বাবুল রবিদাস
ভূমি মানব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণমতে ভূমি হতেই সবকিছুর উৎপত্তি। ভূমিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন্ রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত ও যুদ্ধ হয়। পরিবারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয় ও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভূমিকে কেন্দ্র করে খুন করা হয় এবং সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। জন্মভূমিকে ভালোবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। মানুষ কীভাবে ভূমির মালিকানা অর্জন করেছিল? জানা যায়- যিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষযোগ্য তৈরি করতেন, তিনিই জমির মালিক হতেন। খুবই প্রাচীন লেখক মনু তার সংহিতায় এরূপ কথা উল্লেখ করেছেন।
যিশুখ্রিস্টের আগমনের কয়েকশ’ বছর পূর্বে আর্য জাতির ভারতে আগমন ঘটে। আর্য জাতিরা ভারতে উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যভাগে বসবাসকারী শান্তিকামী দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে ওই এলাকায় বসতি স্থাপন করে। শান্তিপ্রিয় দ্রাবিড়রা পরাভূত হয়। কিছু দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীকে বন্দী করে ফেলে আর্যরা, তারাই অর্থাৎ পরাজিতরাই আজকে দলিত জাতি বলে খ্যাত। অপরদিকে বৃহত্তর দ্রাবিড় গহীন অরণ্যে এবং পাহাড়ি এলাকায় চলে যায়। এরাই মূলত আদিবাসী উপজাতি নামে পরিচিতি লাভ করে।
হিন্দু শাসন, বৌদ্ধ শাসন, পুনরায় হিন্দু শাসন এবং মুসলিম শাসনের ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতায় দেখা যায়। বিভিন্ন চড়াই উতরাইয়ের প্রেক্ষাপটে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে যুদ্ধে পরাজিত হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাজনা আদায়ে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন তৈরি করে। অপরদিকে আদিবাসী জনগণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ছিল এবং অত্যন্ত সহজ-সরল ছিল। আদিবাসীদের বলা হতো ভূমিপূত্র ও আলাভোলা। আদিবাসীরা বনে ও জঙ্গলে বসবাস করত আর জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে আবাদযোগ্য ভূমিতে রূপান্তর করে কৃষিকাজ করতো এবং বন-জঙ্গলের প্রাণী শিকার করতো, ফলমূল যোগাড় করতো, খড়ি জোগাড় করতো। এভাবেই সুখে-শান্তিতে বনে-জঙ্গলে বসবাস করতো আদিবাসী জনগণ। কিন্তু সেই সুখ-শান্তি আর তাদের ভাগ্যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ বন-জঙ্গলে বসবাসরত আদিবাসীরা ছিল নিরীহ, সহজ-সরল, নিরক্ষর, আইন-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ।
ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিশের বন্দোবস্তের সূচনা হয়। এ ব্যবস্থার ফলে কোম্পানির রাজস্ব স্থায়ীভাবে ধার্য হয় এবং নতুন জমি আবাদ করে কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে জমিদারদের অর্থ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে আবহমানকালের কৃষক, আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিক জনগণ ভূমির মালিকানা হারিয়ে ফেলেন। জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা জমির মালিক হন। মধ্যস্বত্বভোগী অভিজাত নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়।
জমিদাররা যেকোন প্রকারে প্রজাদের নিকট হতে খাজনা আদায় করে কোম্পানির পাওনা পরিশোধ করে দিতো। অন্যথায় জমিদারি বকেয়া রাজস্ব অনাদায়ে নিলামে অন্য কোন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করার ব্যবস্থা নেয়া হতো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সব কৃষকদের মতো আদিবাসী উপজাতি, দলিত, বঞ্চিত, অনগ্রসর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার ওপরও হুমকি তৈরি করে। তারা উচ্ছেদ হতে থাকে জমি, জল, জঙ্গল এবং জীবন-জীবিকা থেকে। এর ওপর জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় ও অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের ওপর ধার্য কর (রাজস্ব)। এ অত্যাচার ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ফুসে উঠতেই গড়ে তোলা হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ। এ প্রতিরোধের নাম হলো সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহ নাম হলেও এতে বহু কৃষক, দলিত, বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সেটাই ছিল ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ।’ সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনায় কোম্পানির শাসকদের মসনদ কেঁপে উঠেছিল। বিদ্রোহ দমনের নামে ইংরেজ সেনাদল আদিবাসী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। এ বিদ্রোহে প্রায় ১০ হাজার আদিবাসী যোদ্ধা বীরত্বের সাথে মৃত্যুবরণ করেছিল। এ যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মেজর জারভিস নামে এক ইংরেজ সেনাপতি বলেছিলেন- ‘একে যুদ্ধ বলে না, এ ছিল গণহত্যা।’
এরপর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০-৬১ সালে নীল বিদ্রোহ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে প্রথম ব্রিটিশ সরকার ‘বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট-১৮৮৫’ তৈরির উদ্যোগ নেয়। এই আইন তৈরি করার প্রাক্কালে ব্রিটিশরা আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এবং এক প্রকার অনুতপ্ত হয়ে বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট-১৮৮৫-এর বিধানের ৪৯ ধারা প্রণয়ন করেন। বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট-১৮৮৫-এর বিধানের ৪৯ ধারার বিধানমতে- আদিবাসী জনগণ অত্যন্ত সহজ-সরল, নিরীহ, অজ্ঞ, আলাভোলা মর্মে উল্লেখ করে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়। এ সুরক্ষা কবচের দ্বারা আদিবাসী জনগণের সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পারমিশান প্রয়োজন হতো। তাদের সম্পত্তি জোরপূর্বক কেউ জবরদখল ও ক্রয় করতে পারতো না।
জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণঅসন্তোষ ভীষণভাবে দেখা দেয়। চড়াই-উতরাই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সিস ফ্লাউড কমিশন জমিদারি প্রথা বিলোপের সুপারিশ করেন ১৯৩৮ সালে। অতঃপর প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি ১৯৪৪ সালে গঠন করলে উক্ত কমিটিও ফ্লাউড কমিশন রিপোর্টকে সমর্থন করে জমিদারি প্রথা বাতিলের সুপারিশ করে। এরপর ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপস্থাপনা করে দেশ পাকিস্তান ও ভারতে বিভক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০ পার্লামেন্টে পাস করে এবং জমিদারি প্রথা বাতিল করে।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয় বটে কিন্তু ‘রাষ্ট্রীয় (জমিদারি) অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০ আদিবাসীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ আইনের ৯৭ ধারায় আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার সুরক্ষা প্রদান করা হয়। ৯৭ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, আদিবাসী পিছিয়ে পড়া জাতির নিরক্ষর, সহজ-সরল, আলাভোলা, নিরীহ, অজ্ঞ হওয়ায় তারা যেন ভূমিহীন হয়ে না পড়ে তাদের ভূমি রক্ষার্থে ৯৭ ধারা প্রণয়ন করা হলো। আদিবাসীরা তাদের সম্পত্তি (ভূমি) বিক্রয় করতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া কোন দলিল প্রকাশ পেলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে।
এরপরও পূর্ব পাকিস্তান সরকার বহু আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে কেড়ে নিয়েছে এবং সমগ্র দেশের জনগণকে অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ যুুদ্ধে দলিত, বঞ্চিত, অনগ্রসর জাতি এবং আদিবাসী জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর এ দেশ স্বাধীন হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে বাংলাদেশ নামের একটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। বাংলাদেশে আদিবাসীদের কখনও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, কখনো উপজাতি হিসেবে কাগজপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ৩০ লাখ আদিবাসী জনগণ সংবিধানে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দাবি উপস্থাপন করলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন পর তথা সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন-২০১১ (২০১১ সালের ১৪নং আইন)-এর ১৪ ধারাবলে ২৩(ক) অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) ধারায় উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে এবং সংশোধনপূর্বক সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আদিবাসীরা বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ বিভিন্নভাবে জমি বা ভূমি হারিয়েছে।
আদিবাসী বা দলিত, বঞ্চিত, অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অসহায়, নিরীহ, নিরক্ষর এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলও বটে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সামান্যতেই খুশি হয় এবং আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ পরিলক্ষিত হয়। শক্তিশালী ও পেশিশক্তির অধিকারী চালাক-চতুর ও ধুরন্ধর লোকেরা ঝুপ বুঝে কোপ মারে। সবলেরা কোন সময়ই আইন-আদালতে প্রথমে আশ্রয় নেয় না। তারা অবৈধভাবে জবরদখল করে ফল ভোগ করে এবং অসহায় দুর্বলেরা আইন আদালতের আশ্রয় নিয়ে বছর বছর ঘুরে ঘুরে নিঃশেষ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের উক্তিটি হলো- ‘আইন হচ্ছে মাকড়াশার জাল, যে জালে শুধু মাছিরাই ধরা পড়ে, কিন্তু ভিমরুল ধরা পড়ে না।’
আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত, বঞ্চিত, দুর্বল-নিঃস্ব, অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগণের আশা দ্রুত এই ‘ল্যান্ড ক্রাইম অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে তাদের অর্থাৎ দুর্বলদের পাশে দাঁড়াবেন এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবেন।
[লেখক : সভাপতি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জয়পুরহাট জেলা শাখা]
বাবুল রবিদাস
বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
ভূমি মানব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণমতে ভূমি হতেই সবকিছুর উৎপত্তি। ভূমিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন্ রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত ও যুদ্ধ হয়। পরিবারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয় ও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভূমিকে কেন্দ্র করে খুন করা হয় এবং সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। জন্মভূমিকে ভালোবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। মানুষ কীভাবে ভূমির মালিকানা অর্জন করেছিল? জানা যায়- যিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষযোগ্য তৈরি করতেন, তিনিই জমির মালিক হতেন। খুবই প্রাচীন লেখক মনু তার সংহিতায় এরূপ কথা উল্লেখ করেছেন।
যিশুখ্রিস্টের আগমনের কয়েকশ’ বছর পূর্বে আর্য জাতির ভারতে আগমন ঘটে। আর্য জাতিরা ভারতে উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যভাগে বসবাসকারী শান্তিকামী দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে ওই এলাকায় বসতি স্থাপন করে। শান্তিপ্রিয় দ্রাবিড়রা পরাভূত হয়। কিছু দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীকে বন্দী করে ফেলে আর্যরা, তারাই অর্থাৎ পরাজিতরাই আজকে দলিত জাতি বলে খ্যাত। অপরদিকে বৃহত্তর দ্রাবিড় গহীন অরণ্যে এবং পাহাড়ি এলাকায় চলে যায়। এরাই মূলত আদিবাসী উপজাতি নামে পরিচিতি লাভ করে।
হিন্দু শাসন, বৌদ্ধ শাসন, পুনরায় হিন্দু শাসন এবং মুসলিম শাসনের ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতায় দেখা যায়। বিভিন্ন চড়াই উতরাইয়ের প্রেক্ষাপটে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে যুদ্ধে পরাজিত হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাজনা আদায়ে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন তৈরি করে। অপরদিকে আদিবাসী জনগণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ছিল এবং অত্যন্ত সহজ-সরল ছিল। আদিবাসীদের বলা হতো ভূমিপূত্র ও আলাভোলা। আদিবাসীরা বনে ও জঙ্গলে বসবাস করত আর জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে আবাদযোগ্য ভূমিতে রূপান্তর করে কৃষিকাজ করতো এবং বন-জঙ্গলের প্রাণী শিকার করতো, ফলমূল যোগাড় করতো, খড়ি জোগাড় করতো। এভাবেই সুখে-শান্তিতে বনে-জঙ্গলে বসবাস করতো আদিবাসী জনগণ। কিন্তু সেই সুখ-শান্তি আর তাদের ভাগ্যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ বন-জঙ্গলে বসবাসরত আদিবাসীরা ছিল নিরীহ, সহজ-সরল, নিরক্ষর, আইন-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ।
ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিশের বন্দোবস্তের সূচনা হয়। এ ব্যবস্থার ফলে কোম্পানির রাজস্ব স্থায়ীভাবে ধার্য হয় এবং নতুন জমি আবাদ করে কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে জমিদারদের অর্থ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে আবহমানকালের কৃষক, আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিক জনগণ ভূমির মালিকানা হারিয়ে ফেলেন। জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা জমির মালিক হন। মধ্যস্বত্বভোগী অভিজাত নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়।
জমিদাররা যেকোন প্রকারে প্রজাদের নিকট হতে খাজনা আদায় করে কোম্পানির পাওনা পরিশোধ করে দিতো। অন্যথায় জমিদারি বকেয়া রাজস্ব অনাদায়ে নিলামে অন্য কোন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করার ব্যবস্থা নেয়া হতো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সব কৃষকদের মতো আদিবাসী উপজাতি, দলিত, বঞ্চিত, অনগ্রসর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার ওপরও হুমকি তৈরি করে। তারা উচ্ছেদ হতে থাকে জমি, জল, জঙ্গল এবং জীবন-জীবিকা থেকে। এর ওপর জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় ও অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের ওপর ধার্য কর (রাজস্ব)। এ অত্যাচার ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ফুসে উঠতেই গড়ে তোলা হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ। এ প্রতিরোধের নাম হলো সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহ নাম হলেও এতে বহু কৃষক, দলিত, বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সেটাই ছিল ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ।’ সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনায় কোম্পানির শাসকদের মসনদ কেঁপে উঠেছিল। বিদ্রোহ দমনের নামে ইংরেজ সেনাদল আদিবাসী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। এ বিদ্রোহে প্রায় ১০ হাজার আদিবাসী যোদ্ধা বীরত্বের সাথে মৃত্যুবরণ করেছিল। এ যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মেজর জারভিস নামে এক ইংরেজ সেনাপতি বলেছিলেন- ‘একে যুদ্ধ বলে না, এ ছিল গণহত্যা।’
এরপর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০-৬১ সালে নীল বিদ্রোহ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে প্রথম ব্রিটিশ সরকার ‘বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট-১৮৮৫’ তৈরির উদ্যোগ নেয়। এই আইন তৈরি করার প্রাক্কালে ব্রিটিশরা আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগণের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এবং এক প্রকার অনুতপ্ত হয়ে বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট-১৮৮৫-এর বিধানের ৪৯ ধারা প্রণয়ন করেন। বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট-১৮৮৫-এর বিধানের ৪৯ ধারার বিধানমতে- আদিবাসী জনগণ অত্যন্ত সহজ-সরল, নিরীহ, অজ্ঞ, আলাভোলা মর্মে উল্লেখ করে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়। এ সুরক্ষা কবচের দ্বারা আদিবাসী জনগণের সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পারমিশান প্রয়োজন হতো। তাদের সম্পত্তি জোরপূর্বক কেউ জবরদখল ও ক্রয় করতে পারতো না।
জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণঅসন্তোষ ভীষণভাবে দেখা দেয়। চড়াই-উতরাই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সিস ফ্লাউড কমিশন জমিদারি প্রথা বিলোপের সুপারিশ করেন ১৯৩৮ সালে। অতঃপর প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি ১৯৪৪ সালে গঠন করলে উক্ত কমিটিও ফ্লাউড কমিশন রিপোর্টকে সমর্থন করে জমিদারি প্রথা বাতিলের সুপারিশ করে। এরপর ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপস্থাপনা করে দেশ পাকিস্তান ও ভারতে বিভক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০ পার্লামেন্টে পাস করে এবং জমিদারি প্রথা বাতিল করে।
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয় বটে কিন্তু ‘রাষ্ট্রীয় (জমিদারি) অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০ আদিবাসীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ আইনের ৯৭ ধারায় আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার সুরক্ষা প্রদান করা হয়। ৯৭ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, আদিবাসী পিছিয়ে পড়া জাতির নিরক্ষর, সহজ-সরল, আলাভোলা, নিরীহ, অজ্ঞ হওয়ায় তারা যেন ভূমিহীন হয়ে না পড়ে তাদের ভূমি রক্ষার্থে ৯৭ ধারা প্রণয়ন করা হলো। আদিবাসীরা তাদের সম্পত্তি (ভূমি) বিক্রয় করতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া কোন দলিল প্রকাশ পেলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে।
এরপরও পূর্ব পাকিস্তান সরকার বহু আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে কেড়ে নিয়েছে এবং সমগ্র দেশের জনগণকে অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ যুুদ্ধে দলিত, বঞ্চিত, অনগ্রসর জাতি এবং আদিবাসী জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর এ দেশ স্বাধীন হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে বাংলাদেশ নামের একটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। বাংলাদেশে আদিবাসীদের কখনও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, কখনো উপজাতি হিসেবে কাগজপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ৩০ লাখ আদিবাসী জনগণ সংবিধানে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দাবি উপস্থাপন করলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন পর তথা সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধনী) আইন-২০১১ (২০১১ সালের ১৪নং আইন)-এর ১৪ ধারাবলে ২৩(ক) অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) ধারায় উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে এবং সংশোধনপূর্বক সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আদিবাসীরা বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণ বিভিন্নভাবে জমি বা ভূমি হারিয়েছে।
আদিবাসী বা দলিত, বঞ্চিত, অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অসহায়, নিরীহ, নিরক্ষর এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলও বটে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সামান্যতেই খুশি হয় এবং আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ পরিলক্ষিত হয়। শক্তিশালী ও পেশিশক্তির অধিকারী চালাক-চতুর ও ধুরন্ধর লোকেরা ঝুপ বুঝে কোপ মারে। সবলেরা কোন সময়ই আইন-আদালতে প্রথমে আশ্রয় নেয় না। তারা অবৈধভাবে জবরদখল করে ফল ভোগ করে এবং অসহায় দুর্বলেরা আইন আদালতের আশ্রয় নিয়ে বছর বছর ঘুরে ঘুরে নিঃশেষ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের উক্তিটি হলো- ‘আইন হচ্ছে মাকড়াশার জাল, যে জালে শুধু মাছিরাই ধরা পড়ে, কিন্তু ভিমরুল ধরা পড়ে না।’
আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত, বঞ্চিত, দুর্বল-নিঃস্ব, অনগ্রসর, প্রান্তিক জনগণের আশা দ্রুত এই ‘ল্যান্ড ক্রাইম অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে তাদের অর্থাৎ দুর্বলদের পাশে দাঁড়াবেন এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবেন।
[লেখক : সভাপতি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জয়পুরহাট জেলা শাখা]