alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র কি সবার করা গেল

অমিত রায় চৌধুরী

: বুধবার, ০৬ অক্টোবর ২০২১

দেশের জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলে টকশো চলছিল। শিরোনাম ছিল-‘রাষ্ট্র কি সবার করা গেল?’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি জিজ্ঞাসা। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সংকল্প বাস্তবায়নের পথে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি? স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এমন প্রশ্নই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। সামাজিক মনস্তত্ত্ব বা আচরণে কি কোন পরিবর্তন আমাদের নজরে পড়েছে? উত্তর দেয়াও মুশকিল। তবে যে কথা বলা যায়-তা হলো-রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্রমশ অস্পষ্টতা গাঢ় হয়েছে, আচরণে দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠেছে। জনমিতির কাঠামোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর আয়তন ধারাবাহিকভাবে ছোট হয়ে এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। দেখতে হবে-ঐতিহ্যগতভাবে সহনশীল, বহুত্ববাদী একটা সমাজে কেন এমন প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কায়েমি স্বার্থচক্র পরিকল্পিতভাবে সামাজিক জীবনে বিভাজনের পরিসরকে পরিচর্যা করে এসেছে। আগ্রাসী লালসা ও ক্ষমতার প্রশ্রয় সমাজের দুর্বলতর অংশকে ক্রমেই প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। নিপীড়নের যন্ত্র হয়েছে কখনও অর্পিত সম্পত্তি, কখনও সামাজিক মাধ্যমে গুজবের ফাঁদ, কখনও নির্বাচন বা দৃশ্যত কোন কারণ ছাড়াই যে কোন অজুহাত তৈরি করে হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ্য এক ও অভিন্ন-সম্পত্তি দখল ও টার্গেট জনগোষ্ঠীকে ভিটেছাড়া করা।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। দেশ সাড়ম্বরে উদযাপন করছে সুবর্ণজয়ন্তী। নিঃসন্দেহে বলা যায়-অনেক এগিয়েছে দেশ। বৈষয়িক সূচকে। বিশ্বকে অবাকও করেছে। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জন্মলগ্নে দেশটিকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলে কটাক্ষ করেছিল, তারাই আজ বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা-সর্বত্র দেশ আজ প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে। ব্যক্তি বড় হলে তার দায়িত্ব বাড়ে, আত্ম অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। মানব উন্নয়নের সূচকে আমাদের অগ্রগতি কতটা তা ভাবতেই হয়। গণতন্ত্র, সামাজিক বৈষম্য কিংবা স্রেফ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ নির্মাণের প্রশ্নে আমাদের অর্জন কতটা তা বিশ্লেষণ জরুরি। ফলাফলটা সবাইকে একটা ধুসর এলাকায় নিয়ে যায়; যেখানে অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি অথবা ছলনার আনাগোনা স্পষ্ট। সব দল হয়তো গলা চড়িয়ে বলবে-এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলবে-বিশ্ব এটাকে অনুসরণ করুক। মজার ব্যাপার হলো-এমনই দেশে অন-এয়ারে কোন রাজনীতিক অনায়াসেই বিশ্বের সবত্র ধর্মনিরপেক্ষতা দাবি করেন, অথচ নিজের দেশে তা উচ্চারণ করতে তার ঘোর আপত্তি। যুক্তি দেন-সংখ্যার শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা অন্যদের থেকে অবশ্যই আলাদা।

তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বা জনপ্রিয় ধারণাটা কী-সেটা আগে জানা জরুরি। কোন একটা ক্ষুদ্র বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে দেখেশুনে রাখার মাঝেই সৌহার্দ্যরে উপাদান খুঁজে নিতে হবে। সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলো সে কীভাবে ভোগ করবে তা ঠিক করে দেবে গুটিকয়েক ব্যক্তি বা দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এখানে কোন দায় নেই। একই ব্যক্তি অন্য দেশে অসাম্প্রদায়িকতার ভিন্ন চরিত্র দেখতেই আগ্রহী। সবচেয়ে সত্যি কথা, যিনি এখানে স্রেফ মৌলবাদী চিন্তায় জারিত, তার ভাবনা বিশ্বের অন্যত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। যুক্তি দেখানোর সময় কোন লজ্জা তিনি অনুভব করেন না। এটাই আমাদের আদর্শিক দ্বিচারিতা।

দেশের সংবিধানে প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকার ভোগ করবে সব ধর্মের মানুষ। কারো দয়া বা দাক্ষিণ্যের কারণে নয়। একই সঙ্গে এটাও ঠিক-বিশ্বের নানা প্রান্তে কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এক ধরনের মানসিক দৈন্য বা ভীতিতে আক্রান্ত থাকে। কখনও কারণে, কখনও অকারণে। দেখতে হবে-রাষ্ট্রব্যবস্থা সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিধানে কতটা আন্তরিক, সৎ ও সক্ষম। আসলে সত্যি কথা হলো-সংখ্যালঘু বা দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিই সুশাসনের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে।

বাংলাদেশে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা-নির্বাচনপূর্ব বা নির্বাচনোত্তর সহিংসতা; যার অভিমুখ থাকে হিন্দু জনগোষ্ঠী। আর এসব অপরাধ আগাগোড়াই দায়মুক্তি ভোগ করে থাকে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করেও এদেশে এমন সহিংসতা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। মনে রাখতে হবে-এমন সময়ে ধর্মীয় উপাসনালয় বা বিগ্রহ ভাঙচুরের ঘটনা এখন ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। ব্লাসফেমি আইন এখানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে বলেই অভিজ্ঞতা বলে। স্বাধীন দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে নিয়মিতভাবে নানা অজুহাতে। সম্প্রতি নতুন এক উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে ঘৃণা সৃষ্টি করা এবং সহিংসতায় ইন্ধন দেয়া। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিলের ঘোষণা হলেও আইনের অপব্যবহার এখনও চলছে। সংখ্যালঘু নিগ্রহ এমনকি দেশত্যাগের ঘটনাও অব্যাহত। এতবড় অমানবিক, বর্ণবৈষম্যবাদী আইন কীভাবে একটা সভ্য সমাজে এতদিন টিকে থাকতে পারল তা রীতিমতো বিষ্ময়ের।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস্-১৯৬৫’ জারি হয়। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পর্যন্ত তদানীন্তন পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া নাগরিকদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে যেসব নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের আগে ভারতে ছিল এবং সেই তারিখ থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা অস্থায়ীভাবে শত্রু-সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও শত্রু-সম্পত্তির ধারণা বেঁচে থাকল এবং নতুন করে কোন সম্পত্তির অধিগ্রহণ বন্ধ হলেও সত্যিকারের মালিক বা তাদের শরিকদের মাঝে তা ফিরে গেল না। শুধু তাই না, পরিবারের এক শরিক ভারতে গেলে গোটা পরিবারের জমা-জমি, বাড়িঘর জবরদখলের ঝুঁকিতে চলে যায়। আরও মজার ব্যাপার হলো-শুধু হিন্দু নাগরিকেরাই এই আইনি বৈষম্যের শিকার হলো; যা সংবিধানের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১৯৭৪ সালে দ্য ভেস্টেড অ্যান্ড নন-রেসিডেন্ট প্রোপার্টি অ্যাক্ট জারি করে কার্যত শত্রু-সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পতিতে পরিণত করা হয়। মহামান্য হাইকোর্ট এই আইনকে ইতোমধ্যেই বে-আইনি ও মৃত ঘোষণা করেছে। পর্যবেক্ষণে মহামান্য আদালত এই পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক ভুল বলে চিহ্নিত করেছে। এই তারিখের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন সম্পত্তি অর্পিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ১৯৮৪ সালেও নতুন করে আর কোন সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হবে না মর্মে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কার্যত দেখা যায় দেশে বর্তমানে অপির্ত সম্পত্তির তালিকায় ৮০ শতাংশ সম্পত্তি ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পরে তালিকাভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষের কাছ থেকে বে-আইনিভাবে তাদের পূর্বপুরুষ বা শরিকদের সম্পত্তি জোর করে দখল করা হয়েছে। দখলদারদের কোন দল নেই। সবসময় এরা ক্ষমতার পাশে থেকে দুর্বলকে শোষণ করে। দেখা গেছে সব সরকারের আমলেই দখলদাররা দল বদলে শাসকের প্রশ্রয় লাভ করেছে। বিস্ফোরক তথ্য হলো-১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে শহীদ জিসি দেবের পৈতৃক বাড়ি বা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটিও অপির্ত সম্পত্তি নামক কালাকানুনের ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। সেক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয় যে, সাধারণ দুর্বল সংখ্যালঘু জনগণের সম্পত্তি নিয়ে কীভাবে ছেলেখেলা করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার এই দখলদারি রুখতে কোন চেষ্টা করেনি। বাধা দেয়নি। নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি; যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের জন্য একটি আইন পাস করলেও তা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ পায়নি। কেননা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বিএনপি জামায়াত জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। চার দলীয় জোট সরকার একটি সংশোধনী এনে আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেয়। আবারও চাপা পড়ে যায় সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকদের অধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা। সম্পত্তি ফেরত তো দূরে থাক, ’২০০১-র নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভয়াবহ এক সংগঠিত হামলার মুখে দলে দলে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১-তে কিছু সংশোধনীসহ সম্পত্তি প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেয়। অর্পিত সম্পত্তির দাবিদার(মালিক/উত্তরাধিকারী/সহ-উত্তরাধিকারী) সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য আবেদনের সুযোগ পান। ৭৪ হাজার আবেদন ইতোমধ্যে দাখিল হয়েছে বলে জানা যায়; কিন্তু কীভাবে কবে তা নিষ্পত্তি হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য জমা পড়া আবেদনের ৩০ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে ৩ শতাংশ সম্পত্তিও মালিক এখনও বুঝে পায়নি। আরও বিপজ্জনক হলো আইনি প্রক্রিয়া চলাকালে নতুন করে সম্পত্তি বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে; যা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যৌথ পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে কোন ক্ষুদ্র অংশকে কৌশলে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করতে পারলেই ভুক্তভোগী পরিবারের সব সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি সাব্যস্ত করা সহজ হয়ে উঠছে। আর সেই সুযোগেই বাড়ির রান্নাঘর, পুকুর পর্যন্ত দখল করার জন্য হামলে পড়ছে দুর্বৃত্তরা। প্রশ্রয় দিচ্ছে রাষ্ট্রপোষিত ব্যবস্থা। আইনি ফাঁক-ফোকর ব্যবহারে মদত দিচ্ছে ওঁৎ পেতে থাকা মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় ভূমি প্রশাসনের অসৎ একটি চক্র। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে সংখ্যালঘুদের কোন সম্পত্তি আর অর্পিত সম্পত্তির বাইরে থাকবে না। জলের দামে ভিটে-মাটি বিক্রি করে উদ্বাস্তু হওয়া ছাড়া তাদের কোন উপায়ও থাকবে না। যারা এদেশের ভূমিপুত্র, যারা হাজার বছর ধরে এ জলবায়ুতেই বেড়ে উঠেছে, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের এই হয়রানি মানবতারই অপমান।

বৈষম্যহীন সমাজ ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গীকার নিয়েই একাত্তরে এ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড রাষ্ট্রের দর্শনকে রাতারাতি পাল্টে ফেলে। বঙ্গবন্ধুর দল ’৯৬-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে ফেরত আনার চেষ্টা করেছে সত্যি। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গভীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেখান থেকে উত্তরণ সহজ নয়। অর্থনীতির সূচকে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে সর্বগ্রাসী লোভের বিস্তারকে সামাল দেয়া যায়নি। সে সঙ্গেই বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা, অসহিষ্ণুতা ও সংঘবদ্ধ হিংসা প্রবণতা। সাম্প্রতিক সময়ে শাল্লার ঘটনা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ ঘটনা কিন্তু চরিত্রগতভাবে নতুন নয়। বরং সাম্প্রতিক একটি প্যাটার্ন। আগাম ঘোষণা দিয়ে হিন্দু জানমাল বা মন্দিরের ওপর হামলা। বর্তমান সময়ে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান ছাড়া আর কোথাও এ ধরনের বর্বর ঘটনার নজির দেখা যায় না। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া খুলনার শিয়ালী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নাসির নগর, মুরাদ নগর, সাভার, সাঁথিয়া, পার্বতীপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা বা রামুর ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্বলতাকে। দুর্র্বৃত্ত জামিন পায় আর নিরপরাধ জেলে থাকে সুরক্ষার স্বার্থে? আমরা কি ভেবে দেখেছি এই বার্তা কীভাবে পৌঁছাচ্ছে দুর্বৃত্তদের কাছে? দায়মুক্তির এমন অভিজ্ঞতা এদের তো বেপরোয়া করে তুলবে। তাহলে একটি সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখবো কীভাবে? বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার এখনই সময় কিনা ভেবে দেখা দরকার।

[লেখক : অধ্যক্ষ, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র কি সবার করা গেল

অমিত রায় চৌধুরী

বুধবার, ০৬ অক্টোবর ২০২১

দেশের জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলে টকশো চলছিল। শিরোনাম ছিল-‘রাষ্ট্র কি সবার করা গেল?’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি জিজ্ঞাসা। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সংকল্প বাস্তবায়নের পথে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি? স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এমন প্রশ্নই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। সামাজিক মনস্তত্ত্ব বা আচরণে কি কোন পরিবর্তন আমাদের নজরে পড়েছে? উত্তর দেয়াও মুশকিল। তবে যে কথা বলা যায়-তা হলো-রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্রমশ অস্পষ্টতা গাঢ় হয়েছে, আচরণে দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠেছে। জনমিতির কাঠামোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর আয়তন ধারাবাহিকভাবে ছোট হয়ে এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। দেখতে হবে-ঐতিহ্যগতভাবে সহনশীল, বহুত্ববাদী একটা সমাজে কেন এমন প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কায়েমি স্বার্থচক্র পরিকল্পিতভাবে সামাজিক জীবনে বিভাজনের পরিসরকে পরিচর্যা করে এসেছে। আগ্রাসী লালসা ও ক্ষমতার প্রশ্রয় সমাজের দুর্বলতর অংশকে ক্রমেই প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। নিপীড়নের যন্ত্র হয়েছে কখনও অর্পিত সম্পত্তি, কখনও সামাজিক মাধ্যমে গুজবের ফাঁদ, কখনও নির্বাচন বা দৃশ্যত কোন কারণ ছাড়াই যে কোন অজুহাত তৈরি করে হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ্য এক ও অভিন্ন-সম্পত্তি দখল ও টার্গেট জনগোষ্ঠীকে ভিটেছাড়া করা।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। দেশ সাড়ম্বরে উদযাপন করছে সুবর্ণজয়ন্তী। নিঃসন্দেহে বলা যায়-অনেক এগিয়েছে দেশ। বৈষয়িক সূচকে। বিশ্বকে অবাকও করেছে। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জন্মলগ্নে দেশটিকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলে কটাক্ষ করেছিল, তারাই আজ বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা-সর্বত্র দেশ আজ প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে। ব্যক্তি বড় হলে তার দায়িত্ব বাড়ে, আত্ম অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। মানব উন্নয়নের সূচকে আমাদের অগ্রগতি কতটা তা ভাবতেই হয়। গণতন্ত্র, সামাজিক বৈষম্য কিংবা স্রেফ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ নির্মাণের প্রশ্নে আমাদের অর্জন কতটা তা বিশ্লেষণ জরুরি। ফলাফলটা সবাইকে একটা ধুসর এলাকায় নিয়ে যায়; যেখানে অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি অথবা ছলনার আনাগোনা স্পষ্ট। সব দল হয়তো গলা চড়িয়ে বলবে-এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলবে-বিশ্ব এটাকে অনুসরণ করুক। মজার ব্যাপার হলো-এমনই দেশে অন-এয়ারে কোন রাজনীতিক অনায়াসেই বিশ্বের সবত্র ধর্মনিরপেক্ষতা দাবি করেন, অথচ নিজের দেশে তা উচ্চারণ করতে তার ঘোর আপত্তি। যুক্তি দেন-সংখ্যার শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা অন্যদের থেকে অবশ্যই আলাদা।

তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বা জনপ্রিয় ধারণাটা কী-সেটা আগে জানা জরুরি। কোন একটা ক্ষুদ্র বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে দেখেশুনে রাখার মাঝেই সৌহার্দ্যরে উপাদান খুঁজে নিতে হবে। সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলো সে কীভাবে ভোগ করবে তা ঠিক করে দেবে গুটিকয়েক ব্যক্তি বা দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এখানে কোন দায় নেই। একই ব্যক্তি অন্য দেশে অসাম্প্রদায়িকতার ভিন্ন চরিত্র দেখতেই আগ্রহী। সবচেয়ে সত্যি কথা, যিনি এখানে স্রেফ মৌলবাদী চিন্তায় জারিত, তার ভাবনা বিশ্বের অন্যত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। যুক্তি দেখানোর সময় কোন লজ্জা তিনি অনুভব করেন না। এটাই আমাদের আদর্শিক দ্বিচারিতা।

দেশের সংবিধানে প্রতিশ্রুত নাগরিক অধিকার ভোগ করবে সব ধর্মের মানুষ। কারো দয়া বা দাক্ষিণ্যের কারণে নয়। একই সঙ্গে এটাও ঠিক-বিশ্বের নানা প্রান্তে কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এক ধরনের মানসিক দৈন্য বা ভীতিতে আক্রান্ত থাকে। কখনও কারণে, কখনও অকারণে। দেখতে হবে-রাষ্ট্রব্যবস্থা সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিধানে কতটা আন্তরিক, সৎ ও সক্ষম। আসলে সত্যি কথা হলো-সংখ্যালঘু বা দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিই সুশাসনের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে।

বাংলাদেশে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা-নির্বাচনপূর্ব বা নির্বাচনোত্তর সহিংসতা; যার অভিমুখ থাকে হিন্দু জনগোষ্ঠী। আর এসব অপরাধ আগাগোড়াই দায়মুক্তি ভোগ করে থাকে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করেও এদেশে এমন সহিংসতা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। মনে রাখতে হবে-এমন সময়ে ধর্মীয় উপাসনালয় বা বিগ্রহ ভাঙচুরের ঘটনা এখন ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। ব্লাসফেমি আইন এখানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে বলেই অভিজ্ঞতা বলে। স্বাধীন দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে নিয়মিতভাবে নানা অজুহাতে। সম্প্রতি নতুন এক উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে ঘৃণা সৃষ্টি করা এবং সহিংসতায় ইন্ধন দেয়া। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিলের ঘোষণা হলেও আইনের অপব্যবহার এখনও চলছে। সংখ্যালঘু নিগ্রহ এমনকি দেশত্যাগের ঘটনাও অব্যাহত। এতবড় অমানবিক, বর্ণবৈষম্যবাদী আইন কীভাবে একটা সভ্য সমাজে এতদিন টিকে থাকতে পারল তা রীতিমতো বিষ্ময়ের।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস্-১৯৬৫’ জারি হয়। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পর্যন্ত তদানীন্তন পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া নাগরিকদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে যেসব নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের আগে ভারতে ছিল এবং সেই তারিখ থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা অস্থায়ীভাবে শত্রু-সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও শত্রু-সম্পত্তির ধারণা বেঁচে থাকল এবং নতুন করে কোন সম্পত্তির অধিগ্রহণ বন্ধ হলেও সত্যিকারের মালিক বা তাদের শরিকদের মাঝে তা ফিরে গেল না। শুধু তাই না, পরিবারের এক শরিক ভারতে গেলে গোটা পরিবারের জমা-জমি, বাড়িঘর জবরদখলের ঝুঁকিতে চলে যায়। আরও মজার ব্যাপার হলো-শুধু হিন্দু নাগরিকেরাই এই আইনি বৈষম্যের শিকার হলো; যা সংবিধানের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১৯৭৪ সালে দ্য ভেস্টেড অ্যান্ড নন-রেসিডেন্ট প্রোপার্টি অ্যাক্ট জারি করে কার্যত শত্রু-সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পতিতে পরিণত করা হয়। মহামান্য হাইকোর্ট এই আইনকে ইতোমধ্যেই বে-আইনি ও মৃত ঘোষণা করেছে। পর্যবেক্ষণে মহামান্য আদালত এই পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক ভুল বলে চিহ্নিত করেছে। এই তারিখের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন সম্পত্তি অর্পিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ১৯৮৪ সালেও নতুন করে আর কোন সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হবে না মর্মে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কার্যত দেখা যায় দেশে বর্তমানে অপির্ত সম্পত্তির তালিকায় ৮০ শতাংশ সম্পত্তি ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পরে তালিকাভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষের কাছ থেকে বে-আইনিভাবে তাদের পূর্বপুরুষ বা শরিকদের সম্পত্তি জোর করে দখল করা হয়েছে। দখলদারদের কোন দল নেই। সবসময় এরা ক্ষমতার পাশে থেকে দুর্বলকে শোষণ করে। দেখা গেছে সব সরকারের আমলেই দখলদাররা দল বদলে শাসকের প্রশ্রয় লাভ করেছে। বিস্ফোরক তথ্য হলো-১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে শহীদ জিসি দেবের পৈতৃক বাড়ি বা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটিও অপির্ত সম্পত্তি নামক কালাকানুনের ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। সেক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয় যে, সাধারণ দুর্বল সংখ্যালঘু জনগণের সম্পত্তি নিয়ে কীভাবে ছেলেখেলা করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার এই দখলদারি রুখতে কোন চেষ্টা করেনি। বাধা দেয়নি। নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি; যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের জন্য একটি আইন পাস করলেও তা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ পায়নি। কেননা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বিএনপি জামায়াত জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। চার দলীয় জোট সরকার একটি সংশোধনী এনে আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেয়। আবারও চাপা পড়ে যায় সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকদের অধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা। সম্পত্তি ফেরত তো দূরে থাক, ’২০০১-র নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভয়াবহ এক সংগঠিত হামলার মুখে দলে দলে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১-তে কিছু সংশোধনীসহ সম্পত্তি প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেয়। অর্পিত সম্পত্তির দাবিদার(মালিক/উত্তরাধিকারী/সহ-উত্তরাধিকারী) সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য আবেদনের সুযোগ পান। ৭৪ হাজার আবেদন ইতোমধ্যে দাখিল হয়েছে বলে জানা যায়; কিন্তু কীভাবে কবে তা নিষ্পত্তি হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য জমা পড়া আবেদনের ৩০ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে ৩ শতাংশ সম্পত্তিও মালিক এখনও বুঝে পায়নি। আরও বিপজ্জনক হলো আইনি প্রক্রিয়া চলাকালে নতুন করে সম্পত্তি বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে; যা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যৌথ পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে কোন ক্ষুদ্র অংশকে কৌশলে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করতে পারলেই ভুক্তভোগী পরিবারের সব সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি সাব্যস্ত করা সহজ হয়ে উঠছে। আর সেই সুযোগেই বাড়ির রান্নাঘর, পুকুর পর্যন্ত দখল করার জন্য হামলে পড়ছে দুর্বৃত্তরা। প্রশ্রয় দিচ্ছে রাষ্ট্রপোষিত ব্যবস্থা। আইনি ফাঁক-ফোকর ব্যবহারে মদত দিচ্ছে ওঁৎ পেতে থাকা মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় ভূমি প্রশাসনের অসৎ একটি চক্র। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে সংখ্যালঘুদের কোন সম্পত্তি আর অর্পিত সম্পত্তির বাইরে থাকবে না। জলের দামে ভিটে-মাটি বিক্রি করে উদ্বাস্তু হওয়া ছাড়া তাদের কোন উপায়ও থাকবে না। যারা এদেশের ভূমিপুত্র, যারা হাজার বছর ধরে এ জলবায়ুতেই বেড়ে উঠেছে, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের এই হয়রানি মানবতারই অপমান।

বৈষম্যহীন সমাজ ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গীকার নিয়েই একাত্তরে এ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড রাষ্ট্রের দর্শনকে রাতারাতি পাল্টে ফেলে। বঙ্গবন্ধুর দল ’৯৬-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে ফেরত আনার চেষ্টা করেছে সত্যি। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গভীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেখান থেকে উত্তরণ সহজ নয়। অর্থনীতির সূচকে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে সর্বগ্রাসী লোভের বিস্তারকে সামাল দেয়া যায়নি। সে সঙ্গেই বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা, অসহিষ্ণুতা ও সংঘবদ্ধ হিংসা প্রবণতা। সাম্প্রতিক সময়ে শাল্লার ঘটনা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ ঘটনা কিন্তু চরিত্রগতভাবে নতুন নয়। বরং সাম্প্রতিক একটি প্যাটার্ন। আগাম ঘোষণা দিয়ে হিন্দু জানমাল বা মন্দিরের ওপর হামলা। বর্তমান সময়ে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান ছাড়া আর কোথাও এ ধরনের বর্বর ঘটনার নজির দেখা যায় না। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া খুলনার শিয়ালী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নাসির নগর, মুরাদ নগর, সাভার, সাঁথিয়া, পার্বতীপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা বা রামুর ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্বলতাকে। দুর্র্বৃত্ত জামিন পায় আর নিরপরাধ জেলে থাকে সুরক্ষার স্বার্থে? আমরা কি ভেবে দেখেছি এই বার্তা কীভাবে পৌঁছাচ্ছে দুর্বৃত্তদের কাছে? দায়মুক্তির এমন অভিজ্ঞতা এদের তো বেপরোয়া করে তুলবে। তাহলে একটি সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখবো কীভাবে? বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার এখনই সময় কিনা ভেবে দেখা দরকার।

[লেখক : অধ্যক্ষ, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট]

back to top