alt

উপ-সম্পাদকীয়

সমাপনী পরীক্ষা এবার থেকেই বাদ নয় কেন

আব্দুল মান্নান খান

: বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

বেশকিছু বছর ধরে সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কী থাকবে না এ নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা ছিল। এবার পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা না থাকার যে কথা কর্তৃপক্ষ থেকে উঠেছে তা আশা করা যায় কার্যকর হবে। আগেও দু’একবার পিইসি থাকছে না বলে আমরা শুনেছি ঊর্ধ্বতন মহলের বক্তব্য থেকে। কিন্তু হয়নি। হতে হতেও হয়নি বলা যায়। না হওয়ার অনেক যুক্তি দেখানো হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম প্রধান যুক্তি হলো যতদিন প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা না যাচ্ছে ততদিন পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা চলবে। আরেকটা প্রধান কারণ বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান সহজ হয়েছে। এ রকম নানা কার বিষয়টা যেমন ছিল তেমন রয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা গেলে অনেক দিক থেকে শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশেও এটা রয়েছে। সেক্ষেত্রেও কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলে থেমে যাওয়া হয়েছে যেমন এর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ঠিক করতে হবে অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষ সেভাবে বাড়াতে হবে। পদ সৃষ্টি করতে হবে, শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, তাদের ট্রেনিং দিতে হবে, কারিকুলাম ঠিক করতে হবে আরও কত কি। এখন কথা হলো সমাপনী পরীক্ষা উঠে যেতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে শুনে ভয় তো একটু থেকেই যাচ্ছে কারণ আবার না আগের মতো অবস্থা হয়। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’ আমরাও পাচ্ছি তাই বলতে চাচ্ছি এবার থেকেই পরীক্ষাটা বন্ধ হয়ে যাক।

বদলে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম বলে দৈনিক সংবাদে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ যে বার্তা এসেছে তা বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে শিক্ষা ক্ষেত্রে হবে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। যেমন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না এটা বাস্তবায়িত হলে শিশুদের মনমানসিকতাসহ চেহারা পাল্টে যাবে। তৃতীয় শ্রেণীর শিশুদের কী পরিমাণ লেখাপড়া করতে হয়-তা একটু ভেতরে না ঢুকলে কেউ ধারণা করতে পারবেন না। হেন কিছু নেই যা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ান হয় না। ছয়টা বিষয়ের (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয এবং প্রাথমিক বিজ্ঞান) যে কোন একটা বিষয়ের কারিকুলাম এবং তার প্রশ্নপত্র দেখলে মনে হবে, এ বিষয়ে জীবনে যেন আর কিছু পড়ার প্রয়োজন হবে না ওদের। তৃতীয় শ্রেণীতেই সব পড়িয়ে শেষ করতে হবে।

আমাদের শিশুরা মাতৃভাষার পঠনদক্ষতায় ভীষণরকম পিছিয়ে আছে। মাতৃভাষায় মোটামুটি চলন সই পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে ওদের যেতে হচ্ছে নবম দশম শ্রেণী পর্যন্ত। দেশি-বিদেশি সুধী বিশেষজ্ঞজনরা বলেন, মাতৃভাষায় পঠনদক্ষতা মানবসম্পদ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে পড়তে না পারলে শিক্ষার ভিত শক্ত হয় না। এর অভাব শিশুর ভবিষ্যৎ কর্মদক্ষতার ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের শিশুরা শুরু থেকেই শুধু পরীক্ষা, উঠতে বসতে প্রস্তুতি পরীক্ষা শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা দিয়ে প্রবল শিশুমেধার শক্তিতে এক ধরনের মনে রেখে তারা ক্লাস পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে কাজেই সাবলীলভাবে পঠনদক্ষতা কীভাবে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বছর দুই আগে বলেছিলেন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে না গেলে এতদিনে হয়তো বিষয়টির বাস্তবায়ন দেখা যেত। এবার সামনে কি হয় দেখা যাক। আমরা আশা করব এর শতভাগ বাস্তবায়ন হবে।

দ্বিতীয়ত, নবম-দশমের বিভাগ বিভাজন থাকবে না। প্রায় ৬০ বছর ধরে চলে আসছে যে পদ্ধতি তা উঠে যাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে প্রধানত শিক্ষক মহোদয়দের মূল্যায়নের ভিত্তিতে এবং শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোন বিভাগে পড়বে ঠিক হয়ে তাকে। এখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মতামতেরও প্রয়োজন হয়। প্রথমে এর দুটো বিভাজন ছিল বিজ্ঞান ও মানবিক। পরে বাণিজ্যসহ আরও হয়তো বেড়েছে। যারা লেখাপড়া ভালো করে মেধাবী তারাই সাধারণত যায় বিজ্ঞান বিভাগে। দীর্ঘসময়ে এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি যেটা ঘটা দরকার ছিল। সব ক্ষেত্রেই মেধার প্রয়োজন রয়েছে। এখন এর পরিবর্তন সামনে আসছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। তবে শিক্ষার্থীদের ভালো লাগার বিষয়টা যেন তারা সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে হলেও সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বলা হয়েছে, এবারের ও আগামী বছরের সমাপনী পরীক্ষাও অনিশ্চিত। অনিশ্চিত তো হতেই পারে। ভুলে গেলে চলবে কেমন করে যে, এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে সারেনি ঠিক মতো। কী ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেল প্রায় দুটো বছর। সমাপনী পরীক্ষা তো ছোটখাটো কোন ব্যাপার না, দেশব্যাপী একটা মহাযজ্ঞ চালানো হয় এ নিয়ে। বলতে চাচ্ছি সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেয়া হলে কেন আবার এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। যেখানে প্রস্তুতিই নেই, ক্লাসই হলো না সেখানে এই পরীক্ষায় ওদের বসানোর কি যুক্তি থাকতে পারে। যাহোক যেটা বলতে চাচ্ছি, এবার থেকেই তুলে দিন সমাপনী পরীক্ষা। বলাই যায় এ পরীক্ষাটা আগেও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারেনি। এই যে নোট-গাইড কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থের নামে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য-দুর্নীতি এর মূলে ওই সমাপনী পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণীতে দেশব্যাপী মহাসমারোহে সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার পর যে একখানা সনদ ধরিয়ে দেয়া হয় বাস্তবে তার কোন মূল্য নেই। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ওই সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে ঝরে যায়। কয়দিন পর যেটুকু শিখেছিল তাও ভুলে যায়।

দরকার শিশুদের সাবলীলভাবে পঠনদক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া পরীক্ষার দিকে নয়। সাবলীলভাবে পড়তে হলে প্রয়োজন শিশুর উচ্চারণ জড়তা দূর করা। এ ব্যাপারে প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটা পুরোনো পদ্ধতির কথা বলতে চাই। বেশি পুরোনো বলা যাবে না, অনেকেই দেখে থাকতে পারেন। তারপর এক সময় নিয়মটা কেমন করে যেন নেই হয়ে গেল। কাদের প্রেসক্রিপশনে হলো সে কথায় আর নাইবা গেলাম। শিশুদের জন্য এ নিয়মটা আমার মতো বয়সের যারা তারা শুধু দেখেননি এভাবে পড়েছেনও। তবে দেশের সব অঞ্চলে ছিল কি না বলতে পারলাম না। নিয়মটার নাম ডাকপড়া। জন্য একটা পিরিয়ডই ছিল। ডাকপড়া মানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে পড়া। ব্যাপারটা কয়েক লাইনে ব্যক্ত করা কঠিন তবু একটু চেষ্টা করে দেখি। বিস্তারিত পরে দেখা যাবে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সবাই কয়েকটা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। লাইনগুলোর সামনে মাঝামাঝি একটি জায়গায় একজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে ডাক পড়াতে।

এটা অনেকটা জারী গানের মতো। যে সবার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াবে সে উচ্চৈঃস্বরে যা বলে ছেড়ে দেবে অন্যেরা তাই বলবে সমস্বরে। এভাবে একটা ছন্দে এগিয়ে যাবে ডাকপড়া। শুরু হবে প্রত্যেকটা বর্ণের সঙ্গে ‘কার চিহ্ন’ অর্থাৎ া - ি - ী - ু - ূ - ৃ - ে - ৈ - ে া - ে ৗ যোগ করে। ং- ঃ ও ঁ ও থাকবে তার সঙ্গে।

যেমন - কা কি কী কু কূ কৃ কে কৈ কো কৌ কং কঃ কঁ।

ক বর্ণ দিয়ে শুরু হবে ডাকপড়া এবং শেষ হবে হ বর্ণে গিয়ে। যে ডাক পড়াবে সে পড়ালেখায় ভালো হলেই হবে না তার উচ্চারণও ভালো হতে হবে। সে বলবে: ক-য় আকারে কা, সবাই বলবে ক-য় আকারে কা। সে বলবে, ক-য় হ্রস্বি কারে কি-সবাই বলবে ক-য় হ্রস্বি কারে কি। এভাবে চলবে, ক-য় ী কারে কী, ক-য় ু কারে কু , কয় ূ কারে কূ, কয় ৃ কারে কৃ, কয় ে কারে কে, কয় ৈ কারে কৈ, কয় ে া কারে কো, কয় ে ৗ কারে কৌ, কয় ং এ কং, কয় ঃ কঃ, কয় ঁ কঁ।

একে ক-র বানানও বলা হতো। এর পরে খ-র বানান চলবে একইভাবে। তারপর গ-র বানান এবং শেষ হবে গিয়ে হ-র বানানে আগেই বলেছি।

সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেয়া হলে কেন আবার এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। যেখানে প্রস্তুতিই নেই, ক্লাসই হলো না সেখানে এই পরীক্ষায় ওদের বসানোর কি যুক্তি থাকতে পারে

মনে হতে পারে এভাবে পড়া বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আসলে তা নয় পড়তে শুরু করলে সময় বেশি লাগে না। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবীন যারা ছোট তারা প্রথম প্রথম শুধু লাইনে দাঁড়িয়ে শুনবে ইতি-উতি করবে পরে মুখ মিলাতে থাকবে। এর কদিন পর দেখা যাবে তারা বলতে শুরু করেছে ক-য় আকারে কা, ক-য় ি কারে কি। বিষয়টা ছিল ছোটদের জন্য খুব আনন্দের। এর মধ্যে একটা ছন্দও কাজ করেছে ভালো। এই ডাক পড়তে ক বর্গ থেকে ঙ, চ বর্গ থেকে ঞ এবং ট বর্গ থেকে ণ বাদ থেকেছে। আরও বাদ থেকেছে য় ৎ ড় ঢ় ক্ষ । তারপর নিয়মিত লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক পড়ার ফলে যখন মুখের জড়তা ভেঙে গেছে তখন ওই য় ৎ ড় ঢ় ক্ষ এর উচ্চারণও রপ্ত হয়ে গেছে সহজে। ইংরেজি ও ধারাপাতেরও আছে এরকম ডাকপড়া যেমন বিএ-বে, সবাই বলবে বি এ বে। ধারাপাতের বেলায় যেমন একদশ এক এগারো-সবাই বলবে একদশ এক এগারো। বিষয়টি নিয়ে এখানে এর বেশি আর যাওয়া গেল না।

আজকাল আমাদের কোমলমতি শিশুরা মুখে কথা ফোটার আগেই বলা যায় স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। তাই একেবারে ছোটরা যারা প্লে-নার্সারি-কেজি, সরকারি স্কুলের প্রি-প্রাইমারি এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে তাদের জন্য ডাকপড়া কি শহরে কি গ্রামে ফিরিয়ে আনতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে আশা করা যায়। মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে পড়তে নবম দশম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে হবে না। এর সঙ্গে যখন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না এবং সমাপনী পরীক্ষা উঠে যাবে তখন ওদের মুখে খই ফুটবে। এর নাম বাঙালি সন্তান। এদুটো চাপ কেবল সরিয়ে দিতে হবে। আর এর সঙ্গে ডাকপড়াটা ফিরিয়ে আনতে পারলে আর পায় কে। আশা করি কর্তৃপক্ষ বিষয়টা ভেবে দেখবেন।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সমাপনী পরীক্ষা এবার থেকেই বাদ নয় কেন

আব্দুল মান্নান খান

বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

বেশকিছু বছর ধরে সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কী থাকবে না এ নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা ছিল। এবার পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা না থাকার যে কথা কর্তৃপক্ষ থেকে উঠেছে তা আশা করা যায় কার্যকর হবে। আগেও দু’একবার পিইসি থাকছে না বলে আমরা শুনেছি ঊর্ধ্বতন মহলের বক্তব্য থেকে। কিন্তু হয়নি। হতে হতেও হয়নি বলা যায়। না হওয়ার অনেক যুক্তি দেখানো হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম প্রধান যুক্তি হলো যতদিন প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা না যাচ্ছে ততদিন পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা চলবে। আরেকটা প্রধান কারণ বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান সহজ হয়েছে। এ রকম নানা কার বিষয়টা যেমন ছিল তেমন রয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা গেলে অনেক দিক থেকে শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশেও এটা রয়েছে। সেক্ষেত্রেও কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলে থেমে যাওয়া হয়েছে যেমন এর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ঠিক করতে হবে অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষ সেভাবে বাড়াতে হবে। পদ সৃষ্টি করতে হবে, শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, তাদের ট্রেনিং দিতে হবে, কারিকুলাম ঠিক করতে হবে আরও কত কি। এখন কথা হলো সমাপনী পরীক্ষা উঠে যেতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে শুনে ভয় তো একটু থেকেই যাচ্ছে কারণ আবার না আগের মতো অবস্থা হয়। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’ আমরাও পাচ্ছি তাই বলতে চাচ্ছি এবার থেকেই পরীক্ষাটা বন্ধ হয়ে যাক।

বদলে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম বলে দৈনিক সংবাদে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ যে বার্তা এসেছে তা বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে শিক্ষা ক্ষেত্রে হবে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। যেমন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না এটা বাস্তবায়িত হলে শিশুদের মনমানসিকতাসহ চেহারা পাল্টে যাবে। তৃতীয় শ্রেণীর শিশুদের কী পরিমাণ লেখাপড়া করতে হয়-তা একটু ভেতরে না ঢুকলে কেউ ধারণা করতে পারবেন না। হেন কিছু নেই যা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ান হয় না। ছয়টা বিষয়ের (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয এবং প্রাথমিক বিজ্ঞান) যে কোন একটা বিষয়ের কারিকুলাম এবং তার প্রশ্নপত্র দেখলে মনে হবে, এ বিষয়ে জীবনে যেন আর কিছু পড়ার প্রয়োজন হবে না ওদের। তৃতীয় শ্রেণীতেই সব পড়িয়ে শেষ করতে হবে।

আমাদের শিশুরা মাতৃভাষার পঠনদক্ষতায় ভীষণরকম পিছিয়ে আছে। মাতৃভাষায় মোটামুটি চলন সই পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে ওদের যেতে হচ্ছে নবম দশম শ্রেণী পর্যন্ত। দেশি-বিদেশি সুধী বিশেষজ্ঞজনরা বলেন, মাতৃভাষায় পঠনদক্ষতা মানবসম্পদ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে পড়তে না পারলে শিক্ষার ভিত শক্ত হয় না। এর অভাব শিশুর ভবিষ্যৎ কর্মদক্ষতার ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের শিশুরা শুরু থেকেই শুধু পরীক্ষা, উঠতে বসতে প্রস্তুতি পরীক্ষা শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা দিয়ে প্রবল শিশুমেধার শক্তিতে এক ধরনের মনে রেখে তারা ক্লাস পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে কাজেই সাবলীলভাবে পঠনদক্ষতা কীভাবে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বছর দুই আগে বলেছিলেন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে না গেলে এতদিনে হয়তো বিষয়টির বাস্তবায়ন দেখা যেত। এবার সামনে কি হয় দেখা যাক। আমরা আশা করব এর শতভাগ বাস্তবায়ন হবে।

দ্বিতীয়ত, নবম-দশমের বিভাগ বিভাজন থাকবে না। প্রায় ৬০ বছর ধরে চলে আসছে যে পদ্ধতি তা উঠে যাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে প্রধানত শিক্ষক মহোদয়দের মূল্যায়নের ভিত্তিতে এবং শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোন বিভাগে পড়বে ঠিক হয়ে তাকে। এখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মতামতেরও প্রয়োজন হয়। প্রথমে এর দুটো বিভাজন ছিল বিজ্ঞান ও মানবিক। পরে বাণিজ্যসহ আরও হয়তো বেড়েছে। যারা লেখাপড়া ভালো করে মেধাবী তারাই সাধারণত যায় বিজ্ঞান বিভাগে। দীর্ঘসময়ে এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি যেটা ঘটা দরকার ছিল। সব ক্ষেত্রেই মেধার প্রয়োজন রয়েছে। এখন এর পরিবর্তন সামনে আসছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। তবে শিক্ষার্থীদের ভালো লাগার বিষয়টা যেন তারা সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে হলেও সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বলা হয়েছে, এবারের ও আগামী বছরের সমাপনী পরীক্ষাও অনিশ্চিত। অনিশ্চিত তো হতেই পারে। ভুলে গেলে চলবে কেমন করে যে, এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে সারেনি ঠিক মতো। কী ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেল প্রায় দুটো বছর। সমাপনী পরীক্ষা তো ছোটখাটো কোন ব্যাপার না, দেশব্যাপী একটা মহাযজ্ঞ চালানো হয় এ নিয়ে। বলতে চাচ্ছি সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেয়া হলে কেন আবার এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। যেখানে প্রস্তুতিই নেই, ক্লাসই হলো না সেখানে এই পরীক্ষায় ওদের বসানোর কি যুক্তি থাকতে পারে। যাহোক যেটা বলতে চাচ্ছি, এবার থেকেই তুলে দিন সমাপনী পরীক্ষা। বলাই যায় এ পরীক্ষাটা আগেও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারেনি। এই যে নোট-গাইড কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থের নামে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য-দুর্নীতি এর মূলে ওই সমাপনী পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণীতে দেশব্যাপী মহাসমারোহে সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার পর যে একখানা সনদ ধরিয়ে দেয়া হয় বাস্তবে তার কোন মূল্য নেই। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ওই সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে ঝরে যায়। কয়দিন পর যেটুকু শিখেছিল তাও ভুলে যায়।

দরকার শিশুদের সাবলীলভাবে পঠনদক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া পরীক্ষার দিকে নয়। সাবলীলভাবে পড়তে হলে প্রয়োজন শিশুর উচ্চারণ জড়তা দূর করা। এ ব্যাপারে প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটা পুরোনো পদ্ধতির কথা বলতে চাই। বেশি পুরোনো বলা যাবে না, অনেকেই দেখে থাকতে পারেন। তারপর এক সময় নিয়মটা কেমন করে যেন নেই হয়ে গেল। কাদের প্রেসক্রিপশনে হলো সে কথায় আর নাইবা গেলাম। শিশুদের জন্য এ নিয়মটা আমার মতো বয়সের যারা তারা শুধু দেখেননি এভাবে পড়েছেনও। তবে দেশের সব অঞ্চলে ছিল কি না বলতে পারলাম না। নিয়মটার নাম ডাকপড়া। জন্য একটা পিরিয়ডই ছিল। ডাকপড়া মানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে পড়া। ব্যাপারটা কয়েক লাইনে ব্যক্ত করা কঠিন তবু একটু চেষ্টা করে দেখি। বিস্তারিত পরে দেখা যাবে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সবাই কয়েকটা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। লাইনগুলোর সামনে মাঝামাঝি একটি জায়গায় একজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে ডাক পড়াতে।

এটা অনেকটা জারী গানের মতো। যে সবার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াবে সে উচ্চৈঃস্বরে যা বলে ছেড়ে দেবে অন্যেরা তাই বলবে সমস্বরে। এভাবে একটা ছন্দে এগিয়ে যাবে ডাকপড়া। শুরু হবে প্রত্যেকটা বর্ণের সঙ্গে ‘কার চিহ্ন’ অর্থাৎ া - ি - ী - ু - ূ - ৃ - ে - ৈ - ে া - ে ৗ যোগ করে। ং- ঃ ও ঁ ও থাকবে তার সঙ্গে।

যেমন - কা কি কী কু কূ কৃ কে কৈ কো কৌ কং কঃ কঁ।

ক বর্ণ দিয়ে শুরু হবে ডাকপড়া এবং শেষ হবে হ বর্ণে গিয়ে। যে ডাক পড়াবে সে পড়ালেখায় ভালো হলেই হবে না তার উচ্চারণও ভালো হতে হবে। সে বলবে: ক-য় আকারে কা, সবাই বলবে ক-য় আকারে কা। সে বলবে, ক-য় হ্রস্বি কারে কি-সবাই বলবে ক-য় হ্রস্বি কারে কি। এভাবে চলবে, ক-য় ী কারে কী, ক-য় ু কারে কু , কয় ূ কারে কূ, কয় ৃ কারে কৃ, কয় ে কারে কে, কয় ৈ কারে কৈ, কয় ে া কারে কো, কয় ে ৗ কারে কৌ, কয় ং এ কং, কয় ঃ কঃ, কয় ঁ কঁ।

একে ক-র বানানও বলা হতো। এর পরে খ-র বানান চলবে একইভাবে। তারপর গ-র বানান এবং শেষ হবে গিয়ে হ-র বানানে আগেই বলেছি।

সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেয়া হলে কেন আবার এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। যেখানে প্রস্তুতিই নেই, ক্লাসই হলো না সেখানে এই পরীক্ষায় ওদের বসানোর কি যুক্তি থাকতে পারে

মনে হতে পারে এভাবে পড়া বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আসলে তা নয় পড়তে শুরু করলে সময় বেশি লাগে না। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবীন যারা ছোট তারা প্রথম প্রথম শুধু লাইনে দাঁড়িয়ে শুনবে ইতি-উতি করবে পরে মুখ মিলাতে থাকবে। এর কদিন পর দেখা যাবে তারা বলতে শুরু করেছে ক-য় আকারে কা, ক-য় ি কারে কি। বিষয়টা ছিল ছোটদের জন্য খুব আনন্দের। এর মধ্যে একটা ছন্দও কাজ করেছে ভালো। এই ডাক পড়তে ক বর্গ থেকে ঙ, চ বর্গ থেকে ঞ এবং ট বর্গ থেকে ণ বাদ থেকেছে। আরও বাদ থেকেছে য় ৎ ড় ঢ় ক্ষ । তারপর নিয়মিত লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক পড়ার ফলে যখন মুখের জড়তা ভেঙে গেছে তখন ওই য় ৎ ড় ঢ় ক্ষ এর উচ্চারণও রপ্ত হয়ে গেছে সহজে। ইংরেজি ও ধারাপাতেরও আছে এরকম ডাকপড়া যেমন বিএ-বে, সবাই বলবে বি এ বে। ধারাপাতের বেলায় যেমন একদশ এক এগারো-সবাই বলবে একদশ এক এগারো। বিষয়টি নিয়ে এখানে এর বেশি আর যাওয়া গেল না।

আজকাল আমাদের কোমলমতি শিশুরা মুখে কথা ফোটার আগেই বলা যায় স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। তাই একেবারে ছোটরা যারা প্লে-নার্সারি-কেজি, সরকারি স্কুলের প্রি-প্রাইমারি এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে তাদের জন্য ডাকপড়া কি শহরে কি গ্রামে ফিরিয়ে আনতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে আশা করা যায়। মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে পড়তে নবম দশম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে হবে না। এর সঙ্গে যখন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না এবং সমাপনী পরীক্ষা উঠে যাবে তখন ওদের মুখে খই ফুটবে। এর নাম বাঙালি সন্তান। এদুটো চাপ কেবল সরিয়ে দিতে হবে। আর এর সঙ্গে ডাকপড়াটা ফিরিয়ে আনতে পারলে আর পায় কে। আশা করি কর্তৃপক্ষ বিষয়টা ভেবে দেখবেন।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top