alt

উপ-সম্পাদকীয়

তালেবানরা উদারপন্থি হচ্ছে কি

রণেশ মৈত্র

: বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
image

বিশ্বের হাল-হকিকত, বিশেষ করে আফগানিস্তানে বিগত ১৫ আগস্ট তালেবানদের কাবুল-তথা প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান দখলের পর থেকে যারাই আফগানিস্তানের সদ্য দখল নেওয়া তালেবানদের গতিবিধি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাদের অনেকেই কিছুটা আশ্বস্ত ও উৎসাহিত হয়েছিলেন; যখন তালেবানিদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হলো- আজকের তালেবানরা ২০ বছর আগের তালেবানদের মতো হবে না। তারা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ পরিচালনা করবেন। নারী অধিকারের স্বীকৃতি দেবেন। শুধুমাত্র হিজাব পরেই তারা দেশের যত্রতত্র যেতে পারবেন, লেখাপড়া চাকরি-বাকরি সবই করতে পারবেন। এমন ঘোষণার পর বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই সম্ভবত ভেবেছিলেন- ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং উগ্রতার প্রতিফলন ঘটলেও এবারকার তালেবান সরকার অতীতের তালেবানদের মতো ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা চালাবে না।

কিন্তু মাসখানেক হলো আফগানিস্তান তালেবানদের দখলে যাওয়ার পর এই অল্প সময়ে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করলে আদৌ কি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রতিফলন ঘটার ন্যূনতম লক্ষণ চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে প্রিয় পাঠ-পাঠিকাদের দৃষ্টিতে কতিপয় সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক হবে।

এক. কাবুল দখলের পরপরই তালেবানরা বলেছিল- আমরা সব রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব কামনা করি। এ ঘোষণার পরপরই ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধি কাতারে গিয়ে তালেবানিদের মনোনীত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। আলোচনার সব বিষয় জানা না গেলেও এটুকু জানা গিয়েছিল যে, আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতবিরোধী কোন কিছু কাউকে তালেবানরা করতে দেবে না।

দুই. এর পরপরই সেখানে ছুটে যান পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধান ফয়েজ হামিদ। সেখানকার পাঞ্চশির প্রদেশে তখন সেখানকার যোদ্ধারা কিছুতেই তালেবানি শাসন মেনে না নিয়ে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য ইতোমধ্যে পাঞ্চশিরও তালেবানরা দখলে নিয়েছে বলে তাদের ঘোষণায় জানা যায়।

তিন. আইএসআই প্রতিনিধি সেখানকার সবার সঙ্গেই আলোচনা করেছেন বলে জানা যায়। তালেবানদের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের নতুন মন্ত্রিসভা শীঘ্রই গঠিত হতে যাচ্ছে। বলা হলো- ওই সরকারের প্রধান হবেন মোল্লা হাসান আযুন্দা।

চার. এই মোল্লা হাসান আযুন্দা মারাত্মক উগ্রপন্থি বলে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত। ২০ বছর আগে আমেরিকার ৯/১১-এর ধ্বংসলীলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড বলে তিনি পরিচিত এবং আজও তিনি আমেরিকার কালো তালিকাভুক্ত।

পাঁচ. তৎকালীন তালেবান/আইএস প্রধান, মার্কিন বাহিনী কর্তৃক আফগান মাঠিতে নিহত মোল্লা ওমরের কট্টরপন্থি সন্তানও ওই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন।

ছয়. সম্প্রতি রাশিয়া এবং ভারত সরকার আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। উল্লেখ্য, তালেবানরা আফগান দখল নেওয়ার পরপরই রাশিয়ার সরকার বলেছিল, তারা আশা করছেন, নতুন তালেবানি সরকার অতীতের মতো উগ্র হবে না- নারী অধিাকর প্রতিষ্ঠা ও উদারতার দিকে অগ্রসর হবে বলে তারা মনে করছেন। কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই রুশ-ভারত বৈঠকে সম্ভাব্য তালেবানি সন্ত্রাস প্রতিরোধে উভয় সরকার যৌথভাবে কাজ করবেন বলে আনুষ্ঠানিকভাবে একমত হবেন।

সাত. আফগানিস্তানের নারী সমাজ আজও তালেবানি উত্থান মেনে নেননি। তালেবানিদের বিরুদ্ধে লেখা নানা পোস্টার ব্যানার হাতে তারা প্রায় রোজই মিছিল সমাবেশ করছেন কাবুল ও অন্যান্য শহরের রাজপথে। তাদের দাবি পুরুষের সঙ্গে নারীর সমঅধিকারের স্বীকৃতি, বোরকাকে আদৌ বাধ্যতামূলক করা চলবে না, শুধু হিজাব পরেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত যাতায়াতের স্বাধীনতার স্কীকৃতি দিতে হবে।

আট. শুধুমাত্র পুরুষ সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন নয়, নারীদেরও উপযুক্ত সংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

নয়. অসহিষ্ণু এবং অগণতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিক তালেবানরা নারীদের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং সম্প্রতি একদিন নারীদের প্রতিবাদ মিছিল চলাকালে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে অনেক মহিলাকে আহত করেছে। কোথাও কোথাও বিদ্রোহী মহিলা আফগানকে গুলি করে হত্যাও করেছে; কিন্তু নারী সমাজ তাতে দমে যায়নি। বিক্ষোভ চলছেই।

দশ. সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। নারী বিক্ষোভের ছবি তোলার অপরাধে দুজন আফগান সাংবাদিককে পুলিশ ও তালেবান গুন্ডারা ধরে নিয়ে তাদের অর্ধ-উলঙ্গ করে বেদম প্রহার করেছে। উভয় সাংবাদিককেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

এগারো. তালেবানদের ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান ও উপ-প্রধানমন্ত্রী আবদুল গণি বারদারার মধ্যে মতানৈক্য হওয়ায় বারদারা ইতোমধ্যেই হামলার শিকার হয়েছেন।

বারো. হঠাৎ দিল্লি ছুটে গেছেন পাকিস্তানের আইএসআই প্রতিনিধি আফগানিস্তানের সপক্ষে দূতিয়ালি করতে। আন্তর্জাতিক মহল প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসানকে পাকিস্তান মনোনীত বলেই মনে করছেন।

তেরো. জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ জানিয়েছেন আফগানিস্তানের তালেবানি নতুন সরকারকে স্বীকৃতি না দিতে।

চৌদ্দ. সম্প্রতি একজন তালেবান নেতাকে সেখানকার সাংবাদিকরা নারীর মর্যাদা ও নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে উত্তরে সরাসরি বলেন, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য মুক্তির দাবি মুখরোচক হলেও অর্থহীন। কারণ নারীর প্রধান কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া ও শিশুদের প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। অপর এক প্রশ্নে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন- আশরাফ ঘানির আমলে তো বহুসংখ্যক নারী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, পড়াতেন এবং চাকরিও করতেন। তাহলে এখন অনুরূপ ব্যবস্থায় বাধা কোথায়? উত্তরে তালেবান নেতা বলেন, ওই নারীরা চাকরি করতো নাকি? তারা তো কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে যৌনক্রিয়ায় মত্ত থাকতো; বাস্তবে তাদের বেশ্যা বলে অভিহিত করা উচিত।

পনেরো. ওই সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- নারী সমাজ তো মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, তবু তারা মন্ত্রিসভায় স্থান পাবেন না কেন? এর উত্তরে তালেবানদের পক্ষ থেকে বলা হয়- নারীরা মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ অক্ষম এবং দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি অযোগ্য। তাই মন্ত্রিসভায় নারীর কোন স্থান হবে না।

ষোলো. ক্ষমতায় এসেই তালেবানরা নারীদের জন্য খেলাধুলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়া বলেছে- তাহলে আফগানিস্তানের কোন টিমের সঙ্গেই অস্ট্রেলিয়ার কোনো টিম খেলবে না।

সতেরো. মন্ত্রিসভা গঠনে ১৫ জন সদস্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সবাই পুরুষ। অপরদিকে কাবুল শহরে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সব নাগরিককে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে তালেবানরা। কিন্তু নারীরা মন্ত্রিসভায় স্থান ও তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের দাবিতে তাবৎ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন। তাদের স্লোগান- ‘আমরা সমান অধিকার চাই, সরকারে নারীর স্থান চাই।’

জিয়া নামের এক আফগানি বিক্ষোভকারী মহিলা নেত্রী জানান, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ৪-৫টা গাড়ি এলো আমাদের পেছন পেছন। প্রতিটি গাড়িতে ১০ জন করে তালেবান যোদ্ধা রয়েছেন। এক পর্যায়ে তাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। আঘাত করা হয় চাবুক দিয়ে এবং ব্যাটস দিয়ে মারধর করা হয়।

সারা নামক অপর বিক্ষোভকারী বলেন, আমাদের সবাইকে মারধর করা হয়েছে। আমিও আঘাত পেয়েছি। তারা আমাদের বাড়িতে যেতে বলে। তারা আরও বলে- বাড়িই নারীর জায়গা। তিনি বলেন, মারধরের ভিডিও করতে গেলে তারা হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেয়।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এতিলাতবোজরের খবরে বলা হয়- বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে পেটানো হয়েছে এবং তাদের আটক রাখা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ডব্লিউআইওএন জানিয়েছে, বিক্ষোভ চলতে থাকায় কিছু এলাকায় দুপুর ২টা থেকে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে তালেবান।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের পতন ও তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পেছনে দেশটির সাবেক ক্ষমতাসীন আশরাফ ঘানির সরকারকেই দায়ী করলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক আফগান রাষ্ট্রদূত রয়া রাহমারি। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হলেও বিস্মিত হননি।

[লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

তালেবানরা উদারপন্থি হচ্ছে কি

রণেশ মৈত্র

image

বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

বিশ্বের হাল-হকিকত, বিশেষ করে আফগানিস্তানে বিগত ১৫ আগস্ট তালেবানদের কাবুল-তথা প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান দখলের পর থেকে যারাই আফগানিস্তানের সদ্য দখল নেওয়া তালেবানদের গতিবিধি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাদের অনেকেই কিছুটা আশ্বস্ত ও উৎসাহিত হয়েছিলেন; যখন তালেবানিদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হলো- আজকের তালেবানরা ২০ বছর আগের তালেবানদের মতো হবে না। তারা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ পরিচালনা করবেন। নারী অধিকারের স্বীকৃতি দেবেন। শুধুমাত্র হিজাব পরেই তারা দেশের যত্রতত্র যেতে পারবেন, লেখাপড়া চাকরি-বাকরি সবই করতে পারবেন। এমন ঘোষণার পর বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই সম্ভবত ভেবেছিলেন- ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং উগ্রতার প্রতিফলন ঘটলেও এবারকার তালেবান সরকার অতীতের তালেবানদের মতো ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা চালাবে না।

কিন্তু মাসখানেক হলো আফগানিস্তান তালেবানদের দখলে যাওয়ার পর এই অল্প সময়ে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করলে আদৌ কি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রতিফলন ঘটার ন্যূনতম লক্ষণ চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে প্রিয় পাঠ-পাঠিকাদের দৃষ্টিতে কতিপয় সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক হবে।

এক. কাবুল দখলের পরপরই তালেবানরা বলেছিল- আমরা সব রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব কামনা করি। এ ঘোষণার পরপরই ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধি কাতারে গিয়ে তালেবানিদের মনোনীত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। আলোচনার সব বিষয় জানা না গেলেও এটুকু জানা গিয়েছিল যে, আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতবিরোধী কোন কিছু কাউকে তালেবানরা করতে দেবে না।

দুই. এর পরপরই সেখানে ছুটে যান পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধান ফয়েজ হামিদ। সেখানকার পাঞ্চশির প্রদেশে তখন সেখানকার যোদ্ধারা কিছুতেই তালেবানি শাসন মেনে না নিয়ে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য ইতোমধ্যে পাঞ্চশিরও তালেবানরা দখলে নিয়েছে বলে তাদের ঘোষণায় জানা যায়।

তিন. আইএসআই প্রতিনিধি সেখানকার সবার সঙ্গেই আলোচনা করেছেন বলে জানা যায়। তালেবানদের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের নতুন মন্ত্রিসভা শীঘ্রই গঠিত হতে যাচ্ছে। বলা হলো- ওই সরকারের প্রধান হবেন মোল্লা হাসান আযুন্দা।

চার. এই মোল্লা হাসান আযুন্দা মারাত্মক উগ্রপন্থি বলে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত। ২০ বছর আগে আমেরিকার ৯/১১-এর ধ্বংসলীলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড বলে তিনি পরিচিত এবং আজও তিনি আমেরিকার কালো তালিকাভুক্ত।

পাঁচ. তৎকালীন তালেবান/আইএস প্রধান, মার্কিন বাহিনী কর্তৃক আফগান মাঠিতে নিহত মোল্লা ওমরের কট্টরপন্থি সন্তানও ওই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন।

ছয়. সম্প্রতি রাশিয়া এবং ভারত সরকার আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। উল্লেখ্য, তালেবানরা আফগান দখল নেওয়ার পরপরই রাশিয়ার সরকার বলেছিল, তারা আশা করছেন, নতুন তালেবানি সরকার অতীতের মতো উগ্র হবে না- নারী অধিাকর প্রতিষ্ঠা ও উদারতার দিকে অগ্রসর হবে বলে তারা মনে করছেন। কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই রুশ-ভারত বৈঠকে সম্ভাব্য তালেবানি সন্ত্রাস প্রতিরোধে উভয় সরকার যৌথভাবে কাজ করবেন বলে আনুষ্ঠানিকভাবে একমত হবেন।

সাত. আফগানিস্তানের নারী সমাজ আজও তালেবানি উত্থান মেনে নেননি। তালেবানিদের বিরুদ্ধে লেখা নানা পোস্টার ব্যানার হাতে তারা প্রায় রোজই মিছিল সমাবেশ করছেন কাবুল ও অন্যান্য শহরের রাজপথে। তাদের দাবি পুরুষের সঙ্গে নারীর সমঅধিকারের স্বীকৃতি, বোরকাকে আদৌ বাধ্যতামূলক করা চলবে না, শুধু হিজাব পরেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত যাতায়াতের স্বাধীনতার স্কীকৃতি দিতে হবে।

আট. শুধুমাত্র পুরুষ সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন নয়, নারীদেরও উপযুক্ত সংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

নয়. অসহিষ্ণু এবং অগণতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিক তালেবানরা নারীদের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং সম্প্রতি একদিন নারীদের প্রতিবাদ মিছিল চলাকালে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে অনেক মহিলাকে আহত করেছে। কোথাও কোথাও বিদ্রোহী মহিলা আফগানকে গুলি করে হত্যাও করেছে; কিন্তু নারী সমাজ তাতে দমে যায়নি। বিক্ষোভ চলছেই।

দশ. সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। নারী বিক্ষোভের ছবি তোলার অপরাধে দুজন আফগান সাংবাদিককে পুলিশ ও তালেবান গুন্ডারা ধরে নিয়ে তাদের অর্ধ-উলঙ্গ করে বেদম প্রহার করেছে। উভয় সাংবাদিককেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

এগারো. তালেবানদের ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসান ও উপ-প্রধানমন্ত্রী আবদুল গণি বারদারার মধ্যে মতানৈক্য হওয়ায় বারদারা ইতোমধ্যেই হামলার শিকার হয়েছেন।

বারো. হঠাৎ দিল্লি ছুটে গেছেন পাকিস্তানের আইএসআই প্রতিনিধি আফগানিস্তানের সপক্ষে দূতিয়ালি করতে। আন্তর্জাতিক মহল প্রধানমন্ত্রী মোল্লা হাসানকে পাকিস্তান মনোনীত বলেই মনে করছেন।

তেরো. জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ জানিয়েছেন আফগানিস্তানের তালেবানি নতুন সরকারকে স্বীকৃতি না দিতে।

চৌদ্দ. সম্প্রতি একজন তালেবান নেতাকে সেখানকার সাংবাদিকরা নারীর মর্যাদা ও নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে উত্তরে সরাসরি বলেন, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য মুক্তির দাবি মুখরোচক হলেও অর্থহীন। কারণ নারীর প্রধান কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া ও শিশুদের প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। অপর এক প্রশ্নে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন- আশরাফ ঘানির আমলে তো বহুসংখ্যক নারী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, পড়াতেন এবং চাকরিও করতেন। তাহলে এখন অনুরূপ ব্যবস্থায় বাধা কোথায়? উত্তরে তালেবান নেতা বলেন, ওই নারীরা চাকরি করতো নাকি? তারা তো কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে যৌনক্রিয়ায় মত্ত থাকতো; বাস্তবে তাদের বেশ্যা বলে অভিহিত করা উচিত।

পনেরো. ওই সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- নারী সমাজ তো মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, তবু তারা মন্ত্রিসভায় স্থান পাবেন না কেন? এর উত্তরে তালেবানদের পক্ষ থেকে বলা হয়- নারীরা মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ অক্ষম এবং দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি অযোগ্য। তাই মন্ত্রিসভায় নারীর কোন স্থান হবে না।

ষোলো. ক্ষমতায় এসেই তালেবানরা নারীদের জন্য খেলাধুলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়া বলেছে- তাহলে আফগানিস্তানের কোন টিমের সঙ্গেই অস্ট্রেলিয়ার কোনো টিম খেলবে না।

সতেরো. মন্ত্রিসভা গঠনে ১৫ জন সদস্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সবাই পুরুষ। অপরদিকে কাবুল শহরে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সব নাগরিককে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে তালেবানরা। কিন্তু নারীরা মন্ত্রিসভায় স্থান ও তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের দাবিতে তাবৎ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন। তাদের স্লোগান- ‘আমরা সমান অধিকার চাই, সরকারে নারীর স্থান চাই।’

জিয়া নামের এক আফগানি বিক্ষোভকারী মহিলা নেত্রী জানান, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ৪-৫টা গাড়ি এলো আমাদের পেছন পেছন। প্রতিটি গাড়িতে ১০ জন করে তালেবান যোদ্ধা রয়েছেন। এক পর্যায়ে তাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। আঘাত করা হয় চাবুক দিয়ে এবং ব্যাটস দিয়ে মারধর করা হয়।

সারা নামক অপর বিক্ষোভকারী বলেন, আমাদের সবাইকে মারধর করা হয়েছে। আমিও আঘাত পেয়েছি। তারা আমাদের বাড়িতে যেতে বলে। তারা আরও বলে- বাড়িই নারীর জায়গা। তিনি বলেন, মারধরের ভিডিও করতে গেলে তারা হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেয়।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এতিলাতবোজরের খবরে বলা হয়- বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে পেটানো হয়েছে এবং তাদের আটক রাখা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ডব্লিউআইওএন জানিয়েছে, বিক্ষোভ চলতে থাকায় কিছু এলাকায় দুপুর ২টা থেকে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে তালেবান।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের পতন ও তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পেছনে দেশটির সাবেক ক্ষমতাসীন আশরাফ ঘানির সরকারকেই দায়ী করলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক আফগান রাষ্ট্রদূত রয়া রাহমারি। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হলেও বিস্মিত হননি।

[লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

back to top