alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতে পুলিশের সফট টার্গেট মুসলমান

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

অজয়মোহন বিশওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে উত্তর প্রদেশজুড়ে মুসলমানদের ওপর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক অত্যাচার একটা দৈনন্দিন চিত্রে পরিণত হয়েছে। তবে আদিত্যনাথ সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই অত্যাচার শুরু হয়েছে, আগে একদম স্বর্গরাজ্য ছিল উত্তরপ্রদেশ মুসলমানদের কাছে- এমনটা ভাবার অর্থ হলো মুর্খের স্বর্গে বাস করা। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে শেষ দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল তখন উত্তরপ্রদেশের পুলিশ যে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছিল- সে খবর আজকের দিনে অনেকের কাছেই অজানা থেকে গেছে। ১৯৮০ সালের ১৩ আগস্ট, মোরাদাবাদে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের প্রভিন্সিয়াল আর্মড কন্সটাবুলারি (পি এ সি) পবিত্র ঈদের দিন প্রার্থনারত প্রায় ৪০ হাজার মুসলমানের ওপর বিনাপ্ররোচনায় গুলি চালায়। এই বর্বরতার সময়কালে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং, অনেকেই যাকে ধর্মনিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেন।

সেই গুলিতে কতজন মানুষ যে শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। আদিত্যনাথকে পরিকল্পিত মুসলিম হত্যায় অভিযুক্ত করার আগে আমাদের তো অবশ্যই মোরাদাবাদে ’৮০ সালের কর্মকান্ডের সময়কালের মুখ্যমন্ত্রী ভি পি সিং এবং সেই সময়ের দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর ভূমিকাকেও আলোচনার ভিতরে আনতে হবে। না হলে তো ইতিহাস নির্মাণই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

মোরাদাবাদে সেদিন তো কোনো দাঙ্গা হয়নি। হয়েছিল পরিকল্পিত গণহত্যা। আর সেই গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দ্বারা, যেমনটা পরবর্তীকালে গুজরাটে ঘটেছে। এই কিছুদিন আগে ঘটলো দিল্লিতে। রাজনৈতিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া পুলিশ একতরফাভাবে মুসলমানদের ওপর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক নির্যাতন করে যেতে পারে না। মুসলমানদের প্রতি আচরণ ঘিরে পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে পুলিশ কিন্তু পরবর্তীতে যে ভূমিকা নিয়ে চলেচে, তেমন ভূমিকা নিতে পারত না। নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা ভেঙে একদল দুষ্কৃতির একটি ধাতু মূর্তি রেখে আসার ঘটনার পরে পুলিশের একটি অংশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে। কারণ, সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থের ভূমিকা আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। তার ওপরে পন্থের প্রতি ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। তা সত্ত্বেও পুলিশ কিন্তু পরবর্তী সময়ের মতো খুল্লামখুল্লা মুসলমানবিরোধী অবস্থান নিতে পারেনি দেশের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরুর দৃঢ় অবস্থানের জন্যে।

এই পরিবেশ কিন্তু পরবর্তী সময়ে বজায় থাকেনি। পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রী দের ভেতরে অটলবিহারী বাজপেয়ী আর সাম্প্রতিক সময়ের নরেন্দ্র মোদি ছাড়া আর কেউ প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তবে লালবাহাদুর শাস্ত্রী থেকে ড. মনমোহন সিং ... কেউ ই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানের প্রশ্নে পন্ডিত নেহরুর মতো দৃঢ় চিত্তের মানুষ ছিলেন না। সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নেও পন্ডিত নেহরুর মতো যত্নবান এবং আন্তরিক প্রধানমন্ত্রী ভারত আর পায়নি।

লালাবাহাদুর শাস্ত্রীকে ঘিরে আপামর ভারতবাসীর গভীর শ্রদ্ধা আছে। অনেক ক্ষেত্রে পন্ডিত নেহরুকে যারা পছন্দ করেন না, তারা লালবাহাদুরকে ঘিরে একটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করেন। তাসখন্দে তার মৃত্যু ঘিরেও একটা রহস্যের আফরণ তৈরি করে থাকেন কেউ কেউ। সেই শাস্ত্রীজী ও চরম মুসলমান বিদ্বেষী এবং গান্ধী হত্যাকারী আর এস এস কে তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে প্রজাতন্ত্র দিবসের সময়ের দিল্লির যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।

১৯৬৪ সালে পবিত্র হজরতবাল দরগাশরীফে সংরক্ষিত হজরত মুহাম্মদ-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ঘিরে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পন্ডিত নেহরু। দাঙ্গার ব্যাপ্তির সময়কালে নেহরু ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৭ শে মে তার জীবনাবসান ঘটে। সেই দাঙ্গার ব্যাপ্তি আজকের বাংলাদেশে ভয়ঙ্করভাবে পড়েছিল। আইয়ুব খান তার সামরিক শাসনকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানে এই পবিত্র হজরতবালের ঘটনাকে নগ্নভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

সে সময়ে দাঙ্গার প্রভাব কলকাতাতেও যথেষ্ট পড়েছিল। এই দাঙ্গা মোকাবিলার প্রশ্নে, মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের দৃঢ় ভূমিকার যথেষ্ট অভাব ছিল। দেশব্যাপী এই দাঙ্গার হাত থেকে মুসলমানদের বাঁচানোর প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর ও শক্ত ভূমিকা দেখাতে পারেননি। ফলে পশ্চিমবঙ্গে সেদিন মুসলমানদের ওপর সংগঠিত অত্যাচার হয়েছিল। ’৪৬ এর দাঙ্গায় যেসব হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং ব্যক্তি সংগঠিত অত্যাচার চালিয়েছিল মুসলমানেদের ওপর, তারাই আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল স্বাধীন দেশের পুলিশের একটা বড় অংশের মুসলমানবিরোধী মানসিকতার জেরে এই সময়ে। এই পর্যায়ে হিন্দু মহাসভা এবং ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের যুগপৎ ঘনিষ্ঠ গোপাল মুখার্জী এবং পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অসামরিক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাম চট্টোপাধ্যায়ের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

পুলিশকে দাঙ্গার সময়ে জাতধর্ম না দেখে অসহায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যেতে কতখানি তৎপর হতে আমরা দেখি? ’৯২ সালে কলকাতায় যখন বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা হয়েছিল, তখন ও মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ নিজের থেকে কতখানি আন্তরিক ছিল আর সেই সময়ের প্রশাসনের চাপে কতখানি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখেছিল... সেই বিতর্ক থেকেই যায়। পরবর্তী সময়ে বা তার আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা আমাদের এই রাজ্যে প্রশাসনিক তৎপরতা ব্যতিরেকে পুলিশ কতখানি দাঙ্গার সময়েই হোক বা দাঙ্গার আগে পরেই হোক মুসলমানদের সম্পর্কে সঠিক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে ... এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

একুশ শতকের সূচনাপর্বে এই নিবন্ধকার কে একদিন যেতে হয়েছিল ভবানী ভবনে পুলিশের প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের তৎকালীন আইজির ঘরে। পুলিশ কর্তার টেবিলের কাচের নিচে হরেক রকমের দেবদেবীর ছবি। দেওয়ালেও তাই। বিষয়টি সেই পুলিশ কর্তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি নিজের ভক্তপ্রাণ মানসিকতার কথা জানালেন। প্রশ্ন করলাম; এখন যদি কোনো ধর্মের মানুষ সাম্প্রদায়িক কারণে অপর ধর্মের মানুষের কাছে আক্রান্ত হয়ে আপনার কাছে আসেন, তখন আপনার ঘরে একটি বিশেষ ধর্মের দেবদেবীদের ছবি ইত্যাদি দেখে আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন না? পুলিশ কর্তা সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। সেই পুলিশ কর্তা পরবর্তীতে কলকাতার নগরপাল ও হয়েছিলেন।

প্রত্যেকটা মানুষের ই ধর্ম মানার অধিকার আছে। না মানার ও অধিকার আছে। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সেই ধর্ম মানার ক্ষেত্রে সবসময়ে মনে রাখা দরকার যে, প্রশাসনের একটি অঙ্গ স্বরূপ তিনি ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কাজে দায়বদ্ধ। কোনো অবস্থাতেই সরকারি চেয়ারে বসে একজন আধাকারিক পারেন না একটি বিশেষ ধর্মের দেবদেবীকে নিজের সরকারি অফিসে প্রদর্শিত করতে। সেক্ষেত্রে অপরধর্মের মানুষ যদি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি কর্তার কাছে আসেন সুবিচার চাইতে, সেক্ষেত্রে সেই বিচারপ্রার্থীর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে সেদিকে একবার ও কি আমরা ভেবে দেখেছি?

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতে পুলিশের সফট টার্গেট মুসলমান

গৌতম রায়

শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

অজয়মোহন বিশওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে উত্তর প্রদেশজুড়ে মুসলমানদের ওপর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক অত্যাচার একটা দৈনন্দিন চিত্রে পরিণত হয়েছে। তবে আদিত্যনাথ সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই অত্যাচার শুরু হয়েছে, আগে একদম স্বর্গরাজ্য ছিল উত্তরপ্রদেশ মুসলমানদের কাছে- এমনটা ভাবার অর্থ হলো মুর্খের স্বর্গে বাস করা। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে শেষ দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল তখন উত্তরপ্রদেশের পুলিশ যে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছিল- সে খবর আজকের দিনে অনেকের কাছেই অজানা থেকে গেছে। ১৯৮০ সালের ১৩ আগস্ট, মোরাদাবাদে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের প্রভিন্সিয়াল আর্মড কন্সটাবুলারি (পি এ সি) পবিত্র ঈদের দিন প্রার্থনারত প্রায় ৪০ হাজার মুসলমানের ওপর বিনাপ্ররোচনায় গুলি চালায়। এই বর্বরতার সময়কালে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং, অনেকেই যাকে ধর্মনিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেন।

সেই গুলিতে কতজন মানুষ যে শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। আদিত্যনাথকে পরিকল্পিত মুসলিম হত্যায় অভিযুক্ত করার আগে আমাদের তো অবশ্যই মোরাদাবাদে ’৮০ সালের কর্মকান্ডের সময়কালের মুখ্যমন্ত্রী ভি পি সিং এবং সেই সময়ের দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর ভূমিকাকেও আলোচনার ভিতরে আনতে হবে। না হলে তো ইতিহাস নির্মাণই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

মোরাদাবাদে সেদিন তো কোনো দাঙ্গা হয়নি। হয়েছিল পরিকল্পিত গণহত্যা। আর সেই গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দ্বারা, যেমনটা পরবর্তীকালে গুজরাটে ঘটেছে। এই কিছুদিন আগে ঘটলো দিল্লিতে। রাজনৈতিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া পুলিশ একতরফাভাবে মুসলমানদের ওপর শারীরিক, মানসিক, আর্থিক নির্যাতন করে যেতে পারে না। মুসলমানদের প্রতি আচরণ ঘিরে পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে পুলিশ কিন্তু পরবর্তীতে যে ভূমিকা নিয়ে চলেচে, তেমন ভূমিকা নিতে পারত না। নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা ভেঙে একদল দুষ্কৃতির একটি ধাতু মূর্তি রেখে আসার ঘটনার পরে পুলিশের একটি অংশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে। কারণ, সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থের ভূমিকা আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না। তার ওপরে পন্থের প্রতি ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। তা সত্ত্বেও পুলিশ কিন্তু পরবর্তী সময়ের মতো খুল্লামখুল্লা মুসলমানবিরোধী অবস্থান নিতে পারেনি দেশের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরুর দৃঢ় অবস্থানের জন্যে।

এই পরিবেশ কিন্তু পরবর্তী সময়ে বজায় থাকেনি। পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রী দের ভেতরে অটলবিহারী বাজপেয়ী আর সাম্প্রতিক সময়ের নরেন্দ্র মোদি ছাড়া আর কেউ প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তবে লালবাহাদুর শাস্ত্রী থেকে ড. মনমোহন সিং ... কেউ ই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থানের প্রশ্নে পন্ডিত নেহরুর মতো দৃঢ় চিত্তের মানুষ ছিলেন না। সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নেও পন্ডিত নেহরুর মতো যত্নবান এবং আন্তরিক প্রধানমন্ত্রী ভারত আর পায়নি।

লালাবাহাদুর শাস্ত্রীকে ঘিরে আপামর ভারতবাসীর গভীর শ্রদ্ধা আছে। অনেক ক্ষেত্রে পন্ডিত নেহরুকে যারা পছন্দ করেন না, তারা লালবাহাদুরকে ঘিরে একটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করেন। তাসখন্দে তার মৃত্যু ঘিরেও একটা রহস্যের আফরণ তৈরি করে থাকেন কেউ কেউ। সেই শাস্ত্রীজী ও চরম মুসলমান বিদ্বেষী এবং গান্ধী হত্যাকারী আর এস এস কে তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে প্রজাতন্ত্র দিবসের সময়ের দিল্লির যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।

১৯৬৪ সালে পবিত্র হজরতবাল দরগাশরীফে সংরক্ষিত হজরত মুহাম্মদ-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ঘিরে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পন্ডিত নেহরু। দাঙ্গার ব্যাপ্তির সময়কালে নেহরু ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৭ শে মে তার জীবনাবসান ঘটে। সেই দাঙ্গার ব্যাপ্তি আজকের বাংলাদেশে ভয়ঙ্করভাবে পড়েছিল। আইয়ুব খান তার সামরিক শাসনকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানে এই পবিত্র হজরতবালের ঘটনাকে নগ্নভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

সে সময়ে দাঙ্গার প্রভাব কলকাতাতেও যথেষ্ট পড়েছিল। এই দাঙ্গা মোকাবিলার প্রশ্নে, মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের দৃঢ় ভূমিকার যথেষ্ট অভাব ছিল। দেশব্যাপী এই দাঙ্গার হাত থেকে মুসলমানদের বাঁচানোর প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর ও শক্ত ভূমিকা দেখাতে পারেননি। ফলে পশ্চিমবঙ্গে সেদিন মুসলমানদের ওপর সংগঠিত অত্যাচার হয়েছিল। ’৪৬ এর দাঙ্গায় যেসব হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং ব্যক্তি সংগঠিত অত্যাচার চালিয়েছিল মুসলমানেদের ওপর, তারাই আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল স্বাধীন দেশের পুলিশের একটা বড় অংশের মুসলমানবিরোধী মানসিকতার জেরে এই সময়ে। এই পর্যায়ে হিন্দু মহাসভা এবং ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের যুগপৎ ঘনিষ্ঠ গোপাল মুখার্জী এবং পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অসামরিক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাম চট্টোপাধ্যায়ের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

পুলিশকে দাঙ্গার সময়ে জাতধর্ম না দেখে অসহায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যেতে কতখানি তৎপর হতে আমরা দেখি? ’৯২ সালে কলকাতায় যখন বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা হয়েছিল, তখন ও মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ নিজের থেকে কতখানি আন্তরিক ছিল আর সেই সময়ের প্রশাসনের চাপে কতখানি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখেছিল... সেই বিতর্ক থেকেই যায়। পরবর্তী সময়ে বা তার আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা আমাদের এই রাজ্যে প্রশাসনিক তৎপরতা ব্যতিরেকে পুলিশ কতখানি দাঙ্গার সময়েই হোক বা দাঙ্গার আগে পরেই হোক মুসলমানদের সম্পর্কে সঠিক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে ... এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

একুশ শতকের সূচনাপর্বে এই নিবন্ধকার কে একদিন যেতে হয়েছিল ভবানী ভবনে পুলিশের প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের তৎকালীন আইজির ঘরে। পুলিশ কর্তার টেবিলের কাচের নিচে হরেক রকমের দেবদেবীর ছবি। দেওয়ালেও তাই। বিষয়টি সেই পুলিশ কর্তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি নিজের ভক্তপ্রাণ মানসিকতার কথা জানালেন। প্রশ্ন করলাম; এখন যদি কোনো ধর্মের মানুষ সাম্প্রদায়িক কারণে অপর ধর্মের মানুষের কাছে আক্রান্ত হয়ে আপনার কাছে আসেন, তখন আপনার ঘরে একটি বিশেষ ধর্মের দেবদেবীদের ছবি ইত্যাদি দেখে আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন না? পুলিশ কর্তা সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। সেই পুলিশ কর্তা পরবর্তীতে কলকাতার নগরপাল ও হয়েছিলেন।

প্রত্যেকটা মানুষের ই ধর্ম মানার অধিকার আছে। না মানার ও অধিকার আছে। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সেই ধর্ম মানার ক্ষেত্রে সবসময়ে মনে রাখা দরকার যে, প্রশাসনের একটি অঙ্গ স্বরূপ তিনি ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কাজে দায়বদ্ধ। কোনো অবস্থাতেই সরকারি চেয়ারে বসে একজন আধাকারিক পারেন না একটি বিশেষ ধর্মের দেবদেবীকে নিজের সরকারি অফিসে প্রদর্শিত করতে। সেক্ষেত্রে অপরধর্মের মানুষ যদি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি কর্তার কাছে আসেন সুবিচার চাইতে, সেক্ষেত্রে সেই বিচারপ্রার্থীর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে সেদিকে একবার ও কি আমরা ভেবে দেখেছি?

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top