এমএ কবীর
মানুষ এ কোন সমাজের পেছনে ছুটছে! যাকে এখন সবাই সামাজিক মাধ্যম বলছে। আসলেই কী এখানে সামাজিকতা রয়েছে? থাকলেও তার ধরন কেমন? নাকি এ সব মাধ্যমের কারণে মানুষ সামাজিকতা হারাতে বসেছে। এ প্রশ্ন আজ অনেকের মাথায় উঁকি দিচ্ছে।
যোগাযোগ ও বন্ধন এক নয়। সামাজিক মাধ্যম যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ যোগাযোগে কোন বন্ধন তৈরি হচ্ছে না। বরং পারিবারিক, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে বন্ধন রয়েছে সেই বন্ধনেও শৈথিল্য দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়েছে।
সামাজিকতার অনুষঙ্গ হচ্ছে ভদ্রতা, সভ্যতা, আনন্দ, বেদনা ও সমবেদনায় পারস্পরিক বোঝাপড়া। ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই এখানে বড় কথা। সামাজিক মাধ্যমগুলো এ সত্যকে অস্বীকার করে চলেছে। তারা যেন বিশ্বাস করে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দর্শনে-‘সহেনা সহেনা জনতার জঘন্য মিতালী।’
মতভিন্নতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে মাওসেতুং বলেছেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ মতের ও সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যের সহাবস্থানেই সভ্য হয়ে উঠে সমাজ। শত ফুলের বদলে শত হুল ফুটছে ফেসবুকের অবয়বজুড়ে। রুচিশীল তর্ক সেখানে বিরল। যে কোন বিষয়ে মতভিন্নতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয় কদর্য গালমন্দে। তারকা বা বিশিষ্ট কোন ব্যক্তির চরিত্র হননের পালা শুরু হলে বিপুল উৎসাহে সেখানে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ট্রলের মাধ্যমে বিপন্ন করে তোলেন সেই ব্যক্তির জীবন। ব্যক্তি যদি নারী হন, তাহলে আক্রমণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ‘ট্রল’ নামে অভিহিত এ অনাচারকে ‘ভার্চুয়াল গণপিটুনি’ আখ্যা দেয়াই সঙ্গত।
গোয়েবলস বলেছেন, একটি মিথ্যা কথা ১০ বার বললে এটি সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলসের তত্ত্ব প্রচারের ধারক হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমগুলো। তাদের পরিবেশিত সত্যে আলোর উদ্ভাসন কতটুকু ঘটে জানা নেই। তবে তাদের প্রচারিত মিথ্যার কুহেলিকায় প্রায়ই সত্যের মৃত্যু ঘটে।
সমাজে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার মানুষ যে বেশি এটি ফেসবুকের বদৌলতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। কারও কারও মন্তব্যে স্যাডিস্ট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।’ সংক্রামক ব্যাধির মতোই অপসাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালজুড়ে। পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে একসময় চিঠি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চিঠি, হলুদ খাম, পোস্টকার্ড এখন জাদুঘরে। প্রিয়জনকে লেখা চিঠি, প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি ছিল অপার আবেগের আধার। এর জায়গা নিয়েছে এখন টেক্সট মেসেজ কিংবা ফেসবুক মেসেঞ্জার। মা-বাবা, প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজনকে আগে বিভিন্ন উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো হতো তাদের সঙ্গে হৃদয়ের উষ্ণতা বিনিময় করে। তখন দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কার্ড, চিঠি, ফুল বা অন্য কোন উপহার দিয়ে বিশেষ মুহূর্তটিকে উদ্্যাপন করা হতো। তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থান এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে জগৎ তৈরি হচ্ছে সেটি কৃত্রিম। ছবি দেখে, ভিডিওকলে কথা বলে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়, সম্পর্ক বাঁচানো যায় না। মানুষের ভেতরে একটি স্বার্থপর প্রাণী বাস করে, সুযোগ পেলে সেই প্রাণী আত্মপ্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে উদয়াদিত্য বলেছিলেন, ‘রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।’ বিত্তবান পরিবারে সন্তানের চেয়ে উত্তরাধিকারীই বেশি কাক্সিক্ষত।
সৃজনশীল বই পড়া, খেলার মাঠে যাওয়ার কোন তাগিদ শিক্ষার্থীদের নেই। ঘরে অভিভাবকরা যে যার ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত, সন্তানরাও তাই শিখছে। এ দৃশ্য এখন দুর্লভ নয়।
প্রযুক্তি যত উৎকর্ষই অর্জন করুক না কেন, যন্ত্র কখনও মানুষের বিকল্প হতে পারে না। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা তরুণদের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় আছে, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ/প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন।’
কীটসের বিখ্যাত উক্তি, ‘Our sweetest songs are those which tell us of saddest thoughts.’
একটি জনপ্রিয় গানে মান্না দে’র অনুভূতি, ‘ ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে/পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে/কী করে এখানে তুমি আসবে?’ প্রেমের চিরন্তন অনুভূতি আনন্দ ও বেদনার যৌথ অস্তিত্বে গঠিত। যুগে যুগে, দেশে দেশে প্রেমের এ রূপই বহমান। সামাজিক মাধ্যম প্রেমের এ চিরন্তন রূপকে পাল্টে দিচ্ছে।
সহজলভ্যতা ও স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি প্রেমকে লঘু করে ফেলছে। তরুণ-তরুণীরা সহজেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করছে। এক সময় মোহভঙ্গ হলে সম্পর্কের অবসান ঘটছে। কখনও কখনও বিক্ষুব্ধ পক্ষ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিজেদের অথবা প্রেমিক বা প্রেমিকার অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল করে দিচ্ছে যা একটি নতুন অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। কিছুদিন পর অবলীলায় তারা নতুন কাউকে বেছে নিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এরপর আবারও সেই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রকৃত প্রেমের পরিবর্তে সাময়িক মোহের এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে।
শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিও ক্ষয়িষ্ণু রূপ ধারণ করেছে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। সমালোচনা সাহিত্য বরাবরই দুর্বল আমাদের। উৎকৃষ্ট বইয়ের পাঠক সাধারণত কম হয়, সেই বই সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনা হয় আরও কম। একজন লেখক নিজের নতুন বই সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পর অনেকে লাইক, কমেন্ট করেন। এটি লেখকের জন্য কোন সুসংবাদ নয়। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই বইটি পড়েন না। শিল্পী হওয়ার দিকে ঝোঁক নেই, সবাই তারকা হতে চায়। সামাজিক মাধ্যম অজস্র কবি, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, নির্মাতার জন্ম দিচ্ছে, অগণিত ‘ভিউ’ ও ‘শেয়ার’ হচ্ছে। অযোগ্যদের প্রাদুর্ভাবে প্রকৃত প্রতিভা যে আড়ালে চলে যাচ্ছে সেটি কম দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই এর মূলধন। এভাবে একটি অস্থির জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বায়ন যে বিশ্বগ্রামের কথা বলে সেই গ্রাম সীমায়িত হয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতে। সাক্ষাৎ, স্পর্শ, ঘ্রাণের চেয়ে কাচের পর্দায় চোখ রেখে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। পণ্যভোগবাদের নতুন লীলাভূমি এ কাচের ভূখন্ড। এ ভূখন্ডের জাতীয় সংগীত,
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি ...।’
আসিফ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সেল ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের ফ্ল্যাটের পরিবর্তে অন্য ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়লেন। ওই ফ্ল্যাটের শান্তা ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছেন, তিনি লক্ষ্য করলেন না তার স্বামী নয়, অন্য কোন ব্যক্তি বাসায় এসেছেন। গৃহপরিচারিকা দিয়ে যথারীতি চা পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর সেই ফ্ল্যাটের মালিক সাজেদ ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এলেন। নিজের ড্রয়িংরুমে অচেনা ব্যক্তিকে বসে থাকতে দেখে তিনি ‘সরি’ বলে উপরের তলায় চলে গেলেন নিজের ফ্ল্যাট খুঁজতে। নিজের ঘর, নিজের মানুষ অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের চলতি বছরের মে মাসের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপক হারে। এই পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষ শুধু ফেসবুকই ব্যবহার করে। যার সংখ্যা দাঁড়ায় চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী এবং ৬৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্যবহারকারীই বেশি। যার সংখ্যা দুই কোটি ১২ লাখের মতো। এছাড়াও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৩০০ জন। লিংকডইন ব্যবহারকারী ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার। অনেকেই টুইটার ব্যবহার করে থাকেন।
এ ধারা অব্যাহত থাকলে, ‘মানুষ অসামাজিক জীব’- এ নতুন পরিচিতি পেতে দেরি হবে না।
[লেখক : সভাপতি,
ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]
এমএ কবীর
শনিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
মানুষ এ কোন সমাজের পেছনে ছুটছে! যাকে এখন সবাই সামাজিক মাধ্যম বলছে। আসলেই কী এখানে সামাজিকতা রয়েছে? থাকলেও তার ধরন কেমন? নাকি এ সব মাধ্যমের কারণে মানুষ সামাজিকতা হারাতে বসেছে। এ প্রশ্ন আজ অনেকের মাথায় উঁকি দিচ্ছে।
যোগাযোগ ও বন্ধন এক নয়। সামাজিক মাধ্যম যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ যোগাযোগে কোন বন্ধন তৈরি হচ্ছে না। বরং পারিবারিক, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে বন্ধন রয়েছে সেই বন্ধনেও শৈথিল্য দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়েছে।
সামাজিকতার অনুষঙ্গ হচ্ছে ভদ্রতা, সভ্যতা, আনন্দ, বেদনা ও সমবেদনায় পারস্পরিক বোঝাপড়া। ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই এখানে বড় কথা। সামাজিক মাধ্যমগুলো এ সত্যকে অস্বীকার করে চলেছে। তারা যেন বিশ্বাস করে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দর্শনে-‘সহেনা সহেনা জনতার জঘন্য মিতালী।’
মতভিন্নতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে মাওসেতুং বলেছেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ মতের ও সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যের সহাবস্থানেই সভ্য হয়ে উঠে সমাজ। শত ফুলের বদলে শত হুল ফুটছে ফেসবুকের অবয়বজুড়ে। রুচিশীল তর্ক সেখানে বিরল। যে কোন বিষয়ে মতভিন্নতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয় কদর্য গালমন্দে। তারকা বা বিশিষ্ট কোন ব্যক্তির চরিত্র হননের পালা শুরু হলে বিপুল উৎসাহে সেখানে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ট্রলের মাধ্যমে বিপন্ন করে তোলেন সেই ব্যক্তির জীবন। ব্যক্তি যদি নারী হন, তাহলে আক্রমণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ‘ট্রল’ নামে অভিহিত এ অনাচারকে ‘ভার্চুয়াল গণপিটুনি’ আখ্যা দেয়াই সঙ্গত।
গোয়েবলস বলেছেন, একটি মিথ্যা কথা ১০ বার বললে এটি সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলসের তত্ত্ব প্রচারের ধারক হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমগুলো। তাদের পরিবেশিত সত্যে আলোর উদ্ভাসন কতটুকু ঘটে জানা নেই। তবে তাদের প্রচারিত মিথ্যার কুহেলিকায় প্রায়ই সত্যের মৃত্যু ঘটে।
সমাজে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার মানুষ যে বেশি এটি ফেসবুকের বদৌলতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। কারও কারও মন্তব্যে স্যাডিস্ট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।’ সংক্রামক ব্যাধির মতোই অপসাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালজুড়ে। পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে একসময় চিঠি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চিঠি, হলুদ খাম, পোস্টকার্ড এখন জাদুঘরে। প্রিয়জনকে লেখা চিঠি, প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি ছিল অপার আবেগের আধার। এর জায়গা নিয়েছে এখন টেক্সট মেসেজ কিংবা ফেসবুক মেসেঞ্জার। মা-বাবা, প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজনকে আগে বিভিন্ন উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো হতো তাদের সঙ্গে হৃদয়ের উষ্ণতা বিনিময় করে। তখন দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কার্ড, চিঠি, ফুল বা অন্য কোন উপহার দিয়ে বিশেষ মুহূর্তটিকে উদ্্যাপন করা হতো। তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থান এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে জগৎ তৈরি হচ্ছে সেটি কৃত্রিম। ছবি দেখে, ভিডিওকলে কথা বলে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়, সম্পর্ক বাঁচানো যায় না। মানুষের ভেতরে একটি স্বার্থপর প্রাণী বাস করে, সুযোগ পেলে সেই প্রাণী আত্মপ্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে উদয়াদিত্য বলেছিলেন, ‘রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।’ বিত্তবান পরিবারে সন্তানের চেয়ে উত্তরাধিকারীই বেশি কাক্সিক্ষত।
সৃজনশীল বই পড়া, খেলার মাঠে যাওয়ার কোন তাগিদ শিক্ষার্থীদের নেই। ঘরে অভিভাবকরা যে যার ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত, সন্তানরাও তাই শিখছে। এ দৃশ্য এখন দুর্লভ নয়।
প্রযুক্তি যত উৎকর্ষই অর্জন করুক না কেন, যন্ত্র কখনও মানুষের বিকল্প হতে পারে না। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা তরুণদের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় আছে, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ/প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন।’
কীটসের বিখ্যাত উক্তি, ‘Our sweetest songs are those which tell us of saddest thoughts.’
একটি জনপ্রিয় গানে মান্না দে’র অনুভূতি, ‘ ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে/পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে/কী করে এখানে তুমি আসবে?’ প্রেমের চিরন্তন অনুভূতি আনন্দ ও বেদনার যৌথ অস্তিত্বে গঠিত। যুগে যুগে, দেশে দেশে প্রেমের এ রূপই বহমান। সামাজিক মাধ্যম প্রেমের এ চিরন্তন রূপকে পাল্টে দিচ্ছে।
সহজলভ্যতা ও স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি প্রেমকে লঘু করে ফেলছে। তরুণ-তরুণীরা সহজেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করছে। এক সময় মোহভঙ্গ হলে সম্পর্কের অবসান ঘটছে। কখনও কখনও বিক্ষুব্ধ পক্ষ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিজেদের অথবা প্রেমিক বা প্রেমিকার অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল করে দিচ্ছে যা একটি নতুন অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। কিছুদিন পর অবলীলায় তারা নতুন কাউকে বেছে নিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এরপর আবারও সেই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রকৃত প্রেমের পরিবর্তে সাময়িক মোহের এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে।
শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিও ক্ষয়িষ্ণু রূপ ধারণ করেছে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। সমালোচনা সাহিত্য বরাবরই দুর্বল আমাদের। উৎকৃষ্ট বইয়ের পাঠক সাধারণত কম হয়, সেই বই সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনা হয় আরও কম। একজন লেখক নিজের নতুন বই সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পর অনেকে লাইক, কমেন্ট করেন। এটি লেখকের জন্য কোন সুসংবাদ নয়। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই বইটি পড়েন না। শিল্পী হওয়ার দিকে ঝোঁক নেই, সবাই তারকা হতে চায়। সামাজিক মাধ্যম অজস্র কবি, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, নির্মাতার জন্ম দিচ্ছে, অগণিত ‘ভিউ’ ও ‘শেয়ার’ হচ্ছে। অযোগ্যদের প্রাদুর্ভাবে প্রকৃত প্রতিভা যে আড়ালে চলে যাচ্ছে সেটি কম দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই এর মূলধন। এভাবে একটি অস্থির জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বায়ন যে বিশ্বগ্রামের কথা বলে সেই গ্রাম সীমায়িত হয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতে। সাক্ষাৎ, স্পর্শ, ঘ্রাণের চেয়ে কাচের পর্দায় চোখ রেখে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। পণ্যভোগবাদের নতুন লীলাভূমি এ কাচের ভূখন্ড। এ ভূখন্ডের জাতীয় সংগীত,
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি ...।’
আসিফ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সেল ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের ফ্ল্যাটের পরিবর্তে অন্য ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়লেন। ওই ফ্ল্যাটের শান্তা ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছেন, তিনি লক্ষ্য করলেন না তার স্বামী নয়, অন্য কোন ব্যক্তি বাসায় এসেছেন। গৃহপরিচারিকা দিয়ে যথারীতি চা পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর সেই ফ্ল্যাটের মালিক সাজেদ ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এলেন। নিজের ড্রয়িংরুমে অচেনা ব্যক্তিকে বসে থাকতে দেখে তিনি ‘সরি’ বলে উপরের তলায় চলে গেলেন নিজের ফ্ল্যাট খুঁজতে। নিজের ঘর, নিজের মানুষ অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের চলতি বছরের মে মাসের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপক হারে। এই পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষ শুধু ফেসবুকই ব্যবহার করে। যার সংখ্যা দাঁড়ায় চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী এবং ৬৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্যবহারকারীই বেশি। যার সংখ্যা দুই কোটি ১২ লাখের মতো। এছাড়াও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৩০০ জন। লিংকডইন ব্যবহারকারী ৩৩ লাখ ৪৩ হাজার। অনেকেই টুইটার ব্যবহার করে থাকেন।
এ ধারা অব্যাহত থাকলে, ‘মানুষ অসামাজিক জীব’- এ নতুন পরিচিতি পেতে দেরি হবে না।
[লেখক : সভাপতি,
ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]