alt

উপ-সম্পাদকীয়

খেলার মাঠে পাকিস্তানপন্থার উল্লাস

মনজুরুল হক

: বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১

করপোরেট ক্যাপিটালিজমে সমাজের প্রত্যেকটি বস্তু এক একটা বিজনেস টুলস। সেই টুলস যে করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র যথেচ্ছা ব্যবহার করে। এই সাধারণ নিয়মেই একসময়কার চিত্ত বিনোদনের খেলাধুলাও এখন নির্ভেজাল বাণিজ্যিক উপকরণ বা ওই করপোরেট বিজনেস টুলস। সেই টুলসগুলোর মধ্যে এই সময়ে সবচেয়ে কার্যকর আর লাভজনক টুলস-ক্রিকেট। বিশেষ করে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ক্রিকেট। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ রাজা-রাজড়ারা প্রমোদবিহারে প্রসাদের বাইরে কয়েকদিন কাটানোর সময় এই খেলাটা আবিষ্কার করে। সে সময় প্রবাদ ছিল-ব্রিটিশ সূর্য কখনও অস্তিমিত হয় না। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ব্রিটিশ কলোনী ছিল সেখানেই ক্রিকেটের চাষবাস হয়েছে। ক্রিকেট খেলা হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশগুলোতে অশিক্ষিত অনাধুনিক প্রজাদের মধ্যে ব্রিটিশ এটিকেট ছড়িয়ে দেয়া। ক্রিকেট দিয়ে এটিকেট? হ্যাঁ, তাই। সাদা পোশাকে ভদ্রস্থ আবহে একজন আম্পায়ারের অঙ্গুলি হেলন বিনা তর্কে মেনে নেয়াই এটিকেট। সে কারণে এক সময় ক্রিকেটকে বলা হতো-ভদ্রলোকের খেলা, যা এখন আর ভদ্রলোকের খেলা নয়। এখন ক্রিকেট মানে মুনাফা লোটা, রাজনৈতিক হাতিয়ার, শোষণের হাতিয়ার, জনগণকে বিবশ রাখা এবং তাদের নিত্যনৈমিত্তিক অভাব-অনটন ভুলিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার।

টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বেলুন চুপসে যাওয়ার পর বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী বোর্ড কর্তাদের চাপান-উতোর চলাকালীন বাংলাদেশে ডেকে আনা হয় পাকিস্তান দলকে। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচে জঘন্য হারের দগদগে ঘায়ে মলমপট্টি দিয়ে নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেয়া। তারা তা পেরেছেনও। প্রথমে প্রাকটিস পিচে পাকিস্তনিদের পতাকা ওড়ানো, পরে গ্যালারিজুড়ে পাকিস্তান সমর্থনকারীদের পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন এবং প্রকাশ্যে হাজার হাজার পাকিস্তান সমর্থকের দাঁপিয়ে বেড়ানো। মিরপুরের মাঠে পর পর দুটি ম্যাচে বাংলাদেশ বাজেভাবে হেরেছে। সেই হার ছাপিয়ে এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-পাকিস্তানি পতাকায় গ্যালারি ছেয়ে যাওয়া এবং বেশুমার পাকিস্তান সমর্থকে গ্যালারি উপচেপড়া। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া সরব। বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি, পাকিস্তান দলের সমর্থক, পাকিস্তান প্রিয় দেশ, এইসব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনও লাখ লাখ মানুষ মনে করে-পাকিস্তান ভাঙা ঠিক হয়নি! এরা কারা তাও দিবালোকের মতো পরিষ্কার।

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের পর হেফাজতে ইসলামের কাউন্টার রিভেঞ্জ হিসাবে শাপলা চত্বর দখলের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি মোটা দাগে ভাগ হয়ে গেছে। এবং নির্দ্বিধায় বলা চলে ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকারী দল একটানা থাকার পরও দুই ভাগের বড় ভাগ দক্ষিণপন্থি তথা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। শাপলা চত্বরে পরাজয়ের পরও হেফাজত কার্যত পরাজিত হয়নি। তারা কৌশল বদলে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ফতোয়াকে বগলের তলে লুকিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে, বিশেষ করে দলনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আপোস করে তাকে ‘কওমি জননী’ খেতাব দিয়ে হাত-পা ধুয়ে সাফ-সুতোর হয়ে যাওয়ার পর থেকে একে একে পাঠ্যপুস্তক ধর্মীয়করণ হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মীয় আচার-আচরণ মহামারির মত ছড়িয়েছে। অফিস-আদালতে ধর্মীয় জজবা চালু হয়েছে, নারীরা বুরখাবন্দি হয়েছে। দিকে দিকে ওয়াজিরা মুক্তমনা, বামমনষ্ক, প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদ্গার করেছে। গ্রামে গ্রামে বাউল, যাত্রাপালা, পালাগান, কবিগান নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্যাংক- বীমা-অফিস-দপ্তরে নামাজ পড়ার জোয়ার এসেছে। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে কুৎসিত কদাকার অশ্রাব্য বিষোদগারের ওয়াজ বাধ্যতামূলক হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো সাংস্কৃতিক কর্মকা- সীমিত হয়েছে। অর্থাৎ গোটা সমাজ তথা দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গলাবাজি ছাড়া আর সব ক্ষেত্রে মৌলবাদ ঝাঁকিয়ে বসেছে। বিস্ময়কর হলো বাংলাদেশের সমাজে যেভাবে অলিখিত ইসলামী আইনের শাসন চলছে তা খোদ সৌদি আরবেও নেই! বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও নেই।

এসবেরই ব্যাকফায়ার আজকের নতুন পাকিস্তানপন্থি প্রজন্ম। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তো বটেই, তা বিশ্বাসও করে না! এরা প্রচন্ড রকম ভারতবিদ্বেষী। অবধারিতভাবে হিন্দুবিদ্বেষী। ফারাক্কার পানি, তিস্তার মরূকরণ, সীমান্তে বিএসএফের হত্যা, অসম বাণিজ্য, কম শুল্কে করিডোর, পেঁয়াজ-গরু বাণিজ্য নিয়ে যতটা যুদ্ধংদেহী এবং তীব্র ভারতবিদ্বেষী বা হিন্দুবিদ্বেষী, ঠিক তার বিপরীত পাকিস্তানের বেলায়। ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না’, ‘ওদের খেলা ভালো লাগে’, ‘খেলাকে খেলার মতো দেখুন’-এর মতো খোঁড়াযুক্তি দিয়ে এরা তাদের তীব্র পাকিপ্রেম জায়েজ করে নিয়েছে। এবং সরকার আর সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন যেমন বিসিবি হাসিমুখে সেসব কিছুতে আসকারা দিয়েছে।

ক্রিকেট মাঠে পতাকা উত্তেলন বা প্রদর্শন মোটেও দোষের কিছু নয়। তবে সেটা কারা করবে? সাধারণত যে দুটি দেশ খেলছে সেই দুটি দেশের দর্শক সমর্থকরা নিজ নিজ দেশের পতাকা প্রদর্শন করে থাকে। গোল বেঁধেছে এখানেই। বাংলাদেশের গ্যালারিতে পাকিস্তান সমর্থক হিসাবে থাকার কথা পাকিস্তান থেকে আসা দর্শক-সমর্থকদের। তারা কি এসেছে? না। আর থাকার কথা পাকিস্তান দূতাবাসের কিছু লোকজন এবং এখানে যদি কোনো পাকিস্তানি চাকরি বা ব্যবসাসূত্রে থাকে তাদেরই পতাকা ওড়ানোর কথা। এখানে তেমনটি হয়নি। বাংলাদেশের নাগরিকরাই পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে পাকিস্তানের জয়ে উল্লাস করেছে। এরাই সেই পাকিজাত প্রজন্ম। যারা গত দুই দশক ধরে নিশ্চিতভাবে বিকোশিত হয়েছে। ক্ষমতাবান হয়েছে এবং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে, যা সাংবিধানিক আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ক্রিকেট মাঠে পতাকা উত্তেলন বা প্রদর্শন মোটেও দোষের কিছু নয়। তবে সেটা কারা করবে?

ক্রিকেট মাঠে শিষ্টাচার প্রদর্শনেও ব্রিটিশরা এগিয়ে। সেটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান সেঞ্চরি করলে কিংবা হ্যাটট্রিক করলে বা ভালো কোনো শট নিলে তাকে উৎসাহ দেয়ার সৌজন্য। ব্রিটেনের শুধু নয়, বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সব দেশেই সেটা দেখা যায়। ভারতীয় বা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করলে লডর্সের গ্যালারির ব্রিটিশ দর্শক দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। এটাই ভদ্র লোকের ক্রিকেট জেশ্চার। আমাদের দেশে তেমনটি নেই। এখানে আছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আর অবজ্ঞা। অথচ পাকিস্তানের বেলাতে ঘটে উল্টোটা। এখানে যেন পাকিস্তানই হোস্ট কান্ট্রি! ক্রিকেট মাঠে পাকিস্তান কেন, সকল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাফল্যে বাংলাদেশি দর্শক উল্লাস করুক। সম্মান জানাক। সেটাই ফেয়ার। অথচ দুঃখজনক হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের, ভারতের বা অস্ট্রেলিয়ার কোন ব্যাটার সেঞ্চুরি করলে এখানে উল্লাস নেই। আমাদের পাকিপ্রেমী দর্শকদের উল্লাস আসলে ক্রিকেটের জন্য নয়, একটা দেশের জন্য। তাদের প্রিয় পাকিস্তানের জন্য। এটা জানা কথা, এই মাঠে ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে বাংলাদেশি দর্শকদের ৯০ ভাগই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। সে না হয় করল, তাই বলে নিজের দেশের সঙ্গে পাকিস্তানকে সমর্থন? তাও আবার গায়ে-গতরে পাকিস্তানি পতাকা এঁকে, পতাকা উড়িয়ে, জয়োধ্বনি দিয়ে? এটা সরাসরি অপরাধ।

এই অপরাধকে আমাদের বোর্ড না দেখার ভান করে ভেতরে ভেতরে পুলক পাচ্ছে, কারণ বোর্ডেও পাকিপন্থিদের জোয়ার। ক্রিকেটাররাও পাকিস্তানকে ‘শত্রু প্রতিপক্ষ’ ভাবে না। এ যেন ‘ভাইয়ে-ভাইয়ে’ চ্যারিটি ম্যাচ! আর এইসব চ্যারিটি টাইপ ম্যাচ দিয়ে খুব নিপুণভাবে বোর্ডকর্তারা তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, অযোগ্যতা, আনাড়িপনা, দলবাজি, পক্ষপাতিত্ব, আর কোটাওয়ারি সুবিধা হাসিলের দগদগে ঘা ঢেকে দিতে চাইছে। পাকিস্তানপন্থিদের পতাকা প্রদর্শন যেন পিওরলি রাজনৈতিক, তেমনি বাংলাদেশ বোর্ডের এসব দুর্নীতি, অযোগ্যতা, আনাড়িপনা, দলবাজি, পক্ষপাতিত্ব রাজনৈতিক। পুরো ব্যাপারটা করপোরেট বিজনেস প্যাকেজের মতো। এর দুষ্টচক্র থেকে বেরুতে না পারলে শুধু ক্রিকেট নয়, সব খেলাধুলা শেষ হয়ে যাবে। ফুটবল তো শেষই। অন্য সবকিছু শেষ হবে। তাই ছুটছাট বদল নয়, পুরো কাঠামো বদলাতে হবে। আর তা যত্র শিগগির সম্ভব।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

খেলার মাঠে পাকিস্তানপন্থার উল্লাস

মনজুরুল হক

বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১

করপোরেট ক্যাপিটালিজমে সমাজের প্রত্যেকটি বস্তু এক একটা বিজনেস টুলস। সেই টুলস যে করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র যথেচ্ছা ব্যবহার করে। এই সাধারণ নিয়মেই একসময়কার চিত্ত বিনোদনের খেলাধুলাও এখন নির্ভেজাল বাণিজ্যিক উপকরণ বা ওই করপোরেট বিজনেস টুলস। সেই টুলসগুলোর মধ্যে এই সময়ে সবচেয়ে কার্যকর আর লাভজনক টুলস-ক্রিকেট। বিশেষ করে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ক্রিকেট। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ রাজা-রাজড়ারা প্রমোদবিহারে প্রসাদের বাইরে কয়েকদিন কাটানোর সময় এই খেলাটা আবিষ্কার করে। সে সময় প্রবাদ ছিল-ব্রিটিশ সূর্য কখনও অস্তিমিত হয় না। অর্থাৎ যেখানে যেখানে ব্রিটিশ কলোনী ছিল সেখানেই ক্রিকেটের চাষবাস হয়েছে। ক্রিকেট খেলা হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশগুলোতে অশিক্ষিত অনাধুনিক প্রজাদের মধ্যে ব্রিটিশ এটিকেট ছড়িয়ে দেয়া। ক্রিকেট দিয়ে এটিকেট? হ্যাঁ, তাই। সাদা পোশাকে ভদ্রস্থ আবহে একজন আম্পায়ারের অঙ্গুলি হেলন বিনা তর্কে মেনে নেয়াই এটিকেট। সে কারণে এক সময় ক্রিকেটকে বলা হতো-ভদ্রলোকের খেলা, যা এখন আর ভদ্রলোকের খেলা নয়। এখন ক্রিকেট মানে মুনাফা লোটা, রাজনৈতিক হাতিয়ার, শোষণের হাতিয়ার, জনগণকে বিবশ রাখা এবং তাদের নিত্যনৈমিত্তিক অভাব-অনটন ভুলিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার।

টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বেলুন চুপসে যাওয়ার পর বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী বোর্ড কর্তাদের চাপান-উতোর চলাকালীন বাংলাদেশে ডেকে আনা হয় পাকিস্তান দলকে। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচে জঘন্য হারের দগদগে ঘায়ে মলমপট্টি দিয়ে নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেয়া। তারা তা পেরেছেনও। প্রথমে প্রাকটিস পিচে পাকিস্তনিদের পতাকা ওড়ানো, পরে গ্যালারিজুড়ে পাকিস্তান সমর্থনকারীদের পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন এবং প্রকাশ্যে হাজার হাজার পাকিস্তান সমর্থকের দাঁপিয়ে বেড়ানো। মিরপুরের মাঠে পর পর দুটি ম্যাচে বাংলাদেশ বাজেভাবে হেরেছে। সেই হার ছাপিয়ে এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-পাকিস্তানি পতাকায় গ্যালারি ছেয়ে যাওয়া এবং বেশুমার পাকিস্তান সমর্থকে গ্যালারি উপচেপড়া। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া সরব। বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি, পাকিস্তান দলের সমর্থক, পাকিস্তান প্রিয় দেশ, এইসব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনও লাখ লাখ মানুষ মনে করে-পাকিস্তান ভাঙা ঠিক হয়নি! এরা কারা তাও দিবালোকের মতো পরিষ্কার।

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের পর হেফাজতে ইসলামের কাউন্টার রিভেঞ্জ হিসাবে শাপলা চত্বর দখলের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি মোটা দাগে ভাগ হয়ে গেছে। এবং নির্দ্বিধায় বলা চলে ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকারী দল একটানা থাকার পরও দুই ভাগের বড় ভাগ দক্ষিণপন্থি তথা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। শাপলা চত্বরে পরাজয়ের পরও হেফাজত কার্যত পরাজিত হয়নি। তারা কৌশল বদলে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ফতোয়াকে বগলের তলে লুকিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে, বিশেষ করে দলনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আপোস করে তাকে ‘কওমি জননী’ খেতাব দিয়ে হাত-পা ধুয়ে সাফ-সুতোর হয়ে যাওয়ার পর থেকে একে একে পাঠ্যপুস্তক ধর্মীয়করণ হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মীয় আচার-আচরণ মহামারির মত ছড়িয়েছে। অফিস-আদালতে ধর্মীয় জজবা চালু হয়েছে, নারীরা বুরখাবন্দি হয়েছে। দিকে দিকে ওয়াজিরা মুক্তমনা, বামমনষ্ক, প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদ্গার করেছে। গ্রামে গ্রামে বাউল, যাত্রাপালা, পালাগান, কবিগান নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্যাংক- বীমা-অফিস-দপ্তরে নামাজ পড়ার জোয়ার এসেছে। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে কুৎসিত কদাকার অশ্রাব্য বিষোদগারের ওয়াজ বাধ্যতামূলক হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো সাংস্কৃতিক কর্মকা- সীমিত হয়েছে। অর্থাৎ গোটা সমাজ তথা দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গলাবাজি ছাড়া আর সব ক্ষেত্রে মৌলবাদ ঝাঁকিয়ে বসেছে। বিস্ময়কর হলো বাংলাদেশের সমাজে যেভাবে অলিখিত ইসলামী আইনের শাসন চলছে তা খোদ সৌদি আরবেও নেই! বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও নেই।

এসবেরই ব্যাকফায়ার আজকের নতুন পাকিস্তানপন্থি প্রজন্ম। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তো বটেই, তা বিশ্বাসও করে না! এরা প্রচন্ড রকম ভারতবিদ্বেষী। অবধারিতভাবে হিন্দুবিদ্বেষী। ফারাক্কার পানি, তিস্তার মরূকরণ, সীমান্তে বিএসএফের হত্যা, অসম বাণিজ্য, কম শুল্কে করিডোর, পেঁয়াজ-গরু বাণিজ্য নিয়ে যতটা যুদ্ধংদেহী এবং তীব্র ভারতবিদ্বেষী বা হিন্দুবিদ্বেষী, ঠিক তার বিপরীত পাকিস্তানের বেলায়। ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না’, ‘ওদের খেলা ভালো লাগে’, ‘খেলাকে খেলার মতো দেখুন’-এর মতো খোঁড়াযুক্তি দিয়ে এরা তাদের তীব্র পাকিপ্রেম জায়েজ করে নিয়েছে। এবং সরকার আর সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন যেমন বিসিবি হাসিমুখে সেসব কিছুতে আসকারা দিয়েছে।

ক্রিকেট মাঠে পতাকা উত্তেলন বা প্রদর্শন মোটেও দোষের কিছু নয়। তবে সেটা কারা করবে? সাধারণত যে দুটি দেশ খেলছে সেই দুটি দেশের দর্শক সমর্থকরা নিজ নিজ দেশের পতাকা প্রদর্শন করে থাকে। গোল বেঁধেছে এখানেই। বাংলাদেশের গ্যালারিতে পাকিস্তান সমর্থক হিসাবে থাকার কথা পাকিস্তান থেকে আসা দর্শক-সমর্থকদের। তারা কি এসেছে? না। আর থাকার কথা পাকিস্তান দূতাবাসের কিছু লোকজন এবং এখানে যদি কোনো পাকিস্তানি চাকরি বা ব্যবসাসূত্রে থাকে তাদেরই পতাকা ওড়ানোর কথা। এখানে তেমনটি হয়নি। বাংলাদেশের নাগরিকরাই পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে পাকিস্তানের জয়ে উল্লাস করেছে। এরাই সেই পাকিজাত প্রজন্ম। যারা গত দুই দশক ধরে নিশ্চিতভাবে বিকোশিত হয়েছে। ক্ষমতাবান হয়েছে এবং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে, যা সাংবিধানিক আইনেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ক্রিকেট মাঠে পতাকা উত্তেলন বা প্রদর্শন মোটেও দোষের কিছু নয়। তবে সেটা কারা করবে?

ক্রিকেট মাঠে শিষ্টাচার প্রদর্শনেও ব্রিটিশরা এগিয়ে। সেটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান সেঞ্চরি করলে কিংবা হ্যাটট্রিক করলে বা ভালো কোনো শট নিলে তাকে উৎসাহ দেয়ার সৌজন্য। ব্রিটেনের শুধু নয়, বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সব দেশেই সেটা দেখা যায়। ভারতীয় বা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করলে লডর্সের গ্যালারির ব্রিটিশ দর্শক দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। এটাই ভদ্র লোকের ক্রিকেট জেশ্চার। আমাদের দেশে তেমনটি নেই। এখানে আছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আর অবজ্ঞা। অথচ পাকিস্তানের বেলাতে ঘটে উল্টোটা। এখানে যেন পাকিস্তানই হোস্ট কান্ট্রি! ক্রিকেট মাঠে পাকিস্তান কেন, সকল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাফল্যে বাংলাদেশি দর্শক উল্লাস করুক। সম্মান জানাক। সেটাই ফেয়ার। অথচ দুঃখজনক হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের, ভারতের বা অস্ট্রেলিয়ার কোন ব্যাটার সেঞ্চুরি করলে এখানে উল্লাস নেই। আমাদের পাকিপ্রেমী দর্শকদের উল্লাস আসলে ক্রিকেটের জন্য নয়, একটা দেশের জন্য। তাদের প্রিয় পাকিস্তানের জন্য। এটা জানা কথা, এই মাঠে ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে বাংলাদেশি দর্শকদের ৯০ ভাগই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। সে না হয় করল, তাই বলে নিজের দেশের সঙ্গে পাকিস্তানকে সমর্থন? তাও আবার গায়ে-গতরে পাকিস্তানি পতাকা এঁকে, পতাকা উড়িয়ে, জয়োধ্বনি দিয়ে? এটা সরাসরি অপরাধ।

এই অপরাধকে আমাদের বোর্ড না দেখার ভান করে ভেতরে ভেতরে পুলক পাচ্ছে, কারণ বোর্ডেও পাকিপন্থিদের জোয়ার। ক্রিকেটাররাও পাকিস্তানকে ‘শত্রু প্রতিপক্ষ’ ভাবে না। এ যেন ‘ভাইয়ে-ভাইয়ে’ চ্যারিটি ম্যাচ! আর এইসব চ্যারিটি টাইপ ম্যাচ দিয়ে খুব নিপুণভাবে বোর্ডকর্তারা তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, অযোগ্যতা, আনাড়িপনা, দলবাজি, পক্ষপাতিত্ব, আর কোটাওয়ারি সুবিধা হাসিলের দগদগে ঘা ঢেকে দিতে চাইছে। পাকিস্তানপন্থিদের পতাকা প্রদর্শন যেন পিওরলি রাজনৈতিক, তেমনি বাংলাদেশ বোর্ডের এসব দুর্নীতি, অযোগ্যতা, আনাড়িপনা, দলবাজি, পক্ষপাতিত্ব রাজনৈতিক। পুরো ব্যাপারটা করপোরেট বিজনেস প্যাকেজের মতো। এর দুষ্টচক্র থেকে বেরুতে না পারলে শুধু ক্রিকেট নয়, সব খেলাধুলা শেষ হয়ে যাবে। ফুটবল তো শেষই। অন্য সবকিছু শেষ হবে। তাই ছুটছাট বদল নয়, পুরো কাঠামো বদলাতে হবে। আর তা যত্র শিগগির সম্ভব।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

back to top