alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্মরণ : একজন সাহসী সম্পাদক

বজলুর রহমান

: মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১
image

আহমদুল কবিরের জীবনাবসানে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে একটি যুগের অবসান ঘটল একথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। ত্রিশ বছরেরও অধিককাল তিনি ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তারও আগে, ১৯৫৪ সাল থেকেই তিনি ছিলেন ‘সংবাদ’-এর প্রাণপুরুষ এবং ঢাকার সংবাদপত্র জগতের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব।

শুধু সংবাদপত্র জগৎ নয়, তাঁর পদচারণা ছিল নানা ক্ষেত্রে। বর্ণাঢ্য ছিল তাঁর জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র, লেখাপড়া শেষ করে যোগ দেন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। শিক্ষানবিশির পর দ্রুতই দায়িত্ব পান ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের উঁচু পদে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। প্রথমে করাচি ও পরে চট্টগ্রামে আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক পদে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে আত্মনিয়োগ করেন ব্যবসায়। পাকিস্তানের প্রথম যুগে যে ক’জন বাঙালি ব্যবসায়ী শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হন তিনি ছিলেন তাদের একজন। এসেন্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ ও বেঙ্গল বেভারেজ কোম্পানির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। আজকের কোকা-কোলা, পেপসির যুগে ভিটা-কোলার কথা হয়তো অনেকের স্মৃতি থেকে নির্বাসিত। পঞ্চাশের দশকের এ সাড়া জাগানো পানীয়টি তৈরি করত এ বেঙ্গল বেভারেজ। প্রথম বাঙালি মালিকানাধীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আইএফআইসি ব্যাংকেরও ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালক। চা বাগানের মালিক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন। জেলের ভেতরে-বাইরে কারও জীবন তখন নিরাপদ ছিল না। তথাপি তিনি আপস করেননি। ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও সংবাদ বের করতে রাজি হননি হানাদারদের সঙ্গিনের নিচে। তৎকালীন পরিবেশে ক’জন মানুষ এ সাহস দেখাতে পারতেন?

এ দেশের বাম গণতান্ত্রিক তথা প্রগতিশীল আন্দোলন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্প্রসারণে তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে যুক্ত হন বামপন্থি ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে। পরবর্তী সময়েও সে সংযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে আপসহীন, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে অবিচল। তার জীবনব্যাপী রাজনৈতিক সাধনায় ও সাধারণ মানুষের কল্যাণই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও রোগজর্জর শরীর নিয়ে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কমিটমেন্টে কোন খাদ ছিল না।

তবু বলব, সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক হিসেবেই যেন তাঁর ভূমিকাটি সবচেয়ে উজ্জ্বল। সে যুগটির চেহারা কেমন ছিল, একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সংবাদ-এ যখন যোগ দিই, তখন দেখেছি ঢাকার সংবাদপত্র জগৎ আলো করে আছেন তিনজন সম্পাদক- ইত্তেফাকে-এর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদ-এর জহুর হোসেন চৌধুরী ও অবজারভার-এর আবদুস সালাম। মওলানা আকরম খাঁ তখনও জীবিত; তবে কিছুটা বয়সের ভারে, অনেকটাই আইয়ুবঘেঁষা নতজানু নীতির দরুন ম্লান। ওই তিন সম্পাদকের পাশে চতুর্থ ব্যক্তি যিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল, তাঁর নাম আহমদুল কবির। বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চেহারা, কথাবার্তায় দারুণ চৌকস- একনজরে দৃষ্টি কাড়ার মতো। অভিজাত পরিবারের সন্তান। উঁচু সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকেছেন, রাজনীতিতে উৎসাহী। ’৫৪ সালে ‘সংবাদ’-এর মালিকানা কিনে নিয়ে এর খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন। মুসলিম লীগের অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে সংবাদ পরিণত হলো উদার, অসাম্প্রদায়িক বাম-গণতান্ত্রিক ধারার মুখপত্রে (কারও কারও মতে হয়তো বা সময়ের তুলনায় একটু বেশিই এগিয়ে থাকা)। যে কথা বলছিলাম, আইয়ুব শাহীর অন্ধকার দিনগুলোতে ইত্তেফাক, সংবাদ ও অবজারভারের সেই দুর্দান্ত জোট পূর্ববাংলায় আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল। রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক শূন্যতা অনেকখানিই পূরণ করে রেখেছিল এ তিনটি জনপ্রিয় পত্রিকা। ঢাকার তিন সংবাদপত্রের এ ব্যতিক্রমী ভূমিকার পেছনে কবির সাহেবেরও ছিল বড় ভূমিকা- কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও বা নেপথ্যে।

ষাটের দশকে রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মী, সুশীল সমাজ সব যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। ’৬২-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর উদ্বোধন। রেহমান সোবহানের ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ছাত্র সমাজের এগারো দফা, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন- এ দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণ। সে এক উন্মাদনাময় কাল ছিল বটে। গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের সংগ্রাম পটভূমি রচনা করল স্বাধীনতা সংগ্রামের। ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অভিষেক হয়েছিল যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের তাই পরিণামে রূপ নিল ইতিহাসের নিয়ামক শক্তির।

আজ সুশীল সমাজের নামে বিদেশি অর্থে এনজিও গড়ে ওঠে। কেউ কেউ একে রাজনীতির পুঁজিও করতে চান; কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের বিবেক গর্জে ওঠে না। বিপরীতে দেখুন ’৬৪-এর ছবি। দাঙ্গার বিরুদ্ধে কেমন সম্মিলিত প্রতিরোধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী দাঙ্গাবিরোধী মিছিল নিয়ে পুরনো ঢাকায় বিপন্ন মানুষের পাশে, মানিক মিয়া কোমরে চাদর প্যাঁচিয়ে বন্দুক হাতে দাঙ্গাকারীদের রুখতে দাঁড়িয়ে গেছেন ইত্তেফাক ভবনের সদর দরজায়। কবির সাহেব তোপখানা রোডে তাঁর ব্যবসায়িক অফিস ছেড়ে দিয়েছেন প্রতিরোধ-কর্মীদের সর্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য। শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতারা আসছেন সেখানে-মিটিং করছেন, কাজের পরিকল্পনা নিচ্ছেন। জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় সাড়া জাগানো অভিন্ন সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। পূর্ববাংলা সেদিন সত্যি রুখে দাঁড়িয়েছিল। গণপ্রতিরোধের মুখে শাসকগোষ্ঠীর দাঙ্গা-অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেল। আইয়ুবশাহীর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের শবাধারেও যেন অলক্ষ্যে পোঁতা হয়ে গেল আরেকটি পেরেক।

আগেই বলেছি, রাজনীতিতে কবির সাহেব বরাবর ছিলেন বাম-সুহৃদ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ওয়ালী খান-গাউস বখশ বেজেঞ্জো-মাহমুদ আলী কাসুরির বন্ধু ও সহকর্মী। কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ, শেষ জীবনে গণতন্ত্রী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ’৬৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ ও স্বাধীনতার পর দু’দফা জাতীয় সংসদের সদস্য। তার চেয়েও বড় কথা বোধহয় তিনি ছিলেন রাজনীতিক ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে যোগসূত্র। সংকট মুহূর্তে তিনি এই দু’শক্তিকে মেলাতেন, উভয়ের কাছেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত।

আহমদুল কবির সাহেব সংবাদ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ’৭২ সালের জানুয়ারিতে; স্বাধীনতার পর ‘সংবাদ’ যখন পুনঃপ্রকাশিত হয় বংশাল রোডের সাবেক ভবনের ভস্মস্তূপের ওপর রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো। সংবাদ চিরকালই ছিল শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে; বিজ্ঞাপন বন্ধ, কালো তালিকাভুক্তি, প্রকাশনা নিষিদ্ধ- কিনা করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সবশেষে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে ছাই করে দিল ‘সংবাদ’ কার্যালয়। মুক্তিযুদ্ধে সংবাদ’-এর দুই শহীদ- শহীদুল্লা কায়সার ও শহীদ সাবের। ‘সংবাদ’-এর মালিক হিসেবে কবির সাহেবও নিগ্রহ-নির্যাতন ভোগ করেছেন বিস্তর। দুর্দান্ত সাহসী ও দৃঢ়চেতা ছিলেন তিনি, মাথা নত করেননি কখনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন। জেলের ভেতরে-বাইরে কারও জীবন তখন নিরাপদ ছিল না। তথাপি তিনি আপস করেননি। ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও সংবাদ বের করতে রাজি হননি হানাদারদের সঙ্গিনের নিচে। তৎকালীন পরিবেশে ক’জন মানুষ এ সাহস দেখাতে পারতেন? (পরিমার্জিত ও পুনঃপ্রকাশিত)

[লেখক : বজলুর রহমান দীর্ঘকাল সংবাদ-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সংবাদ-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্মরণ : একজন সাহসী সম্পাদক

বজলুর রহমান

image

মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১

আহমদুল কবিরের জীবনাবসানে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে একটি যুগের অবসান ঘটল একথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। ত্রিশ বছরেরও অধিককাল তিনি ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তারও আগে, ১৯৫৪ সাল থেকেই তিনি ছিলেন ‘সংবাদ’-এর প্রাণপুরুষ এবং ঢাকার সংবাদপত্র জগতের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব।

শুধু সংবাদপত্র জগৎ নয়, তাঁর পদচারণা ছিল নানা ক্ষেত্রে। বর্ণাঢ্য ছিল তাঁর জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র, লেখাপড়া শেষ করে যোগ দেন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। শিক্ষানবিশির পর দ্রুতই দায়িত্ব পান ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের উঁচু পদে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। প্রথমে করাচি ও পরে চট্টগ্রামে আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক পদে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে আত্মনিয়োগ করেন ব্যবসায়। পাকিস্তানের প্রথম যুগে যে ক’জন বাঙালি ব্যবসায়ী শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হন তিনি ছিলেন তাদের একজন। এসেন্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ ও বেঙ্গল বেভারেজ কোম্পানির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। আজকের কোকা-কোলা, পেপসির যুগে ভিটা-কোলার কথা হয়তো অনেকের স্মৃতি থেকে নির্বাসিত। পঞ্চাশের দশকের এ সাড়া জাগানো পানীয়টি তৈরি করত এ বেঙ্গল বেভারেজ। প্রথম বাঙালি মালিকানাধীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আইএফআইসি ব্যাংকেরও ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালক। চা বাগানের মালিক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন। জেলের ভেতরে-বাইরে কারও জীবন তখন নিরাপদ ছিল না। তথাপি তিনি আপস করেননি। ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও সংবাদ বের করতে রাজি হননি হানাদারদের সঙ্গিনের নিচে। তৎকালীন পরিবেশে ক’জন মানুষ এ সাহস দেখাতে পারতেন?

এ দেশের বাম গণতান্ত্রিক তথা প্রগতিশীল আন্দোলন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্প্রসারণে তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে যুক্ত হন বামপন্থি ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে। পরবর্তী সময়েও সে সংযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে আপসহীন, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে অবিচল। তার জীবনব্যাপী রাজনৈতিক সাধনায় ও সাধারণ মানুষের কল্যাণই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও রোগজর্জর শরীর নিয়ে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কমিটমেন্টে কোন খাদ ছিল না।

তবু বলব, সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক হিসেবেই যেন তাঁর ভূমিকাটি সবচেয়ে উজ্জ্বল। সে যুগটির চেহারা কেমন ছিল, একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সংবাদ-এ যখন যোগ দিই, তখন দেখেছি ঢাকার সংবাদপত্র জগৎ আলো করে আছেন তিনজন সম্পাদক- ইত্তেফাকে-এর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদ-এর জহুর হোসেন চৌধুরী ও অবজারভার-এর আবদুস সালাম। মওলানা আকরম খাঁ তখনও জীবিত; তবে কিছুটা বয়সের ভারে, অনেকটাই আইয়ুবঘেঁষা নতজানু নীতির দরুন ম্লান। ওই তিন সম্পাদকের পাশে চতুর্থ ব্যক্তি যিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল, তাঁর নাম আহমদুল কবির। বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চেহারা, কথাবার্তায় দারুণ চৌকস- একনজরে দৃষ্টি কাড়ার মতো। অভিজাত পরিবারের সন্তান। উঁচু সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকেছেন, রাজনীতিতে উৎসাহী। ’৫৪ সালে ‘সংবাদ’-এর মালিকানা কিনে নিয়ে এর খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন। মুসলিম লীগের অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে সংবাদ পরিণত হলো উদার, অসাম্প্রদায়িক বাম-গণতান্ত্রিক ধারার মুখপত্রে (কারও কারও মতে হয়তো বা সময়ের তুলনায় একটু বেশিই এগিয়ে থাকা)। যে কথা বলছিলাম, আইয়ুব শাহীর অন্ধকার দিনগুলোতে ইত্তেফাক, সংবাদ ও অবজারভারের সেই দুর্দান্ত জোট পূর্ববাংলায় আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল। রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক শূন্যতা অনেকখানিই পূরণ করে রেখেছিল এ তিনটি জনপ্রিয় পত্রিকা। ঢাকার তিন সংবাদপত্রের এ ব্যতিক্রমী ভূমিকার পেছনে কবির সাহেবেরও ছিল বড় ভূমিকা- কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও বা নেপথ্যে।

ষাটের দশকে রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মী, সুশীল সমাজ সব যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। ’৬২-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর উদ্বোধন। রেহমান সোবহানের ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ছাত্র সমাজের এগারো দফা, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন- এ দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণ। সে এক উন্মাদনাময় কাল ছিল বটে। গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের সংগ্রাম পটভূমি রচনা করল স্বাধীনতা সংগ্রামের। ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অভিষেক হয়েছিল যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের তাই পরিণামে রূপ নিল ইতিহাসের নিয়ামক শক্তির।

আজ সুশীল সমাজের নামে বিদেশি অর্থে এনজিও গড়ে ওঠে। কেউ কেউ একে রাজনীতির পুঁজিও করতে চান; কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের বিবেক গর্জে ওঠে না। বিপরীতে দেখুন ’৬৪-এর ছবি। দাঙ্গার বিরুদ্ধে কেমন সম্মিলিত প্রতিরোধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী দাঙ্গাবিরোধী মিছিল নিয়ে পুরনো ঢাকায় বিপন্ন মানুষের পাশে, মানিক মিয়া কোমরে চাদর প্যাঁচিয়ে বন্দুক হাতে দাঙ্গাকারীদের রুখতে দাঁড়িয়ে গেছেন ইত্তেফাক ভবনের সদর দরজায়। কবির সাহেব তোপখানা রোডে তাঁর ব্যবসায়িক অফিস ছেড়ে দিয়েছেন প্রতিরোধ-কর্মীদের সর্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য। শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতারা আসছেন সেখানে-মিটিং করছেন, কাজের পরিকল্পনা নিচ্ছেন। জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় সাড়া জাগানো অভিন্ন সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। পূর্ববাংলা সেদিন সত্যি রুখে দাঁড়িয়েছিল। গণপ্রতিরোধের মুখে শাসকগোষ্ঠীর দাঙ্গা-অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেল। আইয়ুবশাহীর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের শবাধারেও যেন অলক্ষ্যে পোঁতা হয়ে গেল আরেকটি পেরেক।

আগেই বলেছি, রাজনীতিতে কবির সাহেব বরাবর ছিলেন বাম-সুহৃদ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ওয়ালী খান-গাউস বখশ বেজেঞ্জো-মাহমুদ আলী কাসুরির বন্ধু ও সহকর্মী। কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ, শেষ জীবনে গণতন্ত্রী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ’৬৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ ও স্বাধীনতার পর দু’দফা জাতীয় সংসদের সদস্য। তার চেয়েও বড় কথা বোধহয় তিনি ছিলেন রাজনীতিক ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে যোগসূত্র। সংকট মুহূর্তে তিনি এই দু’শক্তিকে মেলাতেন, উভয়ের কাছেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত।

আহমদুল কবির সাহেব সংবাদ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ’৭২ সালের জানুয়ারিতে; স্বাধীনতার পর ‘সংবাদ’ যখন পুনঃপ্রকাশিত হয় বংশাল রোডের সাবেক ভবনের ভস্মস্তূপের ওপর রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো। সংবাদ চিরকালই ছিল শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে; বিজ্ঞাপন বন্ধ, কালো তালিকাভুক্তি, প্রকাশনা নিষিদ্ধ- কিনা করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সবশেষে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে ছাই করে দিল ‘সংবাদ’ কার্যালয়। মুক্তিযুদ্ধে সংবাদ’-এর দুই শহীদ- শহীদুল্লা কায়সার ও শহীদ সাবের। ‘সংবাদ’-এর মালিক হিসেবে কবির সাহেবও নিগ্রহ-নির্যাতন ভোগ করেছেন বিস্তর। দুর্দান্ত সাহসী ও দৃঢ়চেতা ছিলেন তিনি, মাথা নত করেননি কখনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন। জেলের ভেতরে-বাইরে কারও জীবন তখন নিরাপদ ছিল না। তথাপি তিনি আপস করেননি। ভয়-ভীতি ও প্রলোভন সত্ত্বেও সংবাদ বের করতে রাজি হননি হানাদারদের সঙ্গিনের নিচে। তৎকালীন পরিবেশে ক’জন মানুষ এ সাহস দেখাতে পারতেন? (পরিমার্জিত ও পুনঃপ্রকাশিত)

[লেখক : বজলুর রহমান দীর্ঘকাল সংবাদ-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সংবাদ-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ]

back to top