অনুবাদ ও সঙ্কলন : কামাল রাহমান
কবি জেব-উন-নিশা
বন্দিনী এক রাজকন্যার প্রেমাশ্রু
মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব-দুহিতা শাহজাদি জেব-উন-নিশা (১৬৩৯-১৬৮৯) ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, দানশীল ও ধর্মাচারী। তাঁর জননী, ইরানের বিখ্যাত সাফাভি রাজবংশের কন্যা দিলরুশ বানু বেগম।
শিল্পসাহিত্যের প্রতি মুগল রাজবংশের অনুরাগ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এই মহিয়সী নারী জেব-উন-নিশা। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন উচ্চমানের কবি। ফার্সি ও তুর্কি, দু’ভাষাতেই কবিতা রচনা করতেন তিনি। কবিতা নির্মাণের নতুন এক শৈলীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবর। বাবরপুত্র মির্জা কামরানও ছিলেন কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। সম্রাট আকবরের জীবনে কাব্য-চর্”ার সুযোগ যদিও আসেনি কিন্তু শিল্পসাহিত্যের গুণীজনেরা তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করে রাখতেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর স্মৃতিকথা নিজেই রচনা করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানও তাঁর ভ্রমণলিপি ও আইন বইয়ের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন। মোগলদের এই সাহিত্যপ্রেম ভারতবর্ষের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত প্রবহমান ছিল। আওরঙ্গজেব ছিলেন কট্টর সুন্নি। কাব্যচর্চ্চার দিকে না গেলেও আইন বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। তাঁর রচিত পত্রাবলির রয়েছে উচ্চ সাহিত্যমূল্য।
সাত বছর বয়সে জেব-উন-নিশা কোরান মুখস্থ করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল সুললিত। অনেকটা রূপকথার মতো ছিল তাঁর জীবন। মোগল রাজবংশের পারিবারিক কাহিনী অনেকটা ধোঁয়াশা। সম্ভবত ব্যর্থ কটা প্রেম এসেছিল তাঁর জীবনে। কিন্তু কবিতায় সে-সবের স্বাক্ষর রাখা তাঁর জন্য ছিল আত্মহননের শামিল। ওগুলোকে তিনি আড়াল করেছিলেন পারস্যের দুই কিংবদন্তি, জামশেদ ও কায়কাউসের ছদ্মাবরণে। মোগলদের পারিবারিক রীতিনীতি অথবা কঠোর ধর্ম-শৃঙ্খল এড়িয়ে প্রকৃত প্রেমিকদের নামোচ্চারণ তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কারণ মোগলদের রাজ্য লিপ্সা মিটাতে তাদের পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খানের আইন ‘যাসা’ ত্যাগ করে আরবদের কট্টর শরিয়া আইন ততদিনে নিয়ে নিয়েছিল তাঁর উত্তরসূরিরা।
জেব-উন-নিশার সব গজল ও রুবাই সুফি ভাবধারায় রচিত। দারা শিকোর পুত্র সুলেইমান শিকোর সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। কিন্তু আওরঙ্গজেব ওটা হতে দেননি। দারা শিকো ছিলেন শিয়া ও উদারপন্থি।
তুর্কিস্তানের মেয়েদের পোশাক অনুসরণ করে ও ভারতবর্ষের জলবাতাস উপযোগী করে আঙ্গিয়া-কুর্তির প্রচলন করেছিলেন জেব-উন-নিশা। ওটার ডিজাইনার ছিলেন তিনি। বর্তমানে জনপ্রিয় সালোয়ার-কামিজ এসেছে ওটা থেকে। লাহোর বাগিচা ও দিল্লির অনেক বাগবাগিচার নক্সাকার ও নির্মাতা ছিলেন তিনি।
এই মহিয়সী নারীর জীবনের শেষ বিশ বছর কাটে কট্টর আওরঙ্গজেবের কারা-প্রাসাদের অন্তরালে। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে এই বিদুষী নারীর দেহাবসান ঘটে।
প্রায় পাঁচ হাজার পঙ্ক্তি রচনা করেছিলেন জেব-উন-নিশা। ১৭২৪ সালে, তাঁর মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ বছর পর, ভারত ও পারস্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু গজল ও রুবাই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। ওগুলো থেকে চারশ’ বিশটি রুবাই ও গজল নিয়ে সঙ্কলিত হয়েছিল ‘দিওয়ান-ই-মাখফি’ নামের কবিতা-সঙ্কলনটি। এটা এখন দুষ্প্রাপ্য।
উইজডম অব দ্য ইস্ট??? সিরিজের ‘দ্য দিওয়ান অব জেব-উন-নিসা’ বইটি হতে প্রথম পঞ্চাশটি গজল ফার্সি থেকে অনুবাদ ও সঙ্কলন করেছিলেন মাগন লাল ও জেসি ডানকান ওয়েস্টব্রুক। ১৯১৩ সনে ওটা প্রকাশ করেছিল লন্ডনের নর্থব্রুক সোসাইটি। যৌথভাবে বইটা সম্পাদনা করেছিলেন এল ক্র্যানমার-বিং ও এস এ কাপাডিয়া। এ বইটাও এখন আর পাওয়া যায় না। গবেষণা ও একাডেমিক প্রয়োজনে ওটার ফটোকপি সংগ্রহ করা হয়তো সম্ভব হতে পারে।
জেব-উন-নিশা নিজেকে ‘মাখফি’ নামে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই কলম-নামের অর্থ: ‘লুকিয়ে যে-জন।’ মাখফির পঞ্চাশটি গজল অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি মুদ্রণ করা হলো। পাঠকের আগহ থাকলে ও পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে পঞ্চাশটি রুবাই অনুবাদেরও ইচ্ছে রয়েছে। সুইন্ডন, ইংল্যান্ড, গ্রীষ্ম, ২০২৪।
গজল : ১
শুরু করি তোমার নামে, যার করুণা
ঝরে ওই মেঘ হতে, দেখি যাকে আমি আমার বাগানের
গোলাপকলিটির মতো!
শুরু করি তোমার ভালোবাসার স্তুতি দিয়ে
উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক আমার এ কবিতাগ্রন্থটি অপার মহিমায় তোমার।
তৃষ্ণার্ত এ হৃদয়,
আমার শরীর ও আত্মা, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য
মনসুরের মতো এক দিওয়ানা; মাটির ঢেলা আমার এ শরীর,
সশব্দে ঝঙ্কার তোলে ওরা। এর ধূলিকণাগুলো তোমারই অংশ, তুমি হলে পূর্ণ,
আমার এ শরীর অংশত ওই পূর্ণতা, তোমারই অন্তর্গত ওটা।
তোমার ভালোবাসায়
মুখর ঢেউগুলো মহাপ্লাবনের নৌকোটির উপর আছড়ে পড়ে,
মৃত্যুশীতলতায় জড়ানো ওগুলো, এমনকি নবি নূহও ভাসিয়ে রাখতে
পারবে না তোমার ভালোবাসায় নিমজ্জমান ওই নৌকোটি
যদি না তুমি ওপরে উঠিয়ে আনো ওটাকে।
দাসেদের মতো
আনুগত্যে আমার প্রতি বয়ে যাবে অন্ধকারের
ঐ কালো শক্তি;
তোমাকে প্রশংসার একটা শব্দও যদি গ্রহণ করো তুমি
নিজেকে তবে বাদশা সুলাইমান ভেবে নেব আমি।
চোখের কোণে টলটলায়মান অশ্রুর
ঐ ধারাটি আর বইবে না তখন
যেমন করে আমার কণ্ঠ হতে ঝরে পড়বে না আর কোনো বিলাপ,
আমার হৃদয় হতে শুষে নেয়া হয়েছে
চুনিলাল রক্তের ফোঁটাগুলো
মুক্তোর মতো জড়িয়ে থাকবে ওগুলো আমার চোখের পাপড়িতে।
ধারণ করো আমাকে
হে মাখফি, অনুভব করো আমাকে তোমার ব্যথার স্থৈর্য নিয়ে,
অন্তহীন ওটা, ছেড়ে দাও রাত্রিগুলো;
তোমার অনুরাগের প্রহরগুলোয় খিজির এসে যেন
উপনীত না হয়, দোলা-দেয়া
এক আনন্দ-বসন্ত নিয়ে।
গজল : ২
নশ্বর ও অনুপম সবকিছু সৃষ্টি করেছে যে,
এবং যার কৃপাধন্য হয়ে বেঁচে আছি আমরা,
অনির্বাণ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকো হে তুমি,
সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রেখো ঐ আশার প্রদীপটি আমাদের মাঝে।
জলধারার মতো আলোড়ন তোলে তোমার করুণা
বয়ে যায় ওটা আমাদের ভেতর দিয়ে।
উপর থেকে সবকিছুই দেখ তুমি,
করুণা করো তুমি মাহমুদকে, এবং তার সবকিছুকে।
হোক না কেন ওটা মক্কার পবিত্র প্রার্থনাগৃহে
অথবা ঐসব মন্দিরপ্রাঙ্গণে, যেখানে রয়েছে পুণ্যার্থীদের পদচিহ্ন,
তোমার সকল সৃজন সর্বদা আমারই জন্য প্রভু,
যেখানেই পূজিত হও না কেন, তুমি আমারই প্রভু।
সূর্যোদয়ের সময়, আমার অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাসে অভিবাদন জানাব আমি তোমাকে,
এবং আমার হৃদয়ে প্রজ¦লিত পবিত্র অগ্নি হতে
উঠে আসবে একটা নিঃশ্বাস
আমার প্রত্যাশা-মুকুর ঘষে উজ্জ্বল করে নিতে।
দাও আমাকে তোমার অশ্রুগুলো, হে মাখফি, প্রবাহিত হতে দাও ওগুলো
মুষলধারা বৃষ্টিজলে, আমার জ্বলন্ত হৃদয়-আধারে,
এত তপ্ত এটার ব্যথা!
প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের পর আমি বুকের ভেতর নিই ঐ শিখাগুলোর দহন।
গজল : ৩
হে পয়গাম্বর, পৃথিবী জুড়ে
ছড়ানো তোমার আত্মা- উছলিত তোমার জয়ধ্বজা,
দেখো, কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তোমার বিশ্বাস
সুদূর ইরান পর্যন্ত, ঐ বেদুইন আরবদের হাত ধরে।
তোমার ঠোঁটজোড়া খুলে যায়
সদ্যফোটা এক গোলাপকলির মতো, এবং ওখান হতে বয়ে যায়
তোমার প্রজ্ঞার শব্দগুলো, এখনো যা জানে না মনুষ্যপুত্রেরা,
কিন্তু বাগানের ভেতর পাখিরা আবার গায় তোমার স্বর্গের শব্দগুলো।
ধারণ করি আমি তোমার সৌন্দর্য, আনন্দচিত্তে।
অন্য কোনো সত্যের প্রতিকৃতি কখনো
আমার ভেতর তৈরি করে নি তোমার যৌবনের মতো সুষমা,
প্রলোভিত করে এটা আমাকে
¤্রয়িমাণ না হওয়া পর্যন্ত আত্ম-অস্বীকৃতির পথ ছেড়ে যাব না আমি
অপার ধৈর্য ধরে থাকব আমি,
এবং অনুসরণ করব তোমাকে যেখানে নিয়ে যায় তোমার পবিত্র পদযুগল।
কিন্তু কীভাবে আমার
স্বপ্ন-লালিত আনন্দগুলো অস্বীকার করবে আমার দুর্বল হৃদয়,
অথবা, তারও বেশি,
আমার পুঞ্জিভূত দুঃখগুলো কী উৎপন্ন করতে পারি আমি,
হৃদয়ে রক্তক্ষরণের জন্য
যেখানে নিষ্ঠুর ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত করেছে ওটা? তাকাও তুমি এবং দেখো
কোথা হতে আমার ক্ষতগুলো অবিরত বইয়ে দেয় এক লাল বন্যা;
তবু তো ফোটে সুগন্ধি ফুল, আমার রক্ত হতে,
এবং প্রতিটি কাঁটা,
ক্ষতবিক্ষত করে আমার ঘুরে বেড়ানো পা-দুটো,
অতঃপর ওগুলো বদলে যায় এক গোলাপে।
হে মাখফি, যদি কাবার রক্ষক বন্ধ করে দেয়
ওটার দরোজা তোমার প্রতি,
কোনো অভিযোগ নেই আমার, তোমার অধিকারে, এমনকি তার চেয়েও
পবিত্র জায়গা যদি থাকে;
ভালোবেসে মুখ ফেরাব সেদিকে,
ভ্রূর ধনুক তোমার কাবাঘরের দরোজার খিলান থেকেও বেশি সুন্দর
বেঁকে যাবে তোমার হৃদয়।
নিজেই খিলান হয়ে স্বাগত জানাবে তোমার বন্ধুদের।
গজল : ৪
উন্মুখ হৃদয় আমার বিদ্ধ হয় এক নগ্নতার অনুশোচনায়
প্রলম্বিত এলোমেলো বাতাস যখন বয়ে আনে আমার ভেতর
এটার ডানায় তোমার উপস্থিতির সৌগন্ধ।
এবং এভাবে অপেক্ষা করি আমি আমার বিষাদরাত্রিগুলোয়,
যে-পর্যন্ত না আমার আহত দৃষ্টির ভেতর তুমি ছড়িয়ে দাও
সৌন্দর্য তোমার, আমার উন্মুখ চোখে আনন্দ-প্রশান্তি দেয়ার জন্য।
শান্তিধর্মের ভেতর দিয়ে অন্ধকার পৃথিবী দেখে আলোর নিশানা,
নিরাপদে হেঁটে যায়, অনুসরণ করে এটার কানুনগুলো,
ঈশ্বরের কাছে নত হয়ে আশা করে পবিত্র সম্ভ্রম।
ঈশ্বরের প্রতি, যিনি ক্ষমা করেন পাপীদের, এবং পরিচালনা করেন,
নিজেকে নির্দেশ্য তিনি, তথাপি যিনি পাঠ করতে পারেন
গোপনে লুকিয়ে রাখা অন্তর-কথা এবং উপলব্ধি করতে পারেন ওটার প্রয়োজনীয়তা।
হে পয়গাম্বর, জ্বলজ্বলে একটি মাত্র রত্নের মতো
সুন্দরতম স্বর্গের সর্বোচ্চ উষ্ণীষ,
তাকিয়ে দেখো, মানুষের প্রয়োজনের প্রতি এবং মিনতি জানাও ওদের জন্য।
তোমার শিল্প মুখোশ যার মধ্য দিয়ে আলো উজ্জ্বল হয়ে প্রতিফলিত হয়,
নাহ্, তুমি নিজেই এক বিশেষ স্বর্গীয় আলোকবর্তিকা
কখনো উপেক্ষা করে না কাউকে তোমার ঐ উজ্জ্বল চোখদুটো।
অনুবাদ ও সঙ্কলন : কামাল রাহমান
কবি জেব-উন-নিশা
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
বন্দিনী এক রাজকন্যার প্রেমাশ্রু
মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব-দুহিতা শাহজাদি জেব-উন-নিশা (১৬৩৯-১৬৮৯) ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, দানশীল ও ধর্মাচারী। তাঁর জননী, ইরানের বিখ্যাত সাফাভি রাজবংশের কন্যা দিলরুশ বানু বেগম।
শিল্পসাহিত্যের প্রতি মুগল রাজবংশের অনুরাগ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এই মহিয়সী নারী জেব-উন-নিশা। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন উচ্চমানের কবি। ফার্সি ও তুর্কি, দু’ভাষাতেই কবিতা রচনা করতেন তিনি। কবিতা নির্মাণের নতুন এক শৈলীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবর। বাবরপুত্র মির্জা কামরানও ছিলেন কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। সম্রাট আকবরের জীবনে কাব্য-চর্”ার সুযোগ যদিও আসেনি কিন্তু শিল্পসাহিত্যের গুণীজনেরা তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করে রাখতেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর স্মৃতিকথা নিজেই রচনা করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানও তাঁর ভ্রমণলিপি ও আইন বইয়ের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন। মোগলদের এই সাহিত্যপ্রেম ভারতবর্ষের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত প্রবহমান ছিল। আওরঙ্গজেব ছিলেন কট্টর সুন্নি। কাব্যচর্চ্চার দিকে না গেলেও আইন বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। তাঁর রচিত পত্রাবলির রয়েছে উচ্চ সাহিত্যমূল্য।
সাত বছর বয়সে জেব-উন-নিশা কোরান মুখস্থ করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল সুললিত। অনেকটা রূপকথার মতো ছিল তাঁর জীবন। মোগল রাজবংশের পারিবারিক কাহিনী অনেকটা ধোঁয়াশা। সম্ভবত ব্যর্থ কটা প্রেম এসেছিল তাঁর জীবনে। কিন্তু কবিতায় সে-সবের স্বাক্ষর রাখা তাঁর জন্য ছিল আত্মহননের শামিল। ওগুলোকে তিনি আড়াল করেছিলেন পারস্যের দুই কিংবদন্তি, জামশেদ ও কায়কাউসের ছদ্মাবরণে। মোগলদের পারিবারিক রীতিনীতি অথবা কঠোর ধর্ম-শৃঙ্খল এড়িয়ে প্রকৃত প্রেমিকদের নামোচ্চারণ তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কারণ মোগলদের রাজ্য লিপ্সা মিটাতে তাদের পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খানের আইন ‘যাসা’ ত্যাগ করে আরবদের কট্টর শরিয়া আইন ততদিনে নিয়ে নিয়েছিল তাঁর উত্তরসূরিরা।
জেব-উন-নিশার সব গজল ও রুবাই সুফি ভাবধারায় রচিত। দারা শিকোর পুত্র সুলেইমান শিকোর সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। কিন্তু আওরঙ্গজেব ওটা হতে দেননি। দারা শিকো ছিলেন শিয়া ও উদারপন্থি।
তুর্কিস্তানের মেয়েদের পোশাক অনুসরণ করে ও ভারতবর্ষের জলবাতাস উপযোগী করে আঙ্গিয়া-কুর্তির প্রচলন করেছিলেন জেব-উন-নিশা। ওটার ডিজাইনার ছিলেন তিনি। বর্তমানে জনপ্রিয় সালোয়ার-কামিজ এসেছে ওটা থেকে। লাহোর বাগিচা ও দিল্লির অনেক বাগবাগিচার নক্সাকার ও নির্মাতা ছিলেন তিনি।
এই মহিয়সী নারীর জীবনের শেষ বিশ বছর কাটে কট্টর আওরঙ্গজেবের কারা-প্রাসাদের অন্তরালে। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে এই বিদুষী নারীর দেহাবসান ঘটে।
প্রায় পাঁচ হাজার পঙ্ক্তি রচনা করেছিলেন জেব-উন-নিশা। ১৭২৪ সালে, তাঁর মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ বছর পর, ভারত ও পারস্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু গজল ও রুবাই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। ওগুলো থেকে চারশ’ বিশটি রুবাই ও গজল নিয়ে সঙ্কলিত হয়েছিল ‘দিওয়ান-ই-মাখফি’ নামের কবিতা-সঙ্কলনটি। এটা এখন দুষ্প্রাপ্য।
উইজডম অব দ্য ইস্ট??? সিরিজের ‘দ্য দিওয়ান অব জেব-উন-নিসা’ বইটি হতে প্রথম পঞ্চাশটি গজল ফার্সি থেকে অনুবাদ ও সঙ্কলন করেছিলেন মাগন লাল ও জেসি ডানকান ওয়েস্টব্রুক। ১৯১৩ সনে ওটা প্রকাশ করেছিল লন্ডনের নর্থব্রুক সোসাইটি। যৌথভাবে বইটা সম্পাদনা করেছিলেন এল ক্র্যানমার-বিং ও এস এ কাপাডিয়া। এ বইটাও এখন আর পাওয়া যায় না। গবেষণা ও একাডেমিক প্রয়োজনে ওটার ফটোকপি সংগ্রহ করা হয়তো সম্ভব হতে পারে।
জেব-উন-নিশা নিজেকে ‘মাখফি’ নামে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই কলম-নামের অর্থ: ‘লুকিয়ে যে-জন।’ মাখফির পঞ্চাশটি গজল অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি মুদ্রণ করা হলো। পাঠকের আগহ থাকলে ও পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে পঞ্চাশটি রুবাই অনুবাদেরও ইচ্ছে রয়েছে। সুইন্ডন, ইংল্যান্ড, গ্রীষ্ম, ২০২৪।
গজল : ১
শুরু করি তোমার নামে, যার করুণা
ঝরে ওই মেঘ হতে, দেখি যাকে আমি আমার বাগানের
গোলাপকলিটির মতো!
শুরু করি তোমার ভালোবাসার স্তুতি দিয়ে
উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক আমার এ কবিতাগ্রন্থটি অপার মহিমায় তোমার।
তৃষ্ণার্ত এ হৃদয়,
আমার শরীর ও আত্মা, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য
মনসুরের মতো এক দিওয়ানা; মাটির ঢেলা আমার এ শরীর,
সশব্দে ঝঙ্কার তোলে ওরা। এর ধূলিকণাগুলো তোমারই অংশ, তুমি হলে পূর্ণ,
আমার এ শরীর অংশত ওই পূর্ণতা, তোমারই অন্তর্গত ওটা।
তোমার ভালোবাসায়
মুখর ঢেউগুলো মহাপ্লাবনের নৌকোটির উপর আছড়ে পড়ে,
মৃত্যুশীতলতায় জড়ানো ওগুলো, এমনকি নবি নূহও ভাসিয়ে রাখতে
পারবে না তোমার ভালোবাসায় নিমজ্জমান ওই নৌকোটি
যদি না তুমি ওপরে উঠিয়ে আনো ওটাকে।
দাসেদের মতো
আনুগত্যে আমার প্রতি বয়ে যাবে অন্ধকারের
ঐ কালো শক্তি;
তোমাকে প্রশংসার একটা শব্দও যদি গ্রহণ করো তুমি
নিজেকে তবে বাদশা সুলাইমান ভেবে নেব আমি।
চোখের কোণে টলটলায়মান অশ্রুর
ঐ ধারাটি আর বইবে না তখন
যেমন করে আমার কণ্ঠ হতে ঝরে পড়বে না আর কোনো বিলাপ,
আমার হৃদয় হতে শুষে নেয়া হয়েছে
চুনিলাল রক্তের ফোঁটাগুলো
মুক্তোর মতো জড়িয়ে থাকবে ওগুলো আমার চোখের পাপড়িতে।
ধারণ করো আমাকে
হে মাখফি, অনুভব করো আমাকে তোমার ব্যথার স্থৈর্য নিয়ে,
অন্তহীন ওটা, ছেড়ে দাও রাত্রিগুলো;
তোমার অনুরাগের প্রহরগুলোয় খিজির এসে যেন
উপনীত না হয়, দোলা-দেয়া
এক আনন্দ-বসন্ত নিয়ে।
গজল : ২
নশ্বর ও অনুপম সবকিছু সৃষ্টি করেছে যে,
এবং যার কৃপাধন্য হয়ে বেঁচে আছি আমরা,
অনির্বাণ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকো হে তুমি,
সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রেখো ঐ আশার প্রদীপটি আমাদের মাঝে।
জলধারার মতো আলোড়ন তোলে তোমার করুণা
বয়ে যায় ওটা আমাদের ভেতর দিয়ে।
উপর থেকে সবকিছুই দেখ তুমি,
করুণা করো তুমি মাহমুদকে, এবং তার সবকিছুকে।
হোক না কেন ওটা মক্কার পবিত্র প্রার্থনাগৃহে
অথবা ঐসব মন্দিরপ্রাঙ্গণে, যেখানে রয়েছে পুণ্যার্থীদের পদচিহ্ন,
তোমার সকল সৃজন সর্বদা আমারই জন্য প্রভু,
যেখানেই পূজিত হও না কেন, তুমি আমারই প্রভু।
সূর্যোদয়ের সময়, আমার অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাসে অভিবাদন জানাব আমি তোমাকে,
এবং আমার হৃদয়ে প্রজ¦লিত পবিত্র অগ্নি হতে
উঠে আসবে একটা নিঃশ্বাস
আমার প্রত্যাশা-মুকুর ঘষে উজ্জ্বল করে নিতে।
দাও আমাকে তোমার অশ্রুগুলো, হে মাখফি, প্রবাহিত হতে দাও ওগুলো
মুষলধারা বৃষ্টিজলে, আমার জ্বলন্ত হৃদয়-আধারে,
এত তপ্ত এটার ব্যথা!
প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের পর আমি বুকের ভেতর নিই ঐ শিখাগুলোর দহন।
গজল : ৩
হে পয়গাম্বর, পৃথিবী জুড়ে
ছড়ানো তোমার আত্মা- উছলিত তোমার জয়ধ্বজা,
দেখো, কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তোমার বিশ্বাস
সুদূর ইরান পর্যন্ত, ঐ বেদুইন আরবদের হাত ধরে।
তোমার ঠোঁটজোড়া খুলে যায়
সদ্যফোটা এক গোলাপকলির মতো, এবং ওখান হতে বয়ে যায়
তোমার প্রজ্ঞার শব্দগুলো, এখনো যা জানে না মনুষ্যপুত্রেরা,
কিন্তু বাগানের ভেতর পাখিরা আবার গায় তোমার স্বর্গের শব্দগুলো।
ধারণ করি আমি তোমার সৌন্দর্য, আনন্দচিত্তে।
অন্য কোনো সত্যের প্রতিকৃতি কখনো
আমার ভেতর তৈরি করে নি তোমার যৌবনের মতো সুষমা,
প্রলোভিত করে এটা আমাকে
¤্রয়িমাণ না হওয়া পর্যন্ত আত্ম-অস্বীকৃতির পথ ছেড়ে যাব না আমি
অপার ধৈর্য ধরে থাকব আমি,
এবং অনুসরণ করব তোমাকে যেখানে নিয়ে যায় তোমার পবিত্র পদযুগল।
কিন্তু কীভাবে আমার
স্বপ্ন-লালিত আনন্দগুলো অস্বীকার করবে আমার দুর্বল হৃদয়,
অথবা, তারও বেশি,
আমার পুঞ্জিভূত দুঃখগুলো কী উৎপন্ন করতে পারি আমি,
হৃদয়ে রক্তক্ষরণের জন্য
যেখানে নিষ্ঠুর ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত করেছে ওটা? তাকাও তুমি এবং দেখো
কোথা হতে আমার ক্ষতগুলো অবিরত বইয়ে দেয় এক লাল বন্যা;
তবু তো ফোটে সুগন্ধি ফুল, আমার রক্ত হতে,
এবং প্রতিটি কাঁটা,
ক্ষতবিক্ষত করে আমার ঘুরে বেড়ানো পা-দুটো,
অতঃপর ওগুলো বদলে যায় এক গোলাপে।
হে মাখফি, যদি কাবার রক্ষক বন্ধ করে দেয়
ওটার দরোজা তোমার প্রতি,
কোনো অভিযোগ নেই আমার, তোমার অধিকারে, এমনকি তার চেয়েও
পবিত্র জায়গা যদি থাকে;
ভালোবেসে মুখ ফেরাব সেদিকে,
ভ্রূর ধনুক তোমার কাবাঘরের দরোজার খিলান থেকেও বেশি সুন্দর
বেঁকে যাবে তোমার হৃদয়।
নিজেই খিলান হয়ে স্বাগত জানাবে তোমার বন্ধুদের।
গজল : ৪
উন্মুখ হৃদয় আমার বিদ্ধ হয় এক নগ্নতার অনুশোচনায়
প্রলম্বিত এলোমেলো বাতাস যখন বয়ে আনে আমার ভেতর
এটার ডানায় তোমার উপস্থিতির সৌগন্ধ।
এবং এভাবে অপেক্ষা করি আমি আমার বিষাদরাত্রিগুলোয়,
যে-পর্যন্ত না আমার আহত দৃষ্টির ভেতর তুমি ছড়িয়ে দাও
সৌন্দর্য তোমার, আমার উন্মুখ চোখে আনন্দ-প্রশান্তি দেয়ার জন্য।
শান্তিধর্মের ভেতর দিয়ে অন্ধকার পৃথিবী দেখে আলোর নিশানা,
নিরাপদে হেঁটে যায়, অনুসরণ করে এটার কানুনগুলো,
ঈশ্বরের কাছে নত হয়ে আশা করে পবিত্র সম্ভ্রম।
ঈশ্বরের প্রতি, যিনি ক্ষমা করেন পাপীদের, এবং পরিচালনা করেন,
নিজেকে নির্দেশ্য তিনি, তথাপি যিনি পাঠ করতে পারেন
গোপনে লুকিয়ে রাখা অন্তর-কথা এবং উপলব্ধি করতে পারেন ওটার প্রয়োজনীয়তা।
হে পয়গাম্বর, জ্বলজ্বলে একটি মাত্র রত্নের মতো
সুন্দরতম স্বর্গের সর্বোচ্চ উষ্ণীষ,
তাকিয়ে দেখো, মানুষের প্রয়োজনের প্রতি এবং মিনতি জানাও ওদের জন্য।
তোমার শিল্প মুখোশ যার মধ্য দিয়ে আলো উজ্জ্বল হয়ে প্রতিফলিত হয়,
নাহ্, তুমি নিজেই এক বিশেষ স্বর্গীয় আলোকবর্তিকা
কখনো উপেক্ষা করে না কাউকে তোমার ঐ উজ্জ্বল চোখদুটো।