল্প বয়সে সন্তান ধারণের পরিণতি সুদূর প্রসারী এবং সঙ্গতকারণেই তা মারাত্মক। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টি চাহিদা অতিরিক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। সন্তানসম্ভবা অধিকাংশ নারীই অতিরিক্ত খাবার ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না। রক্তশূন্যতায় ভোগে। গর্ভকালে মায়েদের ওজন স্বাভাবিকভাবে ১০ কেজি বাড়ার কথা থাকলেও, তথ্য মোতাবেক আমাদের দেশে তা বাড়ে মাত্র পাঁচ কেজি। স্বল্প ওজনের শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকার ফলে প্রতি বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ শিশু মৃত্যুবরণ করে। আর যারা ঠিকে থাকে তারা অনেকটা পঙ্গুত্ব ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হয়। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী চার বছরের নিচে ছেলেদের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ কন্যাশিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগে যা কিশোরী বয়সে চলমান থাকে। ফিট্যাল প্রোগ্রামিং এর ধারণা মতে, ‘যে মা পুষ্ট নয় এবং অপরিণত বয়সের কারণে মায়ের শারীরিক অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো যথাযথভাবে বৃদ্ধি ঘটেনি, সে নিজেই একজন শিশু অথচ সে তার শরীরে আরও একজন শিশুকে ধারণ করছে, লালন করছে এবং পালন করছে। যা সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার।

বাল্যবিয়ের পেছনে অনেকগুলো কারণও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো: দ্ররিদ্রতা, সচেতনতার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, অজ্ঞতা, কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক প্রথা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ইত্যাদি। এ সব কারণে আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের হার ক্রমান্বয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেড়েই চলেছে।

শিশু জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গেই জন্মনিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে এবং এ জন্মনিবন্ধন দিয়েই টিকাকার্ড, স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে হবে এবং বিয়ের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে

তবে উল্লিখিত কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে অনেকেই দারিদ্র্যকেই চিহ্নিত করেন। দারিদ্র্য যেহেতু মানুষের সব চাহিদাগুলোকে কারারুদ্ধ করে ফেলে, সেহেতু মানুষ তখন প্রয়োজনের কাছে সব আইনকে জলাঞ্জলি দেয়। একদিকে চরম দরিদ্রতার কষাঘাত, অপরদিকে অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক পরিবারেই কন্যাশিশুকে বাড়তি বোঝা হিসেবে, পরিবারের দায় হিসেবে মনে করেন। তারা মনে করেন কন্যাশিশু পড়াশোনা করে আয় রোজগার করলেও তা তাদের পরিবারের কাজে লাগবে না। এজন্য তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাদের বিশ্বাস, বিয়ের বয়স যত বাড়বে যৌতুকের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষার অভাবও বাল্যবিয়ের একটি অন্যতম কারণ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছালেও নারী শিক্ষার সুযোগ বা পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। এর ফলে বাল্যবিয়ের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও পরিবারের সম্মান রাখার দায়, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলে এসিড- সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয়, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় বখাটের দ্বারা যত্রতত্র ইভটিজিং এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদির কারণেই অভিভাবকরা তড়িঘড়ি করে কমবয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।

করোনাকালে দারিদ্র বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যদের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করতে না পারার বিষয় বাল্যবিয়ের বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। করোনাকালে বাল্যবিয়ের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, আয়-উপার্জন হ্রাস, বিদ্যমান সামাজিক নিয়ম-বিশ্বাস, লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ইত্যাদি। এদিকে করোনাকালে অনেক প্রবাসী অবিবাহিত যুবক দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের বিয়ে করছেন।

বাল্যবিয়ে এখনও বাংলাদেশের জন্য একটি সমস্যাবহুল বিষয়। এর ফলে সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের নানা ধরনের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। অনেকে মনে করেন বাল্যবিয়ের জন্য দরিদ্রতা, শিক্ষার অভাব, নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা, বখাটেদের উৎপাত, মোবাইলের অপব্যবহারই দায়ী। দারিদ্র্য যেহেতু মানুষের সব মৌলিক চাহিদাগুলোকে কারারুদ্ধ করে ফেলে, সেহেতু মানুষ তখন প্রয়োজনের কাছে সব আইনকে জলাঞ্জলি দেয়। একদিকে চরম দরিদ্রতার কষাঘাত, অপর দিখে অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক পরিবারই কন্যা শিশুকে বাড়তি বোঝা হিসেবে, পরিবারের দায় হিসাবে মনে করে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, মোবাইলে ছবি উঠিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় আজকাল অনেক অভিভাবক পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় এবং তড়িঘড়ি করে কম বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অথচ এর ফলে অভিভাবকরা দুটি ভুল করেন। প্রথমত বাল্যবিয়ে দেয়া, দ্বিতীয়ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই পাত্রস্থ করা। পরিণামে অপাত্রে মেয়েটিকে বিয়ে দেয়ার ফলে দুদিক থেকেই বিপত্তি।

জন্মনিবন্ধন এবং বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম, শিক্ষক, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমামরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। শিশু জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গেই জন্মনিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে এবং এ জন্মনিবন্ধন দিয়েই টিকাকার্ড, স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে হবে এবং বিয়ের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top