alt

উপ-সম্পাদকীয়

মুজিব বাহিনী ও মুজিববাদ

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১

নানা কারণে মুক্তিবাহিনীর শুরুতেই মুজিব বাহিনীর সুপরিকল্পিত প্রশিক্ষণ শুরু হতে পারেনি। এটা সবারই জানা যে মুজিব নগর সরকারের সবার মাঝে ঐক্যমত গড়তে অনেক সময় লেগেছে। অনেকে জানিয়েছেন যে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও বিরোধ ছিল মুজিব বাহিনীর। তবে সিরাজুল আলম খান সেভাবে বিষয়টি দেখেননি। অন্যদিকে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও অধিনায়কদের সঙ্গে তো বিরোধ ছিলই। সামগ্রিকভাবে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার বেশ পরে মুজিব বাহিনীর আলাদা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই সময়ে মুজিব বাহিনীতে যোগ দেবেন এমন ইচ্ছা পোষণকারী অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। দেশের সব অঞ্চলকে চারটি ভাগে ভাগ করে চারজন নেতার নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এটিও প্রণিধানযোগ্য যে দীর্ঘদিনের বিএলএফ প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পর থেকে মুজিববাহিনী নাম ধারণ করে। সবাই ধারণা করেন যে এর ফলে মুজিব বাহিনীর গ্রহণ যোগ্যতা মৃদ্ধি পায়। মুজিব বাহিনী যাতে আরও গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য মুজিববাহিনী মুজিববাদকে তাদের মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করে। যদিও স্বাধীনতার পর মুজিববাহিনী দুটি ধারায় বিভক্ত হয় এবং একটি ধারা জাসদ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করে। তারা মুজিববাদের বদলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র মতবাদ প্রচার করতে থাকে। অন্য ধারাটি কিন্তু মুজিববাদকেই তাদের নীতি ও আদর্শ হিসেবে ধারণ করে। এখন সেই মুজিববাদ নিয়ে কেউ কথা না বললেও স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে মুজিববাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠন বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বস্তুত মুজিববাদই।

এই সম্পর্কে উইকিপিডিয়ার বিবরণ এ রকম:

“মুজিববাদ হলো বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের চর্চিত ও প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন বা মূল্যবোধের সমষ্টি। রাজনৈতিক দর্শনের মূল চারনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেন, “আগে সেøøাগান ছিল ৬ দফা, এখন ৪টি স্তম্ভ।”

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে মুজিববাদের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। উপনিবেশিক আমলে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীর মতে, “মুজিবের রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। আমার উপরোক্ত মতকে অনেকে বলছেন মুজিববাদ। এদেশের লেখক, সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কী নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মোহ নাই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ণ। আমি চাই শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমি চাই আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।”

জাতীয়তাবাদ : রাষ্ট্র ভাষাকরণের দাবিতে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মৃতিকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। বস্তুত এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশের সব অধিবাসীর পরিচয় বাঙালি ও বাংলাদেশি। তিনি ভেদাভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্তম্ভ মনে করতেন। বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা দানই ছিল মুজিববাদের মূল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন এবং পরিভাষার জন্য অপেক্ষা না করে তা তখনই শুরু করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষার অপেক্ষা করব না, কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না।”

তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে। কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে। ১৯৫২ সালে চীনের শান্তি সম্মেলনে ও ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিককরণে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”

সমাজতন্ত্র : মুজিববাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ সমাজতন্ত্র। তার মতে, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। কুষ্টিয়ায় একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘সম্পত্তি এখন সাড়ে সাত কোটি লোকের, যা উৎপাদন হবে সাড়ে সাত কোটি লোক ভোগ করবে। এদেশে শোষণহীন সমাজ হবে।” ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে তিনি বলেন, “গরিব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না।”

তার মতে, “বিদেশ থেকে হাওলাত কইরা আইনা সমাজতন্ত্র হয় না; ওটা যারা করতে গেছেন কেউ সমাজতন্ত্রে পৌঁছতে পারেন নাই।” তিনি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জন এর একটি ধারণা পোষণ করেন।

গণতন্ত্র : শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণকে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েই জনগণের মতামতের ওপর আমরা বিশ্বাস করি। তিনি শোষিতের গণতন্ত্র কথাটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে। তিনি আরও বলেন, “শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হলো জনগণ।”

সরকারি কর্মচারী ও আমলাদের জনগণের সেবক হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “শুধু সামরিক বাহিনীতে দেশ রক্ষা হয় না। দেশ রক্ষা হয় জনগণকে দিয়ে।”

গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেন, “দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করব।”

সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে, দেখা যায়- পুঁজিবাদকে প্রোটেকশন দেয়ার জন্য গণতন্ত্র কাজ করে, এবং যেখানে প্রয়োজন হয়- শোষকদের রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র। সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো আমাদের গণতন্ত্রে যে বিধিবিধান আছে সে সমস্ত প্রোভিশন করা হয়েছে, তাতে এদেশের দুঃখী মানুষ যাতে প্রোটেকশন পায় তারই বন্দোবস্ত আছে; ঐ শোষক প্রতিষ্ঠিত হয় তার ব্যবস্থা নাই।”

ধর্মনিরপেক্ষতা : মুজিববাদের চতুর্থ আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। তার মতে, “বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে; আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম, মুসলমানেরা মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে।”

তিনি আরো বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে, শুধু আমার আপত্তি এইখানে যে পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে যেন একে আর গান্ধা না করা হয় ভবিষ্যতে”

প্রভাব : ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।

বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে মুজিববাদ : মুজিববাদ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে যে মতবাদ বাংলাদেশে প্রচলিত সেটাই মুজিববাদ। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সম্মিলন ঘটেছে মুজিববাদে। মুজিববাদের ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতান্ত্রিক পন্থা এবং শাসন প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের ওপরে জোর দিয়েছিলেন। জাতির পিতা আমৃত্যু মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে সোনার বাংলা বিনির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন।

মুজিববাদ সমন্ধে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। মুজিববাদ সমন্ধে বঙ্গবন্ধুর পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে। খন্দকার ইলিয়াসের ‘মুজিববাদ’ বই থেকে জানা যায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন এই মতবাদ সম্পর্কে।

প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু, আমরা দীর্ঘকাল আপনার রাজনৈতিক জীবনের সংস্পর্শে থেকে লক্ষ্য করে এসেছি যে, বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহাসিক ধারার বিকাশ ও বাঙালি জাতির চেতনার স্তর বিবেচনায় রেখে আপনি এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দিয়ে আসছেন, নিজস্ব একটি মতবাদ ব্যক্ত করে আসছেন। এখন আমার প্রশ্ন আপনি জিন্নাবাদ, গান্ধীবাদ, নাসেরবাদ, ইহুদিবাদ, মাওবাদ, টিটোবাদ, লেনিনবাদ ও মার্কসবাদের আলোকে আপনার মতবাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে কি ভাবছেন?

উত্তর : দেখুন, ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সব মেহনতী মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সব মেহনতী মানুষ। এ দেশে জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে ফড়িয়া-ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের। শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কি? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই।

সামগ্রিকভাবে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার বেশ পরে মুজিব বাহিনীর আলাদা প্রশিক্ষণ শুরু হয়

আমার কোন কোন সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন শ্রেণী সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি যার যার ধর্ম তার তার-এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।

আমার উপরোক্ত মতবাদকে অনেকে বলছে ‘মুজিববাদ’। এ দেশের লেখক, সাহিত্যিক কিংবা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কি নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মোহ নেই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ন। আমি চাই শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমি চাই আমার স্বপ্ন ‘সোনার বাঙলা’ নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯। আপডেট : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মুজিব বাহিনী ও মুজিববাদ

মোস্তাফা জব্বার

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১

নানা কারণে মুক্তিবাহিনীর শুরুতেই মুজিব বাহিনীর সুপরিকল্পিত প্রশিক্ষণ শুরু হতে পারেনি। এটা সবারই জানা যে মুজিব নগর সরকারের সবার মাঝে ঐক্যমত গড়তে অনেক সময় লেগেছে। অনেকে জানিয়েছেন যে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও বিরোধ ছিল মুজিব বাহিনীর। তবে সিরাজুল আলম খান সেভাবে বিষয়টি দেখেননি। অন্যদিকে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও অধিনায়কদের সঙ্গে তো বিরোধ ছিলই। সামগ্রিকভাবে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার বেশ পরে মুজিব বাহিনীর আলাদা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই সময়ে মুজিব বাহিনীতে যোগ দেবেন এমন ইচ্ছা পোষণকারী অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। দেশের সব অঞ্চলকে চারটি ভাগে ভাগ করে চারজন নেতার নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এটিও প্রণিধানযোগ্য যে দীর্ঘদিনের বিএলএফ প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পর থেকে মুজিববাহিনী নাম ধারণ করে। সবাই ধারণা করেন যে এর ফলে মুজিব বাহিনীর গ্রহণ যোগ্যতা মৃদ্ধি পায়। মুজিব বাহিনী যাতে আরও গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য মুজিববাহিনী মুজিববাদকে তাদের মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করে। যদিও স্বাধীনতার পর মুজিববাহিনী দুটি ধারায় বিভক্ত হয় এবং একটি ধারা জাসদ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করে। তারা মুজিববাদের বদলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র মতবাদ প্রচার করতে থাকে। অন্য ধারাটি কিন্তু মুজিববাদকেই তাদের নীতি ও আদর্শ হিসেবে ধারণ করে। এখন সেই মুজিববাদ নিয়ে কেউ কথা না বললেও স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে মুজিববাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠন বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বস্তুত মুজিববাদই।

এই সম্পর্কে উইকিপিডিয়ার বিবরণ এ রকম:

“মুজিববাদ হলো বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের চর্চিত ও প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন বা মূল্যবোধের সমষ্টি। রাজনৈতিক দর্শনের মূল চারনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেন, “আগে সেøøাগান ছিল ৬ দফা, এখন ৪টি স্তম্ভ।”

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে মুজিববাদের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। উপনিবেশিক আমলে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীর মতে, “মুজিবের রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। আমার উপরোক্ত মতকে অনেকে বলছেন মুজিববাদ। এদেশের লেখক, সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কী নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মোহ নাই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ণ। আমি চাই শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমি চাই আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।”

জাতীয়তাবাদ : রাষ্ট্র ভাষাকরণের দাবিতে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মৃতিকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। বস্তুত এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশের সব অধিবাসীর পরিচয় বাঙালি ও বাংলাদেশি। তিনি ভেদাভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্তম্ভ মনে করতেন। বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা দানই ছিল মুজিববাদের মূল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন এবং পরিভাষার জন্য অপেক্ষা না করে তা তখনই শুরু করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষার অপেক্ষা করব না, কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না।”

তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে। কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে। ১৯৫২ সালে চীনের শান্তি সম্মেলনে ও ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিককরণে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”

সমাজতন্ত্র : মুজিববাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ সমাজতন্ত্র। তার মতে, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। কুষ্টিয়ায় একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘সম্পত্তি এখন সাড়ে সাত কোটি লোকের, যা উৎপাদন হবে সাড়ে সাত কোটি লোক ভোগ করবে। এদেশে শোষণহীন সমাজ হবে।” ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে তিনি বলেন, “গরিব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না।”

তার মতে, “বিদেশ থেকে হাওলাত কইরা আইনা সমাজতন্ত্র হয় না; ওটা যারা করতে গেছেন কেউ সমাজতন্ত্রে পৌঁছতে পারেন নাই।” তিনি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জন এর একটি ধারণা পোষণ করেন।

গণতন্ত্র : শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণকে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েই জনগণের মতামতের ওপর আমরা বিশ্বাস করি। তিনি শোষিতের গণতন্ত্র কথাটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে। তিনি আরও বলেন, “শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হলো জনগণ।”

সরকারি কর্মচারী ও আমলাদের জনগণের সেবক হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “শুধু সামরিক বাহিনীতে দেশ রক্ষা হয় না। দেশ রক্ষা হয় জনগণকে দিয়ে।”

গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেন, “দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করব।”

সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে, দেখা যায়- পুঁজিবাদকে প্রোটেকশন দেয়ার জন্য গণতন্ত্র কাজ করে, এবং যেখানে প্রয়োজন হয়- শোষকদের রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র। সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো আমাদের গণতন্ত্রে যে বিধিবিধান আছে সে সমস্ত প্রোভিশন করা হয়েছে, তাতে এদেশের দুঃখী মানুষ যাতে প্রোটেকশন পায় তারই বন্দোবস্ত আছে; ঐ শোষক প্রতিষ্ঠিত হয় তার ব্যবস্থা নাই।”

ধর্মনিরপেক্ষতা : মুজিববাদের চতুর্থ আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। তার মতে, “বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে; আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম, মুসলমানেরা মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে।”

তিনি আরো বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার প্রত্যেকটা মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে, শুধু আমার আপত্তি এইখানে যে পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে যেন একে আর গান্ধা না করা হয় ভবিষ্যতে”

প্রভাব : ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।

বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে মুজিববাদ : মুজিববাদ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে যে মতবাদ বাংলাদেশে প্রচলিত সেটাই মুজিববাদ। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সম্মিলন ঘটেছে মুজিববাদে। মুজিববাদের ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতান্ত্রিক পন্থা এবং শাসন প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের ওপরে জোর দিয়েছিলেন। জাতির পিতা আমৃত্যু মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে সোনার বাংলা বিনির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন।

মুজিববাদ সমন্ধে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। মুজিববাদ সমন্ধে বঙ্গবন্ধুর পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে। খন্দকার ইলিয়াসের ‘মুজিববাদ’ বই থেকে জানা যায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন এই মতবাদ সম্পর্কে।

প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু, আমরা দীর্ঘকাল আপনার রাজনৈতিক জীবনের সংস্পর্শে থেকে লক্ষ্য করে এসেছি যে, বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহাসিক ধারার বিকাশ ও বাঙালি জাতির চেতনার স্তর বিবেচনায় রেখে আপনি এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দিয়ে আসছেন, নিজস্ব একটি মতবাদ ব্যক্ত করে আসছেন। এখন আমার প্রশ্ন আপনি জিন্নাবাদ, গান্ধীবাদ, নাসেরবাদ, ইহুদিবাদ, মাওবাদ, টিটোবাদ, লেনিনবাদ ও মার্কসবাদের আলোকে আপনার মতবাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে কি ভাবছেন?

উত্তর : দেখুন, ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সব মেহনতী মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সব মেহনতী মানুষ। এ দেশে জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে ফড়িয়া-ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের। শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কি? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই।

সামগ্রিকভাবে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর লড়াই শুরু হওয়ার বেশ পরে মুজিব বাহিনীর আলাদা প্রশিক্ষণ শুরু হয়

আমার কোন কোন সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন শ্রেণী সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি যার যার ধর্ম তার তার-এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।

আমার উপরোক্ত মতবাদকে অনেকে বলছে ‘মুজিববাদ’। এ দেশের লেখক, সাহিত্যিক কিংবা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কি নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মোহ নেই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ন। আমি চাই শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমি চাই আমার স্বপ্ন ‘সোনার বাঙলা’ নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯। আপডেট : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]

back to top