alt

উপ-সম্পাদকীয়

নজর মোহাম্মদ আর পরীমনি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
image

আফগানিস্তানের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা নজর মোহাম্মদ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনি

আফগানিস্তানের কান্দাহারের উপকণ্ঠে যুদ্ধ চলার সময় নজর মোহাম্মদ নামে একজন কৌতুক অভিনেতাকে তার বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করার পর রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তা থেকে কৌতুক শিল্পীর দেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা, অনেকের মতে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কৌতুক অভিনেতার পরিবার নজর মোহাম্মদ হত্যার জন্য তালেবানদের দায়ী করেছে। অন্যদিকে তালেবানরা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে একটি ভিডিও দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা গাড়িতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু অবধারিত জেনেও তিনি তালেবানদের নিয়ে রসিকতা করছিলেন; যা শুনে তার দুই পাশে বসা দুজন তালেবান তাকে বারবার চড় মারছিল এবং একজনকে পাশ থেকে বলতে শোনা যায়, ‘এই শত্রুকে আমরা হত্যা করব, আমরা তাকে বাঁচাতে পারব না’। নজর মোহাম্মদ পুলিশ অফিসার হলেও তিনি কখনও পুলিশের দায়িত্ব পালন করেননি, বিভিন্ন পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে মজার গান করা ছাড়াও সহকর্মীদের কাছ থেকে ছুড়ে দেয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মজা করে তাদের হাসাতেন। অন্যদিকে অনলাইনে হাস্যরসাত্মক নানান ভিডিও পোস্ট করার জন্যও আফগানদের কাছে তিনি কৌতুক অভিনেতা হিসেবে অনেক জনপ্রিয়।

নির্বাক চলচ্চিত্র যুগে চার্লি চ্যাপলিন সুপরিচিত একজন কৌতুক অভিনেতা ছিলেন। চার্লি চ্যাপলিন মানবজাতিকে হাসাতে চেয়েছেন, দর্শকও হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেছে, হাসাতে হাসাতেই তিনি সাম্যবাদের বার্তা দিয়েছেন, সমাজের নানা বৈষম্য আর বঞ্চনার চিত্র দর্শকদের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। জুতা সেদ্ধ করে প্লেটে নিয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে নুডুলসের মতো প্যাঁচিয়ে জুতার ফিতা খাওয়ার যে অসাধারণ দৃশ্য তা শুধু হাসির নয়, হাসির মাঝে উঁকি দেয় বুভুক্ষের প্রচন্ড ক্ষুধা। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এক সময় কমিউনিস্ট বলে তাকে গালি দিয়ে আমেরিকা থেকে বের করে দিয়েছিল। করিম আসিরকে বলা হয় আফগান চার্লি চ্যাপলিন; চার্লি চ্যাপলিন সেজে করিম আসির আমেরিকার সঙ্গে তালেবানদের যুদ্ধ চলাকালীন সাধারণ আফগানদের উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করেছেন। তালেবানরা তাকে বহুবার হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল। বিক্রমপুরের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় তিনশত ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং অধিকাংশ ছবিতেই তিনি দর্শকদের নির্মল হাসি উপহার দিয়েছেন।

তালেবান যখন আগেরবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তখন তারা দেশটিতে সব ধরনের বিনোদন নিষিদ্ধ করেছিল। সিনেমা জগৎটি ভিন্ন, এই জগতটি আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ভালো-মন্দ বিচারের কোন সুযোগ থাকবে না। কারণ ছবি তোলাই যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে সিনেমায় ভালো-মন্দ, শ্লীল-অশ্লীল বিচার্য নয়। আমরা স্কুল জীবনে নাটক করেছি, তখন কোন নায়িকা পাওয়া যেত না, পুরুষকে শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে হতো। আমরা তখন জানতাম না যে, নারীর পোশাক পুরুষের পরা শুধু হারাম নয়, অভিশপ্ত কাজও। গ্রামের মৌলভী সাহেবেরা প্রতিবাদ করতেন, কিন্তু নাটক মঞ্চায়ন প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখতেন না। এখন আমাদের গ্রাম অঞ্চলে নাটক করা প্রায় অসম্ভব, আলেম সমাজ অনেক বেশি শক্তিশালী, প্রায় প্রতিটি গ্রামে মাদরাসা গড়ে উঠায় তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে গেছে। আমাদের সময় যাত্রা হতো, রাত জেগে সবাই যাত্রা দেখত, এখন আর হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে সংসদ অধিবেশন দেখতে গিয়েছিলাম; সেইদিন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম স্পিকারের কাছে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গান গাওয়ার নিরাপত্তা চেয়েছিলেন।

হাস্যরসবোধ মানুষের জন্মগত এবং হাস্যরসের অন্যতম উপায় হলো কৌতুক। নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন ইসলামে জায়েজ; সীমারেখা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে কৌতুক করতে হবে হালালভাবে, সবকিছু করতে হবে ইসলামের নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে থেকে, মিথ্যে বলা যাবে না। হাদিস শরিফে আছে, ‘ধ্বংস হোক ওই লোক যে মানুষ হাসাবার জন্য মিথ্যা কথা বলে। সে ধ্বংস হোক, সে ধ্বংস হোক’। কৌতুক আবার সব সময় করা যাবে না, কৌতুককে পেশায় পরিণত করা যাবে না। আমাদের ইসলাম ধর্মে কম হেসে বেশি বেশি কাঁদার নির্দেশনা রয়েছে। সূরা লোকমানে বলা হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ওইগুলো হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’

সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে হাসি-তামাশা ও কৌতুক। গল্প, নাটক, কৌতুক, সিনেমা ইত্যাদি পরিবেশনার মাধ্যমে নির্মল আনন্দ দেয়ার রীতি বহুযুগ পূর্ব থেকেই সমাজে প্রচলিত আছে। নাচ, গান, কৌতুক মানুষের নিরানন্দ জীবনে অনাবিল আনন্দ বয়ে আনে। মনের প্রশান্তি এবং বিষণ্নতা দূর করতে বিনোদন জরুরি। কিন্তু অনৈসলামিক কৌতুক মুসলমানদের কাছে বিশেষ করে তালেবান সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু কল্পনার মায়াময় জগত সৃষ্টি না করে সত্য ও বাস্তবতা দিয়ে মানুষ হাসানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। মানুষ গন্ডির বাইরে গিয়ে হাসতে পারবে না, গাইতে পারবে না, নাচতে পারবে না- এগুলো তালেবান রাষ্ট্রে প্রবর্তিত আইনে নিষিদ্ধ। আনন্দ যত নির্মলই হোক না কেন তা নির্ধারিত গন্ডির বাইরে গিয়ে শরিয়তের নির্ধারিত রীতি ভঙ্গ করে সম্পাদন করলে তা হবে হারাম। তাই বোধ হয় মোহাম্মদ নজরকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

নায়িকা পরীমনিকে নিয়েও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম বেশ সরগরম। তিন তিনবার তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে; জিজ্ঞেসাবাদে কি বেরিয়ে এসেছে তা এখনও জানা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনা প্রচার করে তাকে হেয় করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে গ্রেপ্তার করার পর প্রতিদিন চমকপ্রদ খবর প্রকাশ পেতে থাকে। মামুন এবং তারেক রহমানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াসহ বিভিন্ন তরফ থেকে প্রতিবাদ আসতে থাকে, সবার একটি কথা, কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। রাষ্ট্র তখন শুনেছিল, কিন্তু এখন তেমন প্রতিবাদ হয় না। প্রায়ই দেখা যায়, সমাজের চোখে হেয় করার জন্য মিডিয়া কারও চরিত্রের খারাপ দিকটি বারবার তুলে ধরে; বিচারের আগেই তাকে সমাজের চোখে হেয় করতে উৎসাহ বোধ করে। যেদিন পরীমনিকে জামিন দেয়া হয় সেদিনও কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া তার খোলামেলা পোশাকের নাচটিই উপস্থাপন করেছে। কিন্তু কারো চরিত্র নিয়ে জনসমক্ষে মন্তব্য করা শুধু অশোভন নয়, মানহানিকরও। মিডিয়ায় এ ধরনের মন্তব্য প্রচারিত হলে ব্ল্যাকমেইল করার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে সব শিল্পী সানি লিওনের মতো সাহসী নন। তবে অভিনয় শিল্পীকে অনেকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করে থাকে বিধায় তাদের সমাজ বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নজর মোহাম্মদ আর পরীমনি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

আফগানিস্তানের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা নজর মোহাম্মদ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনি

শনিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

আফগানিস্তানের কান্দাহারের উপকণ্ঠে যুদ্ধ চলার সময় নজর মোহাম্মদ নামে একজন কৌতুক অভিনেতাকে তার বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করার পর রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তা থেকে কৌতুক শিল্পীর দেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা, অনেকের মতে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কৌতুক অভিনেতার পরিবার নজর মোহাম্মদ হত্যার জন্য তালেবানদের দায়ী করেছে। অন্যদিকে তালেবানরা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে একটি ভিডিও দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা গাড়িতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু অবধারিত জেনেও তিনি তালেবানদের নিয়ে রসিকতা করছিলেন; যা শুনে তার দুই পাশে বসা দুজন তালেবান তাকে বারবার চড় মারছিল এবং একজনকে পাশ থেকে বলতে শোনা যায়, ‘এই শত্রুকে আমরা হত্যা করব, আমরা তাকে বাঁচাতে পারব না’। নজর মোহাম্মদ পুলিশ অফিসার হলেও তিনি কখনও পুলিশের দায়িত্ব পালন করেননি, বিভিন্ন পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে মজার গান করা ছাড়াও সহকর্মীদের কাছ থেকে ছুড়ে দেয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মজা করে তাদের হাসাতেন। অন্যদিকে অনলাইনে হাস্যরসাত্মক নানান ভিডিও পোস্ট করার জন্যও আফগানদের কাছে তিনি কৌতুক অভিনেতা হিসেবে অনেক জনপ্রিয়।

নির্বাক চলচ্চিত্র যুগে চার্লি চ্যাপলিন সুপরিচিত একজন কৌতুক অভিনেতা ছিলেন। চার্লি চ্যাপলিন মানবজাতিকে হাসাতে চেয়েছেন, দর্শকও হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেছে, হাসাতে হাসাতেই তিনি সাম্যবাদের বার্তা দিয়েছেন, সমাজের নানা বৈষম্য আর বঞ্চনার চিত্র দর্শকদের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। জুতা সেদ্ধ করে প্লেটে নিয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে নুডুলসের মতো প্যাঁচিয়ে জুতার ফিতা খাওয়ার যে অসাধারণ দৃশ্য তা শুধু হাসির নয়, হাসির মাঝে উঁকি দেয় বুভুক্ষের প্রচন্ড ক্ষুধা। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এক সময় কমিউনিস্ট বলে তাকে গালি দিয়ে আমেরিকা থেকে বের করে দিয়েছিল। করিম আসিরকে বলা হয় আফগান চার্লি চ্যাপলিন; চার্লি চ্যাপলিন সেজে করিম আসির আমেরিকার সঙ্গে তালেবানদের যুদ্ধ চলাকালীন সাধারণ আফগানদের উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করেছেন। তালেবানরা তাকে বহুবার হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল। বিক্রমপুরের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় তিনশত ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং অধিকাংশ ছবিতেই তিনি দর্শকদের নির্মল হাসি উপহার দিয়েছেন।

তালেবান যখন আগেরবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তখন তারা দেশটিতে সব ধরনের বিনোদন নিষিদ্ধ করেছিল। সিনেমা জগৎটি ভিন্ন, এই জগতটি আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ভালো-মন্দ বিচারের কোন সুযোগ থাকবে না। কারণ ছবি তোলাই যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে সিনেমায় ভালো-মন্দ, শ্লীল-অশ্লীল বিচার্য নয়। আমরা স্কুল জীবনে নাটক করেছি, তখন কোন নায়িকা পাওয়া যেত না, পুরুষকে শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে হতো। আমরা তখন জানতাম না যে, নারীর পোশাক পুরুষের পরা শুধু হারাম নয়, অভিশপ্ত কাজও। গ্রামের মৌলভী সাহেবেরা প্রতিবাদ করতেন, কিন্তু নাটক মঞ্চায়ন প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখতেন না। এখন আমাদের গ্রাম অঞ্চলে নাটক করা প্রায় অসম্ভব, আলেম সমাজ অনেক বেশি শক্তিশালী, প্রায় প্রতিটি গ্রামে মাদরাসা গড়ে উঠায় তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে গেছে। আমাদের সময় যাত্রা হতো, রাত জেগে সবাই যাত্রা দেখত, এখন আর হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে সংসদ অধিবেশন দেখতে গিয়েছিলাম; সেইদিন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম স্পিকারের কাছে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গান গাওয়ার নিরাপত্তা চেয়েছিলেন।

হাস্যরসবোধ মানুষের জন্মগত এবং হাস্যরসের অন্যতম উপায় হলো কৌতুক। নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন ইসলামে জায়েজ; সীমারেখা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে কৌতুক করতে হবে হালালভাবে, সবকিছু করতে হবে ইসলামের নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে থেকে, মিথ্যে বলা যাবে না। হাদিস শরিফে আছে, ‘ধ্বংস হোক ওই লোক যে মানুষ হাসাবার জন্য মিথ্যা কথা বলে। সে ধ্বংস হোক, সে ধ্বংস হোক’। কৌতুক আবার সব সময় করা যাবে না, কৌতুককে পেশায় পরিণত করা যাবে না। আমাদের ইসলাম ধর্মে কম হেসে বেশি বেশি কাঁদার নির্দেশনা রয়েছে। সূরা লোকমানে বলা হয়েছে, ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ওইগুলো হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’

সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে হাসি-তামাশা ও কৌতুক। গল্প, নাটক, কৌতুক, সিনেমা ইত্যাদি পরিবেশনার মাধ্যমে নির্মল আনন্দ দেয়ার রীতি বহুযুগ পূর্ব থেকেই সমাজে প্রচলিত আছে। নাচ, গান, কৌতুক মানুষের নিরানন্দ জীবনে অনাবিল আনন্দ বয়ে আনে। মনের প্রশান্তি এবং বিষণ্নতা দূর করতে বিনোদন জরুরি। কিন্তু অনৈসলামিক কৌতুক মুসলমানদের কাছে বিশেষ করে তালেবান সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু কল্পনার মায়াময় জগত সৃষ্টি না করে সত্য ও বাস্তবতা দিয়ে মানুষ হাসানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। মানুষ গন্ডির বাইরে গিয়ে হাসতে পারবে না, গাইতে পারবে না, নাচতে পারবে না- এগুলো তালেবান রাষ্ট্রে প্রবর্তিত আইনে নিষিদ্ধ। আনন্দ যত নির্মলই হোক না কেন তা নির্ধারিত গন্ডির বাইরে গিয়ে শরিয়তের নির্ধারিত রীতি ভঙ্গ করে সম্পাদন করলে তা হবে হারাম। তাই বোধ হয় মোহাম্মদ নজরকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

নায়িকা পরীমনিকে নিয়েও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম বেশ সরগরম। তিন তিনবার তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে; জিজ্ঞেসাবাদে কি বেরিয়ে এসেছে তা এখনও জানা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনা প্রচার করে তাকে হেয় করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে গ্রেপ্তার করার পর প্রতিদিন চমকপ্রদ খবর প্রকাশ পেতে থাকে। মামুন এবং তারেক রহমানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াসহ বিভিন্ন তরফ থেকে প্রতিবাদ আসতে থাকে, সবার একটি কথা, কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। রাষ্ট্র তখন শুনেছিল, কিন্তু এখন তেমন প্রতিবাদ হয় না। প্রায়ই দেখা যায়, সমাজের চোখে হেয় করার জন্য মিডিয়া কারও চরিত্রের খারাপ দিকটি বারবার তুলে ধরে; বিচারের আগেই তাকে সমাজের চোখে হেয় করতে উৎসাহ বোধ করে। যেদিন পরীমনিকে জামিন দেয়া হয় সেদিনও কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া তার খোলামেলা পোশাকের নাচটিই উপস্থাপন করেছে। কিন্তু কারো চরিত্র নিয়ে জনসমক্ষে মন্তব্য করা শুধু অশোভন নয়, মানহানিকরও। মিডিয়ায় এ ধরনের মন্তব্য প্রচারিত হলে ব্ল্যাকমেইল করার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে সব শিল্পী সানি লিওনের মতো সাহসী নন। তবে অভিনয় শিল্পীকে অনেকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করে থাকে বিধায় তাদের সমাজ বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top