এমএ কবীর
ছোট থেকে মানুষ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এক দিন বড় হয়। বড় হয়ে কেউ মানুষ হয়, কেউ অমানুষ হয়। কেউ কেউ আবার জড় পদার্থও হয়। জড় পদার্থ মানে শরীরটা মানুষের মতো তবে মনটা মৃত মানুষের মতো।
৭ সেপ্টম্বর (২০২১ ইং)। ‘লন্ড্রিম্যান’ আবদুর রহমানকে নিয়ে একটি খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়। সেটি নানা কারণেই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। করোনার গ্রাস আবদুর রহমানকে অন্যভাবে ছুঁয়েছে। এই দুঃসময়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ। কাজ নেই হাতে। তাই তিনি নেমে পড়েছেন ভিন্ন পেশায়। ছোট্ট একটা দোকান করেছেন। যার নাম দিয়েছেন ‘লন্ড্রিম্যান’। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি দোকানটাকে দিয়েছে প্রাণ।
ঢাকার নিকটবর্তী দোহারের জয়পাড়া ভোকেশনাল রোড মোড়ের এই দোকান এখন হতাশ মানুষের অনুপ্রেরণার জানালা। হতে পারে পুরোনো প্রচলিত বাক্য- ‘কোন কাজই ছোট নয়’ এর সাক্ষাৎ উদাহরণ। মধুপ্রভাতি কিন্ডারগার্টেনের ধর্মীয় শিক্ষক কেন এমন কাজ করবেন, এ রকম প্রশ্ন যে একেবারেই ওঠেনি তা নয়। খোদ পরিবারের পক্ষ থেকেই ছিল আপত্তি। নিজের কাজের ইচ্ছাকে ভরাডুবি হতে দেননি আবদুর রহমান। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি লন্ড্রিম্যান। কত কারণেই না জীবনের গতিপথে পরিবর্তন আসে। কখনও তা নিয়ে যায় সাফল্যের শিখরে, কখনও তা ছুড়ে ফেলে দেয় নিঃস্বতার গহ্বরে। বড় ধরনের বিপর্যয় এলেই শুধু নতুন নতুন ঘটনা আর গল্পের জন্ম হতে থাকে। যার কিছু কিছু একেবারেই আনকোরা। পরিবর্তনগুলোরও থাকে নানা দিক। যে কোন দুর্দশার পর দেখা যায় কালোবাজারি, আসে স্বজনপ্রীতি। কোন কিছু কেনার সারিতে দাঁড়ায় মানুষ। অন্যদিকে এই পণ্যই কালোবাজারির মাধ্যমে পৌঁছে যায় অবস্থাপন্ন মানুষের হাতে। যে কোন যুদ্ধ শেষে এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয় মানুষ। বিশ্বসাহিত্যে এ ধরনের ঘটনার দেখা পাওয়া যাবে অনেক। তবে আবদুর রহমানের যুদ্ধটা করোনার সময়ে। করোনাও এলো যুদ্ধেরই মতো। এ এমন এক শত্রু, যার সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই চলে না। অগোচরে তা ঢুকে পড়ে শরীরে, সে যুদ্ধে জয়ী হতে গিয়ে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়। হাসপাতালকেই দিতে হয় জীবনের সব সঞ্চয়। তার পরও সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই সময়ে কত মানুষই তো চাকরি হারাল, কত মানুষ বেছে নিল সস্তা দরের কাজ। কেউ কেউ লজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাততে না পেরে হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমা থেকে। গোটা বিশ্বই ভুগল এই অনিশ্চয়তায়।
লন্ড্রিম্যানকে নিয়ে কিছু আপ্তবাক্য আওড়ানো যেত, কিন্তু সেই পথ না মাড়ানোর একটাই কারণ, মানুষটার এই পরিশ্রম, তার কর্মযোগী মনোভাবের শক্তিকে বাহবা দিলে তা তার টুপিতে সাফল্যের পালক যোগ করবে না। নিজের স্থবির সময়টাকে কাজের মাধ্যমে অদম্য করে তোলার এই যে চেষ্টা, সেটা কারও স্বীকৃতির অপেক্ষা করে না। সেটা এমনিতেই স্বয়ংপ্রকাশ। সেই আনন্দটাই জানালাম।
স্কুল, কিন্ডারগার্টেন খুলে যাচ্ছে। আবার ক্লাসরুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন আবদুর রহমান। তাহলে কি জীবনের এই অমূল্য প্রাপ্তিকে বিদায় করবেন তিনি? না, করবেন না। কিন্ডারগার্টেনের কাজ সেরে এখানে এসেই বসবেন তিনি। কাজ করবেন। আরও কিছু ব্যবসার মালামালও রাখছেন দোকানে। বাঁচার এই যে আনন্দটা পাচ্ছেন তিনি, সেটাই কম কিসের?
লেখক মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্পটি মাত্র ছয়টি শব্দে লেখা। গল্পটি এমন :
“For sale. Baby shoes. Never worn.”
গল্পটির বাংলা অনুবাদ : “বিক্রির জন্য। শিশুর জুতা। ব্যবহৃত নয়।” গল্পটির ভেতর একটা অজানা রহস্য লুকিয়ে ছিল। ছোট গল্পটির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো গল্পটি নিয়ে যে যার মতো করে ভাবতে পারে। তার মানে ছোট গল্প মানুষের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি তৈরি করতে পারে। ভাবা যায়, গল্পটা ছোট হলেও তার মধ্যে চিন্তাচর্চার জায়গাটা অসম্ভব একটা পাওয়ার হাউসের মতো। খুব সাধারণভাবে গল্পটার ভাবার্থ হলো, ‘বাচ্চার জন্য জুতা কেনা হয়েছিল, কিন্তু সেই বাচ্চাটা পৃথিবীর আলোই দেখেনি।’ ছয় শব্দের এই গল্পে গর্ভে মারা যাওয়া শিশুর জন্য মায়ের গভীর বেদনা আর ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অযত্নে পড়ে থাকা ছোট একটা গল্প খুব কম সময়ে একটা মানুষের মধ্যে যে বোধের সৃষ্টি করেছে, একটা বড় মহাকাব্য বা উপন্যাসও তা হয়তো পারবে না। এখানে ছোটর হার না মানা হারের না বলা শব্দের মেরুদন্ডটা খাড়া করে দাঁড়ানো। কারণ নীরবতা একটা এমন শক্তি, যা অনেক ছোটকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে এক দিন বড় করে তোলে।
৪ সেপ্টেম্বর (২০২১ ইং) এলজিইডি ভবনে আলোচনা সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের ধর্মে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ঘুষ খেলে নামাজ হবে না, হারাম খেলে নামাজ হবে না। শুধু তা-ই নয়, হারাম টাকায় কেনা কোন পোশাক যদি অন্য পোশাক স্পর্শ করে, তবে নাপাক হয়ে যাবে। প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়ান। সারা দিন কী কাজ করলেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন।’
তিনি বলেছেন, ‘সরকার আমাদের বেতন অনেক বাড়িয়েছে। তার পরও কেউ চুরি করে ধরা পড়লে সরাসরি অ্যাকশন নেয়া হবে।’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটি ফেলনা নয়।
মাছ পানি খাবে, কর্মকর্তা ঘুষ খাবে, গরু ঘাস-বিচালি খাবে, ছাগল পাতা খাবে, মাতাল মদ খাবে এতে বাধা দেয়ার কী আছে? যার যেটা ভালো লাগে, যে যা খেয়ে অভ্যস্ত, যা খেয়ে আরেকজন উপকার পায়, সে সেটা খাবেই। বাধা দিলেই বরং বিপত্তি। তিনি বলেছেন, ‘হারাম খেলে নামাজ হয় না।’ কিন্তু ‘হারাম’ না খেলে যাদের ঘুম হয় না, ফুটানি হয় না, পরিবারের সদস্যদের আরাম-আয়েশ, বিলাস-ব্যসন হয় না, ছটফটানি বাড়ে, তাদের কষ্টটাও বুঝতে হবে।
যারা ঘুষ খান, তারা জেনে-বুঝে, নিয়ম মেনেই খান। সাক্ষী-প্রমাণ রেখে ঘুষ খান নবিশরা। যিনি যত পাকা, তিনি ততই কুশলী। তারা নিয়মিত ঘুষ খাচ্ছেন, অথচ ব্যাংকে কোন টাকা পাবেন না। যেখানে যতটুকু নীতি-নৈতিকতার কথা বলা দরকার, তা ঝেড়ে দিচ্ছেন। এমন নিখুঁত ‘অভিনেতা’দের সামলাবেন, কীভাবে সামলাবেন? যত বড় কর্মকর্তা, তার জন্য পারসেন্টেজ তত বেশি। এমনভাবে প্রকল্প তৈরি করা হয়, সেটা এমনভাবে অনুমোদন হয়, এমন কায়দায় বাস্তবায়িত হয়, কোন একজন ঝানু গোয়েন্দার পক্ষেও সেটাতে কোন অনিয়ম খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। অথচ শিকড় থেকে ডালপালা পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতির উপাদান নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে।
শচীন টেন্ডুলকার আর ব্রায়ান লারা ছোটখাটো দু’জন মানুষ। কিন্তু ক্রিকেটকে তারা দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন। পেলে আর মারাদোনাও ছোটখাটো দু’টো মানুষ। তারা ফুটবলকে শিল্পের রূপ দিয়ে মানুষের গতানুগতিক ভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। বি আর আম্বেদকর ছোট ঘরে জন্মেছিলেন বলে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বারান্দায় বসে লেখাপড়া করেছেন। মানুষ তাকে এক দিন ছোট করে দেখেছে, অবহেলা করেছে। তিনি সেই ছোটত্বের উদারতা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ভারতের সংবিধানপ্রণেতা হয়ে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন।
অবাক করার মতো বিষয় হলো এক দিনের বঞ্চিত এই মানুষটি ২০১২ সালে হিস্ট্রি টিভি ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা ‘শ্রেষ্ঠ ভারতীয়’ নির্বাচিত হয়েছেন। এ পি জে আবদুল কালাম ছোট এক জেলে পরিবারে জন্মেছিলেন। অনেক অনেক টাকা তাদের ছিল না, দারিদ্র্যও ছিল। না পাওয়ার কষ্ট ছিল। সেই চোখের অগোচরে পড়ে থাকা ছোট পেশার বাবার সন্তানটি ভারতের পারমাণবিক শক্তির জনক হয়েছেন। সব ছোটর ছোটকে অতিক্রম করে তিনি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একাদশ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাই তিনিই বলতে পারেন, তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তখন নেহেরুর মন্ত্রিসভার রেলমন্ত্রী। ছোটখাটো গড়নের হালকা-পাতলা মানুষ। পরপর দুটো রেল দুর্ঘটনার পর, দুর্ঘটনার সব দায় মাথায় নিয়ে তিনি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেকে ভেবেছে, তারার পতনের মতো তার পতন হয়েছে। অনেকে তাকে ছোট চোখে দেখতে লাগলেন। কিন্তু তার এই দায়বদ্ধতা সাধারণ মানুষের কাছে তাকে বড় বানিয়ে দিল। তিনি একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন। মানুষ ছোট হয় না। ছোট হয় মানুষের চারপাশের মানুষ। এর ফলে যারা অন্যদের ছোট ভেবে অপমান করে, অবাঞ্ছিত করে তারাই এক দিন বড় হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বিচারটা আসলে এমনই। যেখানে সময় এসে মানুষকে ধরা দেয়।
আমাদের জীবনে এমন অনেক ছোট ছোট ঘটনা আছে, যা দিয়ে আমরা ইতিহাস গড়তে পারি। ছোট ছোট মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে আমরা মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন গড়তে পারি। ছোট ছোট উপাদান দিয়ে নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতে পারি। ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, কষ্ট, আবেগ, যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে জীবনবোধকে খুঁজে পেতে পারি। ছোট ছোট জয় আর ছোট ছোট পরাজয় দিয়ে মনকে আরও বড় করে গড়ে তুলতে পারি। ছোট ছোট ত্যাগ দিয়ে বড় ত্যাগের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারি।
ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার রিচার্ড ব্র্যানসন ও আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস যখন কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে মহাশূন্যে বেড়াতে যান, তখন কি আমাদের কর্মকর্তারা আটার রুটি আর আলুভাজি চিবোতে চিবোতে সেই খবর পত্রিকায় পড়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারেন? তাদেরও কি ইচ্ছে করে না কোটিপতি হওয়ার? মহাশূন্যে না হোক, ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে বেড়ানোর? সীমিত আয়, সীমাবদ্ধ জীবন কি কারও আরাধ্য হতে পারে? ঘুষ-দুর্নীতির অনেক উপকারিতাও আছে। উপকারিতা আছে বলেই সমাজে বীরবিক্রমে টিকে আছে। ভয় দেখিয়ে, কমিশন গঠন করে, আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে ঘুষ কমানো যাবে না। দুর্নীতি নিয়ে মানুষের উৎসাহ অসীম। কে খেলো, কত খেলো, কীভাবে খেলো এসব জানতে মানুষের মন আঁকুপাঁকু করে। ঘুষ-দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে মানুষ রসিয়ে রসিয়ে পড়ে। অনেকে গোপনে দীর্ঘশ্বাসও ফেলে। ইশ, এমন একটা সুযোগ আমি কেন পেলাম না! প্রকল্পের কেনাকাটায় দুর্নীতির খবর যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, মানুষের মধ্যে তখন বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই যেমন রূপপুরের বালিশ কেনা, মেডিকেল কলেজের বই কেনা, পর্দা কেনা, সরঞ্জাম কেনা। এসব নিয়ে অনেকে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। কারণ যে পেরেছে আর যে পারেনি, দুইয়ের একটা দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ থাকবেই!
ঘুষকে আমরা ‘খাদ্য’ বানিয়েছি। মানুষ এখন আমিষ-নিরামিষ, পানীয়র পাশাপাশি ঘুষও ‘খায়’। জীবজন্তুও এখন ঘুষ খেতে শিখেছে। চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে যতই ভেংচি কাটেন, বানর কিছুতেই সাড়া দেবে না। ও ঠিক ‘লিভ মি এলোন’ ভাব নিয়ে বসে থাকবে। একটা কলা ছুড়ে দেন। এবার দেখুন তার বাঁদরামো। বাড়ির টিউবওয়েলের কথাই ধরুন, সকাল থেকে চাপাচাপি করছেন, পানি বের হচ্ছে না। একটু পানি ঢালুন। দেখবেন জোয়ারের মতো পানি বেরিয়ে আসছে। কেউ একে বলেন উপহার, কেউ বলেন ডোনেশন, আবার কেউ বলেন পারসেন্টেজ।
বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারের জন্য যমুনা নদীর তীরে ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অধিকৃত জায়গার একটি বড় অংশই দখলে নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তার ব্যবসায়ের অংশীদার, অভিযোগটা এমনই। নাটকটির প্রথম অঙ্ক লেখা হয়েছে এবং ক্লাইমেক্স এখনও অনেক দূর। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। বেশ কয়েকটি নদীর প্রবাহ সচল হবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে। এই তালিকায় আছে নতুন ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশাই, তুরাগ হয়ে বুড়িগঙ্গা। নাট্যকার এই সময় পর্যন্ত ঠিকভাবেই এগোতে পেরেছেন। আমাদের নদীগুলোর যে দুর্দশা, তাতে সত্যিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে অনেক দুর্গতিই পোহাতে হবে। আসলেই নদীকে ঠিকভাবে চলতে না দিয়ে, নদীর সঙ্গে বহু ধরনের দুর্ব্যবহার করে আমরা এরই মধ্যে বহু দুর্গতির শিকার হয়েছি। জীবন-নাটক এখন কোন পথে এগোবে সেটাই প্রশ্ন। নাটকটি কমিক হতে পারে, যদি প্রকল্প থেকে এই তথাকথিত ‘বৈধ’ ব্যবসায়ীদের বিতাড়ন করা যায় এবং নদীগুলোর প্রবাহ সচল হয়। নাটকটি ট্র্যাজিক হতে পারে, যদি কিছুসংখ্যক লোভী ব্যবসায়ীর কারণে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে, আর নদী ও নদীর অববাহিকার মানুষ অকারণ কষ্ট ভোগ করতে বাধ্য হয়। নাটকটি কীভাবে শেষ হবে, তা জানা নেই আমাদের।
মাছ পানি খাবে, কর্মকর্তা ঘুষ খাবে, গরু ঘাস-বিচালি খাবে, ছাগল পাতা খাবে, মাতাল মদ খাবে এতে বাধা দেয়ার কী আছে?
ও হেনরির জীবনটা কেমন ছিল, সেটা হয়তো তার গল্পের বইগুলোর ভূমিকায় পাওয়া যাবে। ছোটগল্প লিখে যারা নাম করেছেন বিশ্বজুড়ে, তাদের মধ্যে মার্কিন এই লেখকের নাম অবধারিতভাবেই আসবে। রুশ ভাষায় আন্তন চেখভ, বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ফরাসি ভাষায় মোপাসাঁর কথাও ছোটগল্পের জন্য চিরন্তন হয়ে আছে। ও হেনরি কিন্তু ভদ্রলোকের নাম নয়। কেউই বলতে পারে না, কীভাবে তার নামটা ও হেনরি হলো। তবে একটা কথা জীবনীকারদের রচনায় ভেসে বেড়ায়। সেটাই আমাদের জানা থাক।
ও হেনরির আসল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। ছেলেবেলায় হারিয়েছেন মাকে, কিছুকালের মধ্যেই মদ্যপ বাবা পৃথিবীকে বিদায় জানান। এ অবস্থায় নিজেকেই নিজের খাবারের জোগাড় করতে হয়েছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে একটা ওষুধের ফার্মেসিতে কাজে লেগে যান। আরও বহুদিন পর জেলখানার ফার্মেসিতে কাজ করার সময় তিনি নিজের পদবি বদলে নেন ফরাসি চিন্তক, লেখক ও অঁরির পদবিতে। ইংরেজিতে অঁরি হয়ে যায় হেনরি। তাই তিনি হলেন ও হেনরি।
জীবনটা খুব আনন্দে কাটেনি লেখকের। নিজের জীবন আর আশপাশের অভিজ্ঞতা থেকেই লেখার মালমসলা জোগাড় করতেন। চেষ্টা করতেন, সব গল্পই যেন শেষ হয় ইতিবাচক রেশে।
ও হেনরির ‘গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ গল্পটি স্কুলেই পড়েছেন অনেকে। আত্মত্যাগের এ রকম গল্প লেখাই হয়েছে কম। এ গল্পটির অনুপ্রেরণা এসেছিল একটি করুণ ঘটনা থেকে। মারা যাচ্ছিলেন ও হেনরির স্ত্রী অ্যাটল। অ্যাটলের কাছে ছুটে গেছেন তিনি। তিনি পৌঁছানোর পরও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন স্ত্রী। সে সময় অ্যাটল তাকে জীবনের শেষ উপহারটি দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ঘড়ির জন্য একটি সোনার চেইন। মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটা জানত না, গ্রামের বাড়ি যাওয়ার টিকিট কেনার জন্য ঘড়িটা বেচে দিয়েছেন ও হেনরি। ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন এই লেখক। বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৭ বছর।
[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা
রিপোর্টার্স ইউনিটি]
এমএ কবীর
শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
ছোট থেকে মানুষ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এক দিন বড় হয়। বড় হয়ে কেউ মানুষ হয়, কেউ অমানুষ হয়। কেউ কেউ আবার জড় পদার্থও হয়। জড় পদার্থ মানে শরীরটা মানুষের মতো তবে মনটা মৃত মানুষের মতো।
৭ সেপ্টম্বর (২০২১ ইং)। ‘লন্ড্রিম্যান’ আবদুর রহমানকে নিয়ে একটি খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়। সেটি নানা কারণেই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। করোনার গ্রাস আবদুর রহমানকে অন্যভাবে ছুঁয়েছে। এই দুঃসময়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ। কাজ নেই হাতে। তাই তিনি নেমে পড়েছেন ভিন্ন পেশায়। ছোট্ট একটা দোকান করেছেন। যার নাম দিয়েছেন ‘লন্ড্রিম্যান’। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি দোকানটাকে দিয়েছে প্রাণ।
ঢাকার নিকটবর্তী দোহারের জয়পাড়া ভোকেশনাল রোড মোড়ের এই দোকান এখন হতাশ মানুষের অনুপ্রেরণার জানালা। হতে পারে পুরোনো প্রচলিত বাক্য- ‘কোন কাজই ছোট নয়’ এর সাক্ষাৎ উদাহরণ। মধুপ্রভাতি কিন্ডারগার্টেনের ধর্মীয় শিক্ষক কেন এমন কাজ করবেন, এ রকম প্রশ্ন যে একেবারেই ওঠেনি তা নয়। খোদ পরিবারের পক্ষ থেকেই ছিল আপত্তি। নিজের কাজের ইচ্ছাকে ভরাডুবি হতে দেননি আবদুর রহমান। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি লন্ড্রিম্যান। কত কারণেই না জীবনের গতিপথে পরিবর্তন আসে। কখনও তা নিয়ে যায় সাফল্যের শিখরে, কখনও তা ছুড়ে ফেলে দেয় নিঃস্বতার গহ্বরে। বড় ধরনের বিপর্যয় এলেই শুধু নতুন নতুন ঘটনা আর গল্পের জন্ম হতে থাকে। যার কিছু কিছু একেবারেই আনকোরা। পরিবর্তনগুলোরও থাকে নানা দিক। যে কোন দুর্দশার পর দেখা যায় কালোবাজারি, আসে স্বজনপ্রীতি। কোন কিছু কেনার সারিতে দাঁড়ায় মানুষ। অন্যদিকে এই পণ্যই কালোবাজারির মাধ্যমে পৌঁছে যায় অবস্থাপন্ন মানুষের হাতে। যে কোন যুদ্ধ শেষে এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয় মানুষ। বিশ্বসাহিত্যে এ ধরনের ঘটনার দেখা পাওয়া যাবে অনেক। তবে আবদুর রহমানের যুদ্ধটা করোনার সময়ে। করোনাও এলো যুদ্ধেরই মতো। এ এমন এক শত্রু, যার সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই চলে না। অগোচরে তা ঢুকে পড়ে শরীরে, সে যুদ্ধে জয়ী হতে গিয়ে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়। হাসপাতালকেই দিতে হয় জীবনের সব সঞ্চয়। তার পরও সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই সময়ে কত মানুষই তো চাকরি হারাল, কত মানুষ বেছে নিল সস্তা দরের কাজ। কেউ কেউ লজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাততে না পেরে হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমা থেকে। গোটা বিশ্বই ভুগল এই অনিশ্চয়তায়।
লন্ড্রিম্যানকে নিয়ে কিছু আপ্তবাক্য আওড়ানো যেত, কিন্তু সেই পথ না মাড়ানোর একটাই কারণ, মানুষটার এই পরিশ্রম, তার কর্মযোগী মনোভাবের শক্তিকে বাহবা দিলে তা তার টুপিতে সাফল্যের পালক যোগ করবে না। নিজের স্থবির সময়টাকে কাজের মাধ্যমে অদম্য করে তোলার এই যে চেষ্টা, সেটা কারও স্বীকৃতির অপেক্ষা করে না। সেটা এমনিতেই স্বয়ংপ্রকাশ। সেই আনন্দটাই জানালাম।
স্কুল, কিন্ডারগার্টেন খুলে যাচ্ছে। আবার ক্লাসরুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন আবদুর রহমান। তাহলে কি জীবনের এই অমূল্য প্রাপ্তিকে বিদায় করবেন তিনি? না, করবেন না। কিন্ডারগার্টেনের কাজ সেরে এখানে এসেই বসবেন তিনি। কাজ করবেন। আরও কিছু ব্যবসার মালামালও রাখছেন দোকানে। বাঁচার এই যে আনন্দটা পাচ্ছেন তিনি, সেটাই কম কিসের?
লেখক মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্পটি মাত্র ছয়টি শব্দে লেখা। গল্পটি এমন :
“For sale. Baby shoes. Never worn.”
গল্পটির বাংলা অনুবাদ : “বিক্রির জন্য। শিশুর জুতা। ব্যবহৃত নয়।” গল্পটির ভেতর একটা অজানা রহস্য লুকিয়ে ছিল। ছোট গল্পটির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো গল্পটি নিয়ে যে যার মতো করে ভাবতে পারে। তার মানে ছোট গল্প মানুষের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি তৈরি করতে পারে। ভাবা যায়, গল্পটা ছোট হলেও তার মধ্যে চিন্তাচর্চার জায়গাটা অসম্ভব একটা পাওয়ার হাউসের মতো। খুব সাধারণভাবে গল্পটার ভাবার্থ হলো, ‘বাচ্চার জন্য জুতা কেনা হয়েছিল, কিন্তু সেই বাচ্চাটা পৃথিবীর আলোই দেখেনি।’ ছয় শব্দের এই গল্পে গর্ভে মারা যাওয়া শিশুর জন্য মায়ের গভীর বেদনা আর ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অযত্নে পড়ে থাকা ছোট একটা গল্প খুব কম সময়ে একটা মানুষের মধ্যে যে বোধের সৃষ্টি করেছে, একটা বড় মহাকাব্য বা উপন্যাসও তা হয়তো পারবে না। এখানে ছোটর হার না মানা হারের না বলা শব্দের মেরুদন্ডটা খাড়া করে দাঁড়ানো। কারণ নীরবতা একটা এমন শক্তি, যা অনেক ছোটকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে এক দিন বড় করে তোলে।
৪ সেপ্টেম্বর (২০২১ ইং) এলজিইডি ভবনে আলোচনা সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের ধর্মে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ঘুষ খেলে নামাজ হবে না, হারাম খেলে নামাজ হবে না। শুধু তা-ই নয়, হারাম টাকায় কেনা কোন পোশাক যদি অন্য পোশাক স্পর্শ করে, তবে নাপাক হয়ে যাবে। প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়ান। সারা দিন কী কাজ করলেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন।’
তিনি বলেছেন, ‘সরকার আমাদের বেতন অনেক বাড়িয়েছে। তার পরও কেউ চুরি করে ধরা পড়লে সরাসরি অ্যাকশন নেয়া হবে।’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটি ফেলনা নয়।
মাছ পানি খাবে, কর্মকর্তা ঘুষ খাবে, গরু ঘাস-বিচালি খাবে, ছাগল পাতা খাবে, মাতাল মদ খাবে এতে বাধা দেয়ার কী আছে? যার যেটা ভালো লাগে, যে যা খেয়ে অভ্যস্ত, যা খেয়ে আরেকজন উপকার পায়, সে সেটা খাবেই। বাধা দিলেই বরং বিপত্তি। তিনি বলেছেন, ‘হারাম খেলে নামাজ হয় না।’ কিন্তু ‘হারাম’ না খেলে যাদের ঘুম হয় না, ফুটানি হয় না, পরিবারের সদস্যদের আরাম-আয়েশ, বিলাস-ব্যসন হয় না, ছটফটানি বাড়ে, তাদের কষ্টটাও বুঝতে হবে।
যারা ঘুষ খান, তারা জেনে-বুঝে, নিয়ম মেনেই খান। সাক্ষী-প্রমাণ রেখে ঘুষ খান নবিশরা। যিনি যত পাকা, তিনি ততই কুশলী। তারা নিয়মিত ঘুষ খাচ্ছেন, অথচ ব্যাংকে কোন টাকা পাবেন না। যেখানে যতটুকু নীতি-নৈতিকতার কথা বলা দরকার, তা ঝেড়ে দিচ্ছেন। এমন নিখুঁত ‘অভিনেতা’দের সামলাবেন, কীভাবে সামলাবেন? যত বড় কর্মকর্তা, তার জন্য পারসেন্টেজ তত বেশি। এমনভাবে প্রকল্প তৈরি করা হয়, সেটা এমনভাবে অনুমোদন হয়, এমন কায়দায় বাস্তবায়িত হয়, কোন একজন ঝানু গোয়েন্দার পক্ষেও সেটাতে কোন অনিয়ম খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। অথচ শিকড় থেকে ডালপালা পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতির উপাদান নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে।
শচীন টেন্ডুলকার আর ব্রায়ান লারা ছোটখাটো দু’জন মানুষ। কিন্তু ক্রিকেটকে তারা দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন। পেলে আর মারাদোনাও ছোটখাটো দু’টো মানুষ। তারা ফুটবলকে শিল্পের রূপ দিয়ে মানুষের গতানুগতিক ভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। বি আর আম্বেদকর ছোট ঘরে জন্মেছিলেন বলে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বারান্দায় বসে লেখাপড়া করেছেন। মানুষ তাকে এক দিন ছোট করে দেখেছে, অবহেলা করেছে। তিনি সেই ছোটত্বের উদারতা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ভারতের সংবিধানপ্রণেতা হয়ে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন।
অবাক করার মতো বিষয় হলো এক দিনের বঞ্চিত এই মানুষটি ২০১২ সালে হিস্ট্রি টিভি ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা ‘শ্রেষ্ঠ ভারতীয়’ নির্বাচিত হয়েছেন। এ পি জে আবদুল কালাম ছোট এক জেলে পরিবারে জন্মেছিলেন। অনেক অনেক টাকা তাদের ছিল না, দারিদ্র্যও ছিল। না পাওয়ার কষ্ট ছিল। সেই চোখের অগোচরে পড়ে থাকা ছোট পেশার বাবার সন্তানটি ভারতের পারমাণবিক শক্তির জনক হয়েছেন। সব ছোটর ছোটকে অতিক্রম করে তিনি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একাদশ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাই তিনিই বলতে পারেন, তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তখন নেহেরুর মন্ত্রিসভার রেলমন্ত্রী। ছোটখাটো গড়নের হালকা-পাতলা মানুষ। পরপর দুটো রেল দুর্ঘটনার পর, দুর্ঘটনার সব দায় মাথায় নিয়ে তিনি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেকে ভেবেছে, তারার পতনের মতো তার পতন হয়েছে। অনেকে তাকে ছোট চোখে দেখতে লাগলেন। কিন্তু তার এই দায়বদ্ধতা সাধারণ মানুষের কাছে তাকে বড় বানিয়ে দিল। তিনি একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন। মানুষ ছোট হয় না। ছোট হয় মানুষের চারপাশের মানুষ। এর ফলে যারা অন্যদের ছোট ভেবে অপমান করে, অবাঞ্ছিত করে তারাই এক দিন বড় হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বিচারটা আসলে এমনই। যেখানে সময় এসে মানুষকে ধরা দেয়।
আমাদের জীবনে এমন অনেক ছোট ছোট ঘটনা আছে, যা দিয়ে আমরা ইতিহাস গড়তে পারি। ছোট ছোট মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে আমরা মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন গড়তে পারি। ছোট ছোট উপাদান দিয়ে নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতে পারি। ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, কষ্ট, আবেগ, যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে জীবনবোধকে খুঁজে পেতে পারি। ছোট ছোট জয় আর ছোট ছোট পরাজয় দিয়ে মনকে আরও বড় করে গড়ে তুলতে পারি। ছোট ছোট ত্যাগ দিয়ে বড় ত্যাগের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারি।
ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার রিচার্ড ব্র্যানসন ও আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস যখন কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে মহাশূন্যে বেড়াতে যান, তখন কি আমাদের কর্মকর্তারা আটার রুটি আর আলুভাজি চিবোতে চিবোতে সেই খবর পত্রিকায় পড়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারেন? তাদেরও কি ইচ্ছে করে না কোটিপতি হওয়ার? মহাশূন্যে না হোক, ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে বেড়ানোর? সীমিত আয়, সীমাবদ্ধ জীবন কি কারও আরাধ্য হতে পারে? ঘুষ-দুর্নীতির অনেক উপকারিতাও আছে। উপকারিতা আছে বলেই সমাজে বীরবিক্রমে টিকে আছে। ভয় দেখিয়ে, কমিশন গঠন করে, আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে ঘুষ কমানো যাবে না। দুর্নীতি নিয়ে মানুষের উৎসাহ অসীম। কে খেলো, কত খেলো, কীভাবে খেলো এসব জানতে মানুষের মন আঁকুপাঁকু করে। ঘুষ-দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে মানুষ রসিয়ে রসিয়ে পড়ে। অনেকে গোপনে দীর্ঘশ্বাসও ফেলে। ইশ, এমন একটা সুযোগ আমি কেন পেলাম না! প্রকল্পের কেনাকাটায় দুর্নীতির খবর যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, মানুষের মধ্যে তখন বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই যেমন রূপপুরের বালিশ কেনা, মেডিকেল কলেজের বই কেনা, পর্দা কেনা, সরঞ্জাম কেনা। এসব নিয়ে অনেকে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। কারণ যে পেরেছে আর যে পারেনি, দুইয়ের একটা দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ থাকবেই!
ঘুষকে আমরা ‘খাদ্য’ বানিয়েছি। মানুষ এখন আমিষ-নিরামিষ, পানীয়র পাশাপাশি ঘুষও ‘খায়’। জীবজন্তুও এখন ঘুষ খেতে শিখেছে। চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে যতই ভেংচি কাটেন, বানর কিছুতেই সাড়া দেবে না। ও ঠিক ‘লিভ মি এলোন’ ভাব নিয়ে বসে থাকবে। একটা কলা ছুড়ে দেন। এবার দেখুন তার বাঁদরামো। বাড়ির টিউবওয়েলের কথাই ধরুন, সকাল থেকে চাপাচাপি করছেন, পানি বের হচ্ছে না। একটু পানি ঢালুন। দেখবেন জোয়ারের মতো পানি বেরিয়ে আসছে। কেউ একে বলেন উপহার, কেউ বলেন ডোনেশন, আবার কেউ বলেন পারসেন্টেজ।
বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারের জন্য যমুনা নদীর তীরে ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অধিকৃত জায়গার একটি বড় অংশই দখলে নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তার ব্যবসায়ের অংশীদার, অভিযোগটা এমনই। নাটকটির প্রথম অঙ্ক লেখা হয়েছে এবং ক্লাইমেক্স এখনও অনেক দূর। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। বেশ কয়েকটি নদীর প্রবাহ সচল হবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে। এই তালিকায় আছে নতুন ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশাই, তুরাগ হয়ে বুড়িগঙ্গা। নাট্যকার এই সময় পর্যন্ত ঠিকভাবেই এগোতে পেরেছেন। আমাদের নদীগুলোর যে দুর্দশা, তাতে সত্যিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে অনেক দুর্গতিই পোহাতে হবে। আসলেই নদীকে ঠিকভাবে চলতে না দিয়ে, নদীর সঙ্গে বহু ধরনের দুর্ব্যবহার করে আমরা এরই মধ্যে বহু দুর্গতির শিকার হয়েছি। জীবন-নাটক এখন কোন পথে এগোবে সেটাই প্রশ্ন। নাটকটি কমিক হতে পারে, যদি প্রকল্প থেকে এই তথাকথিত ‘বৈধ’ ব্যবসায়ীদের বিতাড়ন করা যায় এবং নদীগুলোর প্রবাহ সচল হয়। নাটকটি ট্র্যাজিক হতে পারে, যদি কিছুসংখ্যক লোভী ব্যবসায়ীর কারণে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে, আর নদী ও নদীর অববাহিকার মানুষ অকারণ কষ্ট ভোগ করতে বাধ্য হয়। নাটকটি কীভাবে শেষ হবে, তা জানা নেই আমাদের।
মাছ পানি খাবে, কর্মকর্তা ঘুষ খাবে, গরু ঘাস-বিচালি খাবে, ছাগল পাতা খাবে, মাতাল মদ খাবে এতে বাধা দেয়ার কী আছে?
ও হেনরির জীবনটা কেমন ছিল, সেটা হয়তো তার গল্পের বইগুলোর ভূমিকায় পাওয়া যাবে। ছোটগল্প লিখে যারা নাম করেছেন বিশ্বজুড়ে, তাদের মধ্যে মার্কিন এই লেখকের নাম অবধারিতভাবেই আসবে। রুশ ভাষায় আন্তন চেখভ, বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ফরাসি ভাষায় মোপাসাঁর কথাও ছোটগল্পের জন্য চিরন্তন হয়ে আছে। ও হেনরি কিন্তু ভদ্রলোকের নাম নয়। কেউই বলতে পারে না, কীভাবে তার নামটা ও হেনরি হলো। তবে একটা কথা জীবনীকারদের রচনায় ভেসে বেড়ায়। সেটাই আমাদের জানা থাক।
ও হেনরির আসল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। ছেলেবেলায় হারিয়েছেন মাকে, কিছুকালের মধ্যেই মদ্যপ বাবা পৃথিবীকে বিদায় জানান। এ অবস্থায় নিজেকেই নিজের খাবারের জোগাড় করতে হয়েছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে একটা ওষুধের ফার্মেসিতে কাজে লেগে যান। আরও বহুদিন পর জেলখানার ফার্মেসিতে কাজ করার সময় তিনি নিজের পদবি বদলে নেন ফরাসি চিন্তক, লেখক ও অঁরির পদবিতে। ইংরেজিতে অঁরি হয়ে যায় হেনরি। তাই তিনি হলেন ও হেনরি।
জীবনটা খুব আনন্দে কাটেনি লেখকের। নিজের জীবন আর আশপাশের অভিজ্ঞতা থেকেই লেখার মালমসলা জোগাড় করতেন। চেষ্টা করতেন, সব গল্পই যেন শেষ হয় ইতিবাচক রেশে।
ও হেনরির ‘গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ গল্পটি স্কুলেই পড়েছেন অনেকে। আত্মত্যাগের এ রকম গল্প লেখাই হয়েছে কম। এ গল্পটির অনুপ্রেরণা এসেছিল একটি করুণ ঘটনা থেকে। মারা যাচ্ছিলেন ও হেনরির স্ত্রী অ্যাটল। অ্যাটলের কাছে ছুটে গেছেন তিনি। তিনি পৌঁছানোর পরও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন স্ত্রী। সে সময় অ্যাটল তাকে জীবনের শেষ উপহারটি দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ঘড়ির জন্য একটি সোনার চেইন। মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটা জানত না, গ্রামের বাড়ি যাওয়ার টিকিট কেনার জন্য ঘড়িটা বেচে দিয়েছেন ও হেনরি। ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন এই লেখক। বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৭ বছর।
[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা
রিপোর্টার্স ইউনিটি]