alt

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের ব্যাধি

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

ভোটে জেতা, সরকার করা, সংসদ সদস্য হওয়া- এটাই কখনো একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না বামপন্থিদের। জ্যোতি বসুর মতো মানুষেরা যখন নিজেদের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারকে উপেক্ষা করে কমিউনিস্ট হয়েছিলেন, দেশ-দেশের মানুষদের জন্য জীবন সঁপেছিলেন, তখন তারা স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি, মুখ্যমন্ত্রী হবেন বা মন্ত্রী হবেন বা দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ ও কমিউনিস্টদের সামনে আসবে। তারা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছিলেন। সেই লড়াই করতে গিয়ে ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের এতটুকু পরোয়া করেননি। আদর্শবাদকে সামনে রেখে কখনো কখনো কৌশলকেও সামনে রেখে লড়েছেন। সেই লড়াইয়ের অভিশ্রুতিতে সাফল্য এসেছে। সেই সাফল্যের মূলে ছিল মানুষের নাড়িক উপলব্ধি করবার অদম্য শক্তি এবং যোগ্যতা।

মুজফফর আহমদ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, মহ. ইসমাইল, বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী, গীতা মুখোপাধ্যায়, সরোজ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহেরা যখন রাজনীতির অঙ্গনে ছিলেন- সেই সময়কালটার রাজনীতির ধারাটা বর্তমান সময়ের থেকে অনেকটাই অন্যরকম ছিল। জাতীয় আন্দোলনের মূল্যবোধ এবং সেই মূল্যবোধকে জীবনের মূলধন করে বেঁচে থাকা মানুষেরাই ছিলেন সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাদের ভিতরে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ফারাক থাকলেও, ব্যক্তি জীবনে ছিল একটা বিশেষ সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক।

প্রফুল্লচন্দ্র সেনের একগুঁয়েমিই যে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম কারণ- এই বাস্তবকথাটা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। ’৭৭-এর বিধানসভা ভোটের আগে জনতা পার্টির আসন ঘিরে যদি প্রফুল্লবাবু জেদ ধরে বসে না থাকতেন, জ্যোতি বাবু, প্রমোদবাবুদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও অনমনীয় না থাকতেন, সেক্ষেত্রে কিন্তু জনতা পার্টি এবং বামফ্রন্টের ভিতর নির্বাচনী ঐক্য হতো এবং প্রফুল্লবাবুই মুখ্যমন্ত্রী হতেন। কারণ জ্যোতিবাবু- প্রমোদবাবুরা বামফ্রন্টের থেকে ও বেশি আসন দিতে চেয়েছিলেন। প্রফুল্ল সেন সেই প্রস্তাবে রাজি হননি মূলত অশোককৃষ্ণ দত্ত, নির্মলেন্দু দে (বদু), হরিপদ ভারতী প্রমুখদের প্ররোচনায়। জ্যোতিবাবুদের প্রস্তাবে যদি সেইদিন প্রফুল্লচন্দ্র সেন রাজি হয়ে যেতেন, সেক্ষেত্রে জনতা-বাম কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হতেন প্রফুল্লবাবু।

তীব্র কমিউনিস্টবিরোধী প্রফুল্লবাবুর সঙ্গে বামেদের সেই কোয়ালিশন সরকার দীর্ঘস্থায়ী হতো কিনা- এই সংশয় থেকেই যায়। বিশেষ করে ১৯৮০ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস আবার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসার পর সেই কোয়ালিশন যদি আদৌ হতো, শ্রীমতী গান্ধীর প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতি যে ওই জোট সরকারকে টিকে থাকতে দিতো না- তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানুষের কিছুটা স্বস্তি হয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা রিলিফ পায়- সেইদিকটার প্রতি বামফ্রন্ট সরকার প্রথম থেকেই বিশেষ যত্নবান ছিল। কিন্তু এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভিতরে ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, সেই সরকারকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে চোখকান খোলা রাখার যে পর্যায়কে বামপন্থিদের অতিক্রম করতে হয়েছিল, সেই পর্যায়ে বামপন্থি দৃষ্টিকোণকে সৎভাবে অবলম্বন করে চলাটা সব সময়ে সম্ভবপর হয়েছিল কিনা- সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।

সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী করবার লক্ষ্য থেকেই এসে যায় দলের ব্যাপ্তি ঘটাবার প্রসঙ্গটি। আর এই প্রসঙ্গক্রম থেকেই এসে যায় মান না দেখে সংখ্যার ওপর নির্ভর করে শাসক শিবিরে ভিড় করবার বিষয়টিও। কি বুর্জোয়া, কি কমিউনিস্ট- সব পরিকাঠামোতেই আমরা দেখেছি শাসক শিবিরে এসে ভিড় করে জনগণেশ। এই ছবি আমরা সাবেক সোভিয়েতেও দেখেছি। আর এই শাসক শিবিরে ভিড় করা মানুষদের খুশি করবার ক্ষেত্রে অতীতের কর্মপদ্ধতি ছিল একটু ভিন্নতর। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যখন বাম শাসকদের ব্যাপ্তি ঘটছে তখন সাধারণ মানুষের যে ভিড় বাম শিবিরের দিকে, সেই ভিড় কে মতাদর্শগত তাগিদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করাটা প্রায় হয়নি-ই বলা চলে।

জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবার তাগিদে মুড়ি মিছরিকে একই সঙ্গে শামিল করা শুরু হয় বামপন্থি দলগুলোর ভিতরে। শ্রেণীচেতনার ন্যূনতম অধ্যয়ন ছাড়া এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টির দরজা সকলের জন্যে খুলে দেওয়ার ফলে একটা বড়ো অংশের মানুষ, তাদের ভিতরে গরিব মানুষ ও যথেষ্ট-ই ছিলেন, কিন্তু ছিল না শ্রেণীচেতনা, শ্রেণী ঘৃণা। এসব মানুষেরাই ধীরে ধীরে নানা কৌশলে ভূমিস্তরের দল পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধানমুখ হয়ে উঠতে শুরু করলেন। এসব মানুষেরা একটা সময়ে হয়তো সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরে ছিলেন। সেই বিপরীত রাজনৈতিক শিবির যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এসব মানুষদেরই একটা বড় অংশ তখনকার শাসকদলে থেকে অর্থ আর পেশিশক্তির জেরে সমাজে কীভাবে ছড়ি ঘোরাতে হয়, সেটাও হয়তো অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। সেসব মানুষের বেশিরভাগই কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্রবে এলেন মতাদর্শের তাগিদ থেকে নয়, দল ক্ষমতায় আছে- সেই আকর্ষণেই। এখানে যে শক্ত বাঁধ দেওয়ার দরকার ছিল, সেটা কোন অবস্থাতেই দেওয়া হয়নি।

এই মতাদর্শবিহীনতার দিকটি সেই সময়ের শাসকেরা খুব একটা নজরে এনেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু তলাতেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তখন ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তের আনাগোনা একটু বেশি পরিমাণেই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রমোদ দাশগুপ্তই নতুন প্রজন্মের যেসব কর্মীকে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিকলে তোলবার পথটিকে মসৃণ করে দিয়েছিলেন, তারা প্রায় কেউই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী জনতার ভিতর থেকে উঠে আসেননি। ছাত্র-যুব আন্দোলন, যেটার মূল কেন্দ্রবিন্দু পরিচালিত হয়েছিল শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের দ্বারা, তাদের ভিতর থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের মূলত বেছেছিলেন প্রমোদবাবু। অকালপ্রয়াত দীনেশ মজুমদারের কর্মক্ষেত্র ছিল যুব আন্দোলন। আর এক অকাল প্রয়াত ব্যক্তিত্ব শঙ্কর গুপ্ত, যাকে প্রশাসনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নির্ভর করতেন জ্যোতিবাবু, তিনি ছিলেন ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা মানুষ। বিমান বসুর রাজনেতিক ভিত্তি ও ছিল ছাত্র আন্দোলন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছিল যুব আন্দোলন, অনিল বিশ্বাসের ছিল ছাত্র আন্দোলন, সুভাষ চক্রবর্তী-শ্যামল চক্রবর্তীর রাজনৈতিক ভিত্তি ও ছিল একদম ছাত্র আন্দোলন। কৃষ্ণপদ ঘোষ, চিত্তব্রত মজুমদারদের মতো শ্রমিক আন্দোলন বা বিনয় চৌধুরী, সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহ বা প্রভাষ রায়দের মতো কৃষক আন্দোলন থেকে উঠে আসা মানুষদের নেতৃত্বের শীর্ষে তুলে আনার প্রবণতাটা পরবর্তীকালে আর বজায় থাকেনি। তাই শ্যামল চক্রবর্তীর মতো ছাত্র আন্দোলনের মানুষকে শ্রমিক নেতা করে শ্রমিকদের ভিতরে কতখানি নির্ভরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারা গিয়েছিল- সেই বিতর্ক থেকেই যায়।

শ্রেণী সচেতনতা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তার উদাহরণ প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের রেখেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. অশোক মিত্রের মতো মানুষকে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতর থেকে উঠে এসেও শ্রেণী সচেতনতার প্রশ্নে যে পরাকাষ্ঠার নির্দশন ড. মিত্র রেখে গিয়েছেন, বামফ্রন্টের গোটা ৩৪ বছরের শাসন কালে তার তুলনা চলে জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, প্রভাষ রায়, অমৃতেন্দু মুখার্জী, মহ. আমিন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মহ. সেলিমের মতো হাতেগোনা কয়েকজনের সঙ্গে। শ্রেণী সচেতনতার প্রশ্নে ড. মিত্রের যে অবস্থান, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, মধ্যবিত্তের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ঘিরে রিজারভেশন- এই অবস্থানে যদি পরবর্তীতে বামফ্রন্ট সরকার স্থিত থাকতে পারতো, তাহলে আজ বামপন্থিদের এতখানি রাজনৈতিক দুরবস্থার ভিতরে পড়তে হতো না।

গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্বেরা যখন মন্ত্রী হিসেবে প্রশাসনের শীর্ষে থেকেছেন, ফ্রন্ট সরকারের প্রথম দিকে তাবড় তাবড় আমলারা চেষ্টা করেও সরকারকে কখনো বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। একদম সঙ্কীর্ণতাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল বা বামপন্থিদের সাবোতেজ করবার মানসিকতা সম্পন্ন বেশ কিছু শীর্ষস্তরের আমলা ছিলেন। যেমন অর্কপ্রভ দেবের সঙ্গেনকশাল রাজনীতির সংযোগ ঘিরে অনেক কথাই শোনা যেতো। দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ভূমিসংস্কার ঘিরে অনেককিছু দাবি করলেও, পরবর্তীতে যেভাবে বামফ্রন্ট বিরোধী শিবিরে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছিলেন, সাংসদ হয়েছিলেন, মনীষ গুপ্তের ভূমিকা- এসব ঘটনার পরম্পরা থেকে বলতে হয় যে, গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের প্রশাসন সামলানোর রীতিনীতি আর শৌখিন মজদুরির মাধ্যমে মন্ত্রিত্বে উপনীত হওয়া মানুষদের প্রশাসন চালানোর বৈশিষ্ট্যের ফারাক থেকেই অনেক কিছু বোঝা না বোঝার বিষয় উঠে আসতে থাকে।

একটা সময় ছিল যখন আমলারা নিজেদের খুশিমতো যা কিছু মন্ত্রীদের বুঝিয়ে করে নিতে কোনো অবস্থাতেই সক্ষম হতেন না। সেই সময়ের মন্ত্রীদের অনেকেরই হয়তো প্রথম জীবনটা ব্রিটিশবিরোধী নানারকম লড়াইয়ে সংযুক্ত থাকার জন্যে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংস্পৃক্ততার দরুণ তারা জীবনের শিক্ষা, প্রথাগত শিক্ষার গজদন্তমিনারে বাস করা মানুষদের থেকে অনেক বেশিই আহরণ করেছিলেন এই মানুষের কাছ থেকেই। তাই এসব মানুষদের ভুল বুঝিয়ে মানুষের স্বার্থবিরোধী কোনো কিছুই করিয়ে নেয়া সম্ভবপর হতো না সেসব আমলাদের পক্ষে।

পরবর্তীতে দেখা গেল, ধীরে ধীরে এসব আমলারা কীভাবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করছেন। কোনো না কোনো ছিদ্রপথে তারা ঢুকে পড়তে সক্ষম ও হচ্ছেন। আর বিশেষ বিশেষ মন্ত্রী, যাদের হয়তো অতীতের গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে, সেই সব। মন্ত্রীদের কুমন্ত্রণা দিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা তৈরিতে একটা বড় রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছেন। উদাহরণ হিসেবে আরএসপির প্রখ্যাত নেতা তথা দীর্ঘদিনের মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী এবং তৎকালীন পূর্ত সচাব মোর্শেদ সাহেবকে ঘিরে বিতর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মোর্শেদের ঘটনাক্রম অনেককালের হয়ে গেলেও সেই কার্যক্রমের ভিতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল বর্তমান সময়ের ইঙ্গিত। যতীন চক্রবর্তীর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিক নিজের দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা জ্যোতি বসুর থেকেও বেশি বিশ্বাস করে বসলেন একজন আমলাকে। যে জ্যোতি বসুর সঙ্গে যতীন চক্রবর্তীর সম্পর্কটা একদম ব্যক্তিগত স্তরের ছিল, সেই জ্যোতি বাবুর উদ্দেশে ব্যক্তি কুৎসামূলক নোট তিনি লিখলেন আমলার প্ররোচনায় সরকারি ফাইলে।

সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নিঃসৃত অবস্থানের অভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের প্রায় সিংহভাগই এখন বামপন্থিদের সঙ্গে নেই

যতীন চক্রবর্তীর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের সঙ্গে ও কি খেলা খেলতে পারে একাংশের আমলাবাহিনী, সেটা বোঝার মতো রাজনৈতিক দক্ষতা হয়তো পরবর্তী সময়ের একাংশের মন্ত্রীদের ছিল না। আর তা না হলে, গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা সেভাবে না থাকার কারণে এসব আমলারা কী ধরনের বিতত বিতংস নির্মাণ করেছে, তা বুঝে ওঠার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পরবর্তী সময়ের মন্ত্রীদের অনেকেরই হয়তো ছিল না।

বামফ্রন্টকে পুনরায় রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সংখ্যালঘু সমাজের সমস্যার প্রতি প্রকৃত দৃষ্টি নিক্ষেপ। শ্রেণী রাজনীতি কখনই সংখ্যালঘুর অধিকার নিরপেক্ষ হতে পারে না। সংখ্যালঘুর অধিকারের কথা বললেই অনেক বামপন্থিই বলেন, আমরা জাতিসত্তার রাজনীতি করি না। তাদের কাছে প্রশ্ন; তফসিলি জাতি-উপজাতি, ওবিসি, দলিত ইত্যাদিদের ঘিরে যখন অধিকারের প্রশ্ন তুলেন বামপন্থিরা, তখন সেটা তো জাতিসত্তার রাজনীতি বলে আপনারা মনে করেন না। অথচ এই আন্দোলনের ভিতর দিয়ে সত্যিকারের তফসিলি জাতি-উপজাতির ভিতরে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া কয়জন মানুষ সত্যিকারের উপকৃত হয়েছেন? আর কান্তি বিশ্বাস প্রমুখদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা, অর্থনৈতিকভাবে সবল কতজন মানুষ উপকৃত হয়েছেন?

সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নিঃসৃত অবস্থানের অভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের প্রায় সিংহভাগই এখন বামপন্থিদের সঙ্গে নেই। নানা ধরনের প্রতীকী, পোশাকি উন্নয়নের ভাবনার ফাঁদে তারা আটকে আছেন। আর যেসব সংখ্যালঘুরা এখনো বামপন্থিদের সঙ্গে আছেন, নানা পারিপার্শ্বিকের দরুণ তারা এখন অনেক বেশি বেশি করে মুসলমান হয়ে উঠতে চাইছেন। এ জায়গা থেকে তাদের উত্তরিত করে, পবিত্র ইসলামের প্রতি অনুরাগ বজায় রেখেই আধুনিক বিজ্ঞানমুখী চেতনায় পরিচালিত করবার সামাজিক উদ্যোগ তো বামপন্থিদেরই নিতে হবে। শুধু মুখে আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে মূল সমস্যার কি আদৌ কোনো সুরাহা হবে?

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের ব্যাধি

গৌতম রায়

শুক্রবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

ভোটে জেতা, সরকার করা, সংসদ সদস্য হওয়া- এটাই কখনো একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না বামপন্থিদের। জ্যোতি বসুর মতো মানুষেরা যখন নিজেদের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারকে উপেক্ষা করে কমিউনিস্ট হয়েছিলেন, দেশ-দেশের মানুষদের জন্য জীবন সঁপেছিলেন, তখন তারা স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি, মুখ্যমন্ত্রী হবেন বা মন্ত্রী হবেন বা দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ ও কমিউনিস্টদের সামনে আসবে। তারা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছিলেন। সেই লড়াই করতে গিয়ে ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের এতটুকু পরোয়া করেননি। আদর্শবাদকে সামনে রেখে কখনো কখনো কৌশলকেও সামনে রেখে লড়েছেন। সেই লড়াইয়ের অভিশ্রুতিতে সাফল্য এসেছে। সেই সাফল্যের মূলে ছিল মানুষের নাড়িক উপলব্ধি করবার অদম্য শক্তি এবং যোগ্যতা।

মুজফফর আহমদ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, মহ. ইসমাইল, বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী, গীতা মুখোপাধ্যায়, সরোজ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহেরা যখন রাজনীতির অঙ্গনে ছিলেন- সেই সময়কালটার রাজনীতির ধারাটা বর্তমান সময়ের থেকে অনেকটাই অন্যরকম ছিল। জাতীয় আন্দোলনের মূল্যবোধ এবং সেই মূল্যবোধকে জীবনের মূলধন করে বেঁচে থাকা মানুষেরাই ছিলেন সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাদের ভিতরে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ফারাক থাকলেও, ব্যক্তি জীবনে ছিল একটা বিশেষ সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক।

প্রফুল্লচন্দ্র সেনের একগুঁয়েমিই যে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম কারণ- এই বাস্তবকথাটা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। ’৭৭-এর বিধানসভা ভোটের আগে জনতা পার্টির আসন ঘিরে যদি প্রফুল্লবাবু জেদ ধরে বসে না থাকতেন, জ্যোতি বাবু, প্রমোদবাবুদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও অনমনীয় না থাকতেন, সেক্ষেত্রে কিন্তু জনতা পার্টি এবং বামফ্রন্টের ভিতর নির্বাচনী ঐক্য হতো এবং প্রফুল্লবাবুই মুখ্যমন্ত্রী হতেন। কারণ জ্যোতিবাবু- প্রমোদবাবুরা বামফ্রন্টের থেকে ও বেশি আসন দিতে চেয়েছিলেন। প্রফুল্ল সেন সেই প্রস্তাবে রাজি হননি মূলত অশোককৃষ্ণ দত্ত, নির্মলেন্দু দে (বদু), হরিপদ ভারতী প্রমুখদের প্ররোচনায়। জ্যোতিবাবুদের প্রস্তাবে যদি সেইদিন প্রফুল্লচন্দ্র সেন রাজি হয়ে যেতেন, সেক্ষেত্রে জনতা-বাম কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হতেন প্রফুল্লবাবু।

তীব্র কমিউনিস্টবিরোধী প্রফুল্লবাবুর সঙ্গে বামেদের সেই কোয়ালিশন সরকার দীর্ঘস্থায়ী হতো কিনা- এই সংশয় থেকেই যায়। বিশেষ করে ১৯৮০ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস আবার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসার পর সেই কোয়ালিশন যদি আদৌ হতো, শ্রীমতী গান্ধীর প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতি যে ওই জোট সরকারকে টিকে থাকতে দিতো না- তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানুষের কিছুটা স্বস্তি হয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা রিলিফ পায়- সেইদিকটার প্রতি বামফ্রন্ট সরকার প্রথম থেকেই বিশেষ যত্নবান ছিল। কিন্তু এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভিতরে ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, সেই সরকারকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে চোখকান খোলা রাখার যে পর্যায়কে বামপন্থিদের অতিক্রম করতে হয়েছিল, সেই পর্যায়ে বামপন্থি দৃষ্টিকোণকে সৎভাবে অবলম্বন করে চলাটা সব সময়ে সম্ভবপর হয়েছিল কিনা- সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।

সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী করবার লক্ষ্য থেকেই এসে যায় দলের ব্যাপ্তি ঘটাবার প্রসঙ্গটি। আর এই প্রসঙ্গক্রম থেকেই এসে যায় মান না দেখে সংখ্যার ওপর নির্ভর করে শাসক শিবিরে ভিড় করবার বিষয়টিও। কি বুর্জোয়া, কি কমিউনিস্ট- সব পরিকাঠামোতেই আমরা দেখেছি শাসক শিবিরে এসে ভিড় করে জনগণেশ। এই ছবি আমরা সাবেক সোভিয়েতেও দেখেছি। আর এই শাসক শিবিরে ভিড় করা মানুষদের খুশি করবার ক্ষেত্রে অতীতের কর্মপদ্ধতি ছিল একটু ভিন্নতর। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যখন বাম শাসকদের ব্যাপ্তি ঘটছে তখন সাধারণ মানুষের যে ভিড় বাম শিবিরের দিকে, সেই ভিড় কে মতাদর্শগত তাগিদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করাটা প্রায় হয়নি-ই বলা চলে।

জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবার তাগিদে মুড়ি মিছরিকে একই সঙ্গে শামিল করা শুরু হয় বামপন্থি দলগুলোর ভিতরে। শ্রেণীচেতনার ন্যূনতম অধ্যয়ন ছাড়া এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টির দরজা সকলের জন্যে খুলে দেওয়ার ফলে একটা বড়ো অংশের মানুষ, তাদের ভিতরে গরিব মানুষ ও যথেষ্ট-ই ছিলেন, কিন্তু ছিল না শ্রেণীচেতনা, শ্রেণী ঘৃণা। এসব মানুষেরাই ধীরে ধীরে নানা কৌশলে ভূমিস্তরের দল পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধানমুখ হয়ে উঠতে শুরু করলেন। এসব মানুষেরা একটা সময়ে হয়তো সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরে ছিলেন। সেই বিপরীত রাজনৈতিক শিবির যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এসব মানুষদেরই একটা বড় অংশ তখনকার শাসকদলে থেকে অর্থ আর পেশিশক্তির জেরে সমাজে কীভাবে ছড়ি ঘোরাতে হয়, সেটাও হয়তো অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। সেসব মানুষের বেশিরভাগই কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্রবে এলেন মতাদর্শের তাগিদ থেকে নয়, দল ক্ষমতায় আছে- সেই আকর্ষণেই। এখানে যে শক্ত বাঁধ দেওয়ার দরকার ছিল, সেটা কোন অবস্থাতেই দেওয়া হয়নি।

এই মতাদর্শবিহীনতার দিকটি সেই সময়ের শাসকেরা খুব একটা নজরে এনেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু তলাতেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তখন ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তের আনাগোনা একটু বেশি পরিমাণেই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রমোদ দাশগুপ্তই নতুন প্রজন্মের যেসব কর্মীকে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিকলে তোলবার পথটিকে মসৃণ করে দিয়েছিলেন, তারা প্রায় কেউই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী জনতার ভিতর থেকে উঠে আসেননি। ছাত্র-যুব আন্দোলন, যেটার মূল কেন্দ্রবিন্দু পরিচালিত হয়েছিল শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের দ্বারা, তাদের ভিতর থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের মূলত বেছেছিলেন প্রমোদবাবু। অকালপ্রয়াত দীনেশ মজুমদারের কর্মক্ষেত্র ছিল যুব আন্দোলন। আর এক অকাল প্রয়াত ব্যক্তিত্ব শঙ্কর গুপ্ত, যাকে প্রশাসনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নির্ভর করতেন জ্যোতিবাবু, তিনি ছিলেন ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা মানুষ। বিমান বসুর রাজনেতিক ভিত্তি ও ছিল ছাত্র আন্দোলন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছিল যুব আন্দোলন, অনিল বিশ্বাসের ছিল ছাত্র আন্দোলন, সুভাষ চক্রবর্তী-শ্যামল চক্রবর্তীর রাজনৈতিক ভিত্তি ও ছিল একদম ছাত্র আন্দোলন। কৃষ্ণপদ ঘোষ, চিত্তব্রত মজুমদারদের মতো শ্রমিক আন্দোলন বা বিনয় চৌধুরী, সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহ বা প্রভাষ রায়দের মতো কৃষক আন্দোলন থেকে উঠে আসা মানুষদের নেতৃত্বের শীর্ষে তুলে আনার প্রবণতাটা পরবর্তীকালে আর বজায় থাকেনি। তাই শ্যামল চক্রবর্তীর মতো ছাত্র আন্দোলনের মানুষকে শ্রমিক নেতা করে শ্রমিকদের ভিতরে কতখানি নির্ভরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারা গিয়েছিল- সেই বিতর্ক থেকেই যায়।

শ্রেণী সচেতনতা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তার উদাহরণ প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের রেখেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. অশোক মিত্রের মতো মানুষকে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতর থেকে উঠে এসেও শ্রেণী সচেতনতার প্রশ্নে যে পরাকাষ্ঠার নির্দশন ড. মিত্র রেখে গিয়েছেন, বামফ্রন্টের গোটা ৩৪ বছরের শাসন কালে তার তুলনা চলে জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, প্রভাষ রায়, অমৃতেন্দু মুখার্জী, মহ. আমিন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মহ. সেলিমের মতো হাতেগোনা কয়েকজনের সঙ্গে। শ্রেণী সচেতনতার প্রশ্নে ড. মিত্রের যে অবস্থান, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, মধ্যবিত্তের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ঘিরে রিজারভেশন- এই অবস্থানে যদি পরবর্তীতে বামফ্রন্ট সরকার স্থিত থাকতে পারতো, তাহলে আজ বামপন্থিদের এতখানি রাজনৈতিক দুরবস্থার ভিতরে পড়তে হতো না।

গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্বেরা যখন মন্ত্রী হিসেবে প্রশাসনের শীর্ষে থেকেছেন, ফ্রন্ট সরকারের প্রথম দিকে তাবড় তাবড় আমলারা চেষ্টা করেও সরকারকে কখনো বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। একদম সঙ্কীর্ণতাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল বা বামপন্থিদের সাবোতেজ করবার মানসিকতা সম্পন্ন বেশ কিছু শীর্ষস্তরের আমলা ছিলেন। যেমন অর্কপ্রভ দেবের সঙ্গেনকশাল রাজনীতির সংযোগ ঘিরে অনেক কথাই শোনা যেতো। দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ভূমিসংস্কার ঘিরে অনেককিছু দাবি করলেও, পরবর্তীতে যেভাবে বামফ্রন্ট বিরোধী শিবিরে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছিলেন, সাংসদ হয়েছিলেন, মনীষ গুপ্তের ভূমিকা- এসব ঘটনার পরম্পরা থেকে বলতে হয় যে, গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের প্রশাসন সামলানোর রীতিনীতি আর শৌখিন মজদুরির মাধ্যমে মন্ত্রিত্বে উপনীত হওয়া মানুষদের প্রশাসন চালানোর বৈশিষ্ট্যের ফারাক থেকেই অনেক কিছু বোঝা না বোঝার বিষয় উঠে আসতে থাকে।

একটা সময় ছিল যখন আমলারা নিজেদের খুশিমতো যা কিছু মন্ত্রীদের বুঝিয়ে করে নিতে কোনো অবস্থাতেই সক্ষম হতেন না। সেই সময়ের মন্ত্রীদের অনেকেরই হয়তো প্রথম জীবনটা ব্রিটিশবিরোধী নানারকম লড়াইয়ে সংযুক্ত থাকার জন্যে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংস্পৃক্ততার দরুণ তারা জীবনের শিক্ষা, প্রথাগত শিক্ষার গজদন্তমিনারে বাস করা মানুষদের থেকে অনেক বেশিই আহরণ করেছিলেন এই মানুষের কাছ থেকেই। তাই এসব মানুষদের ভুল বুঝিয়ে মানুষের স্বার্থবিরোধী কোনো কিছুই করিয়ে নেয়া সম্ভবপর হতো না সেসব আমলাদের পক্ষে।

পরবর্তীতে দেখা গেল, ধীরে ধীরে এসব আমলারা কীভাবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করছেন। কোনো না কোনো ছিদ্রপথে তারা ঢুকে পড়তে সক্ষম ও হচ্ছেন। আর বিশেষ বিশেষ মন্ত্রী, যাদের হয়তো অতীতের গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে, সেই সব। মন্ত্রীদের কুমন্ত্রণা দিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা তৈরিতে একটা বড় রকমের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছেন। উদাহরণ হিসেবে আরএসপির প্রখ্যাত নেতা তথা দীর্ঘদিনের মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী এবং তৎকালীন পূর্ত সচাব মোর্শেদ সাহেবকে ঘিরে বিতর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মোর্শেদের ঘটনাক্রম অনেককালের হয়ে গেলেও সেই কার্যক্রমের ভিতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল বর্তমান সময়ের ইঙ্গিত। যতীন চক্রবর্তীর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিক নিজের দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা জ্যোতি বসুর থেকেও বেশি বিশ্বাস করে বসলেন একজন আমলাকে। যে জ্যোতি বসুর সঙ্গে যতীন চক্রবর্তীর সম্পর্কটা একদম ব্যক্তিগত স্তরের ছিল, সেই জ্যোতি বাবুর উদ্দেশে ব্যক্তি কুৎসামূলক নোট তিনি লিখলেন আমলার প্ররোচনায় সরকারি ফাইলে।

সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নিঃসৃত অবস্থানের অভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের প্রায় সিংহভাগই এখন বামপন্থিদের সঙ্গে নেই

যতীন চক্রবর্তীর মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের সঙ্গে ও কি খেলা খেলতে পারে একাংশের আমলাবাহিনী, সেটা বোঝার মতো রাজনৈতিক দক্ষতা হয়তো পরবর্তী সময়ের একাংশের মন্ত্রীদের ছিল না। আর তা না হলে, গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা সেভাবে না থাকার কারণে এসব আমলারা কী ধরনের বিতত বিতংস নির্মাণ করেছে, তা বুঝে ওঠার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা পরবর্তী সময়ের মন্ত্রীদের অনেকেরই হয়তো ছিল না।

বামফ্রন্টকে পুনরায় রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সংখ্যালঘু সমাজের সমস্যার প্রতি প্রকৃত দৃষ্টি নিক্ষেপ। শ্রেণী রাজনীতি কখনই সংখ্যালঘুর অধিকার নিরপেক্ষ হতে পারে না। সংখ্যালঘুর অধিকারের কথা বললেই অনেক বামপন্থিই বলেন, আমরা জাতিসত্তার রাজনীতি করি না। তাদের কাছে প্রশ্ন; তফসিলি জাতি-উপজাতি, ওবিসি, দলিত ইত্যাদিদের ঘিরে যখন অধিকারের প্রশ্ন তুলেন বামপন্থিরা, তখন সেটা তো জাতিসত্তার রাজনীতি বলে আপনারা মনে করেন না। অথচ এই আন্দোলনের ভিতর দিয়ে সত্যিকারের তফসিলি জাতি-উপজাতির ভিতরে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া কয়জন মানুষ সত্যিকারের উপকৃত হয়েছেন? আর কান্তি বিশ্বাস প্রমুখদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা, অর্থনৈতিকভাবে সবল কতজন মানুষ উপকৃত হয়েছেন?

সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নিঃসৃত অবস্থানের অভাবে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের প্রায় সিংহভাগই এখন বামপন্থিদের সঙ্গে নেই। নানা ধরনের প্রতীকী, পোশাকি উন্নয়নের ভাবনার ফাঁদে তারা আটকে আছেন। আর যেসব সংখ্যালঘুরা এখনো বামপন্থিদের সঙ্গে আছেন, নানা পারিপার্শ্বিকের দরুণ তারা এখন অনেক বেশি বেশি করে মুসলমান হয়ে উঠতে চাইছেন। এ জায়গা থেকে তাদের উত্তরিত করে, পবিত্র ইসলামের প্রতি অনুরাগ বজায় রেখেই আধুনিক বিজ্ঞানমুখী চেতনায় পরিচালিত করবার সামাজিক উদ্যোগ তো বামপন্থিদেরই নিতে হবে। শুধু মুখে আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে মূল সমস্যার কি আদৌ কোনো সুরাহা হবে?

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top