alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শূন্যতা ও জঙ্গিবাদ

সজীব ওয়াফি

: বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পৌঁছতে পৌঁছতে দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি কার্যক্রম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। কিছু দিন আগে জয়পুরহাটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এক বিচারককে ডাকযোগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে আদালতে সবাইকে তালেবানি পাগড়ি পরার। নতুবা আদালতে যেতে দেওয়া হবে না। হামলার শিকার হতে হবে। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হুমকি দিয়ে লালখামে চিঠি এসেছিলো, দিনদুপুরে শিক্ষক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আঘাত এসেছে বহু আগে থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারসহ দেশের নানা প্রান্তে ঘরে ঘরে জঙ্গি আদর্শের খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন দাঁড়ালো- একাত্তরে মুক্তির আকাক্সক্ষার বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কেন বাড়লো? সম্ভাবনাময় তরুণেরা যখন উগ্রবাদে অংশগ্রহণ করে, তখন তা উদ্বেগের-উৎকণ্ঠার; অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত বিশ্বে উত্তরণ করতে চাওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য।

গত শতাব্দীর শেষদিকে একটু ফেরা যাক- আমরা দেখতাম গ্রামাঞ্চলে যাত্রাপালা আসছে, কবিগান হচ্ছে, কখনো ওরস শরীফে পালাগানের আসর; মুর্শিদি-শরীয়তী-মারফতি গানের লড়াই, আবার কখনো আঞ্চলিক গানের মহড়া। ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী এমন কেউ নেই যে এসব পরিবেশনা উপভোগ করতে না যেত। বরঞ্চ দলে দলে সবাই অংশগ্রহণ করতো। হঠাৎ করেই সাংস্কৃতিক এই আয়োজনগুলো নাই হয়ে গেছে। কেউ গানবাজনা-সাংস্কৃতিক আয়োজন করার আগ্রহ দেখালে আসে আজানা চাপ। তার উপরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে অনুমতি মেলে না। নানান সীমাবদ্ধতা। কালের খেয়ায় সংস্কৃতির শূন্য জায়গাটা দখল করেছে ইসলামী জলসা, ধর্মীয় আলোচনা।

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বা গণতান্ত্রিক বিপর্যয় জঙ্গিবাদ উত্থানের সহায়ক। একটি দেশের মুক্তমত এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগার তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ কারণে বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের রূপ নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপরে। দেশে গণতন্ত্র আছে কি নাই অথবা মুক্তমত চর্চার দৌড় কতদূর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারার দিকে তাকালে এক নিমিষে বলে দেওয়া সম্ভব। সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে- ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত বিলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।’

অর্থাৎ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ অনুপস্থিত। ফ্লোর ক্রসিং করে বিপক্ষে সমর্থন দিলে অটোভাবে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার গলাকাটা খড়গ আইন। তাহলে গণবিরোধী সিদ্ধান্তে হাত-পা বাঁধা সংসদ সদস্য কী করতে পারবেন? অথচ জনগনের গণতান্ত্রিক রায়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সংসদে গিয়েছেন জনগণের স্বার্থে কথা বলার জন্য। এই হলো আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংবিধানে বাকস্বাধীনতার অবস্থা; যা ৩৯ অনুচ্ছেদের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। মোদ্দাকথা, গণতন্ত্র বা মুক্তমত সাংবিধানিকভাবেই খর্ব।

স্বায়ত্তশাসিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট হচ্ছে সিনেট। সিনেটে ছাত্রদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ছাত্র সংসদ থেকে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দুই আগে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হলেও কার্যকারিতা পরিণত হয়েছিল অথর্ব ডাকসুতে। এ পরিস্থিতিতে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ পাওয়া দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। ছাত্ররা তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে, গণতান্ত্রিক মতামত নিয়ে হাজির হলে, তাদের ওপর সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন এবং পুলিশি হামলা হয়েছে সব সরকারের আমলেই। একের পর এক নীতিমালা দিয়ে খর্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের করা হচ্ছে হয়রানি। অর্থাৎ আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতি ঘটিয়েছে সামাজিক বিপর্যয়।

২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা বাংলাদেশে জঙ্গি হামলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করা করার মাধ্যমে আক্রমণ হয় সেদিন। বাংলাদেশি জঙ্গি সংশ্লিষ্ট বিপর্যস্ত তরুণেরা এই জঙ্গি আক্রমণে অংশগ্রহণ করে, যার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামী স্টেট (আইএস) তাদের ওয়েবসাইটে। অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করে অনেকে উদ্ধার হয়; মারা যায় কয়েকজন সাধারণ নাগরিক। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বড় ধরনের সূচনা হয় বর্তমান শতাব্দীর প্রথমদিকে; ‘বাংলা ভাই’ নেতৃত্বাধীন জেএমবি (জামাত-উল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) নামক সংগঠনের হাত ধরে। প্রথমদিকে এরা প্রগতিশীল এবং বামঘরানার রাজনৈতিক কার্যক্রমে হানা দেয়। এরপর সবক্ষেত্রেই একের পর এক ঘটনা ঘটছেই। কখনো রাজনৈতিক সমাবেশে বোমা হামলা, কখনো সাংস্কৃতিক মঞ্চে বোমা হামা, কখনো দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের ওপর বিচ্ছিন্ন আক্রমণ, আবার কখনো তাদের আদর্শের বিস্তৃতি ঘটিয়ে।

কিছুসংখ্যক ধর্মালায়ে সাপ্তাহিক আলোচনায় এবং ধর্মীয় জলসার আয়োজন করে করা হয় জিহাদের প্ররোচনা। অনেক সময় বিতরণ করা হয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের লিফলেট। সমাবেশ করে বাল্যবিবাহ এবং জিহাদের প্ররোচনার দায়ে খোদ আগস্ট মাসেই কিশোরগঞ্জে গ্রেফতার হয়েছে ১৭ জন। আমাদের তরুণ প্রজন্ম, যাদের ইসলামী বা ধর্মীয় জ্ঞানের পরিধি কিছুটা অল্প, নিজেদের অজান্তেই তারা খপ্পরে পরে যায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের। সাংস্কৃতিক শূন্যতায় এবং পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাবে, মননের পরিবর্তন ঘটে ইতিমধ্যে আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সহিষ্ণুতা কমেছে। বেড়েছে উগ্র আক্রমণাত্মক হার। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় নারী বিদ্বেষ, ঠাট্টা-তামাশার দৃষ্টিভঙ্গি পৌঁছেছে চরমে। সংবাদমাধ্যম গুলোকে বাধ্য হয়েই অনেক সময়ে মন্তব্য সেকশন বন্ধ রাখতে হয়। পর্যায়ক্রমে অসহিষ্ণু আক্রমণাত্মক উগ্রবাদ থেকেই জঙ্গিবাদের নৈতিক উত্থান ঘটেছে, সমর্থক বেড়েছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখা গেল আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান ঘটায়। উৎফুল্ল হয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। সংস্কৃতিবান মানুষ কিন্তু এই বলয়ের ভেতরে নেই।

জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আস্তানায় বারবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে এসেছে। নারায়ণগঞ্জে জঙ্গিবাদের পথ থেকে সরিয়ে আনতে অভিযুক্তদের বাড়িতে হয়েছে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ব্যক্তিবর্গের উঠোন বৈঠক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অভিযান, মামলা, উঠোন বৈঠক বা সালিশিই কি জঙ্গি তৎপরতা দমনের স্থায়ী সমাধান? অধঃপতন ঠেকাতে এটাই যদি স্থায়ী সমাধান হয়, তাহলে জঙ্গি কার্যক্রম থামছে না কেন? আর যদি এটাই স্থায়ী সমাধান না হয়, তবে বারবার কেন একেই পথে হাঁটা হচ্ছে! ক্রসফায়ারে দিয়ে, অভিযান চালিয়ে, গ্রেফতার করে জঙ্গি তৎপরতা সাময়িক দমন করা গেলেও স্থায়ীভাবে অসম্ভব। কারণ জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পরা বিভ্রান্ত তরুণেরা মনে করে- তাদের উপর দমন যত বেশি হয় তারা ততই সঠিক পথে আছে। তাদের মনোবল আরো দ্বিগুণ চাঙ্গা হয়।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে শাহবাগে ঘটেছিলো ইতিহাসের সেরা গণজাগরণ। তারই বিপরীতে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে পাঠ্য বইয়ের মুসলমানিকরণ হয় ধীরে ধীরে। বাদ দেয়া হয় অনেক প্রয়োজনীয় অধ্যায়। যে গান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের মনের খোরাক, সেই গানের শিল্পীকে মামলা করে বন্দী করা হয় নেহাৎ একটা গানের জন্য। ব্যক্তিগত ফায়দা লুটতে, গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে উগ্রবাদীদের হামলা-অগ্নিসংযোগ অপ্রত্যাশিত। অতঃপর ভুক্তভোগী ঝুমন দাশদের দিনের পর দিন কারাগারে আটকে রাখা কেবল পরোক্ষ সমর্থন।

ইসলামী জলসা এবং আমাদের বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এ ভূখন্ডে পরস্পর পরিপূরক। কেউ কারো বিপরীত নয়। বিপরীত করে তোলা হয়েছে মাত্র। এর থেকে বের হতে এবং জঙ্গিবাদ রোধে প্রবল ভূমিকা রাখতে পারেন মসজিদের ইমাম। বিপথে না যেতে তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে পাঠাগারে বই পড়ায়। নতুন প্রজন্মকে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানানো ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে জঙ্গি যোগাযোগের দিকে। রক্তারক্তি করে বেহেশত অর্জিত হয় না এটা স্বয়ং পরিবারকে বোঝাতে হবে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক আয়োজন বা শুধুমাত্র ইসলামী জলসা নয়। সংস্কৃতির বিকাশে একসাথে দুই সাংস্কৃতিক ধারাই গলা ধরাধরি চলুক। ইসলামী জ্ঞানের সাথে সৃজনশীল পদ্ধতিতেই চলুক আমাদের পুরনো পাঠ্যধারা।

সাধারণ মানুষ মেরে, বোমাবাজি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে আর যাই হোক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না; ইসলামের বিজয় আসে না। ইসলামের বিজয় আসে দেশপ্রেমে, মানুষের মঙ্গলে। প্রচার করার সময় এসেছে ইসলামের সত্যিকারের মর্মবাণী। নতুবা এ ভূখন্ডেও তালেবানি প্রভাব পড়তে বাধ্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শক্তিশালী বিরোধী দল শূন্যতা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জঙ্গি তৎপরতা বন্ধের একমাত্র হাতিয়ার। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ওপরেই নির্ভরশীল আমাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ। সময়ের প্রয়োজনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে একান্ত প্রত্যাশা।

[লেখক : কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ভাসানী পরিষদ]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শূন্যতা ও জঙ্গিবাদ

সজীব ওয়াফি

বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পৌঁছতে পৌঁছতে দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি কার্যক্রম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। কিছু দিন আগে জয়পুরহাটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এক বিচারককে ডাকযোগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে আদালতে সবাইকে তালেবানি পাগড়ি পরার। নতুবা আদালতে যেতে দেওয়া হবে না। হামলার শিকার হতে হবে। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হুমকি দিয়ে লালখামে চিঠি এসেছিলো, দিনদুপুরে শিক্ষক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আঘাত এসেছে বহু আগে থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারসহ দেশের নানা প্রান্তে ঘরে ঘরে জঙ্গি আদর্শের খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্ন দাঁড়ালো- একাত্তরে মুক্তির আকাক্সক্ষার বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কেন বাড়লো? সম্ভাবনাময় তরুণেরা যখন উগ্রবাদে অংশগ্রহণ করে, তখন তা উদ্বেগের-উৎকণ্ঠার; অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত বিশ্বে উত্তরণ করতে চাওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য।

গত শতাব্দীর শেষদিকে একটু ফেরা যাক- আমরা দেখতাম গ্রামাঞ্চলে যাত্রাপালা আসছে, কবিগান হচ্ছে, কখনো ওরস শরীফে পালাগানের আসর; মুর্শিদি-শরীয়তী-মারফতি গানের লড়াই, আবার কখনো আঞ্চলিক গানের মহড়া। ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী এমন কেউ নেই যে এসব পরিবেশনা উপভোগ করতে না যেত। বরঞ্চ দলে দলে সবাই অংশগ্রহণ করতো। হঠাৎ করেই সাংস্কৃতিক এই আয়োজনগুলো নাই হয়ে গেছে। কেউ গানবাজনা-সাংস্কৃতিক আয়োজন করার আগ্রহ দেখালে আসে আজানা চাপ। তার উপরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে অনুমতি মেলে না। নানান সীমাবদ্ধতা। কালের খেয়ায় সংস্কৃতির শূন্য জায়গাটা দখল করেছে ইসলামী জলসা, ধর্মীয় আলোচনা।

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বা গণতান্ত্রিক বিপর্যয় জঙ্গিবাদ উত্থানের সহায়ক। একটি দেশের মুক্তমত এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগার তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ কারণে বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের রূপ নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপরে। দেশে গণতন্ত্র আছে কি নাই অথবা মুক্তমত চর্চার দৌড় কতদূর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারার দিকে তাকালে এক নিমিষে বলে দেওয়া সম্ভব। সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে- ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত বিলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।’

অর্থাৎ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ অনুপস্থিত। ফ্লোর ক্রসিং করে বিপক্ষে সমর্থন দিলে অটোভাবে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার গলাকাটা খড়গ আইন। তাহলে গণবিরোধী সিদ্ধান্তে হাত-পা বাঁধা সংসদ সদস্য কী করতে পারবেন? অথচ জনগনের গণতান্ত্রিক রায়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সংসদে গিয়েছেন জনগণের স্বার্থে কথা বলার জন্য। এই হলো আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংবিধানে বাকস্বাধীনতার অবস্থা; যা ৩৯ অনুচ্ছেদের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। মোদ্দাকথা, গণতন্ত্র বা মুক্তমত সাংবিধানিকভাবেই খর্ব।

স্বায়ত্তশাসিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট হচ্ছে সিনেট। সিনেটে ছাত্রদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ছাত্র সংসদ থেকে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দুই আগে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হলেও কার্যকারিতা পরিণত হয়েছিল অথর্ব ডাকসুতে। এ পরিস্থিতিতে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ পাওয়া দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। ছাত্ররা তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে, গণতান্ত্রিক মতামত নিয়ে হাজির হলে, তাদের ওপর সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন এবং পুলিশি হামলা হয়েছে সব সরকারের আমলেই। একের পর এক নীতিমালা দিয়ে খর্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের করা হচ্ছে হয়রানি। অর্থাৎ আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতি ঘটিয়েছে সামাজিক বিপর্যয়।

২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা বাংলাদেশে জঙ্গি হামলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করা করার মাধ্যমে আক্রমণ হয় সেদিন। বাংলাদেশি জঙ্গি সংশ্লিষ্ট বিপর্যস্ত তরুণেরা এই জঙ্গি আক্রমণে অংশগ্রহণ করে, যার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামী স্টেট (আইএস) তাদের ওয়েবসাইটে। অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করে অনেকে উদ্ধার হয়; মারা যায় কয়েকজন সাধারণ নাগরিক। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বড় ধরনের সূচনা হয় বর্তমান শতাব্দীর প্রথমদিকে; ‘বাংলা ভাই’ নেতৃত্বাধীন জেএমবি (জামাত-উল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) নামক সংগঠনের হাত ধরে। প্রথমদিকে এরা প্রগতিশীল এবং বামঘরানার রাজনৈতিক কার্যক্রমে হানা দেয়। এরপর সবক্ষেত্রেই একের পর এক ঘটনা ঘটছেই। কখনো রাজনৈতিক সমাবেশে বোমা হামলা, কখনো সাংস্কৃতিক মঞ্চে বোমা হামা, কখনো দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের ওপর বিচ্ছিন্ন আক্রমণ, আবার কখনো তাদের আদর্শের বিস্তৃতি ঘটিয়ে।

কিছুসংখ্যক ধর্মালায়ে সাপ্তাহিক আলোচনায় এবং ধর্মীয় জলসার আয়োজন করে করা হয় জিহাদের প্ররোচনা। অনেক সময় বিতরণ করা হয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের লিফলেট। সমাবেশ করে বাল্যবিবাহ এবং জিহাদের প্ররোচনার দায়ে খোদ আগস্ট মাসেই কিশোরগঞ্জে গ্রেফতার হয়েছে ১৭ জন। আমাদের তরুণ প্রজন্ম, যাদের ইসলামী বা ধর্মীয় জ্ঞানের পরিধি কিছুটা অল্প, নিজেদের অজান্তেই তারা খপ্পরে পরে যায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের। সাংস্কৃতিক শূন্যতায় এবং পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাবে, মননের পরিবর্তন ঘটে ইতিমধ্যে আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সহিষ্ণুতা কমেছে। বেড়েছে উগ্র আক্রমণাত্মক হার। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় নারী বিদ্বেষ, ঠাট্টা-তামাশার দৃষ্টিভঙ্গি পৌঁছেছে চরমে। সংবাদমাধ্যম গুলোকে বাধ্য হয়েই অনেক সময়ে মন্তব্য সেকশন বন্ধ রাখতে হয়। পর্যায়ক্রমে অসহিষ্ণু আক্রমণাত্মক উগ্রবাদ থেকেই জঙ্গিবাদের নৈতিক উত্থান ঘটেছে, সমর্থক বেড়েছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখা গেল আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান ঘটায়। উৎফুল্ল হয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। সংস্কৃতিবান মানুষ কিন্তু এই বলয়ের ভেতরে নেই।

জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আস্তানায় বারবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে এসেছে। নারায়ণগঞ্জে জঙ্গিবাদের পথ থেকে সরিয়ে আনতে অভিযুক্তদের বাড়িতে হয়েছে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং ব্যক্তিবর্গের উঠোন বৈঠক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অভিযান, মামলা, উঠোন বৈঠক বা সালিশিই কি জঙ্গি তৎপরতা দমনের স্থায়ী সমাধান? অধঃপতন ঠেকাতে এটাই যদি স্থায়ী সমাধান হয়, তাহলে জঙ্গি কার্যক্রম থামছে না কেন? আর যদি এটাই স্থায়ী সমাধান না হয়, তবে বারবার কেন একেই পথে হাঁটা হচ্ছে! ক্রসফায়ারে দিয়ে, অভিযান চালিয়ে, গ্রেফতার করে জঙ্গি তৎপরতা সাময়িক দমন করা গেলেও স্থায়ীভাবে অসম্ভব। কারণ জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পরা বিভ্রান্ত তরুণেরা মনে করে- তাদের উপর দমন যত বেশি হয় তারা ততই সঠিক পথে আছে। তাদের মনোবল আরো দ্বিগুণ চাঙ্গা হয়।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে শাহবাগে ঘটেছিলো ইতিহাসের সেরা গণজাগরণ। তারই বিপরীতে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে পাঠ্য বইয়ের মুসলমানিকরণ হয় ধীরে ধীরে। বাদ দেয়া হয় অনেক প্রয়োজনীয় অধ্যায়। যে গান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের মনের খোরাক, সেই গানের শিল্পীকে মামলা করে বন্দী করা হয় নেহাৎ একটা গানের জন্য। ব্যক্তিগত ফায়দা লুটতে, গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে উগ্রবাদীদের হামলা-অগ্নিসংযোগ অপ্রত্যাশিত। অতঃপর ভুক্তভোগী ঝুমন দাশদের দিনের পর দিন কারাগারে আটকে রাখা কেবল পরোক্ষ সমর্থন।

ইসলামী জলসা এবং আমাদের বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এ ভূখন্ডে পরস্পর পরিপূরক। কেউ কারো বিপরীত নয়। বিপরীত করে তোলা হয়েছে মাত্র। এর থেকে বের হতে এবং জঙ্গিবাদ রোধে প্রবল ভূমিকা রাখতে পারেন মসজিদের ইমাম। বিপথে না যেতে তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে পাঠাগারে বই পড়ায়। নতুন প্রজন্মকে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানানো ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে জঙ্গি যোগাযোগের দিকে। রক্তারক্তি করে বেহেশত অর্জিত হয় না এটা স্বয়ং পরিবারকে বোঝাতে হবে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক আয়োজন বা শুধুমাত্র ইসলামী জলসা নয়। সংস্কৃতির বিকাশে একসাথে দুই সাংস্কৃতিক ধারাই গলা ধরাধরি চলুক। ইসলামী জ্ঞানের সাথে সৃজনশীল পদ্ধতিতেই চলুক আমাদের পুরনো পাঠ্যধারা।

সাধারণ মানুষ মেরে, বোমাবাজি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে আর যাই হোক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না; ইসলামের বিজয় আসে না। ইসলামের বিজয় আসে দেশপ্রেমে, মানুষের মঙ্গলে। প্রচার করার সময় এসেছে ইসলামের সত্যিকারের মর্মবাণী। নতুবা এ ভূখন্ডেও তালেবানি প্রভাব পড়তে বাধ্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শক্তিশালী বিরোধী দল শূন্যতা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জঙ্গি তৎপরতা বন্ধের একমাত্র হাতিয়ার। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ওপরেই নির্ভরশীল আমাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ। সময়ের প্রয়োজনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে একান্ত প্রত্যাশা।

[লেখক : কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ভাসানী পরিষদ]

back to top