alt

উপ-সম্পাদকীয়

বেশি মজুরি তত্ত্বে অর্থনীতির নোবেল

শঙ্কর প্রসাদ দে

: শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর ২০২১

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির বক্তব্য হলো, মজুরি বাড়লে শ্রমিক চাকরি হারাবে। এবারের নোবেল পাওয়া তিন অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছেন তথ্য উপাত্ত দিয়ে। ডেভিড কার্ড কানাডীয় বংশোদ্ভূত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গত তিন দশক ধরে তিনি মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ব্রিটেন ও আমেরিকায় যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেটির ওপর গবেষণা করেছেন। ইইউর অন্য দেশগুলো থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা সত্যিই কি ব্রিটিশ নাগরিকদের বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রধান কারণ? দ্বিতীয়ত আমেরিকান শ্রমবাজারের তথ্য সংগ্রহ করে দেখতে চেয়েছেন গোটা পৃথিবী থেকে অভিবাসী শ্রমশক্তি এনে আমেরিকা কি নিজ জনগণের প্রতি অবিচার করছে?

ইইউর অভিবাসী শ্রমিকদের কারণে ব্রিটেনের নাগরিকরা চাকরি পাচ্ছে না, এই বক্তব্য গত দু’দশক ব্রিটেনের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ডেভিট ক্যামেরন ইইউ থেকে বের হতে রাজী ছিলেন না। গণভোটে তার মতো পরাজিত হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন এরপর টেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হলেন এই বলে যে তিনি মাঝামাঝি একটা সমাধান আনতে পারবেন। সেটিও প্রত্যাখ্যাত হলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস ডানসন বললেন, ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করবেনই। তোপের মুখে, টেরিসা মে পদত্যাগ করার পর জনসন সত্যিই ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করে আনলেন।

একই জাতীয় বক্তব্য নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকা আমাদের। গোটা পৃথিবী থেকে আমেরিকায় মানুষ ঢুকতে দেয়ার দরকার নেই। তিনি বিদেশিদের নতুনভাবে নাগরিকত্ব দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শক্তিশালী এই দুটি দেশের রক্ষণশীল এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল অভিবাসী লোকজন ঢুকে পড়ায় দেশের মানুষ চাকরি পায় না। ডেভিড কার্ড তথ্য হাজির করে দেখালেন, অভিবাসী শ্রমিকরা ছোট খাট চাকরিতে ঢোকার ফলে দেশের জনগণ ভালো চাকরিগুলোতে ঢোকার সুযোগ পায়।

উনার মূল বক্তব্য ছিল, শ্রমিকদের বেতন বাড়ালে অনেকে চাকরি হারাবে এটা ভুল কথা। তথ্য হাজির করে বললেন, বেতন বাড়ালে শ্রমিক কাজে আগ্রহী হয়, দক্ষতা বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, মজুরি বাড়ালে শিল্পপতিরা নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের সুযোগ পায়। এতে অর্থনীতি আরও চাঙা হয়। ক্লাসিকাল অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে দেয়া এই তত্ত্বের জন্য ডেভিড কার্ডকে যথাযথ সম্মান দেয়া হয়েছে। বেশি মজুরি ও অভিবাসী শ্রমিকের পর তার তৃতীয় বক্তব্য ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানুষকে বেশি দক্ষ করে না অভিজ্ঞতা বেশি দক্ষ করে। পৃথিবীব্যাপী সরকারগুলো টেকনিক্যাল শিক্ষার ওপর যে হারে গুরুত্ব দিচ্ছে, ডেভিড কার্ডের বক্তব্য এক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য হাজির করেছে। টেকনিক্যাল শিক্ষা ন্যূনতম হলেই যথেষ্ঠ। ন্যূনতম শিক্ষার পর জনশক্তিকে চাকরিতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ৫ বছর লেখাপড়া করে একজন মানুষ যা শেখে, ১ বছর সরাসরি কাজ করে একই লোক অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এই তত্ত্বটি গোটা পৃথিবীর সাধারণ শিক্ষা, টেকনিক্যাল শিক্ষা ও শ্রমবাজারের জন্য একটি যুৎসই নতুন চিন্তা।

ডেভিড কার্ডের এই চিন্তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন, দুই বন্ধু অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্স। এরা অর্থনীতিকে সমাজ বিজ্ঞানের টেবিলে রেখে শ্রমবাজার ব্যাখা করেছেন। হঠাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বিগ্রহ, এথনিক ক্লিঞ্জিংসহ বিভিন্ন কারণে একটি বড় জনগোষ্ঠী যখন অন্য কোন দেশে রিফিউজি হয়, তখন ওই দেশের শ্রমবাজার কেমন হবে? এর ভালো উদাহরণ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। তাদের আমরা রীতিমতো বেড়া দিয়ে আটকিয়ে রেখেছি। মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এদের বসে বসে না খাইয়ে শ্রমবাজারে কি দেয়া যায় না? ফিলিস্তিন, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বাস্তু হওয়া রিফিউজিরা কি আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য বোঝা? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন দুই বন্ধু দুই দশক ধরে। তারা দেখেছেন উদ্বাস্তু শ্রমিকরা উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। দেখা গেছে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণেই কোন দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণে। উদাহরণ তো সামনেই আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগান সংকট সৃষ্টির পেছনে রাশিয়া আমেরিকার অর্থনৈতিক সামরিক দাবা খেলাই মূলত দায়ী। রোহিঙ্গ সংকটতো প্রতিদিন দেখছি আর ভুগছি। অথচ চীন আর ভারত যদি মিয়ানমারকে বলে, রোহিঙ্গাদের আজই নাগরিকত্ব দিয়ে সসম্মানে ফিরিয়ে নাও, তবে দেখবেন কাল থেকে ফেরৎ নেয়া শুরু হয়ে গেছে।

অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্সের বক্তব্য নিতান্তই শ্রমবাজার কেন্দ্রিক। তারা দেখাতে চেয়েছেন, উদ্বাস্তুদের চাকরি দিলে দেশের মানুষ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্সের বক্তব্য নিতান্তই শ্রমবাজার কেন্দ্রিক। তারা দেখাতে চেয়েছেন, উদ্বাস্তুদের চাকরি দিলে দেশের মানুষ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? দুই বন্ধু বলেছেন, এখানে অর্থনীতির চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব বেশি। যখন, একটি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হবে, সে যে দেশেই হাজির হউক, শ্রম বাজারে তাদের ঢুকতে দিতেই হবে।

এরপর দুইবন্ধু উদ্বাস্তুদের স্থাপন করেছেন ডেভিড কার্ডের মজুরি তত্ত্বের ছকে। সোজা কথায় উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দিলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিই কার্যত শক্তিশালী হবে। উদ্বাস্তু শ্রমিক এমন কিছু পরিশ্রমী কাজ করতে রাজি হয় যা নিজ দেশের মানুষ করতে আগ্রহী হয় না। আমি নিজে ইউরোপের যে কটি দেশের হোটেলে ছিলাম, দেখেছি ক্লিনারগুলো সব আফ্রিকা, সিরিয়া, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হওয়া শ্রমিক। দেখেছি রোম আর প্যারিসে আসা বাঙালি আর পাকিস্তানি যুবকদের শতকরা আশি ভাগই ট্যাক্সি চালায়। আমার কয়েকজন বন্ধু আমেরিকায় ট্যাক্সি চালায়। আমেরিকান আর ইউরোপিয়ানদের এখন আর এমন ছোটখাট কাজ ভালো লাগে না। একটি নতুন চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য তিনজনকে যৌথভাবে অর্থনীতির ২০২১ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের সাগরের মাঝখানে বেকার না রেখে কর্মে লাগানোর চিন্তা করার সময় এসেছে। ফেরৎ যখন যাবার যাবে। যদ্দিন এখানে থাকবে তদ্দিন কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, সব্জি চাষ, লবণ চাষ, চিংড়ি ঘের, পশুপালনসহ উৎপাদনমুখী কাজে এদের লাগানো উচিত। এরা কাজ করবে। উৎপাদন করবে, আয় করবে। আমাদের অর্থনীতিরতো তাতে ক্ষতি নেই। জানি না আমাদের নীতি নির্ধারক অর্থনীতিবিদরা ডেভিড কার্ডের বক্তব্যকে আমলে নেবেন কি না?

[লেখক : অর্থশাস্ত্রের প্রাক্তন প্রভাষক,

কাটিরহাট মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বেশি মজুরি তত্ত্বে অর্থনীতির নোবেল

শঙ্কর প্রসাদ দে

শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর ২০২১

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির বক্তব্য হলো, মজুরি বাড়লে শ্রমিক চাকরি হারাবে। এবারের নোবেল পাওয়া তিন অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছেন তথ্য উপাত্ত দিয়ে। ডেভিড কার্ড কানাডীয় বংশোদ্ভূত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গত তিন দশক ধরে তিনি মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ব্রিটেন ও আমেরিকায় যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেটির ওপর গবেষণা করেছেন। ইইউর অন্য দেশগুলো থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা সত্যিই কি ব্রিটিশ নাগরিকদের বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রধান কারণ? দ্বিতীয়ত আমেরিকান শ্রমবাজারের তথ্য সংগ্রহ করে দেখতে চেয়েছেন গোটা পৃথিবী থেকে অভিবাসী শ্রমশক্তি এনে আমেরিকা কি নিজ জনগণের প্রতি অবিচার করছে?

ইইউর অভিবাসী শ্রমিকদের কারণে ব্রিটেনের নাগরিকরা চাকরি পাচ্ছে না, এই বক্তব্য গত দু’দশক ব্রিটেনের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ডেভিট ক্যামেরন ইইউ থেকে বের হতে রাজী ছিলেন না। গণভোটে তার মতো পরাজিত হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন এরপর টেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হলেন এই বলে যে তিনি মাঝামাঝি একটা সমাধান আনতে পারবেন। সেটিও প্রত্যাখ্যাত হলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস ডানসন বললেন, ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করবেনই। তোপের মুখে, টেরিসা মে পদত্যাগ করার পর জনসন সত্যিই ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করে আনলেন।

একই জাতীয় বক্তব্য নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকা আমাদের। গোটা পৃথিবী থেকে আমেরিকায় মানুষ ঢুকতে দেয়ার দরকার নেই। তিনি বিদেশিদের নতুনভাবে নাগরিকত্ব দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শক্তিশালী এই দুটি দেশের রক্ষণশীল এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল অভিবাসী লোকজন ঢুকে পড়ায় দেশের মানুষ চাকরি পায় না। ডেভিড কার্ড তথ্য হাজির করে দেখালেন, অভিবাসী শ্রমিকরা ছোট খাট চাকরিতে ঢোকার ফলে দেশের জনগণ ভালো চাকরিগুলোতে ঢোকার সুযোগ পায়।

উনার মূল বক্তব্য ছিল, শ্রমিকদের বেতন বাড়ালে অনেকে চাকরি হারাবে এটা ভুল কথা। তথ্য হাজির করে বললেন, বেতন বাড়ালে শ্রমিক কাজে আগ্রহী হয়, দক্ষতা বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, মজুরি বাড়ালে শিল্পপতিরা নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের সুযোগ পায়। এতে অর্থনীতি আরও চাঙা হয়। ক্লাসিকাল অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে দেয়া এই তত্ত্বের জন্য ডেভিড কার্ডকে যথাযথ সম্মান দেয়া হয়েছে। বেশি মজুরি ও অভিবাসী শ্রমিকের পর তার তৃতীয় বক্তব্য ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানুষকে বেশি দক্ষ করে না অভিজ্ঞতা বেশি দক্ষ করে। পৃথিবীব্যাপী সরকারগুলো টেকনিক্যাল শিক্ষার ওপর যে হারে গুরুত্ব দিচ্ছে, ডেভিড কার্ডের বক্তব্য এক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য হাজির করেছে। টেকনিক্যাল শিক্ষা ন্যূনতম হলেই যথেষ্ঠ। ন্যূনতম শিক্ষার পর জনশক্তিকে চাকরিতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ৫ বছর লেখাপড়া করে একজন মানুষ যা শেখে, ১ বছর সরাসরি কাজ করে একই লোক অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এই তত্ত্বটি গোটা পৃথিবীর সাধারণ শিক্ষা, টেকনিক্যাল শিক্ষা ও শ্রমবাজারের জন্য একটি যুৎসই নতুন চিন্তা।

ডেভিড কার্ডের এই চিন্তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন, দুই বন্ধু অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্স। এরা অর্থনীতিকে সমাজ বিজ্ঞানের টেবিলে রেখে শ্রমবাজার ব্যাখা করেছেন। হঠাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বিগ্রহ, এথনিক ক্লিঞ্জিংসহ বিভিন্ন কারণে একটি বড় জনগোষ্ঠী যখন অন্য কোন দেশে রিফিউজি হয়, তখন ওই দেশের শ্রমবাজার কেমন হবে? এর ভালো উদাহরণ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। তাদের আমরা রীতিমতো বেড়া দিয়ে আটকিয়ে রেখেছি। মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এদের বসে বসে না খাইয়ে শ্রমবাজারে কি দেয়া যায় না? ফিলিস্তিন, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বাস্তু হওয়া রিফিউজিরা কি আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য বোঝা? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন দুই বন্ধু দুই দশক ধরে। তারা দেখেছেন উদ্বাস্তু শ্রমিকরা উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। দেখা গেছে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণেই কোন দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণে। উদাহরণ তো সামনেই আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগান সংকট সৃষ্টির পেছনে রাশিয়া আমেরিকার অর্থনৈতিক সামরিক দাবা খেলাই মূলত দায়ী। রোহিঙ্গ সংকটতো প্রতিদিন দেখছি আর ভুগছি। অথচ চীন আর ভারত যদি মিয়ানমারকে বলে, রোহিঙ্গাদের আজই নাগরিকত্ব দিয়ে সসম্মানে ফিরিয়ে নাও, তবে দেখবেন কাল থেকে ফেরৎ নেয়া শুরু হয়ে গেছে।

অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্সের বক্তব্য নিতান্তই শ্রমবাজার কেন্দ্রিক। তারা দেখাতে চেয়েছেন, উদ্বাস্তুদের চাকরি দিলে দেশের মানুষ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্সের বক্তব্য নিতান্তই শ্রমবাজার কেন্দ্রিক। তারা দেখাতে চেয়েছেন, উদ্বাস্তুদের চাকরি দিলে দেশের মানুষ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? দুই বন্ধু বলেছেন, এখানে অর্থনীতির চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব বেশি। যখন, একটি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হবে, সে যে দেশেই হাজির হউক, শ্রম বাজারে তাদের ঢুকতে দিতেই হবে।

এরপর দুইবন্ধু উদ্বাস্তুদের স্থাপন করেছেন ডেভিড কার্ডের মজুরি তত্ত্বের ছকে। সোজা কথায় উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দিলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিই কার্যত শক্তিশালী হবে। উদ্বাস্তু শ্রমিক এমন কিছু পরিশ্রমী কাজ করতে রাজি হয় যা নিজ দেশের মানুষ করতে আগ্রহী হয় না। আমি নিজে ইউরোপের যে কটি দেশের হোটেলে ছিলাম, দেখেছি ক্লিনারগুলো সব আফ্রিকা, সিরিয়া, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হওয়া শ্রমিক। দেখেছি রোম আর প্যারিসে আসা বাঙালি আর পাকিস্তানি যুবকদের শতকরা আশি ভাগই ট্যাক্সি চালায়। আমার কয়েকজন বন্ধু আমেরিকায় ট্যাক্সি চালায়। আমেরিকান আর ইউরোপিয়ানদের এখন আর এমন ছোটখাট কাজ ভালো লাগে না। একটি নতুন চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য তিনজনকে যৌথভাবে অর্থনীতির ২০২১ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের সাগরের মাঝখানে বেকার না রেখে কর্মে লাগানোর চিন্তা করার সময় এসেছে। ফেরৎ যখন যাবার যাবে। যদ্দিন এখানে থাকবে তদ্দিন কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, সব্জি চাষ, লবণ চাষ, চিংড়ি ঘের, পশুপালনসহ উৎপাদনমুখী কাজে এদের লাগানো উচিত। এরা কাজ করবে। উৎপাদন করবে, আয় করবে। আমাদের অর্থনীতিরতো তাতে ক্ষতি নেই। জানি না আমাদের নীতি নির্ধারক অর্থনীতিবিদরা ডেভিড কার্ডের বক্তব্যকে আমলে নেবেন কি না?

[লেখক : অর্থশাস্ত্রের প্রাক্তন প্রভাষক,

কাটিরহাট মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম]

back to top