চন্দন চৌধুরী
আঁকাআঁকি
তাঁবুর মধ্যে একটা কাগজ পেয়েছে মেয়েটা। কাগজ দেখতেই আঁকার নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মেয়েটা চারকোল দিয়ে এঁকে ফেলল ট্যাংক, প্লেন আর মৃত মানুষ। ঠিক তখনই তাঁবুর মধ্যে উঁকি দিলেন এক ইউনিসেফ কর্মী। বললেন, বাহ্, তুমি তো ভালো আঁকো। আগেও আঁকতে?
মেয়েটা বলল, আগে ফুল, রোদ আর আমার পরিবার আঁকতাম।
গমন
একজন বলল, আমাদের এখান থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় জন বলল, কোথায় যাব? আর কোথায় যাবার জায়গা আছে? একজন বয়স্ক তাদের পাশেই ছিলেন। তিনি শুধু ফিসফিস করে বললেন, ওরা শুধু আমাদের এক মৃত্যু থেকে অন্য মৃত্যুতে যেতে বলছে।
আকাশ চাষ
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি উম আল জামাল গ্রামে উপস্থিত হলো ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সেখানে বাসকারী ৪৩ বছর বয়সী মাহমুদ কাবনেহকে বলল, দ্রুত মালামাল সরিয়ে নাও। এই এলাকা অধিগ্রহণ করা হলো।
চোখের নিমিষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো ৩৬টি বাড়ি। সর্বস্বান্ত করে তারা চলে গেল। এরপর থাকার জন্য আবার কয়েকটি ঘর নির্মাণ করলেন মাহমুদরা। কিন্তু এর মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী এসে হাজির। ৬৬ জন বাস্তুচ্যুত মানুষের সামনে নবনির্মিত ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল আর বলল, তোমরা কেন বুঝতে পারছো না, এই এলাকায় আমরা আকাশ চাষ করতে এসেছি।
মৃত্যুর আগমন
পালাতে পালাতে কয়েকজন দোকান খুঁজছে। ওরা দোকান খুঁজে পেল। তাকগুলো খালি। এক দোকানের পাশে লেখা : এখানে খামির বা লবণ নেই। কয়েকটা বিল্ডিং পরে একটা বিস্ফোরণ হলো। তারা দৌড়ে গেল সেখানে। প্রচ- ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে সবাই। একই সঙ্গে আরেকটি বিস্ফোরণের ভয়ে কুঁকড়ে আছে। বিস্ফোরণে বিল্ডিংটি একেবারে ধূলিসাৎ। দলের একজন ভস্মস্তূপের মাঝখানে একটা জুসের বোতল খুঁজে পেল। সবাই এক ঢোক করে খেলো। শেষজন একটা চুমুকও দিতে পারল না।
সামান্য দূরে বিমান হামলা হচ্ছে। তবু দলের একজন বলল, মৃত্যু যদি বিমান হামলা থেকে না আসে, তবে তা ক্ষুধা থেকে আসবে।
একজন তবু হেসে বলল, চিন্তা করো না বন্ধু, আমি কলা দিয়ে প্যানকেকের স্বাদ ভুলে গেছি।
শেখা
বাবা আর ছেলে তাঁবুতে বসে আছে। বাবা জানতে চাইলেন, তুমি কী শিখেছ বাবা? ছেলে বলল, আমি বিমানের শব্দ ঘৃণা করতে শিখেছি বাবা।
বাবা আবার বললেন, আর কী শিখেছ? ছেলে বলল, আমি সাইরেনের শব্দ ঘৃণা করতে শিখেছি বাবা।
বাবা আবার জানতে চাইলেন, আর কী? তখন ছেলে বলল, খুব বৃষ্টি হচ্ছে বাবা। আমি বৃষ্টি দেখতেও ঘৃণা করি। কারণ খুব ঠা-া। আমাদের কারোই শীতের কাপড় নেই। সবাই কাঁপছে বাবা।
নিরাপদ
এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশা এবং তার স্বামী। তাদের সন্তানদের মুখেও উদ্বেগ। ছয় বছরের মেয়েটা বলল, আমাদের জামাকাপড় এবং খেলনাগুলির কী হবে? আমরা কেন চলে যাচ্ছি? আমরা কোথায় যাবো?
রাশা বলল, শোনো, যুদ্ধের পর তোমাদের নতুন জামাকাপড় এবং খেলনা কিনে দেবো। আর শোনো, আমরা তোমাদের নিরাপদ রাখার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছি।
মেয়েটা বলল, এখানে যে আমরা খেলনাগুলি রেখে যাচ্ছি, ওরা কি নিরাপদ থাকবে মা?
শিক্ষা
উত্তর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের তীব্রতার কারণে উত্তর গাজা উপত্যকা থেকে বাস্তুচ্যুত লোকজন দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। আলিয়া গর্ভবতী, সে অত্যন্ত ক্লান্ত। অস্থির ব্যথা আর ওজন হ্রাস তার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। তার প্রয়োজনীয় আয়রন ট্যাবলেট ফুরিয়ে গিয়েছে এবং সে তার শিশুর নড়াচড়াও অনুভব করছে না। পরামর্শের জন্য কোনো ডাক্তার নেই, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। আবার এই পরিস্থিতিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পালাতে হচ্ছে। কোনোভাবে থামতে পারছে না তারা। আলিয়া শুধু তার হাতব্যাগ বহন করছে। যার মধ্যে পরিবারের সবার পাসপোর্ট, রুটি এবং বাচ্চাদের জন্য এক বোতল জল। রাস্তায় ভিড়, ট্যাংক আর সৈন্যরা জড়ো হয়ে আছে। সামনে এমন মৃত্যুকে দেখে বাচ্চারা কাঁদছে আর সবাই মাথা নিচু করে চলছে। আলিয়া বলল, তোমরা মাথা নিচু করে কাঁদছো কেন?
এই শুনে ভয়ার্ত বাচ্চারা তাকে জড়িয়ে ধরল। আলিয়া বলল, মৃত্যুকে দেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়।
দুঃখপর্ব
আল-আকসা বিশ^বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র। আয়া লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের দীর্ঘ সারি। দুঘণ্টা ধরে সে লাইনে আছে। পেট মোচড় দিয়েছে সেই কখন। কিন্তু আর কোথাও যাবারও কোনো জায়গা নেই। আর অন্যরাও হয়তো তার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। হয়তো তারাও কষ্ট পাচ্ছে। পাশের একজনকে বলল, জীবন কি এতই দুঃখের আর যন্ত্রণাকর?
পাশের জন দুঃখের হাসি হেসে বলল, আমাদের জন্য মৃত্যু দুঃখের নয় বলেই হয়তো জীবন এত দুঃখের আর যন্ত্রণাময়।
পাতা
দীর্ঘ ৯ বছর পর ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেল বাশার। কারাগারে যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ২৪। আর এখন ৩৩। বাড়ি এসেই সে একটু পরপর এই গাছের পাতা ওই গাছের পাতা বারবার স্পর্শ করে দেখছে। ঘটনাটি চোখ এড়াল না একজনের। জানতে চাইল, তুমি একটু পরপর এভাবে গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখছো কেন?
বাশার বলল, গত ৯ বছর কোনো গাছ দেখিনি। কারাগার থেকে বের হতেই সমস্ত পাতাকে নিজের শরীর মনে হচ্ছে।
জুতো
হাসপাতালে ছোট মেয়েকে নিয়ে হাঁটছেন বাবা। হঠাৎ মেয়েটা থমকে দাঁড়াল। বারান্দার পাশে পড়ে আছে একজোড়া রক্তমাখা জুতা। সেগুলো বাবাকে দেখিয়ে মেয়ে বলল, দেখো বাবা, জুতোগুলো আপুর জুতোর মতো।
বাবা আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এগুলো তোমার আপুরই জুতা সোনা।
চন্দন চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
আঁকাআঁকি
তাঁবুর মধ্যে একটা কাগজ পেয়েছে মেয়েটা। কাগজ দেখতেই আঁকার নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মেয়েটা চারকোল দিয়ে এঁকে ফেলল ট্যাংক, প্লেন আর মৃত মানুষ। ঠিক তখনই তাঁবুর মধ্যে উঁকি দিলেন এক ইউনিসেফ কর্মী। বললেন, বাহ্, তুমি তো ভালো আঁকো। আগেও আঁকতে?
মেয়েটা বলল, আগে ফুল, রোদ আর আমার পরিবার আঁকতাম।
গমন
একজন বলল, আমাদের এখান থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় জন বলল, কোথায় যাব? আর কোথায় যাবার জায়গা আছে? একজন বয়স্ক তাদের পাশেই ছিলেন। তিনি শুধু ফিসফিস করে বললেন, ওরা শুধু আমাদের এক মৃত্যু থেকে অন্য মৃত্যুতে যেতে বলছে।
আকাশ চাষ
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি উম আল জামাল গ্রামে উপস্থিত হলো ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সেখানে বাসকারী ৪৩ বছর বয়সী মাহমুদ কাবনেহকে বলল, দ্রুত মালামাল সরিয়ে নাও। এই এলাকা অধিগ্রহণ করা হলো।
চোখের নিমিষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো ৩৬টি বাড়ি। সর্বস্বান্ত করে তারা চলে গেল। এরপর থাকার জন্য আবার কয়েকটি ঘর নির্মাণ করলেন মাহমুদরা। কিন্তু এর মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী এসে হাজির। ৬৬ জন বাস্তুচ্যুত মানুষের সামনে নবনির্মিত ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল আর বলল, তোমরা কেন বুঝতে পারছো না, এই এলাকায় আমরা আকাশ চাষ করতে এসেছি।
মৃত্যুর আগমন
পালাতে পালাতে কয়েকজন দোকান খুঁজছে। ওরা দোকান খুঁজে পেল। তাকগুলো খালি। এক দোকানের পাশে লেখা : এখানে খামির বা লবণ নেই। কয়েকটা বিল্ডিং পরে একটা বিস্ফোরণ হলো। তারা দৌড়ে গেল সেখানে। প্রচ- ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে সবাই। একই সঙ্গে আরেকটি বিস্ফোরণের ভয়ে কুঁকড়ে আছে। বিস্ফোরণে বিল্ডিংটি একেবারে ধূলিসাৎ। দলের একজন ভস্মস্তূপের মাঝখানে একটা জুসের বোতল খুঁজে পেল। সবাই এক ঢোক করে খেলো। শেষজন একটা চুমুকও দিতে পারল না।
সামান্য দূরে বিমান হামলা হচ্ছে। তবু দলের একজন বলল, মৃত্যু যদি বিমান হামলা থেকে না আসে, তবে তা ক্ষুধা থেকে আসবে।
একজন তবু হেসে বলল, চিন্তা করো না বন্ধু, আমি কলা দিয়ে প্যানকেকের স্বাদ ভুলে গেছি।
শেখা
বাবা আর ছেলে তাঁবুতে বসে আছে। বাবা জানতে চাইলেন, তুমি কী শিখেছ বাবা? ছেলে বলল, আমি বিমানের শব্দ ঘৃণা করতে শিখেছি বাবা।
বাবা আবার বললেন, আর কী শিখেছ? ছেলে বলল, আমি সাইরেনের শব্দ ঘৃণা করতে শিখেছি বাবা।
বাবা আবার জানতে চাইলেন, আর কী? তখন ছেলে বলল, খুব বৃষ্টি হচ্ছে বাবা। আমি বৃষ্টি দেখতেও ঘৃণা করি। কারণ খুব ঠা-া। আমাদের কারোই শীতের কাপড় নেই। সবাই কাঁপছে বাবা।
নিরাপদ
এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশা এবং তার স্বামী। তাদের সন্তানদের মুখেও উদ্বেগ। ছয় বছরের মেয়েটা বলল, আমাদের জামাকাপড় এবং খেলনাগুলির কী হবে? আমরা কেন চলে যাচ্ছি? আমরা কোথায় যাবো?
রাশা বলল, শোনো, যুদ্ধের পর তোমাদের নতুন জামাকাপড় এবং খেলনা কিনে দেবো। আর শোনো, আমরা তোমাদের নিরাপদ রাখার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছি।
মেয়েটা বলল, এখানে যে আমরা খেলনাগুলি রেখে যাচ্ছি, ওরা কি নিরাপদ থাকবে মা?
শিক্ষা
উত্তর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের তীব্রতার কারণে উত্তর গাজা উপত্যকা থেকে বাস্তুচ্যুত লোকজন দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। আলিয়া গর্ভবতী, সে অত্যন্ত ক্লান্ত। অস্থির ব্যথা আর ওজন হ্রাস তার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। তার প্রয়োজনীয় আয়রন ট্যাবলেট ফুরিয়ে গিয়েছে এবং সে তার শিশুর নড়াচড়াও অনুভব করছে না। পরামর্শের জন্য কোনো ডাক্তার নেই, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। আবার এই পরিস্থিতিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পালাতে হচ্ছে। কোনোভাবে থামতে পারছে না তারা। আলিয়া শুধু তার হাতব্যাগ বহন করছে। যার মধ্যে পরিবারের সবার পাসপোর্ট, রুটি এবং বাচ্চাদের জন্য এক বোতল জল। রাস্তায় ভিড়, ট্যাংক আর সৈন্যরা জড়ো হয়ে আছে। সামনে এমন মৃত্যুকে দেখে বাচ্চারা কাঁদছে আর সবাই মাথা নিচু করে চলছে। আলিয়া বলল, তোমরা মাথা নিচু করে কাঁদছো কেন?
এই শুনে ভয়ার্ত বাচ্চারা তাকে জড়িয়ে ধরল। আলিয়া বলল, মৃত্যুকে দেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়।
দুঃখপর্ব
আল-আকসা বিশ^বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র। আয়া লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের দীর্ঘ সারি। দুঘণ্টা ধরে সে লাইনে আছে। পেট মোচড় দিয়েছে সেই কখন। কিন্তু আর কোথাও যাবারও কোনো জায়গা নেই। আর অন্যরাও হয়তো তার মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। হয়তো তারাও কষ্ট পাচ্ছে। পাশের একজনকে বলল, জীবন কি এতই দুঃখের আর যন্ত্রণাকর?
পাশের জন দুঃখের হাসি হেসে বলল, আমাদের জন্য মৃত্যু দুঃখের নয় বলেই হয়তো জীবন এত দুঃখের আর যন্ত্রণাময়।
পাতা
দীর্ঘ ৯ বছর পর ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেল বাশার। কারাগারে যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ২৪। আর এখন ৩৩। বাড়ি এসেই সে একটু পরপর এই গাছের পাতা ওই গাছের পাতা বারবার স্পর্শ করে দেখছে। ঘটনাটি চোখ এড়াল না একজনের। জানতে চাইল, তুমি একটু পরপর এভাবে গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখছো কেন?
বাশার বলল, গত ৯ বছর কোনো গাছ দেখিনি। কারাগার থেকে বের হতেই সমস্ত পাতাকে নিজের শরীর মনে হচ্ছে।
জুতো
হাসপাতালে ছোট মেয়েকে নিয়ে হাঁটছেন বাবা। হঠাৎ মেয়েটা থমকে দাঁড়াল। বারান্দার পাশে পড়ে আছে একজোড়া রক্তমাখা জুতা। সেগুলো বাবাকে দেখিয়ে মেয়ে বলল, দেখো বাবা, জুতোগুলো আপুর জুতোর মতো।
বাবা আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এগুলো তোমার আপুরই জুতা সোনা।