শেখর ভট্টাচার্য
শরৎ এসে গেছে। রাতের আঁধার কেটে সোনালি ভোর যখন চোখ মেলে তাকায় গ্রাম কিংবা শহরে, মিঠে কড়া সোনালি আভার রোদ বলে দেয় শরৎ এসে গেছে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ নাগরিক জানালার গ্রিল দিয়ে পাশের দালানগুলোর গা-ঘেঁষে আকাশ দেখার চেষ্টা করেন। এক টুকরো আকাশ কখনো দেখা যায় কখনো বা স্পষ্ট দেখা যায় না। এরকম আকাশ দেখে কী ঋতুর বৈচিত্র্য কিংবা সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়? শরতের অনুষঙ্গ, সহচর অনেক। ঝকঝকে নীল আকাশ। আকাশের বুকে খেলা করা সাদা মেঘের ভেলা, বিস্তীর্ণ কাশবন, কচি ঘাসের ডগায় মুক্তোর মতো শিশিরের অনিন্দ্য সুন্দর কণা আর থোঁকা থোঁকা শিউলি ফুল। শরতের আকুল করা ভোর কিংবা সন্ধ্যার অপরূপ রূপ ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরে বসে শুধু কল্পনাই করা যায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি যারা প্রকৃতির খুব কাছে যেতে পারেন না, তাদের কাছে শরৎ হলো পথের পাঁচালির অপু, দুর্গার কাশবনের মধ্য দিয়ে রেলগাড়ি দেখার দৃশ্য। কী অসাধারণ কাশবন। সত্যজিৎ রায় বিভুতি ভূষণের কল্পনাকে দর্শকের সামনে অনিন্দ্য সুন্দর রূপে তুলে ধরেছেন।
ঢাকার মানুষ শরৎ উপভোগ করতে প্রতিবার শরৎকালে বেড়াতে যান ঢাকার আধুনিক আবাসন অঞ্চল উত্তরা মডেল শহরের লাগুয়া দিয়াবাড়িতে। শরৎকালে ঢাকার সব স্তরের মানুষের শরৎ দর্শন হয় দিয়াবাড়ির বিস্তীর্ণ কাশবন দেখে। এই কাশবনেই যে শরৎ উৎসব ঢাকাবাসীর। উত্তরা মডেল শহরের পশ্চিমে, তুরাগের পারে এই ঘন সাদা কাশবন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারিত প্রকল্পের অংশ এই দিয়াবাড়ি। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের এই এলাকাটিতে কিছুদিন আগেও ছিল সুনসান নীরবতা। বালুমাটি ফেলে সমতল করা এই বিশাল মাঠের মতো খোলা জায়গাটি প্রতি শরতে শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যায়। কাশবনের ভেতর দিয়ে পথ। নগরের যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে একটু প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা নগরবাসী হাঁটতে থাকেন এই পথ ধরে।
কাশবনের এই অপার সৌন্দর্যমন্ডিত অঞ্চলটিকে আর কতদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে জানি না। এ অপুর্ব সুন্দর কাশবনের পাশেই আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল পথের প্রথম স্টেশন, উত্তর দিয়াবাড়ি। কিছুদিন আগেও এলাকাটি দুর্গম ছিল। জনমানুষের আনাগোনা ছিল না। অবারিত ফসলের ক্ষেত আর তুরাগ তীরে শ্বেত-শুভ্র চোখজুড়ানো কাশের বাগান। এলাকা যত দুর্গম থাকে, প্রকৃতি তত শান্তিতে স্বভাবিক উপায়ে বিকাশ লাভ করতে পারে। মানুষের পদচারণা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এলাকাটি কত দুর্গম ছিল সেদিন আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চালনা উদ্বোধন করতে এসে আমাদেরকে আবার মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম যখন এই দুর্গম এলাকায় ডিপোর পূর্তকাজের উদ্বোধনের জন্য আসি। তখন বৃষ্টিতে ভিজে তিন দিন জ্বরে ভুগেছি। অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে মেট্রোরেলের এই দুর্গম এলাকা পর্যন্ত আসতে পেরেছিলাম।’
ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হলো অনেক। মানুষের চিন্তার যোগসূত্র কত বিচিত্র। মূলত আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্প নিয়ে লিখতে গিয়ে দিয়াবাড়ির কথা মনে হলো। দিয়াবাড়ির সাথে ঢাকার মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কাশফুল, কাশবন বললে দিয়াবাড়ির কথা মনে হয়ে যায়। কাশফুলের সাথে শরৎকালের এবং শরতের সাথে ঢাকার প্রকৃতির কথা চলে আসে।
মূল কথায় ফিরে আসি। মানুষ তার বৃহত্তর প্রয়োজনে গড়ে তুলে জল-স্থল অন্তরীক্ষে নতুন নতুন পথ-ঘাট, অবকাঠামো। দেড় কোটি মানুষের এই আবাসস্থল ঢাকাকে যানজট মুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পরিকল্পনা ছিল একটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের। মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই এটিকে ‘অসম্ভব’ এবং অবাস্তব পরিকল্পনা মনে করেছিলেন। অসম্ভব ও অবাস্তব পরিকল্পনা এখন আর অসম্ভব নয়। চোখের সামনে দৃশ্যমান। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই মেট্রোরেল প্রকল্পটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। সাহসী নেতৃত্ব, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে স্বাপ্নিক মানুষের অবস্থান যদি থাকে তাহলে আকাশের কুসুমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা খুবই সহজ; যা বাংলাদেশ করে দেখাচ্ছে। শুধু মেট্রোরেল নয় সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। ২০২২ সালের জুনে চালু হবে পদ্মা সেতু, সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল ও ডিসেম্বর চালু করা হবে স্বপ্নের এই মেট্রোরেল।
স্বপ্নগুলো পাখা মেলে এখন আর আকাশে উড়ছে না, স্বপ্নগুলো আর কোনভাবেই স্বপ্নের পর্যায়ে নেই, চোখের সামনে দৃশ্যমান। স্বপ্নগুলো এখন নির্মিতব্য নয়, স্বপ্নগুলো এখন নির্মিত। সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক আধুনিক পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য অদম্য সাহস, আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখার কারণে আজ বাংলাদেশের অনেক স্বপ্ন আর স্বপ্নের পর্যায়ে নেই তা আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে উড়াল ও পাতাল রেলের সমন্বয়ে নির্মিতব্য মেট্রোরেলের ৬টি লাইন। পুরো রেলপথ হবে ১২৮ দশমিক ৭৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৭ দশমিক ৫৬৯ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে এবং ৬১ দশমিক ১৭২ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেলের এই ছয়টি লাইনের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল লাইন-৬, এটি উদ্বোধনের পর দীর্ঘদিনের অসহনীয় যানজটের কবল থেকে ঢাকার মানুষ এবং প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা কাজে ঢাকায় আসা মানুষদের যানজটের কারণে যে অসহনীয় ভোগান্তি হতো এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতো তা অনেকাংশেই কমে যাবে বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন।
উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে শুরু হয়ে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর রুট হবে মতিঝিল পর্যন্ত। বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এ লাইনে ষোলোটি স্টেশন থাকবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে যেকোন কর্মদিবসে যেখানে কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়; সেই পথ মাড়াবে ঢাকার নাগরিকরা মাত্র চল্লিশ মিনিটে। রূপকথার গল্পের মতো মানুষ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত ছুটে চলবে। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৪০ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। ভেবে দেখুন মেট্রোরেলকে কেন স্বপ্নের রেলপথ মনে করা হচ্ছে? সারাদিন কয়েক লাখ লোক এই ষোলোটি স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে সরকার।
কর্মদিবসের ভোরবেলায় ঢাকার মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের অফিস, শিক্ষাঙ্গন, ব্যবসা বাণিজ্য স্থলে সঠিক সময়ে পৌছানোর জন্য যে মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক কষ্ট ভোগ করতেন, তা বোধ হয় এই স্বপ্নের পথ চালু হলে অনেকাংশেই লাঘব হবে। আবার সঠিক সময়ে বাড়ি ফেরার জন্যও এই সেবাটি মানুষকে একইভাবে উপকৃত করবে। পথে পথে মানুষের কত যে প্রয়োজনীয় কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এখন তার কোন সীমা নেই। এ কর্মঘণ্টাগুলোকে আমরা যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করতে পারি এবং তার অর্থমূল্য বিবেচনা করি তাহলে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আমাদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের স্ত্রী আন্না এলিয়ান্ট রুজভেল্ট; যিনি নিজে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার একটি অসামান্য উক্তির কথা মনে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন- যারা স্বপ্নের সৌন্দর্যে বিশ্বাস করে, ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। আমরা স্বপ্নের সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করি। আমরা ১৯৬৬ সালে স্বপ্ন দেখেছিলাম শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি স্ব-অধিকারের আবাসভূমি; যা আমাদের ধাবিত করবে স্বাধীনতার দিকে। আমাদের নিবেদন, অদম্য দেশপ্রেম, সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা তা অর্জন করতে পেরেছি।
আমরা এবার নেমেছি শোষণমুক্ত বঞ্চনাহীন আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। যে প্রত্যয়ের আপাতত মাইলস্টোন ২০৪১, যে সময়ে আমরা রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন করব। আমাদের লক্ষ্য দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসা। ২০২১ সালে অবস্থান করে আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে এটি অনেকটা দিবাস্বপ্ন, দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসা অসম্ভব। আমাদের প্রত্যয় যদি হয় দৃঢ়, আমাদের আত্মবিশ্বাস যদি হয় ইস্পাত কঠিন, রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য রোড ম্যাপ যদি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়- তাহলে এ স্বপ্নকে ছোঁয়াও অসম্ভব নয় আমাদের জন্য। হ্যাঁ, আমরা পারব আমাদের অভীষ্ট স্বপ্নকে ছুঁতে। তবে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে- আমরা যেন প্রকৃতিকে নির্বিচারে বিনাশ করে কোন উন্নয়ন কর্মকা- না করি। দিয়াবাড়ির কাশবনকে ধ্বংস করে আমরা যেন আবাসন প্রকল্প না করি। আধুনিক, কল্যাণমুখী দেশে উন্নয়ন ও প্রকৃতি রক্ষণ এ দুটি কাজকে কিন্তু সমগুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করা হয়। ঢাকার মানুষদের শরৎ অনুভব, উপভোগ করার সুযোগকে যেন আমরা সীমিত না করি। শুভ্র কাশবনের ভেতর দিয়ে, শরতের সৌন্দর্য আভা গায়ে মেখে আমরা যেন মেট্রোরেলে চড়তে পারি। আশা করি আমাদের স্বপ্নের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য নীতি-নির্ধারকরা এ কথাটি বিবেচনায় রাখবেন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
বৃহস্পতিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
শরৎ এসে গেছে। রাতের আঁধার কেটে সোনালি ভোর যখন চোখ মেলে তাকায় গ্রাম কিংবা শহরে, মিঠে কড়া সোনালি আভার রোদ বলে দেয় শরৎ এসে গেছে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ নাগরিক জানালার গ্রিল দিয়ে পাশের দালানগুলোর গা-ঘেঁষে আকাশ দেখার চেষ্টা করেন। এক টুকরো আকাশ কখনো দেখা যায় কখনো বা স্পষ্ট দেখা যায় না। এরকম আকাশ দেখে কী ঋতুর বৈচিত্র্য কিংবা সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়? শরতের অনুষঙ্গ, সহচর অনেক। ঝকঝকে নীল আকাশ। আকাশের বুকে খেলা করা সাদা মেঘের ভেলা, বিস্তীর্ণ কাশবন, কচি ঘাসের ডগায় মুক্তোর মতো শিশিরের অনিন্দ্য সুন্দর কণা আর থোঁকা থোঁকা শিউলি ফুল। শরতের আকুল করা ভোর কিংবা সন্ধ্যার অপরূপ রূপ ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরে বসে শুধু কল্পনাই করা যায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি যারা প্রকৃতির খুব কাছে যেতে পারেন না, তাদের কাছে শরৎ হলো পথের পাঁচালির অপু, দুর্গার কাশবনের মধ্য দিয়ে রেলগাড়ি দেখার দৃশ্য। কী অসাধারণ কাশবন। সত্যজিৎ রায় বিভুতি ভূষণের কল্পনাকে দর্শকের সামনে অনিন্দ্য সুন্দর রূপে তুলে ধরেছেন।
ঢাকার মানুষ শরৎ উপভোগ করতে প্রতিবার শরৎকালে বেড়াতে যান ঢাকার আধুনিক আবাসন অঞ্চল উত্তরা মডেল শহরের লাগুয়া দিয়াবাড়িতে। শরৎকালে ঢাকার সব স্তরের মানুষের শরৎ দর্শন হয় দিয়াবাড়ির বিস্তীর্ণ কাশবন দেখে। এই কাশবনেই যে শরৎ উৎসব ঢাকাবাসীর। উত্তরা মডেল শহরের পশ্চিমে, তুরাগের পারে এই ঘন সাদা কাশবন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারিত প্রকল্পের অংশ এই দিয়াবাড়ি। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের এই এলাকাটিতে কিছুদিন আগেও ছিল সুনসান নীরবতা। বালুমাটি ফেলে সমতল করা এই বিশাল মাঠের মতো খোলা জায়গাটি প্রতি শরতে শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যায়। কাশবনের ভেতর দিয়ে পথ। নগরের যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে একটু প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা নগরবাসী হাঁটতে থাকেন এই পথ ধরে।
কাশবনের এই অপার সৌন্দর্যমন্ডিত অঞ্চলটিকে আর কতদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে জানি না। এ অপুর্ব সুন্দর কাশবনের পাশেই আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল পথের প্রথম স্টেশন, উত্তর দিয়াবাড়ি। কিছুদিন আগেও এলাকাটি দুর্গম ছিল। জনমানুষের আনাগোনা ছিল না। অবারিত ফসলের ক্ষেত আর তুরাগ তীরে শ্বেত-শুভ্র চোখজুড়ানো কাশের বাগান। এলাকা যত দুর্গম থাকে, প্রকৃতি তত শান্তিতে স্বভাবিক উপায়ে বিকাশ লাভ করতে পারে। মানুষের পদচারণা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এলাকাটি কত দুর্গম ছিল সেদিন আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চালনা উদ্বোধন করতে এসে আমাদেরকে আবার মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম যখন এই দুর্গম এলাকায় ডিপোর পূর্তকাজের উদ্বোধনের জন্য আসি। তখন বৃষ্টিতে ভিজে তিন দিন জ্বরে ভুগেছি। অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে মেট্রোরেলের এই দুর্গম এলাকা পর্যন্ত আসতে পেরেছিলাম।’
ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হলো অনেক। মানুষের চিন্তার যোগসূত্র কত বিচিত্র। মূলত আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্প নিয়ে লিখতে গিয়ে দিয়াবাড়ির কথা মনে হলো। দিয়াবাড়ির সাথে ঢাকার মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কাশফুল, কাশবন বললে দিয়াবাড়ির কথা মনে হয়ে যায়। কাশফুলের সাথে শরৎকালের এবং শরতের সাথে ঢাকার প্রকৃতির কথা চলে আসে।
মূল কথায় ফিরে আসি। মানুষ তার বৃহত্তর প্রয়োজনে গড়ে তুলে জল-স্থল অন্তরীক্ষে নতুন নতুন পথ-ঘাট, অবকাঠামো। দেড় কোটি মানুষের এই আবাসস্থল ঢাকাকে যানজট মুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পরিকল্পনা ছিল একটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের। মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই এটিকে ‘অসম্ভব’ এবং অবাস্তব পরিকল্পনা মনে করেছিলেন। অসম্ভব ও অবাস্তব পরিকল্পনা এখন আর অসম্ভব নয়। চোখের সামনে দৃশ্যমান। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই মেট্রোরেল প্রকল্পটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। সাহসী নেতৃত্ব, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে স্বাপ্নিক মানুষের অবস্থান যদি থাকে তাহলে আকাশের কুসুমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা খুবই সহজ; যা বাংলাদেশ করে দেখাচ্ছে। শুধু মেট্রোরেল নয় সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। ২০২২ সালের জুনে চালু হবে পদ্মা সেতু, সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল ও ডিসেম্বর চালু করা হবে স্বপ্নের এই মেট্রোরেল।
স্বপ্নগুলো পাখা মেলে এখন আর আকাশে উড়ছে না, স্বপ্নগুলো আর কোনভাবেই স্বপ্নের পর্যায়ে নেই, চোখের সামনে দৃশ্যমান। স্বপ্নগুলো এখন নির্মিতব্য নয়, স্বপ্নগুলো এখন নির্মিত। সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক আধুনিক পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য অদম্য সাহস, আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখার কারণে আজ বাংলাদেশের অনেক স্বপ্ন আর স্বপ্নের পর্যায়ে নেই তা আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে উড়াল ও পাতাল রেলের সমন্বয়ে নির্মিতব্য মেট্রোরেলের ৬টি লাইন। পুরো রেলপথ হবে ১২৮ দশমিক ৭৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৭ দশমিক ৫৬৯ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে এবং ৬১ দশমিক ১৭২ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেলের এই ছয়টি লাইনের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল লাইন-৬, এটি উদ্বোধনের পর দীর্ঘদিনের অসহনীয় যানজটের কবল থেকে ঢাকার মানুষ এবং প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা কাজে ঢাকায় আসা মানুষদের যানজটের কারণে যে অসহনীয় ভোগান্তি হতো এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতো তা অনেকাংশেই কমে যাবে বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন।
উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে শুরু হয়ে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর রুট হবে মতিঝিল পর্যন্ত। বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এ লাইনে ষোলোটি স্টেশন থাকবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে যেকোন কর্মদিবসে যেখানে কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়; সেই পথ মাড়াবে ঢাকার নাগরিকরা মাত্র চল্লিশ মিনিটে। রূপকথার গল্পের মতো মানুষ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত ছুটে চলবে। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৪০ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। ভেবে দেখুন মেট্রোরেলকে কেন স্বপ্নের রেলপথ মনে করা হচ্ছে? সারাদিন কয়েক লাখ লোক এই ষোলোটি স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে সরকার।
কর্মদিবসের ভোরবেলায় ঢাকার মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের অফিস, শিক্ষাঙ্গন, ব্যবসা বাণিজ্য স্থলে সঠিক সময়ে পৌছানোর জন্য যে মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক কষ্ট ভোগ করতেন, তা বোধ হয় এই স্বপ্নের পথ চালু হলে অনেকাংশেই লাঘব হবে। আবার সঠিক সময়ে বাড়ি ফেরার জন্যও এই সেবাটি মানুষকে একইভাবে উপকৃত করবে। পথে পথে মানুষের কত যে প্রয়োজনীয় কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে এখন তার কোন সীমা নেই। এ কর্মঘণ্টাগুলোকে আমরা যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করতে পারি এবং তার অর্থমূল্য বিবেচনা করি তাহলে মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আমাদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের স্ত্রী আন্না এলিয়ান্ট রুজভেল্ট; যিনি নিজে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার একটি অসামান্য উক্তির কথা মনে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন- যারা স্বপ্নের সৌন্দর্যে বিশ্বাস করে, ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। আমরা স্বপ্নের সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করি। আমরা ১৯৬৬ সালে স্বপ্ন দেখেছিলাম শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি স্ব-অধিকারের আবাসভূমি; যা আমাদের ধাবিত করবে স্বাধীনতার দিকে। আমাদের নিবেদন, অদম্য দেশপ্রেম, সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা তা অর্জন করতে পেরেছি।
আমরা এবার নেমেছি শোষণমুক্ত বঞ্চনাহীন আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। যে প্রত্যয়ের আপাতত মাইলস্টোন ২০৪১, যে সময়ে আমরা রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন করব। আমাদের লক্ষ্য দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসা। ২০২১ সালে অবস্থান করে আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে এটি অনেকটা দিবাস্বপ্ন, দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসা অসম্ভব। আমাদের প্রত্যয় যদি হয় দৃঢ়, আমাদের আত্মবিশ্বাস যদি হয় ইস্পাত কঠিন, রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য রোড ম্যাপ যদি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়- তাহলে এ স্বপ্নকে ছোঁয়াও অসম্ভব নয় আমাদের জন্য। হ্যাঁ, আমরা পারব আমাদের অভীষ্ট স্বপ্নকে ছুঁতে। তবে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে- আমরা যেন প্রকৃতিকে নির্বিচারে বিনাশ করে কোন উন্নয়ন কর্মকা- না করি। দিয়াবাড়ির কাশবনকে ধ্বংস করে আমরা যেন আবাসন প্রকল্প না করি। আধুনিক, কল্যাণমুখী দেশে উন্নয়ন ও প্রকৃতি রক্ষণ এ দুটি কাজকে কিন্তু সমগুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করা হয়। ঢাকার মানুষদের শরৎ অনুভব, উপভোগ করার সুযোগকে যেন আমরা সীমিত না করি। শুভ্র কাশবনের ভেতর দিয়ে, শরতের সৌন্দর্য আভা গায়ে মেখে আমরা যেন মেট্রোরেলে চড়তে পারি। আশা করি আমাদের স্বপ্নের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য নীতি-নির্ধারকরা এ কথাটি বিবেচনায় রাখবেন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]