কামরুল ইসলাম
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৪.
ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান এবং প্রেসিডেন্ট অব দ্য বোর্ড অব কন্ট্রোল স্যার চার্লস উডের ১৮৫৪ সালের শিক্ষা সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবনাগুলো সেসময়ের জন্য খুবই যুগান্তকারী ছিল এবং আজও এই সময়ের বাস্তবতায়ও সেগুলিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা যেন উল্টো পথেই চলছি বলেই আমার মনে হয়েছে। তিনি যেমন নারী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন, তেমনি প্রাইমারি শিক্ষা মাতৃভাষায় হবে, এব্যাপারেও মত দিয়েছিলেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে নিজের ভাষা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই শিক্ষাদান পরিচালনার কথা বলেছিলেন। ওই সময়ে ভারতবর্ষে শিক্ষার যে সংস্কার হয়েছিল, তা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। নারী শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্বকে আমরা সব সময়ই স্বাগত জানিয়েছি। তবে সর্বাগ্রে নিজের ভাষাটা ভালোভাবে শেখার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবার সুযোগ নেই।
In 1854 Charles Wood had sent the Wood’s Despatch to the Governor-General Lord Dalhousie, and it primarily dealt with educational reforms. And this creates a huge change in the education policy of the British. Its main motto is to separate the education department. All the Universities were set up at Presidency towns of Bombay, Calcutta, and Madras. Wood had suggested different opinions towards education departments like primary school must adopt the vernacular language, high schools must adopt Anglo-vernacular language and at the college level, English should be the medium of education. Different kinds of institutions were set up like the Universities of Madras in 1857, Universities of Calcutta, Universities of Bombay, Universities of Punjab in 1882, and Universities of Allahabad in 1887. By this educational reform, at least one government school will be opened in every district. Indian natives should be given training in their mother tongue. The education of women should be highlighted. The government supports women’s education. Teacher’s training and promotion at all levels. English education should be promoted. Wood’s Despatch made the government realize the importance of education for people.( Wikipedia)
‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেন-
‘যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন বাংলাশিক্ষার রাস্তা খুলিয়া যায় তবে তখন এই বঙ্গসাহিত্য পরিষদের দিন আসিবে। এখন রাস্তা নাই তাই সে হোঁচট খাইতে খাইতে চলে,...জার্মানিতে ফ্রান্সে আমেরিকায় যে সকল আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় জাগিয়া উঠিয়াছে তাদের মুল উদ্দেশ্য সমস্ত দেশের চিত্তকে মানুষ করা।... দেশের এই মনকে মানুষ করা কোনোমতেই পরের ভাষায় সম্ভবপর নহে। আমরা লাভ করিব, কিন্তু সে লাভ আমাদের ভাষাকে পূর্ণ করিবে না, আমরা চিন্তা করিব কিন্তু সে চিন্তার বাহিরে আমাদের ভাষা পড়িয়া থাকিবে, আমাদের মন বাড়িয়া চলিবে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাষা বাড়িতে থাকিবে না, সমস্ত শিক্ষাকে অকৃতার্থ করিবার এমন উপায় আর কী হইতে পারে। (কালান্তর)।
উল্লেখ্য, সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় শিক্ষাদানের কোনো সুযোগ ছিল না। বাংলা ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই ভালোবাসা এবং হিন্দু-মুসলিম মিলনের যে আকাক্সক্ষা- এই ভালোবাসা ও আকাক্সক্ষার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বীজ।
আহমদ ছফা লিখেছেন- ‘আমাদের আনন্দ আমাদের গৌরব রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে মানুষের উপযোগী ভাষা হিসেবে রূপায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা মানুষ হবার প্রেরণা পাই’।’ (আহমদ ছফা রচনানাবলী-১, পৃ ১২৫)
এমনকি রবীন্দ্রনাথ এ-ও লিখেছেন যে, ‘পিতৃদেবের শাসনে তখনকার দিনেও আমাদের পরিবারে পরস্পর পত্র লেখা প্রভৃতি ব্যাপারে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অপমানজনক বলে গণ্য হত।’ ১২৯৯-এর ২৯ কার্তিক থেকে ১৬ অগ্রহায়ণ পর্যন্ত প্রায় ১৮ দিন রবীন্দ্রনাথ রাজশাহীতে ছিলেন। (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাধ রাজশাহী কলেজে ‘শিক্ষার হেরফের’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ওইদিন সভাপতিত্ব করেছিলেন নাটোরের জমিদার জগদীন্দ্রনাথ রায়। অক্ষয়কুমার মৈত্র, লোকেন পালিত, প্রমথ চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন সেদিন আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মূলত রাজশাহীতে এসেছিলেন বন্ধু লোকেন পালিতের আমন্ত্রণে। তিনি তখন রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট। রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেদিন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবিষয়ে লেখেন-
‘দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার ওপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে, এবং সেই শিক্ষার গভীরতা ও স্থায়িত্বের ওপর যদি উন্নতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে, তবে মাতৃভাষা ছাড়া যে আর কোনো গতি নাই একথা কেহ না বুঝিলে হাল ছাড়িয়া দিতে হয়। রাজা কত আসিতেছে, কত যাইতেছে; পাঠান গেল, মোগল গেল, ইংরেজ আসিল আবার কালক্রমে ইংরেজও যাইবে, কিন্তু ভাষা সেই বাংলাই চলিয়া আসিতেছে এবং বাংলাই চলিবে। (কালান্তর)
ভাষা যে নদীর ¯্রােতের মতো তা আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছেই শুনেছি। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের শুরুটা রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে হয়ে উঠতে হয়েছে তার চিরকালের দ্বন্দ্বে-সংগ্রামে এবং সে তার ভাষিক আয়োজনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে। ব্রাত্যজনের এই ভাষাকে যিনি আকণ্ঠ দরদে সম্মানিত করেছেন দেশে ও বিদেশে, সেই রবীন্দ্রনাথকেও নানাভাবে দ্বন্দ্বে-সংগ্রামেই হয়ে উঠতে হয়েছে। সরবে নীরবে নিন্দিত হয়েছেন, নন্দিত হয়েছেন মহাগৌরবে; এবং রবীন্দ্রমানসসঞ্জাত যে উষ্ণপ্রবাহ বাঙালির সমন্বিত মানসচেতনায় সংক্রমিত, তা কোনোকালেই কেউ শত-সহস্র আঘাতেও ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে সাহসী হবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাঙালির বিকাশমান জাতিসত্তার প্রোজ্জ্বল অহংকারকেই অস্বীকার করা হয়।
বাঙালির সংস্কৃতি, ভাষার বৈচিত্র্য এবং জীবনধারায় যে স্বাতন্ত্র্য রয়েছে তা তাকে অন্যের থেকে আলাদা করেছে। ভাবের মধ্যে তার মন উড়– উড়– থাকে। তবে কোনো অশুভশক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও তার সময় লাগে না, সে আবেগে চলে যতোটা, ততোটা যুক্তিতে নয়, আর ভুল করার এবং ভুলে যাবারও খুব মানানসই স্বভাব রয়েছে তার।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের বড় রকমের সাংস্কৃতিক আশ্রয়। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তার অবদান অসামান্য।
বাঙালির প্রেরণার উৎস যে রবীন্দ্রনাথ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা ভালোভাবেই জানতো এবং যে কারণে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এদেশের প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এর বিরোধিতা করে। তবে বেশকিছু লেখক বুদ্ধিজীবী সরকারের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিল
এরও আগে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালেও সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে এইসব বুদ্ধিজীবীরা বিরোধিতায় নেমেছিল। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সেদিন এদেশের অনেক শিল্পী-কবি-বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিল সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও।
গোলাম মুরশিদের সাথে আমরা এবিষয়ে একমত যে,
‘তা সত্ত্বেও সরকারি বাধা-নিষেধের মুখে বাঙালিরা স্বতঃর্স্ফূতভাবে এ উৎসব (১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্র্ষিকী) পালন করেন। পালন করেন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে। কেবল ঢাকা অথবা বড়ো শহরে নয়,মফস্বলেও বহু জায়গায় এ উৎসব পালিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ততোদিনে হিন্দু কবি নন, তাঁদের নিজেদের- বাঙালি কবি’তে পরিণত হয়েছিলেন। বস্তুত, দুই বাংলার মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক ভাতৃত্ববোধসৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিয়ানা এবং অসাম্প্রদায়িকতার জোয়ার এসেছিল।’ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস, পৃ. ৫৬)
আবুজাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন:
‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপক চর্চা প্রকৃতপক্ষে বাংলার সমন্বিত শাশ্বত মানবিক সংস্কৃতির সেবা এবং তাকে উত্তরোত্তর বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত করার অত্যাবশ্যক দায়িত্ব পালন। সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্কট পৃথিবীর সর্বত্রই কখনও কখনও দেখা দেয়। সে সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে খুঁজতে হবে।’ (রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের বার্ষিক পত্রিকা ‘সঙ্গীত সংস্কৃতি’-১৯৮৪)।
সন্জীদা খাতুন লিখেছেন-
‘রবীন্দ্রসংগীত উপলব্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কাছে আমি ঋণী। এ দেশের সাংস্কৃতিক জীবনে যত পীড়ন এসেছে ততই নব উৎসাহে রবীন্দ্রসংগীতের কাছে সরে এসেছি আমরা। বিচিত্র বিরূপ ব্যবহার রবীন্দ্রসংগীতকে উত্তরোত্তর অন্তরঙ্গ করে তুলেছে। তাই রবীন্দ্রসংগীত হয়েছে আমাদের নিশ্চিত আশ্রয়।’ (রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ)
নীরোদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন-
‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ রবীন্দ্রনাথের যে গানটিতে ভাষাবদ্ধ হইয়া, সমস্ত বাঙালীর কাছে মায়ের মূর্তিতে দেখা দিয়া ভালোবাসা ও ভক্তিতে পূর্ণ বাঙালীপ্রাণের জাতীয় সঙ্গীতের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, সেটি ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলিকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ সভায় গাওয়া হইয়াছিল। উহা অবশ্য, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। উহার শেষ চরণটি ছাড়া আগেকার চব্বিশটি চরণে রাজনৈতিক ভাবের ছোঁয়াচও নাই। শুধু সেই চরণটিতে বঙ্গমাতার ভূষণের জন্য বিলাতি জিনিস না কিনিবার প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত সন্তর্পণে দেওয়া হইয়াছিল। উহার জন্যই ১৯০৬ সন হইতে আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজায় দেবীর মুকুটে, বক্ষে, বা বাহুতে রাংতা ইত্যাদির আভরণ আর দেখিলাম না, সবই রং-করা মাটির হইল।’ (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ১০৫-৬)।
একদিন বাংলাদেশ যদি পুরোটাই আরবান এলাকায় রূপান্তরিত হয়, রবীন্দ্রনাথের এই গানের (আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি) মধ্যে তার শ্যামল-সৌন্দর্য, পল্লীর মাঠ-ঘাট, আ¤্রকানন, খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গানটি যখনই শুনি, দেখি, পুরো দেশটাই মাতৃমূর্তি রূপে সামনে এসে পড়ে। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুযারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই এই গানটির প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার লিখেছেন-
‘বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র আজ সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়ে বিশ্বের জাতিগুলির মধ্যে আসন নিয়েছে প্রথম জীবনে পদ্মায় বোটে করে ভেসে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথ এই দেশের স্বরূপ দেখেছিলেন। তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে বাংলাদেশের মনোহরণ মূর্তি খুলে যায়। সেই অপরূপ, স্নেহঘন মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে চেয়ে তিনি গান বাঁধেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। নদীমাতৃক বাংলার দিগন্ত বিহার জলরেখা আর শস্যভরা ক্ষেতের প্রসন্ন হাসি, তার হাট-বাট, পল্লীর নিভৃত সৌন্দর্য, বাঙালির সহজ সরল জীবন গাথা, এমন মধুর হয়ে আর কোন গানে ফুটেছে? সেই কল্যাণরূপিণী মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে কবি যে স্তব রচনা করেন পল্লীগীতির মধুমাখা সুরে, তাই আজ বাঙালির জাতীয় সঙ্গীত।’ (রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ)। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)
১৯৫৬ সালে কার্জন হলে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের অনুরোধে শিল্পী সন্জীদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়েছিলেন। সেদিনই ঠিক হয়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কী হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা গণপরিষদের সদস্যদের সম্মানে আয়োজিত সেই সাংস্কৃতিক-সন্ধ্যায় তিনি আরো অনেক শিল্পীদের দিয়ে সংগীত পরিবেশন করিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে তাদের সামনে তুলে ধরা এবং প্রমাণ করা রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে বাংলাদেশ কী রূপ-লাবণ্যে ফুটে আছে। এই ‘পল্লীগীতির মধুমাখা সুর’টি তিনি শিলাইদহের বাউল গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি থেকে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার গান থেকে শুধু সুরটাই গ্রহণ করেছেন, বাকি সব তাঁর নিজের।
কবি কাজী ইসলাম ছিলেন সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক এবং শোষিত মানুষের মুখপত্র। এমনকি তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি পৃথিবীর সমস্ত নির্যাতিত মানুষের সর্বৈব মুক্তির কথা ব্যক্ত করেছেন তাঁর লেখায়। কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি নিজে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পছন্দ করতেন এবং রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন গুরু মেনেই চলেছেন। রবীন্দ্রনাথও এই বিদ্রোহী কবিকে ¯েœহের চোখে দেখতেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর নজরুল ইসলাম কবির স্মরণে ‘রবিহারা’ নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। বাংলা সাহিত্যে ও আমাদের জীবন-সংসার-সংস্কৃতিতে কাজী নজরুল ইসলামের সগৌরব উপস্থিতি আমরা প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করি। তাঁর লেখা ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯)কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘চল চল চল! ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’ (গান হিসেবে সুরারোপ করেছিলেন কবি নিজে) স্বাধীন বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশের সামরিক অনুষ্ঠানে যন্ত্রসংগীতে এই গানের ২১ লাইন বাজানো হয়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, আমাদের সাহিত্যের তো বটেই, আমাদের সংগীত সংস্কৃতির দুই বটবৃক্ষ, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা বুক ভরে শ^াস নিতে পারি। প্রতিটি সংকটে তারা সামনে এসে দাঁড়ান।
বাংলার লোকসংগীত, উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মহুয়া-মলুয়ার পালা, কবিগান, জারি-সারি, রাখালি গান, বিয়ের গান, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ, বেহুলা-লখিন্দরের পালা, মাদারের গান, কীর্তন, বাউল গান ইত্যাদি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সংগীত হলেও এদের জনপ্রিয়তা একটুও ম্লান হয়নি। আবহমান বাংলার জনপ্রান্তরে এইসব গানের কোনো কলি যখন শুনি, কেবলই মুগ্ধ হই, অনন্ত বিরহের ঘেরাটোপে আটকে যাই কিংবা নস্টালজিক হয়ে পড়ি। ‘কী যাদু বাংলা গানে, গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে/গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা’ এসব গান যতবার শুনি ততবারই নতুন লাগে। বাংলা সংগীতের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। পুরনো দিনের বাংলা গানের যে কাব্যময় আবেদন, যে চির বিরহের আকুতি আমাদের হৃদয়ে স্পন্দন তোলে আজও, তার কোনো তুলনা হয় না। রাধারমণ দত্ত- মরমী কবি ও ধামাইল গানের জনক। ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো/আমি বুক চিরিয়া।/অন্তরে তুষেরই আগুন/ জ¦লে রইয়া রইয়া।।’ ‘আমার বন্ধু দয়াময়’ ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ কিংবা ‘বিনোদিনী গো...’ রাধারমণের এরকম অনেক গানের মধ্যে কৃষ্ণপ্রেমের বিরহ হাহাকার এবং না পাওয়ার বেদনা মর্মরিত। লোকসংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি এই লোককবি আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তিনি কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন। এছাড়া অনেক জানা-অজানা লোককবি কিংবা বাউল কবির গান, পঞ্চকবির গান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির মূল্যবান অংশ হয়ে আছে। আমাদের গণসংগীত গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার এক অন্যতম প্লাটফর্ম। কাজী নজরুল ইসলাম, হেমাঙ্গ বিশ^াস, সলিল চৌধুরীর গণসংগীতগুলো আমাদের আজো উদ্দীপ্ত করে। বাংলা গান সলিল চৌধুরী হয়ে কবির সুমন এবং তারপর নানাভাবে নতুন নতুন গীতিকার-সুরকার-শিল্পীদের সমন্বয়ে এগিয়ে চলেছে- সেসব নিয়ে বিশদে যাবার কোনো সুযোগ নেই এখানে। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)
কামরুল ইসলাম
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৪.
ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান এবং প্রেসিডেন্ট অব দ্য বোর্ড অব কন্ট্রোল স্যার চার্লস উডের ১৮৫৪ সালের শিক্ষা সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবনাগুলো সেসময়ের জন্য খুবই যুগান্তকারী ছিল এবং আজও এই সময়ের বাস্তবতায়ও সেগুলিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা যেন উল্টো পথেই চলছি বলেই আমার মনে হয়েছে। তিনি যেমন নারী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন, তেমনি প্রাইমারি শিক্ষা মাতৃভাষায় হবে, এব্যাপারেও মত দিয়েছিলেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে নিজের ভাষা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই শিক্ষাদান পরিচালনার কথা বলেছিলেন। ওই সময়ে ভারতবর্ষে শিক্ষার যে সংস্কার হয়েছিল, তা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। নারী শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্বকে আমরা সব সময়ই স্বাগত জানিয়েছি। তবে সর্বাগ্রে নিজের ভাষাটা ভালোভাবে শেখার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবার সুযোগ নেই।
In 1854 Charles Wood had sent the Wood’s Despatch to the Governor-General Lord Dalhousie, and it primarily dealt with educational reforms. And this creates a huge change in the education policy of the British. Its main motto is to separate the education department. All the Universities were set up at Presidency towns of Bombay, Calcutta, and Madras. Wood had suggested different opinions towards education departments like primary school must adopt the vernacular language, high schools must adopt Anglo-vernacular language and at the college level, English should be the medium of education. Different kinds of institutions were set up like the Universities of Madras in 1857, Universities of Calcutta, Universities of Bombay, Universities of Punjab in 1882, and Universities of Allahabad in 1887. By this educational reform, at least one government school will be opened in every district. Indian natives should be given training in their mother tongue. The education of women should be highlighted. The government supports women’s education. Teacher’s training and promotion at all levels. English education should be promoted. Wood’s Despatch made the government realize the importance of education for people.( Wikipedia)
‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেন-
‘যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন বাংলাশিক্ষার রাস্তা খুলিয়া যায় তবে তখন এই বঙ্গসাহিত্য পরিষদের দিন আসিবে। এখন রাস্তা নাই তাই সে হোঁচট খাইতে খাইতে চলে,...জার্মানিতে ফ্রান্সে আমেরিকায় যে সকল আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় জাগিয়া উঠিয়াছে তাদের মুল উদ্দেশ্য সমস্ত দেশের চিত্তকে মানুষ করা।... দেশের এই মনকে মানুষ করা কোনোমতেই পরের ভাষায় সম্ভবপর নহে। আমরা লাভ করিব, কিন্তু সে লাভ আমাদের ভাষাকে পূর্ণ করিবে না, আমরা চিন্তা করিব কিন্তু সে চিন্তার বাহিরে আমাদের ভাষা পড়িয়া থাকিবে, আমাদের মন বাড়িয়া চলিবে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাষা বাড়িতে থাকিবে না, সমস্ত শিক্ষাকে অকৃতার্থ করিবার এমন উপায় আর কী হইতে পারে। (কালান্তর)।
উল্লেখ্য, সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় শিক্ষাদানের কোনো সুযোগ ছিল না। বাংলা ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই ভালোবাসা এবং হিন্দু-মুসলিম মিলনের যে আকাক্সক্ষা- এই ভালোবাসা ও আকাক্সক্ষার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বীজ।
আহমদ ছফা লিখেছেন- ‘আমাদের আনন্দ আমাদের গৌরব রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে মানুষের উপযোগী ভাষা হিসেবে রূপায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা মানুষ হবার প্রেরণা পাই’।’ (আহমদ ছফা রচনানাবলী-১, পৃ ১২৫)
এমনকি রবীন্দ্রনাথ এ-ও লিখেছেন যে, ‘পিতৃদেবের শাসনে তখনকার দিনেও আমাদের পরিবারে পরস্পর পত্র লেখা প্রভৃতি ব্যাপারে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অপমানজনক বলে গণ্য হত।’ ১২৯৯-এর ২৯ কার্তিক থেকে ১৬ অগ্রহায়ণ পর্যন্ত প্রায় ১৮ দিন রবীন্দ্রনাথ রাজশাহীতে ছিলেন। (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাধ রাজশাহী কলেজে ‘শিক্ষার হেরফের’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ওইদিন সভাপতিত্ব করেছিলেন নাটোরের জমিদার জগদীন্দ্রনাথ রায়। অক্ষয়কুমার মৈত্র, লোকেন পালিত, প্রমথ চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন সেদিন আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মূলত রাজশাহীতে এসেছিলেন বন্ধু লোকেন পালিতের আমন্ত্রণে। তিনি তখন রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট। রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেদিন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবিষয়ে লেখেন-
‘দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার ওপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে, এবং সেই শিক্ষার গভীরতা ও স্থায়িত্বের ওপর যদি উন্নতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে, তবে মাতৃভাষা ছাড়া যে আর কোনো গতি নাই একথা কেহ না বুঝিলে হাল ছাড়িয়া দিতে হয়। রাজা কত আসিতেছে, কত যাইতেছে; পাঠান গেল, মোগল গেল, ইংরেজ আসিল আবার কালক্রমে ইংরেজও যাইবে, কিন্তু ভাষা সেই বাংলাই চলিয়া আসিতেছে এবং বাংলাই চলিবে। (কালান্তর)
ভাষা যে নদীর ¯্রােতের মতো তা আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছেই শুনেছি। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের শুরুটা রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে হয়ে উঠতে হয়েছে তার চিরকালের দ্বন্দ্বে-সংগ্রামে এবং সে তার ভাষিক আয়োজনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে। ব্রাত্যজনের এই ভাষাকে যিনি আকণ্ঠ দরদে সম্মানিত করেছেন দেশে ও বিদেশে, সেই রবীন্দ্রনাথকেও নানাভাবে দ্বন্দ্বে-সংগ্রামেই হয়ে উঠতে হয়েছে। সরবে নীরবে নিন্দিত হয়েছেন, নন্দিত হয়েছেন মহাগৌরবে; এবং রবীন্দ্রমানসসঞ্জাত যে উষ্ণপ্রবাহ বাঙালির সমন্বিত মানসচেতনায় সংক্রমিত, তা কোনোকালেই কেউ শত-সহস্র আঘাতেও ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে সাহসী হবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাঙালির বিকাশমান জাতিসত্তার প্রোজ্জ্বল অহংকারকেই অস্বীকার করা হয়।
বাঙালির সংস্কৃতি, ভাষার বৈচিত্র্য এবং জীবনধারায় যে স্বাতন্ত্র্য রয়েছে তা তাকে অন্যের থেকে আলাদা করেছে। ভাবের মধ্যে তার মন উড়– উড়– থাকে। তবে কোনো অশুভশক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও তার সময় লাগে না, সে আবেগে চলে যতোটা, ততোটা যুক্তিতে নয়, আর ভুল করার এবং ভুলে যাবারও খুব মানানসই স্বভাব রয়েছে তার।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের বড় রকমের সাংস্কৃতিক আশ্রয়। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তার অবদান অসামান্য।
বাঙালির প্রেরণার উৎস যে রবীন্দ্রনাথ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা ভালোভাবেই জানতো এবং যে কারণে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এদেশের প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এর বিরোধিতা করে। তবে বেশকিছু লেখক বুদ্ধিজীবী সরকারের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিল
এরও আগে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালেও সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে এইসব বুদ্ধিজীবীরা বিরোধিতায় নেমেছিল। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সেদিন এদেশের অনেক শিল্পী-কবি-বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিল সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও।
গোলাম মুরশিদের সাথে আমরা এবিষয়ে একমত যে,
‘তা সত্ত্বেও সরকারি বাধা-নিষেধের মুখে বাঙালিরা স্বতঃর্স্ফূতভাবে এ উৎসব (১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্র্ষিকী) পালন করেন। পালন করেন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে। কেবল ঢাকা অথবা বড়ো শহরে নয়,মফস্বলেও বহু জায়গায় এ উৎসব পালিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ততোদিনে হিন্দু কবি নন, তাঁদের নিজেদের- বাঙালি কবি’তে পরিণত হয়েছিলেন। বস্তুত, দুই বাংলার মধ্যে ভাষাতাত্ত্বিক ভাতৃত্ববোধসৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিয়ানা এবং অসাম্প্রদায়িকতার জোয়ার এসেছিল।’ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস, পৃ. ৫৬)
আবুজাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন:
‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপক চর্চা প্রকৃতপক্ষে বাংলার সমন্বিত শাশ্বত মানবিক সংস্কৃতির সেবা এবং তাকে উত্তরোত্তর বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত করার অত্যাবশ্যক দায়িত্ব পালন। সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্কট পৃথিবীর সর্বত্রই কখনও কখনও দেখা দেয়। সে সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে খুঁজতে হবে।’ (রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের বার্ষিক পত্রিকা ‘সঙ্গীত সংস্কৃতি’-১৯৮৪)।
সন্জীদা খাতুন লিখেছেন-
‘রবীন্দ্রসংগীত উপলব্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কাছে আমি ঋণী। এ দেশের সাংস্কৃতিক জীবনে যত পীড়ন এসেছে ততই নব উৎসাহে রবীন্দ্রসংগীতের কাছে সরে এসেছি আমরা। বিচিত্র বিরূপ ব্যবহার রবীন্দ্রসংগীতকে উত্তরোত্তর অন্তরঙ্গ করে তুলেছে। তাই রবীন্দ্রসংগীত হয়েছে আমাদের নিশ্চিত আশ্রয়।’ (রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ)
নীরোদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন-
‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ রবীন্দ্রনাথের যে গানটিতে ভাষাবদ্ধ হইয়া, সমস্ত বাঙালীর কাছে মায়ের মূর্তিতে দেখা দিয়া ভালোবাসা ও ভক্তিতে পূর্ণ বাঙালীপ্রাণের জাতীয় সঙ্গীতের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, সেটি ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলিকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ সভায় গাওয়া হইয়াছিল। উহা অবশ্য, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। উহার শেষ চরণটি ছাড়া আগেকার চব্বিশটি চরণে রাজনৈতিক ভাবের ছোঁয়াচও নাই। শুধু সেই চরণটিতে বঙ্গমাতার ভূষণের জন্য বিলাতি জিনিস না কিনিবার প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত সন্তর্পণে দেওয়া হইয়াছিল। উহার জন্যই ১৯০৬ সন হইতে আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজায় দেবীর মুকুটে, বক্ষে, বা বাহুতে রাংতা ইত্যাদির আভরণ আর দেখিলাম না, সবই রং-করা মাটির হইল।’ (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ১০৫-৬)।
একদিন বাংলাদেশ যদি পুরোটাই আরবান এলাকায় রূপান্তরিত হয়, রবীন্দ্রনাথের এই গানের (আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি) মধ্যে তার শ্যামল-সৌন্দর্য, পল্লীর মাঠ-ঘাট, আ¤্রকানন, খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গানটি যখনই শুনি, দেখি, পুরো দেশটাই মাতৃমূর্তি রূপে সামনে এসে পড়ে। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুযারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই এই গানটির প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার লিখেছেন-
‘বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র আজ সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়ে বিশ্বের জাতিগুলির মধ্যে আসন নিয়েছে প্রথম জীবনে পদ্মায় বোটে করে ভেসে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথ এই দেশের স্বরূপ দেখেছিলেন। তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে বাংলাদেশের মনোহরণ মূর্তি খুলে যায়। সেই অপরূপ, স্নেহঘন মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে চেয়ে তিনি গান বাঁধেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। নদীমাতৃক বাংলার দিগন্ত বিহার জলরেখা আর শস্যভরা ক্ষেতের প্রসন্ন হাসি, তার হাট-বাট, পল্লীর নিভৃত সৌন্দর্য, বাঙালির সহজ সরল জীবন গাথা, এমন মধুর হয়ে আর কোন গানে ফুটেছে? সেই কল্যাণরূপিণী মাতৃমূর্তির দিকে চেয়ে কবি যে স্তব রচনা করেন পল্লীগীতির মধুমাখা সুরে, তাই আজ বাঙালির জাতীয় সঙ্গীত।’ (রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ)। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)
১৯৫৬ সালে কার্জন হলে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের অনুরোধে শিল্পী সন্জীদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়েছিলেন। সেদিনই ঠিক হয়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কী হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা গণপরিষদের সদস্যদের সম্মানে আয়োজিত সেই সাংস্কৃতিক-সন্ধ্যায় তিনি আরো অনেক শিল্পীদের দিয়ে সংগীত পরিবেশন করিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে তাদের সামনে তুলে ধরা এবং প্রমাণ করা রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে বাংলাদেশ কী রূপ-লাবণ্যে ফুটে আছে। এই ‘পল্লীগীতির মধুমাখা সুর’টি তিনি শিলাইদহের বাউল গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি থেকে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার গান থেকে শুধু সুরটাই গ্রহণ করেছেন, বাকি সব তাঁর নিজের।
কবি কাজী ইসলাম ছিলেন সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক এবং শোষিত মানুষের মুখপত্র। এমনকি তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি পৃথিবীর সমস্ত নির্যাতিত মানুষের সর্বৈব মুক্তির কথা ব্যক্ত করেছেন তাঁর লেখায়। কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি নিজে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পছন্দ করতেন এবং রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন গুরু মেনেই চলেছেন। রবীন্দ্রনাথও এই বিদ্রোহী কবিকে ¯েœহের চোখে দেখতেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর নজরুল ইসলাম কবির স্মরণে ‘রবিহারা’ নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। বাংলা সাহিত্যে ও আমাদের জীবন-সংসার-সংস্কৃতিতে কাজী নজরুল ইসলামের সগৌরব উপস্থিতি আমরা প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করি। তাঁর লেখা ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯)কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘চল চল চল! ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’ (গান হিসেবে সুরারোপ করেছিলেন কবি নিজে) স্বাধীন বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশের সামরিক অনুষ্ঠানে যন্ত্রসংগীতে এই গানের ২১ লাইন বাজানো হয়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, আমাদের সাহিত্যের তো বটেই, আমাদের সংগীত সংস্কৃতির দুই বটবৃক্ষ, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা বুক ভরে শ^াস নিতে পারি। প্রতিটি সংকটে তারা সামনে এসে দাঁড়ান।
বাংলার লোকসংগীত, উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মহুয়া-মলুয়ার পালা, কবিগান, জারি-সারি, রাখালি গান, বিয়ের গান, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ, বেহুলা-লখিন্দরের পালা, মাদারের গান, কীর্তন, বাউল গান ইত্যাদি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সংগীত হলেও এদের জনপ্রিয়তা একটুও ম্লান হয়নি। আবহমান বাংলার জনপ্রান্তরে এইসব গানের কোনো কলি যখন শুনি, কেবলই মুগ্ধ হই, অনন্ত বিরহের ঘেরাটোপে আটকে যাই কিংবা নস্টালজিক হয়ে পড়ি। ‘কী যাদু বাংলা গানে, গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে/গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা’ এসব গান যতবার শুনি ততবারই নতুন লাগে। বাংলা সংগীতের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। পুরনো দিনের বাংলা গানের যে কাব্যময় আবেদন, যে চির বিরহের আকুতি আমাদের হৃদয়ে স্পন্দন তোলে আজও, তার কোনো তুলনা হয় না। রাধারমণ দত্ত- মরমী কবি ও ধামাইল গানের জনক। ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো/আমি বুক চিরিয়া।/অন্তরে তুষেরই আগুন/ জ¦লে রইয়া রইয়া।।’ ‘আমার বন্ধু দয়াময়’ ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ কিংবা ‘বিনোদিনী গো...’ রাধারমণের এরকম অনেক গানের মধ্যে কৃষ্ণপ্রেমের বিরহ হাহাকার এবং না পাওয়ার বেদনা মর্মরিত। লোকসংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি এই লোককবি আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তিনি কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন। এছাড়া অনেক জানা-অজানা লোককবি কিংবা বাউল কবির গান, পঞ্চকবির গান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির মূল্যবান অংশ হয়ে আছে। আমাদের গণসংগীত গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার এক অন্যতম প্লাটফর্ম। কাজী নজরুল ইসলাম, হেমাঙ্গ বিশ^াস, সলিল চৌধুরীর গণসংগীতগুলো আমাদের আজো উদ্দীপ্ত করে। বাংলা গান সলিল চৌধুরী হয়ে কবির সুমন এবং তারপর নানাভাবে নতুন নতুন গীতিকার-সুরকার-শিল্পীদের সমন্বয়ে এগিয়ে চলেছে- সেসব নিয়ে বিশদে যাবার কোনো সুযোগ নেই এখানে। (আগামী সংখ্যায় পড়–ন)