alt

উপ-সম্পাদকীয়

এক অনন্য চিকিৎসক

অরূপরতন চৌধুরী

: রোববার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
image

১৯৮৬ সালের মার্চ মাসের একটি সকাল। আমি তখন তাদানিন্তন ইনস্টিটিউট আব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (IPGM&R) বা পিজি হাসপাতালে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তখনকার সময়ের ডাইরেক্টর পিজি হাসপাতাল জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। একদিন সকালে ডেন্টাল বিভাগে ফোন এলো যে বারডেম থেকে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মুহম্মদ ইব্রাহিম দাঁত পরীক্ষা করতে আসছেন। সেদিন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছুটিতে ছিলেন। সুতরাং দায়িত্ব পড়ল আমার। যথারীতি ডা. মুহম্মদ ইব্রাহিম স্যার এলেন বিভাগে। আমি সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে বললেন ‘আমার দাঁতের একটি ধারালো অংশের জন্য জিহ্বাতে ঘা হয়েছে, একটু দেখে দাও তো, আর কোন সমস্যা আছে কিনা।’ আমি স্যার কে ডেন্টাল চেয়ারে বসিয়ে দাঁত ও মুখ পরীক্ষা করে দেখলাম, সত্যিই তার একটি দাঁত ভেঙে ধারালো হয়ে গেছে সেই সঙ্গে মাড়িতেও প্লাক জমা হয়ে প্রদাহ হয়েছে। এমতাবস্তায় তার দাঁতের ধারালো অংশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘষে মসৃণ করে দিলাম সেই সঙ্গে ডেন্টাল স্কেলিং করে দিলাম, দাঁতগুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। সঙ্গে একটি প্রেসক্রিপশনও করলাম। তিনি খুব খুশি হয়ে, আমার নাম পরিচয় জেনে গেলেন। পিজি থেকে বারডেম এ পৌঁছেই তিনি তাদানিন্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. মতিন স্যারকে ফোন করলেন এবং আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। অধ্যাপক ডা. মতিন আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানালেন, ইব্রাহিম স্যার তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বললেন “এক কাজ করো ডা. অরূপরতন কে বারডেম এ দিয়ে দাও” । স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. মতিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন বললেন” স্যার অরূপ তো সরকারি চাকরিতে পিজিতে আছে, ওকে কীভাবে দেব”

ডা. ইব্রাহিম স্যার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন “ডিপুটেশনে দাও”। এর দুই দিন পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি অর্ডার এলো, এরকমভাবে যে, আমি সপ্তাহে দু’দিন পিজিতে চাকরিরত অবস্থাতেই বারডেম এ এসে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁত পরীক্ষা করে চিকিৎসা দেব। আমি অর্ডারটি নিয়ে পিজির পরিচালক স্যারের অনুমতি নিয়ে বারডেম এসে ইব্রাহিম স্যারের সঙ্গে দেখা করে স্যারকে সালাম দিয়ে আমার কৃতজ্ঞতার কথা তাকে জানালাম, এবং আমি বললাম “স্যার আমি আজ ধন্য, আপনি আমার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সুপারিশ করে বারডেম ডায়াবেটিস রোগীদের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ইব্রাহিম স্যার বললেন, “এটা তো আমাদের লাভ হলো, তুমি কাজ শুরু করে দাও”। পরের দিন আমার চেম্বার থেকে একটি ডেন্টাল চেয়ার নিয়ে এসে বারডেমের নিচতলায় এখন যেখানে ী-ৎধু করা হয় সেখানের একটি ছোট রুমে ডেন্টাল চেয়ার বসালাম। সঙ্গে চেম্বার থেকে কিছু যন্ত্রপাতিও নিয়ে আসলাম। এভাবেই চললো আমার প্রতি সপ্তাহে দ্ইু দিন বারডেমে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁতের চিকিৎসাসেবা দেয়ার কাজ।

আমার ইব্রাহিম স্যারের প্রতি এতই শ্রদ্ধাবোধ জাগলো যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছিলাম না। তাই স্যারকে একটি বারও জিজ্ঞাসা করিনি যে, আমার ডেন্টাল চেয়ার বা যন্ত্রপাতি কোথা থেকে পাব। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আর কৃতজ্ঞতা থেকে ১৯৮৬ সালেই নিজের চেম্বারের ডেন্টাল চেয়ার আর যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে বারডেম এ রোগী দেখা শুরু করি। ইব্রাহিম স্যারও আমার এই কর্মকান্ডকে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। পরবর্তীতে তিনি জাপান বাংলাদেশ সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে যে সিটিস্ক্যান মেশিনটি বাংলাদেশে আনিয়েছিলেন তার সঙ্গে একটি ডেন্টাল চেয়ারও জাপান থেকে আমাকে এনে দিয়েছিলেন কাজ করার জন্য। ধীরে ধীরে আমার রোগীর সংখ্যাও বাড়তে লাগলো এর ঠিক এক বছর পর তিনি আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করে ১৯৮৭ সালে আমাকে পূর্ণাঙ্গভাবে পিজি হাসপাতাল থেকে ডিপুটেশন এ নিয়ে আসলেন। এবং ১৯৮৭ সাল থেকে আমি বারডেম হাসপাতালে ফুলটাইম কাজ শুরু করি। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইব্রাহিম স্যারের সানিধ্যে আসার পর থেকে আমার পেশাগত জীবনেরও অনেক পরিবর্তন শুরু হয়। আমি এখানে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে ইব্রাহিম স্যারের অনুপ্রেরণায় গবেষণা কাজও শুরু করি। পরবর্তীতে আমার ডায়াবেটিস ও মুখের রোগের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রায় ৩৮টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশে^র ২৪টি দেশে উপস্থাপন করার সুযোগ পাই। বিশেষত প্রায় সব বিশ^ ডায়াবেটিক সম্মেলন ও আন্তর্জাতিক ডেন্টাল সম্মেলনে ইতোমধ্যে আমার প্রায় ২১টি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এবং পরবর্তীতে ২০০০ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডায়াবেটিস ও মাড়ির রোগের সঙ্গে এন্টিঅক্সিডেন্ট সম্পর্ক নিয়ে আমার গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি। ডায়াবেটিস ও মুখের রোগ নিয়ে আমার অসংখ্য লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৪টি বই প্রকাশ পেয়েছে। বারডেম থেকে রোগীদেরকে যে ডায়াবেটিক গাইড বই দেয়া হয়, তাতেও আমি মুখ ও দাঁতের যত্ন সম্পর্কে একটি অধ্যায় রচনা করে দিয়েছি। ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁতের যত্নের ও চিকিৎসায় ফলে এখন অসংখ্য ডায়াবেটিস রোগী যেমন মুখ ও দাঁতের যত্ন সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন তেমনি, তারা তাদের ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ আছেন। চিন্তা করলে অবাক লাগে যে, মরহুম ডা. মো. ইব্রাহিম যে চিন্তা নিয়ে আমাকে ৩৫ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানে এনে ঢুকিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে, ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ শুধু না, তাদের সুস্থভাবে বাঁচতে হলে এবং অন্যান্য জটিলতা যেমন হার্ট ডিজিজ, ফুসফুসের রোগ, লিভার ও কিডনি রোগ, নাক, কান, গলার বিভিন্ন রোগ এমনকি ক্যানসার থেকে বাঁচতে হলে মুখের ও দাঁতের যত্ন তাদের অবশ্যই নিতে হবে।

আজ পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি দেশেই ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের রোগের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং মাড়ির রোগকে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগের ৫টি জটিলতার সঙ্গে যুক্ত করে ষষ্ঠ জটিলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। আজ আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি ডা. মো. ইব্রাহিমের রোগীদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার জন্যই এখন আমাদের ডেন্টাল বিভাগ আগের চাইতে অনেক বড় হয়েছে। এখানে প্রায় প্রতিটি ডেন্টাল বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছে। সেই সঙ্গে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের সঙ্গে খোলা হয়েছে ডেন্টাল ইউনিট। যেখানেও প্রতি বছর প্রায় ২৫ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছে এবং প্রতি বছরই নতুন ডেন্টাল সার্জনদের ব্যাচ বেরিয়ে আসছে এই কলেজ থেকে। যে ছয়টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখন এখানে কাজ করছেন সেগুলো হলো, মেক্সিলো ফেসিয়াল সার্জারি, পেরিওডন্টলজি, প্রস্থডনসিয়া, চিলড্রেন ডেনটিস্ট্রি, অরথডনসিয়া ও কনসারডেটিভ ডেন্টিস্ট্রি ইত্যাদি।

সুতরাং, বারডেম হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের যেমন- বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিচ্ছেন তেমনি ডেন্টাল বিভাগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এবং কলেজ থেকে প্রতি বছর নতুন ডেন্টিস্টরা বের হয়ে যাচ্ছেন। ডা. মো. ইব্রাহিমের এই দূরদৃষ্টি না থাকলে আজ অগণিত ডায়াবেটিস রোগীরা মুখের ও দাঁতের চিকিৎসা সেবা থেকে শুধু যে বঞ্চিত থাকত তা নয়, তারা অনেক জটিলতায়ও আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করত। এর সবই সম্ভব হয়েছে ডা. মো. ইব্রাহিমের মতো একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহান চিকিৎসকের জন্য। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে স্যারকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাভরে।

[লেখক : সাম্মানিক সিনিয়র কনসালটেন্ট, ডেন্টাল বিভাগ, বারডেম জেনারের হাসপাতাল ও অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

এক অনন্য চিকিৎসক

অরূপরতন চৌধুরী

image

রোববার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

১৯৮৬ সালের মার্চ মাসের একটি সকাল। আমি তখন তাদানিন্তন ইনস্টিটিউট আব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (IPGM&R) বা পিজি হাসপাতালে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তখনকার সময়ের ডাইরেক্টর পিজি হাসপাতাল জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। একদিন সকালে ডেন্টাল বিভাগে ফোন এলো যে বারডেম থেকে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মুহম্মদ ইব্রাহিম দাঁত পরীক্ষা করতে আসছেন। সেদিন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছুটিতে ছিলেন। সুতরাং দায়িত্ব পড়ল আমার। যথারীতি ডা. মুহম্মদ ইব্রাহিম স্যার এলেন বিভাগে। আমি সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে বললেন ‘আমার দাঁতের একটি ধারালো অংশের জন্য জিহ্বাতে ঘা হয়েছে, একটু দেখে দাও তো, আর কোন সমস্যা আছে কিনা।’ আমি স্যার কে ডেন্টাল চেয়ারে বসিয়ে দাঁত ও মুখ পরীক্ষা করে দেখলাম, সত্যিই তার একটি দাঁত ভেঙে ধারালো হয়ে গেছে সেই সঙ্গে মাড়িতেও প্লাক জমা হয়ে প্রদাহ হয়েছে। এমতাবস্তায় তার দাঁতের ধারালো অংশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘষে মসৃণ করে দিলাম সেই সঙ্গে ডেন্টাল স্কেলিং করে দিলাম, দাঁতগুলো পরিষ্কার হয়ে গেল। সঙ্গে একটি প্রেসক্রিপশনও করলাম। তিনি খুব খুশি হয়ে, আমার নাম পরিচয় জেনে গেলেন। পিজি থেকে বারডেম এ পৌঁছেই তিনি তাদানিন্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. মতিন স্যারকে ফোন করলেন এবং আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। অধ্যাপক ডা. মতিন আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানালেন, ইব্রাহিম স্যার তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বললেন “এক কাজ করো ডা. অরূপরতন কে বারডেম এ দিয়ে দাও” । স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. মতিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন বললেন” স্যার অরূপ তো সরকারি চাকরিতে পিজিতে আছে, ওকে কীভাবে দেব”

ডা. ইব্রাহিম স্যার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন “ডিপুটেশনে দাও”। এর দুই দিন পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি অর্ডার এলো, এরকমভাবে যে, আমি সপ্তাহে দু’দিন পিজিতে চাকরিরত অবস্থাতেই বারডেম এ এসে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁত পরীক্ষা করে চিকিৎসা দেব। আমি অর্ডারটি নিয়ে পিজির পরিচালক স্যারের অনুমতি নিয়ে বারডেম এসে ইব্রাহিম স্যারের সঙ্গে দেখা করে স্যারকে সালাম দিয়ে আমার কৃতজ্ঞতার কথা তাকে জানালাম, এবং আমি বললাম “স্যার আমি আজ ধন্য, আপনি আমার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সুপারিশ করে বারডেম ডায়াবেটিস রোগীদের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ইব্রাহিম স্যার বললেন, “এটা তো আমাদের লাভ হলো, তুমি কাজ শুরু করে দাও”। পরের দিন আমার চেম্বার থেকে একটি ডেন্টাল চেয়ার নিয়ে এসে বারডেমের নিচতলায় এখন যেখানে ী-ৎধু করা হয় সেখানের একটি ছোট রুমে ডেন্টাল চেয়ার বসালাম। সঙ্গে চেম্বার থেকে কিছু যন্ত্রপাতিও নিয়ে আসলাম। এভাবেই চললো আমার প্রতি সপ্তাহে দ্ইু দিন বারডেমে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁতের চিকিৎসাসেবা দেয়ার কাজ।

আমার ইব্রাহিম স্যারের প্রতি এতই শ্রদ্ধাবোধ জাগলো যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছিলাম না। তাই স্যারকে একটি বারও জিজ্ঞাসা করিনি যে, আমার ডেন্টাল চেয়ার বা যন্ত্রপাতি কোথা থেকে পাব। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আর কৃতজ্ঞতা থেকে ১৯৮৬ সালেই নিজের চেম্বারের ডেন্টাল চেয়ার আর যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে বারডেম এ রোগী দেখা শুরু করি। ইব্রাহিম স্যারও আমার এই কর্মকান্ডকে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। পরবর্তীতে তিনি জাপান বাংলাদেশ সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে যে সিটিস্ক্যান মেশিনটি বাংলাদেশে আনিয়েছিলেন তার সঙ্গে একটি ডেন্টাল চেয়ারও জাপান থেকে আমাকে এনে দিয়েছিলেন কাজ করার জন্য। ধীরে ধীরে আমার রোগীর সংখ্যাও বাড়তে লাগলো এর ঠিক এক বছর পর তিনি আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করে ১৯৮৭ সালে আমাকে পূর্ণাঙ্গভাবে পিজি হাসপাতাল থেকে ডিপুটেশন এ নিয়ে আসলেন। এবং ১৯৮৭ সাল থেকে আমি বারডেম হাসপাতালে ফুলটাইম কাজ শুরু করি। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইব্রাহিম স্যারের সানিধ্যে আসার পর থেকে আমার পেশাগত জীবনেরও অনেক পরিবর্তন শুরু হয়। আমি এখানে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে ইব্রাহিম স্যারের অনুপ্রেরণায় গবেষণা কাজও শুরু করি। পরবর্তীতে আমার ডায়াবেটিস ও মুখের রোগের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রায় ৩৮টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশে^র ২৪টি দেশে উপস্থাপন করার সুযোগ পাই। বিশেষত প্রায় সব বিশ^ ডায়াবেটিক সম্মেলন ও আন্তর্জাতিক ডেন্টাল সম্মেলনে ইতোমধ্যে আমার প্রায় ২১টি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এবং পরবর্তীতে ২০০০ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডায়াবেটিস ও মাড়ির রোগের সঙ্গে এন্টিঅক্সিডেন্ট সম্পর্ক নিয়ে আমার গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি। ডায়াবেটিস ও মুখের রোগ নিয়ে আমার অসংখ্য লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৪টি বই প্রকাশ পেয়েছে। বারডেম থেকে রোগীদেরকে যে ডায়াবেটিক গাইড বই দেয়া হয়, তাতেও আমি মুখ ও দাঁতের যত্ন সম্পর্কে একটি অধ্যায় রচনা করে দিয়েছি। ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের মুখ ও দাঁতের যত্নের ও চিকিৎসায় ফলে এখন অসংখ্য ডায়াবেটিস রোগী যেমন মুখ ও দাঁতের যত্ন সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন তেমনি, তারা তাদের ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ আছেন। চিন্তা করলে অবাক লাগে যে, মরহুম ডা. মো. ইব্রাহিম যে চিন্তা নিয়ে আমাকে ৩৫ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানে এনে ঢুকিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে, ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ শুধু না, তাদের সুস্থভাবে বাঁচতে হলে এবং অন্যান্য জটিলতা যেমন হার্ট ডিজিজ, ফুসফুসের রোগ, লিভার ও কিডনি রোগ, নাক, কান, গলার বিভিন্ন রোগ এমনকি ক্যানসার থেকে বাঁচতে হলে মুখের ও দাঁতের যত্ন তাদের অবশ্যই নিতে হবে।

আজ পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি দেশেই ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের রোগের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং মাড়ির রোগকে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগের ৫টি জটিলতার সঙ্গে যুক্ত করে ষষ্ঠ জটিলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। আজ আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি ডা. মো. ইব্রাহিমের রোগীদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার জন্যই এখন আমাদের ডেন্টাল বিভাগ আগের চাইতে অনেক বড় হয়েছে। এখানে প্রায় প্রতিটি ডেন্টাল বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছে। সেই সঙ্গে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের সঙ্গে খোলা হয়েছে ডেন্টাল ইউনিট। যেখানেও প্রতি বছর প্রায় ২৫ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছে এবং প্রতি বছরই নতুন ডেন্টাল সার্জনদের ব্যাচ বেরিয়ে আসছে এই কলেজ থেকে। যে ছয়টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এখন এখানে কাজ করছেন সেগুলো হলো, মেক্সিলো ফেসিয়াল সার্জারি, পেরিওডন্টলজি, প্রস্থডনসিয়া, চিলড্রেন ডেনটিস্ট্রি, অরথডনসিয়া ও কনসারডেটিভ ডেন্টিস্ট্রি ইত্যাদি।

সুতরাং, বারডেম হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের যেমন- বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিচ্ছেন তেমনি ডেন্টাল বিভাগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এবং কলেজ থেকে প্রতি বছর নতুন ডেন্টিস্টরা বের হয়ে যাচ্ছেন। ডা. মো. ইব্রাহিমের এই দূরদৃষ্টি না থাকলে আজ অগণিত ডায়াবেটিস রোগীরা মুখের ও দাঁতের চিকিৎসা সেবা থেকে শুধু যে বঞ্চিত থাকত তা নয়, তারা অনেক জটিলতায়ও আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করত। এর সবই সম্ভব হয়েছে ডা. মো. ইব্রাহিমের মতো একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহান চিকিৎসকের জন্য। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে স্যারকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাভরে।

[লেখক : সাম্মানিক সিনিয়র কনসালটেন্ট, ডেন্টাল বিভাগ, বারডেম জেনারের হাসপাতাল ও অধ্যাপক ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট]

back to top