alt

উপ-সম্পাদকীয়

কিশোর শিক্ষার্থীদের কোভিড ভ্যাকসিন

নাজমুল হুদা খান

: বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

বৈশ্বিক অতিমারি কোভিড-১৯ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও সম্পদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরনে কোয়ারেন্টাইন, শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কন্ট্রাক্ট ট্র্যাসিং, লকডাউন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সব কার্যক্রম গ্রহণ করে বাংলাদেশ।

করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধকরণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো, দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে সচল রাখা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রমগুলো সফলভাবে চলছে অদ্যাবধি।

কোভিড-১৯ প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরপরই সম্ভাব্য সব উৎস থেকে দেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্র্যাজেনেকা ও সিনোফার্ম প্রভৃতি ৪টি ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে। এ পর্যন্ত সর্বমোট পৌনে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে। শতকরা হারে এর পরিমাণ ১১.৩%। ২০২২ সালের মধ্যে জনসংখ্যার ৮০% জনকে ভ্যাকসিন প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের মতো কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ধাপে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। যে সব শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্বে তাদের বিষয়ে অনুমোদনবিষয়ক জটিলতা নেই। তবে ১২ থেকে ১৮-এর নিচের বয়সী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে।

ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (EMA)-এর অনুমোদনের পর ১২-এর ঊর্ধ্বে বয়সীদের ভ্যাকসিন প্রদান ইতোমধ্যে শুরু করেছে। ডেনমার্ক ও স্পেনে এ বয়সী কিশোরদের ভ্যাকসিন প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ফ্রান্স ৬৬% ছেলেমেয়েকে ১ম ডোজ এবং ৫২% জনকে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে। তবে জার্মানি যে সব বাচ্চাদের শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে শুধু তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। সুইডেন যাদের ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি বা এতদ-সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে তাদের ভ্যাকসিন প্রদান করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডা ১২ বা তদূর্ধ্ব বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য ফাইজার এবং মডার্না ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে এবং জুলাই ২০২১ অবধি ৪২% কে প্রথম এবং ৩২ শতাংশকে পূর্ণাঙ্গ ডোজ প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের গবেষণার তথ্যে বলেছে যে, ভ্যাকসিন গ্রহণকৃত ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভ্যাকসিনবিহীনদের দেহে সংক্রমণের পরিমাণ ৩.৫ গুণ বেশি। চীনে তাদের প্রস্তুতকৃত সিনোভ্যাক টিকা ৩-১৭ বছরের বাচ্চাদের প্রয়োগ শুরু করেছে। ভারতে এ বয়সীদের অক্টোবর ২০২১ অবধি ভ্যাকসিন প্রদানের আওতায় আনার বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন গাইডলাইন অনুসরণে ১৮ বছরের নিচের বয়সী ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করেছে। তারা সারাদেশের ১৬-১৭ বছর বয়সী সব ছেলেমেয়ে এবং শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে এমন ১২-১৫ বয়সীদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। তবে যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অফ ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজিশন (JCVI) ১২-১৫ বছর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান না করার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, এ বয়সীদের ভ্যাকসিন প্রদানের স্বপক্ষে কোন অকাট্য তথ্য-উপাত্ত নেই। তারা আরও বলেছে, তাদের গবেষণায় ১০ লাখের মধ্যে মাত্র দুজন ছেলেমেয়ের করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হয়েছে, সুতরাং এ পরিস্থিতিতে তাদের সার্বজনীন ভ্যাকসিনের আওতায় আনার প্রয়োজন নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ফাইজার টিকাকে ১২ বছরের ঊর্ধ্বের ছেলেমেয়েদের প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে। ফাইজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি ১২-১৫ বছর বয়সীদের দেহে প্রায় ১০০ ভাগ কার্যকরী এবং ১৬ এবং তদূর্ধ্ব বয়সীদের দেহে সফলতা ৯১% ভাগ। ২২০০ জন ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি গবেষণা জরিপে তারা প্রমাণ পান, যে ১০০৫ জন ছেলেমেয়েকে ফাইজার ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে তাদের কারো দেহে করোনা সংক্রমণ হয়নি। অপরপক্ষে ৯৭৮ জন ভ্যাকসিনবিহীনদের মধ্যে ১৫ জনের দেহে করোনা সংক্রমিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের গবেষণার তথ্যে বলেছে যে, ভ্যাকসিন নেয়া ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভ্যাকসিন না নেয়াদের দেহে করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা ৩.৫ গুণ বেশি

তবে তারা গবেষণায় দেখেছে, এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর অন্যান্য বয়স্কদের ন্যায় টিকা প্রদানের স্থানে ব্যথা, মৃদু অবসাদ, মাথাব্যথা, কাঁপুনি, মাংসপেশীতে ব্যথা, জ্বর ও জয়েন্টে ব্যথা দেখা দিতে পারে।

ফাইজার কর্তৃপক্ষের গবেষকরা আরও জানিয়েছে যে, এ ভ্যাকসিনের মেসেঞ্জার আরএনএ দেহ কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে না-তাই ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা নেই। এটি করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অনুরূপ এন্টিবডি প্রস্তুত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

এক সময় অভিযোগ উঠে যে, এ ভ্যাকসিন হৃদপি-ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। যদিও সিডিসির গবেষণায় এর সত্যতা মিলেনি। ফাইজার ও মডার্না ৫-১১ বছরের ছেলেমেয়েদেরও এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের গবেষণা তথ্য শিগগিরই প্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর তাদের দেশের ৩-১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের প্রদানের জন্য চীনে তৈরি সিনোফার্ম ভ্যাকসিন অনুমোদন প্রদান করেছে।

অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন কর্তৃপক্ষ ১২><১৮ বছর বয়সীদের দেহে ব্যবহারের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের জন্য গবেষণা কার্যপরিচালনা করছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ০-১৯ বছর বয়সী জনসংখ্যার পরিমাণ শতকরা প্রায় ৪৪ শতাংশ, এর মধ্যে ১২-১৮ বছর পর্যন্ত প্রায় ১০.৫%। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসেবে দেশের ৩০ হাজার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় কোটি ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করার জন্য সব শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার কর্তৃপক্ষের ভাবনা সময়োপযোগী। ভ্যাকসিন এ বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বিজ্ঞানসম্মত গাইডলাইন প্রস্তুতের মাধ্যমে প্রয়োগও করেছে অনেক দেশ, যাতে এ পর্যন্ত তেমন তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার প্রমান মেলেনি। শিগগিরই অনুমোদিত অন্যান্য ভ্যাকসিনসমূহও স্কুলগামীদের ভ্যাকসিন প্রদানের স্বপক্ষে তাদের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের সংশ্লিষ্টদের মতামত ও অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগিরই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদেরও ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে মনে রাখতে হবে, কোন ভ্যাকসিনই সব ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সমভাবে কার্যকরী নয়। তাই ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও এ বয়সী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সক্রিয় ও সচেতন থাকতে হবে।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কিশোর শিক্ষার্থীদের কোভিড ভ্যাকসিন

নাজমুল হুদা খান

বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

বৈশ্বিক অতিমারি কোভিড-১৯ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও সম্পদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরনে কোয়ারেন্টাইন, শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কন্ট্রাক্ট ট্র্যাসিং, লকডাউন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সব কার্যক্রম গ্রহণ করে বাংলাদেশ।

করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধকরণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো, দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে সচল রাখা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রমগুলো সফলভাবে চলছে অদ্যাবধি।

কোভিড-১৯ প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরপরই সম্ভাব্য সব উৎস থেকে দেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্র্যাজেনেকা ও সিনোফার্ম প্রভৃতি ৪টি ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে। এ পর্যন্ত সর্বমোট পৌনে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে। শতকরা হারে এর পরিমাণ ১১.৩%। ২০২২ সালের মধ্যে জনসংখ্যার ৮০% জনকে ভ্যাকসিন প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের মতো কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ধাপে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। যে সব শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্বে তাদের বিষয়ে অনুমোদনবিষয়ক জটিলতা নেই। তবে ১২ থেকে ১৮-এর নিচের বয়সী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে।

ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (EMA)-এর অনুমোদনের পর ১২-এর ঊর্ধ্বে বয়সীদের ভ্যাকসিন প্রদান ইতোমধ্যে শুরু করেছে। ডেনমার্ক ও স্পেনে এ বয়সী কিশোরদের ভ্যাকসিন প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ফ্রান্স ৬৬% ছেলেমেয়েকে ১ম ডোজ এবং ৫২% জনকে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে। তবে জার্মানি যে সব বাচ্চাদের শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে শুধু তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। সুইডেন যাদের ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি বা এতদ-সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে তাদের ভ্যাকসিন প্রদান করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডা ১২ বা তদূর্ধ্ব বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য ফাইজার এবং মডার্না ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে এবং জুলাই ২০২১ অবধি ৪২% কে প্রথম এবং ৩২ শতাংশকে পূর্ণাঙ্গ ডোজ প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের গবেষণার তথ্যে বলেছে যে, ভ্যাকসিন গ্রহণকৃত ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভ্যাকসিনবিহীনদের দেহে সংক্রমণের পরিমাণ ৩.৫ গুণ বেশি। চীনে তাদের প্রস্তুতকৃত সিনোভ্যাক টিকা ৩-১৭ বছরের বাচ্চাদের প্রয়োগ শুরু করেছে। ভারতে এ বয়সীদের অক্টোবর ২০২১ অবধি ভ্যাকসিন প্রদানের আওতায় আনার বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন গাইডলাইন অনুসরণে ১৮ বছরের নিচের বয়সী ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করেছে। তারা সারাদেশের ১৬-১৭ বছর বয়সী সব ছেলেমেয়ে এবং শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে এমন ১২-১৫ বয়সীদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। তবে যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অফ ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজিশন (JCVI) ১২-১৫ বছর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান না করার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, এ বয়সীদের ভ্যাকসিন প্রদানের স্বপক্ষে কোন অকাট্য তথ্য-উপাত্ত নেই। তারা আরও বলেছে, তাদের গবেষণায় ১০ লাখের মধ্যে মাত্র দুজন ছেলেমেয়ের করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হয়েছে, সুতরাং এ পরিস্থিতিতে তাদের সার্বজনীন ভ্যাকসিনের আওতায় আনার প্রয়োজন নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ফাইজার টিকাকে ১২ বছরের ঊর্ধ্বের ছেলেমেয়েদের প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে। ফাইজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি ১২-১৫ বছর বয়সীদের দেহে প্রায় ১০০ ভাগ কার্যকরী এবং ১৬ এবং তদূর্ধ্ব বয়সীদের দেহে সফলতা ৯১% ভাগ। ২২০০ জন ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি গবেষণা জরিপে তারা প্রমাণ পান, যে ১০০৫ জন ছেলেমেয়েকে ফাইজার ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে তাদের কারো দেহে করোনা সংক্রমণ হয়নি। অপরপক্ষে ৯৭৮ জন ভ্যাকসিনবিহীনদের মধ্যে ১৫ জনের দেহে করোনা সংক্রমিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের গবেষণার তথ্যে বলেছে যে, ভ্যাকসিন নেয়া ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভ্যাকসিন না নেয়াদের দেহে করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা ৩.৫ গুণ বেশি

তবে তারা গবেষণায় দেখেছে, এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর অন্যান্য বয়স্কদের ন্যায় টিকা প্রদানের স্থানে ব্যথা, মৃদু অবসাদ, মাথাব্যথা, কাঁপুনি, মাংসপেশীতে ব্যথা, জ্বর ও জয়েন্টে ব্যথা দেখা দিতে পারে।

ফাইজার কর্তৃপক্ষের গবেষকরা আরও জানিয়েছে যে, এ ভ্যাকসিনের মেসেঞ্জার আরএনএ দেহ কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে না-তাই ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা নেই। এটি করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অনুরূপ এন্টিবডি প্রস্তুত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

এক সময় অভিযোগ উঠে যে, এ ভ্যাকসিন হৃদপি-ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। যদিও সিডিসির গবেষণায় এর সত্যতা মিলেনি। ফাইজার ও মডার্না ৫-১১ বছরের ছেলেমেয়েদেরও এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের গবেষণা তথ্য শিগগিরই প্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর তাদের দেশের ৩-১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের প্রদানের জন্য চীনে তৈরি সিনোফার্ম ভ্যাকসিন অনুমোদন প্রদান করেছে।

অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন কর্তৃপক্ষ ১২><১৮ বছর বয়সীদের দেহে ব্যবহারের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের জন্য গবেষণা কার্যপরিচালনা করছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ০-১৯ বছর বয়সী জনসংখ্যার পরিমাণ শতকরা প্রায় ৪৪ শতাংশ, এর মধ্যে ১২-১৮ বছর পর্যন্ত প্রায় ১০.৫%। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসেবে দেশের ৩০ হাজার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় কোটি ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করার জন্য সব শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার কর্তৃপক্ষের ভাবনা সময়োপযোগী। ভ্যাকসিন এ বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বিজ্ঞানসম্মত গাইডলাইন প্রস্তুতের মাধ্যমে প্রয়োগও করেছে অনেক দেশ, যাতে এ পর্যন্ত তেমন তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার প্রমান মেলেনি। শিগগিরই অনুমোদিত অন্যান্য ভ্যাকসিনসমূহও স্কুলগামীদের ভ্যাকসিন প্রদানের স্বপক্ষে তাদের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের সংশ্লিষ্টদের মতামত ও অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগিরই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদেরও ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে মনে রাখতে হবে, কোন ভ্যাকসিনই সব ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সমভাবে কার্যকরী নয়। তাই ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও এ বয়সী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সক্রিয় ও সচেতন থাকতে হবে।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

back to top