alt

উপ-সম্পাদকীয়

তেল-গ্যাস সংকট : হাত বাড়াতে হবে সমুদ্রে

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

: বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১

গ্যাস সংকট তীব্র হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালেই বাংলাদেশ জ্বালানি গ্যাসের সংকটে পড়তে যাচ্ছে। জ্বালানি গ্যাস বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের মৌলিক উৎস। আর সেই গ্যাস সংকট দেখা দিলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে- এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে গ্যাস মোট জ্বালানির প্রায় ৬৫ শতাংশ ভূমিকা রাখছে। গত ১ জুন পর্যন্ত সরকারিভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে বলা হয়- উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আছে ১১ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ), আর বছরে উত্তোলন হচ্ছে ০১ টিসিএফ।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলেছে, গত এক দশকে এক টিসিএফ গ্যাসও রিজার্ভে যুক্ত হয়নি। এতে দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় বিদেশ থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। অপরদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের রিজার্ভ ০৬ টিসিএফ এবং ২০৩০ সালে ৩ দশমিক ৫ টিসিএফে নেমে আসবে; যা ব্যাপকভাবে এলএনজি আমদানিনির্ভর করে তুলবে। যার ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, যার বিপরীতে দেশীয় (বিদেশি কোম্পানির উৎপাদনসহ) ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানিকৃত ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (এলএনজিসহ) মোট ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে; যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর গ্যাসের দাম বাড়াতে গিয়ে অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে। আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০০ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) এবং ২০৩০ সরবরাহ হবে ৬৫০ বিলিয়ন ঘনফুট। এ সময়ে গ্যাসের চাহিদা হবে প্রায় ২ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট; যা চাহিদার তুলনায় সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট। আর তখন চাহিদা থাকবে ২ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকবে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ২০৩০ সালে চাহিদা হবে ২ হাজার ২২৭ বিলিয়ন ঘনফুট আর সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০৮ বিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকবে ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ওই সময়ে এলএনজি আমদানি করেও চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। সূত্র : এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

এদিকে এনার্জি লেগুলেটরি কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছিল ৫৫০ এমএমসিডিএফডি। তাতে আমদানি ব্যয় হয় বছরে ১১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। কমিশন সূত্রে আরো জানা যায়, ২০২৫ সালে এ খাতে ব্যয় দাঁড়াবে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর ২০৩০ সালে ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। গত দুই দশকে গ্যাস অনুসন্ধান তেমন হয়নি, যার ফলে মজুদ ভান্ডারে নতুন করে গ্যাস যোগ হয়নি। গত ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর গ্যাস উত্তেলান হচ্ছে ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট; যার ফলে অচিরেই মজুদ ভান্ডার শেষ হয়ে যাবে। আর বাড়বে এলএনজি আমদানি নির্ভরতা; যার প্রভাবে বিদ্যুৎ খাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এখনও গ্যাসনির্ভর।

পেট্রোবাংলা এখনও মুনাফায় চলছে। গত ২০২১ সালে গ্যাস বিক্রয় বাবদ আয় ছিল ১ হাজার ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা; যা পরের মাসে বেড়ে ১ হাজার ১১৫ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আয় ছিল ১০ হাজার ৯৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলা গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে গত অর্থবছরে কর অন্তে নিট মুনাফা করে ১ হাজার ৬৫১ কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়েছে ৭ হাজার ৯১৭ কোটি ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পেট্রোবাংলা এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে, আর সরকারকে দিয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা প্রায়।

সরকার গ্যাসে মুনাফা করলেও সংকট মোকাবেলায় এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ছেই। আর এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সরকারকে মোটা অংকের লোকসানও গুনতে হচ্ছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারিভাবে ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়; যাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ধরা হয় ২ হাজার ৮শ কোটি টাকার বেশি। আর জাতীয় বাজেটের আওতায় এলএনজি আমদানি মূল্য পরিশোধ বাবদ পেট্রোবাংলাকে দেয়া হয় ১ হাজার ৪শ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি আমদানিসহ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ বিসিএফ। প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি যাচ্ছে ২ টাকা ২১ পয়সা। এতে ভর্তুকি গুনতে হবে প্রায় ৬ হাজার ৮শ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকি দেয়া হয় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

গ্যাস সংকট মোকাবেলায় এখনই সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদন। যদিও দেশের স্থলভাগে গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান কাজ চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। আর নিজেরাও ৮টি ক্ষেত্রের ৭টিতে গ্যাস উৎপাদন করছে। তাদের দৈনিক উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ৬৯২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। তবে বাপেক্সের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। অভিযোগ তাদের আবিষ্কৃত ক্ষেত্র দেয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকে। তাদের উৎপাদিত গ্যাসের দামও কম দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। বাপেক্সের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, ৮টি গ্যাসফিল্ডের ৫টি গ্যাসক্ষেত্রেও এ স্তর থেকে গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এ স্তরের আরো নিচে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য প্রয়োজন ডিপ ড্রিলিং বা মাটির আরো গভীরে খনন কাজ চালানো। তিনি আরো বলেন, বাপেক্সের রিগগুলো গড়ে ৫ হাজার মিটারে খনন করার সক্ষমতা রয়েছে। ৭ হাজার মিটারের বেশি গভীরতায় খনন করতে হলে নতুন রিগ দরকার; কিন্তু তাদের রিগ সংকট রয়েছে বলেও তিনি জানান।

বর্তমান সরকার সমুদ্র জয় করেছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল সমুদ্র এলাকা। বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে অনেক আগেই। এর মধ্যে অগভীরে আছে ১১টি আর গভীরে আছে ১৫টি ব্লগ। ভারত ও মায়ানমার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তৎপরতা চালাচ্ছে, এমনকি তারা অনেকদূর এগিয়েও গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের তৎপরতা নেই বললেই চলে। সেই ১৯৯৬ সালে অগভীর সমুদ্রে ৯নং ব্লকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে কেয়ার্নস এনার্জি। ১৯৯৮ সালে তারা সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে। ২০১৩ সালে মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষেত্রটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কনোকোফিলিপস ২০০৮ সালে দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। কিন্তু দামের বিতর্কতায় তারা ২০১৪ সালে চলে যায়। এছাড়া বহুজাতিক কোম্পানি কনোকো গভীর সমুদ্রে ডিএস-১২, ১৬ ও ২১ এই তিনটি ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপত্র জমা দিয়েছিল। পরে তারাও চলে যায়। সে যাই হোক- সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের স্থল ও জল ভাগে রয়েছে তেল-গ্যাসের অনেক সম্ভাবনা। বাংলাদেশের স্থল ভাগের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর প্রায় সবটিই ভারত সীমান্ত ঘেঁষে। ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করায় বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে; যার বাস্তব প্রমাণ তিতাসের একটি ক্ষেত্রের একটি অংশের গ্যাস ইতোমধ্যে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে গেছে। তিতাস হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্যাস ক্ষেত্র যেখানে ৪ টিসিএফের বেশি গ্যাসের মজুদ পাওয়া গিয়েছিল। সিলেটের হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেখানে উত্তোলনযোগ্য মজুদ ছিল শূন্য দশমিক ১৬৬ টিসিএফ; যার মাত্র অর্ধেক উত্তোলন করা হয়েছিল।

আমাদের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম আরো জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়ছে। আমাদের সামনে বড় সংকট অপেক্ষা করছে। শুধু এলএনজি আমদানিনির্ভর করে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া কতটুকুই বা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে? জ্বালানি সংকটে যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে না পড়ে সেই বিষয়ে এখনই সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

তেল-গ্যাস সংকট : হাত বাড়াতে হবে সমুদ্রে

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১

গ্যাস সংকট তীব্র হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালেই বাংলাদেশ জ্বালানি গ্যাসের সংকটে পড়তে যাচ্ছে। জ্বালানি গ্যাস বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের মৌলিক উৎস। আর সেই গ্যাস সংকট দেখা দিলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে- এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে গ্যাস মোট জ্বালানির প্রায় ৬৫ শতাংশ ভূমিকা রাখছে। গত ১ জুন পর্যন্ত সরকারিভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে বলা হয়- উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ আছে ১১ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ), আর বছরে উত্তোলন হচ্ছে ০১ টিসিএফ।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলেছে, গত এক দশকে এক টিসিএফ গ্যাসও রিজার্ভে যুক্ত হয়নি। এতে দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় বিদেশ থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। অপরদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের রিজার্ভ ০৬ টিসিএফ এবং ২০৩০ সালে ৩ দশমিক ৫ টিসিএফে নেমে আসবে; যা ব্যাপকভাবে এলএনজি আমদানিনির্ভর করে তুলবে। যার ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, যার বিপরীতে দেশীয় (বিদেশি কোম্পানির উৎপাদনসহ) ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানিকৃত ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (এলএনজিসহ) মোট ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে; যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

গ্যাসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর গ্যাসের দাম বাড়াতে গিয়ে অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে। আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০০ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) এবং ২০৩০ সরবরাহ হবে ৬৫০ বিলিয়ন ঘনফুট। এ সময়ে গ্যাসের চাহিদা হবে প্রায় ২ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট; যা চাহিদার তুলনায় সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুট। আর তখন চাহিদা থাকবে ২ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকবে ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ২০৩০ সালে চাহিদা হবে ২ হাজার ২২৭ বিলিয়ন ঘনফুট আর সরবরাহ হবে ১ হাজার ৩০৮ বিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকবে ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট। ওই সময়ে এলএনজি আমদানি করেও চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। সূত্র : এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

এদিকে এনার্জি লেগুলেটরি কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছিল ৫৫০ এমএমসিডিএফডি। তাতে আমদানি ব্যয় হয় বছরে ১১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। কমিশন সূত্রে আরো জানা যায়, ২০২৫ সালে এ খাতে ব্যয় দাঁড়াবে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর ২০৩০ সালে ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। গত দুই দশকে গ্যাস অনুসন্ধান তেমন হয়নি, যার ফলে মজুদ ভান্ডারে নতুন করে গ্যাস যোগ হয়নি। গত ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর গ্যাস উত্তেলান হচ্ছে ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট; যার ফলে অচিরেই মজুদ ভান্ডার শেষ হয়ে যাবে। আর বাড়বে এলএনজি আমদানি নির্ভরতা; যার প্রভাবে বিদ্যুৎ খাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এখনও গ্যাসনির্ভর।

পেট্রোবাংলা এখনও মুনাফায় চলছে। গত ২০২১ সালে গ্যাস বিক্রয় বাবদ আয় ছিল ১ হাজার ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা; যা পরের মাসে বেড়ে ১ হাজার ১১৫ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আয় ছিল ১০ হাজার ৯৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলা গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে গত অর্থবছরে কর অন্তে নিট মুনাফা করে ১ হাজার ৬৫১ কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়েছে ৭ হাজার ৯১৭ কোটি ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পেট্রোবাংলা এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে, আর সরকারকে দিয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা প্রায়।

সরকার গ্যাসে মুনাফা করলেও সংকট মোকাবেলায় এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ছেই। আর এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সরকারকে মোটা অংকের লোকসানও গুনতে হচ্ছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারিভাবে ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়; যাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ধরা হয় ২ হাজার ৮শ কোটি টাকার বেশি। আর জাতীয় বাজেটের আওতায় এলএনজি আমদানি মূল্য পরিশোধ বাবদ পেট্রোবাংলাকে দেয়া হয় ১ হাজার ৪শ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি আমদানিসহ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ বিসিএফ। প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি যাচ্ছে ২ টাকা ২১ পয়সা। এতে ভর্তুকি গুনতে হবে প্রায় ৬ হাজার ৮শ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকি দেয়া হয় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

গ্যাস সংকট মোকাবেলায় এখনই সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদন। যদিও দেশের স্থলভাগে গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান কাজ চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। আর নিজেরাও ৮টি ক্ষেত্রের ৭টিতে গ্যাস উৎপাদন করছে। তাদের দৈনিক উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ৬৯২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। তবে বাপেক্সের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। অভিযোগ তাদের আবিষ্কৃত ক্ষেত্র দেয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকে। তাদের উৎপাদিত গ্যাসের দামও কম দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। বাপেক্সের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, ৮টি গ্যাসফিল্ডের ৫টি গ্যাসক্ষেত্রেও এ স্তর থেকে গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এ স্তরের আরো নিচে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য প্রয়োজন ডিপ ড্রিলিং বা মাটির আরো গভীরে খনন কাজ চালানো। তিনি আরো বলেন, বাপেক্সের রিগগুলো গড়ে ৫ হাজার মিটারে খনন করার সক্ষমতা রয়েছে। ৭ হাজার মিটারের বেশি গভীরতায় খনন করতে হলে নতুন রিগ দরকার; কিন্তু তাদের রিগ সংকট রয়েছে বলেও তিনি জানান।

বর্তমান সরকার সমুদ্র জয় করেছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল সমুদ্র এলাকা। বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে অনেক আগেই। এর মধ্যে অগভীরে আছে ১১টি আর গভীরে আছে ১৫টি ব্লগ। ভারত ও মায়ানমার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তৎপরতা চালাচ্ছে, এমনকি তারা অনেকদূর এগিয়েও গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের তৎপরতা নেই বললেই চলে। সেই ১৯৯৬ সালে অগভীর সমুদ্রে ৯নং ব্লকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে কেয়ার্নস এনার্জি। ১৯৯৮ সালে তারা সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে। ২০১৩ সালে মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষেত্রটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কনোকোফিলিপস ২০০৮ সালে দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। কিন্তু দামের বিতর্কতায় তারা ২০১৪ সালে চলে যায়। এছাড়া বহুজাতিক কোম্পানি কনোকো গভীর সমুদ্রে ডিএস-১২, ১৬ ও ২১ এই তিনটি ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপত্র জমা দিয়েছিল। পরে তারাও চলে যায়। সে যাই হোক- সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের স্থল ও জল ভাগে রয়েছে তেল-গ্যাসের অনেক সম্ভাবনা। বাংলাদেশের স্থল ভাগের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর প্রায় সবটিই ভারত সীমান্ত ঘেঁষে। ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করায় বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে; যার বাস্তব প্রমাণ তিতাসের একটি ক্ষেত্রের একটি অংশের গ্যাস ইতোমধ্যে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে গেছে। তিতাস হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্যাস ক্ষেত্র যেখানে ৪ টিসিএফের বেশি গ্যাসের মজুদ পাওয়া গিয়েছিল। সিলেটের হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রটি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেখানে উত্তোলনযোগ্য মজুদ ছিল শূন্য দশমিক ১৬৬ টিসিএফ; যার মাত্র অর্ধেক উত্তোলন করা হয়েছিল।

আমাদের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম আরো জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়ছে। আমাদের সামনে বড় সংকট অপেক্ষা করছে। শুধু এলএনজি আমদানিনির্ভর করে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া কতটুকুই বা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে? জ্বালানি সংকটে যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে না পড়ে সেই বিষয়ে এখনই সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]

back to top