ফরিদ আহমদ দুলাল
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
শৈশব থেকেই পথকবিতার সাথে আমার পরিচয়; পরিচয় মানে রীতিমতো প্রেমে পড়া পরিচয়। কতোদিন যে পথের পাশে জমে ওঠা আসরে পথকবিতা শুনতে শুনতে আমার দিন গড়িয়ে গেছে ঠাহর করে উঠতে পারিনি। দু’আনা পয়সা খরচ করে যে একটা কবিতার বুকলেট কিনে নিয়ে বাসায় ফিরবো সে সামর্থ্য ছিলো না তখন। অথচ কবিকণ্ঠে কবিতা শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেছি। দু’একবার কবিতা কিনে বাসায় নিয়ে গেছি, কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখেছি, যে আনন্দ পেতাম কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে, তার সিকি ভাগও আনন্দ পাচ্ছি না। আমার শৈশবে পথকবিতার পুস্তিকাগুলো সাধারণত দুইআনা করে বিক্রি হতো। বিক্রির পরিমাণ নেহাত কম ছিলো না। বড় একটি কাগজকে বিশেষভাবে ভাঁজ করে আট/বারো বা ষোল পৃষ্ঠায় একটি দীর্ঘ কবিতা ছাপানো থাকত পুস্তিকায়। কবিতাটি লেখা হতো কোনো এক বিশেষ ঘটনা বা কাহিনীকে ঘিরে। যেমন প্রেমের কারণে কোনো মেয়ের আত্মহত্যা বা গোপনে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, শ্বশুর বাড়ির নির্যাতনে কোনো বধূর আত্মহত্যা কিংবা কোনো পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি কাহিনী উপজীব্য হয়ে উঠতো সেসব কবিতায়। যারা এই কবিতাগুলো রচনা করতেন তাদেরকে বলা হতো পথকবি, পল্লীকবি, লোককবি, ভাট কবি কিংবা হাটুরে কবি। আমি অবশ্য তাঁদের পথকবি নামেই জানতাম।
লোকবাংলার অজানা সেই কবিরা যেসব কবিতা লিখতেন, তার নাম কোথাও বলা হয়েছে ‘হাটুরে কবিতা’, কোথাও বলা হয়েছে ‘মেঠো কবিতা’, কোথাও বলা হয়েছে ‘হাঁটুরে কবিতা’, কোথাও বলা হয়েছে ‘ভাট কবিতা, কোথাও আবার বলা হয়েছে ‘পথকবিতা’; হাট-বাজারে পড়া হতো তাই হাটুরে কবিতা হতেই পারে; মাঠে বা উন্মুক্ত জায়গায় পড়া হতো তাই মেঠো কবিতা, বিশেষ গোত্র বা সম্প্রদায়ের লোকেরা পড়তেন তাই ভাট কবিতা; আবার হেঁটে হেঁটে পড়া হতো তাই হাঁটুরে কবিতা; এবং পথ পাশে পড়া হতো তাই ‘পথকবিতা’ নামে ডাকা যেতেই পারে। যে নামেই ডাকা হোক, কবিতা কবিতাই। বর্তমান রচনায় আমি ‘পথকবিতা’ অভিধাটি বেছে নিলাম। এবং নমুনা হিসাবে বাংলা একাডেমির বাছাই থেকে একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে ধরলাম। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার ময়মনসিংহ খ-ে ‘ভাট কবিতা’ শিরোনামে মুক্তাগাছার কবি মোঃ আব্দুল হাই ফকিরের কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি; সেখান থেকে একটি কবিতার কতিপয় পঙ্ক্তি নিচে উদ্ধৃত করছি; আগ্রহীরা চাইলে বাংলা একাডেমিতে সন্ধান করে বইটি পড়তে পারেন : “ওহে সৃষ্টি কর্তা (২) মূল দেবতা বিপদের কা-ার / কে পারে বুঝিতে আল্লা মহিমা তোমার / তুমি কাউরে হাসাও (২) কাউরে কাঁদাও নিঃসন্তানী করে / কাউরে তুমি সন্তান দিয়া কাঁদাও অনাদরে।... / জিলা রংপুরে (২) বসত করে পাহাড়তলী গ্রাম / হাশেম আলী কাশেম আলী দুইটি ভাইয়ের নাম / মা বাপ ছোট থুইয়া (২) যায় মরিয়া কাশেমেরে ভাই / বড় ভাই হাশেম তারে পালন করে ভাই। / কাশেম ১ বৎসরে (২) হইলে পরে হাশেম করে বিয়া / স্ত্রী লইয়া করে সংসার কাশেমেরে লইয়া। / ভাবী আদর করে (২) কাশেমেরে ছেলেরি মতন / স্কুলে পাঠাইত তারে করিয়া যতন।” (স্বামী স্ত্রীর গলে ফাঁসি ॥ মোঃ আব্দুল হাই ফকির ॥ মুক্তাগাছা ॥ ময়মনসিংহ)
আমার শোনা পথকবিতার প্রায় সবই ছিলো প্রেম-উপাখ্যান। সাধারণত আলোচিত প্রেমকাহিনী নিয়েই কবিতা লেখা হতো; তা সে অতীতের গল্পই হোক আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাই হোক। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পথকবিতা লেখার প্রবণতা কমে গেছে; অন্তত রাস্তায় রাস্তায় পাঠ করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য শহর বা গ্রাম গঞ্জে হাটে-মাঠে এর বাস্তব চিত্রটি নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও আমার জন্মের শহর ময়মনসিংহের চিত্রটি এরকমই। সর্বশেষ শোনা দু’টি পথকবিতার কথা স্মৃতি থেকে স্মরণ করছি। দুই কবিতার কোনটি আগে আর কোনটি পরে শুনেছি তা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও, এটা নিশ্চিত বলতে পারি, দু’টি ঘটনাই দেশব্যাপী আলোচিত এবং আলোড়িত হয়েছিলো। দুই ঘটনার একটি একজন ডাক্তারের ছেলে মুনিরের পরকীয়া প্রেম ছিলো তার মায়ের বয়সী খুকু নামে এক নারীর সাথে; তারই জেরে মুনির তার স্ত্রী রিমাকে খুন ক’রে ব্রিজের নিচে ফেলে দেয়। রিমার বাবা ছিলেন ১৯৭১-এর শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক; সঙ্গত কারণেই দেশের সাংবাদিক সমাজ বিষয়টি নিয়ে তৎপর ছিলেন। অন্যদিকে মনিরের মা দেশের একজন প্রভাবশালী চিৎিসক; উপর মহলে তাঁর শক্ত যোগাযোগ ছিলো; কিন্তু কোনভাবেই বাঁচাতে পারেননি ছেলেকে; বিচারে মুনিরের ফাঁসি হয় এবং ফাঁসি কার্যকরী করা হয়; সেই ঘটনা নিয়ে রচিত হয় খুকু-মনির কাহিনি। অন্যটি খুলনার ত্রাস এরশাদ শিকদার নামে এক কুখ্যাত সন্ত্রাসীর আলোচিত ঘটনা এবং ফাঁসির ঘটনা। দু’টি ঘটনাই সারাদেশে আলোচিত আলোড়িত ঘটনা। প্রথমটি সম্ভবত আশির দশকের গোড়ার দিকে, আর দ্বিতীয়টি নব্বইয়ের দশকে। এই দুই কবিতার পর আমি নিজে আর কখনো কোথাও পথকবিতা পঠিত হতে দেখিনি বা শুনিনি। তবে এ কথা নিশ্চত শুনেছি এখনও কেউ কেউ পথকবিতা লেখার কসরত করে থাকেন; আমি নিজেও সাম্প্রতিক করোনাকালে একটি পথকবিতা লিখতে চেষ্টা করেছি। একাধিক নাটকের সূচনায় পথকবিতার ব্যবহার করেছি এবং অনেককে করতে দেখেছি। আমার রচিত পথকবিতাগুলোর কিছু অংশ অবশ্যই উদ্ধার করতে চেষ্টা করবো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন গ্রামের হাটে আমি পথকবিতা শোনার সুযোগ পেয়েছি। আমার বন্ধু কবি হোসেন আলী মিয়া সে সময় বিভিন্ন গ্রামের হাটে বেশ ক’টি পথকবিতা রচনা করে পাঠ করেছেন, এবং সে কারণে তাঁকে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হোসেন আলী মিয়ার সেসব পথকবিতা আজ আর আমাদের সংগ্রহে নেই। কেবল হোসেন আলী মিয়া নন, সে সময় অনেকেই পথকবিতা লিখে আলোচিত হয়েছেন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও সে সময় বেশকিছু পথকবিতা রচিত হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজার-গঞ্জে কিংবা রেল স্টেশনে এসব পথকবিদের দেখা মিলত। তাঁদের গেটআপ দেখলে বুঝতে পারা যেতো, তিনি কবি। হাট বা স্টেশনের কোন একটা ফাঁকা জায়গায় আসর জমিয়ে জনসমক্ষে হেঁটে হেঁটে তাঁরা নিজের রচিত কবিতা সুর করে পড়তেন। তাঁদের পড়ার ভঙ্গিমার কারণে সাধারণ কাহিনিও অসামান্য হয়ে উঠত। একসময় রেল স্টেশনের বুকস্টলে পথকবিতার চটি পুস্তিকা কিনতেও পাওয়া যেতো। সময়ের বিবর্তনে পথকবিতা প্রায় বিলুপ্ত আজ। বিলুপ্ত হলেও পথকবিতার উপযোগিতা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বিশেষ করে লোকবাংলার সাধারণ এবং নাগরিক মানুষের কাছে পথকবিতার জনপ্রিয়তা এতটাই, যে শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা পথকবিতা প্রয়োগ হতে দেখি। মনে পড়ছে, জহির রায়হান প্রযোজিত রহিম নওয়াজ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’তে আবদুল লতিফ-এর কথায় শহিদ আলতাফ মাহমুদ একটি গানে পথকবিতার ঢং ব্যবহার করেছিলেন, এবং গানটি সে-সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। নিচে আমি সে গানটিরকয়েক পঙ্ক্তি স্মরণ করতে চেষ্টা করছি- “শোন শোন কন্যা ওগো কন্যা মনের কথা বলি / থাকলে কিছু দাওনা খাইতে ক্ষুধার জ্বালায় জ্বলি / শোন পরদেশী (২) পরবাসী বলি তোমার কাছে / খাইতে পারো বাগানে মোর তিনটা যে ফল আছে / কোনবা ফলের কী গুণ (২) মিঠা কি নুন করি জিজ্ঞাসন / জলদি কইরা বল তুমি সত্য বিবরণ / দেহে থাকে যদি (২) পুরান ব্যাধি দিনে দিনে বাড়ে / খাইলে এই ফল এক পলকে সকল ব্যাধি সারে।”
আধুনিক বাংলা নাটকের লোককাহিনীভিত্তিক নাটকে কেবল নয়, সমকালীন অনেক নাটকেই আমরা পথকবিতার ব্যবহার দেখতে পাই। এই মুহূর্তে স্মরণে আসছে ‘সমাপ্তি অন্যরকম’ নামে একটি নাটকের কথা, নাটকের নাট্যকার রবিউল আলম; সে নাটক শুরু হয়েছে পথকবিতা দিয়ে। স্মৃতি থেকে কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করছি- “বলি ভাইরে ভাই বলে যাই পুরান ঘটনা / বগুড়া জেলার ঘটনা ক্ষেতলাল থানা / সাকিন মধুমতি (২) করেন বসতি আবেদিন মাস্টার / করুণ কাহিনী আমি বলিব তাহার / মানুষ মহৎ অতি (২) সুন্দরমতি অতি সয়সজ্জন / স্বভাবগুণে মান্য করে পাঁচগাঁয়ের দশজন / অতি সাম্প্রতিককালে একজন তরুণ কবিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুেেক নিজের ছোট বোনের ছেলের বিয়েতে শুভেচ্ছা জানাতে দেখলাম পথকবিতা উচ্চারণের ঢঙে। সেই কবিতা থেকে সামান্য কয়েক পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরছি- ‘আমরা সকলে চাই সুখ-আনন্দে জীবনটা কাটাই: / নতুন আনন্দের কথা সবারে জানাই। / কী সে ঘটনাটা? / কী সে ঘটনাটা সবার জন্য আনন্দ ঘটনা / বিয়ে আনে সবার জন্য নয়া সম্ভাবনা / শোনেন বলবো বিশদ / শোনেন বলবো বিশদ / আসল কথা এই আনন্দ দিনে / সবাই আসুন ভালোবেসে সবাইকে নিই চিনে, / মাকসু আমারই বোন / মাকসু আমারই বোন ঢাকার শ’রে উত্তরাতে থাকে / সুখে দুখে আনন্দেতে সকলকে সে ডাকে।”
সমাজে বিলুপ্তপ্রায় পথকবিতা এভাবেও ফিরে আসছে। আমাদের লোকসংগীত, লোককবিতাগুলো যে সহজেই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবার সক্ষমতা রাখতো, তার প্রমাণ কিন্তু একটু মনোযোগী হলে আমরা সহজেই পেয়ে যেতে পারি। আধুনিক কালের বাংলা গানের দিকে যদি দৃষ্টি দিই, সহজেই চোখে পড়ে এ সময়ের গানের সুরে, কথায় এবং উপস্থাপন শৈলীতে লোকসংগীতের কতটা প্রভাব। আমি বলবো, এ সময়ের জনপ্রিয় গান সমূহের সুর-কথা ও উপস্থাপন শৈলীর সিংহভাগই লোকসংগীত দ্বারা প্রভাবিত। বাংলার লোকমানসের প্রেম-বিরহের অনুষঙ্গগুলো যেভাবে মানুষকে আচ্ছন্ন করেছিলো, আমার বিশ্বাস তারই পরম্পরা আজও বাঙালির মননে বহমান।
সবশেষে আমি মৈমনসিংহ গীতিকার কথা উল্লেখ করতে চাই। আমরা জানি মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো শত শত বছর ধরে বঙ্গ জনপদের মানুষকে আনন্দ-বেদনায় আপ্লুত এবং আকুল করেছে। দর্শক-শ্রেতা-পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখেই গীতিকার পালাগুলো নানান আঙ্গিকে রূপান্তরিত হয়ে উপস্থাপিত হয়ে চলেছে। আমাদের চলচ্চিত্র, নাটক, গান কবিতায় মৈমনসিংহ গীতিকার রূপান্তর নিয়ে ইতোপূর্বেই প্রকাশিত হয়েছে আমার নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ; আগ্রহীরা চাইলে পড়ে নিতে পারেন (স্বতন্ত্র: মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশনার শতবর্ষপূর্তি সংখ্যার সম্পাদকীয় ॥ সম্পাদক: ফরিদ আহমদ দুলাল)। মৈমনসিংহ-গীতিকার বিভিন্ন পালা নিয়েও রচিত হয়েছে পথকবিতা। আমি এখানে নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কবি রাখাল বিশ্বাস রচিত ‘কংক-লীলার প্রেম’ শিরোনামের কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি- “পভু নিরঞ্জন করি স্মরণ আমি অভাজন, বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বান্দিলাম চরণ। / কবি রাখাল বিশ্বাস (২) করি প্রকাশ শোনেন দিয়া মন, কংক-লীলার প্রেম কাহিনী করিব বর্ণন। / জেলা-নেত্রকোণা (২) কেন্দুয়া থানা, বিপ্রবর্গ গ্রাম। সেই গ্রামেতে বাস করিত গুনরাজ বিপ্র নাম। / ছিল অতি গরীব (২) ভিক্ষা করি দুঃখে দিন কাটায় মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীতে উপোষে দিন যায়।”
উপরের আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয়, একদিকে পথকবিতা যেমন বিলুপ্তির পথে, অন্যদিকে নবায়ন এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আজও পথকবিতা টিকে আছে সমাজে; বিষয়টি নিয়ে সচেতন মানুষের ভাবনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
ফরিদ আহমদ দুলাল
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫
শৈশব থেকেই পথকবিতার সাথে আমার পরিচয়; পরিচয় মানে রীতিমতো প্রেমে পড়া পরিচয়। কতোদিন যে পথের পাশে জমে ওঠা আসরে পথকবিতা শুনতে শুনতে আমার দিন গড়িয়ে গেছে ঠাহর করে উঠতে পারিনি। দু’আনা পয়সা খরচ করে যে একটা কবিতার বুকলেট কিনে নিয়ে বাসায় ফিরবো সে সামর্থ্য ছিলো না তখন। অথচ কবিকণ্ঠে কবিতা শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেছি। দু’একবার কবিতা কিনে বাসায় নিয়ে গেছি, কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখেছি, যে আনন্দ পেতাম কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে, তার সিকি ভাগও আনন্দ পাচ্ছি না। আমার শৈশবে পথকবিতার পুস্তিকাগুলো সাধারণত দুইআনা করে বিক্রি হতো। বিক্রির পরিমাণ নেহাত কম ছিলো না। বড় একটি কাগজকে বিশেষভাবে ভাঁজ করে আট/বারো বা ষোল পৃষ্ঠায় একটি দীর্ঘ কবিতা ছাপানো থাকত পুস্তিকায়। কবিতাটি লেখা হতো কোনো এক বিশেষ ঘটনা বা কাহিনীকে ঘিরে। যেমন প্রেমের কারণে কোনো মেয়ের আত্মহত্যা বা গোপনে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, শ্বশুর বাড়ির নির্যাতনে কোনো বধূর আত্মহত্যা কিংবা কোনো পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি কাহিনী উপজীব্য হয়ে উঠতো সেসব কবিতায়। যারা এই কবিতাগুলো রচনা করতেন তাদেরকে বলা হতো পথকবি, পল্লীকবি, লোককবি, ভাট কবি কিংবা হাটুরে কবি। আমি অবশ্য তাঁদের পথকবি নামেই জানতাম।
লোকবাংলার অজানা সেই কবিরা যেসব কবিতা লিখতেন, তার নাম কোথাও বলা হয়েছে ‘হাটুরে কবিতা’, কোথাও বলা হয়েছে ‘মেঠো কবিতা’, কোথাও বলা হয়েছে ‘হাঁটুরে কবিতা’, কোথাও বলা হয়েছে ‘ভাট কবিতা, কোথাও আবার বলা হয়েছে ‘পথকবিতা’; হাট-বাজারে পড়া হতো তাই হাটুরে কবিতা হতেই পারে; মাঠে বা উন্মুক্ত জায়গায় পড়া হতো তাই মেঠো কবিতা, বিশেষ গোত্র বা সম্প্রদায়ের লোকেরা পড়তেন তাই ভাট কবিতা; আবার হেঁটে হেঁটে পড়া হতো তাই হাঁটুরে কবিতা; এবং পথ পাশে পড়া হতো তাই ‘পথকবিতা’ নামে ডাকা যেতেই পারে। যে নামেই ডাকা হোক, কবিতা কবিতাই। বর্তমান রচনায় আমি ‘পথকবিতা’ অভিধাটি বেছে নিলাম। এবং নমুনা হিসাবে বাংলা একাডেমির বাছাই থেকে একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে ধরলাম। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার ময়মনসিংহ খ-ে ‘ভাট কবিতা’ শিরোনামে মুক্তাগাছার কবি মোঃ আব্দুল হাই ফকিরের কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি; সেখান থেকে একটি কবিতার কতিপয় পঙ্ক্তি নিচে উদ্ধৃত করছি; আগ্রহীরা চাইলে বাংলা একাডেমিতে সন্ধান করে বইটি পড়তে পারেন : “ওহে সৃষ্টি কর্তা (২) মূল দেবতা বিপদের কা-ার / কে পারে বুঝিতে আল্লা মহিমা তোমার / তুমি কাউরে হাসাও (২) কাউরে কাঁদাও নিঃসন্তানী করে / কাউরে তুমি সন্তান দিয়া কাঁদাও অনাদরে।... / জিলা রংপুরে (২) বসত করে পাহাড়তলী গ্রাম / হাশেম আলী কাশেম আলী দুইটি ভাইয়ের নাম / মা বাপ ছোট থুইয়া (২) যায় মরিয়া কাশেমেরে ভাই / বড় ভাই হাশেম তারে পালন করে ভাই। / কাশেম ১ বৎসরে (২) হইলে পরে হাশেম করে বিয়া / স্ত্রী লইয়া করে সংসার কাশেমেরে লইয়া। / ভাবী আদর করে (২) কাশেমেরে ছেলেরি মতন / স্কুলে পাঠাইত তারে করিয়া যতন।” (স্বামী স্ত্রীর গলে ফাঁসি ॥ মোঃ আব্দুল হাই ফকির ॥ মুক্তাগাছা ॥ ময়মনসিংহ)
আমার শোনা পথকবিতার প্রায় সবই ছিলো প্রেম-উপাখ্যান। সাধারণত আলোচিত প্রেমকাহিনী নিয়েই কবিতা লেখা হতো; তা সে অতীতের গল্পই হোক আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাই হোক। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পথকবিতা লেখার প্রবণতা কমে গেছে; অন্তত রাস্তায় রাস্তায় পাঠ করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য শহর বা গ্রাম গঞ্জে হাটে-মাঠে এর বাস্তব চিত্রটি নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও আমার জন্মের শহর ময়মনসিংহের চিত্রটি এরকমই। সর্বশেষ শোনা দু’টি পথকবিতার কথা স্মৃতি থেকে স্মরণ করছি। দুই কবিতার কোনটি আগে আর কোনটি পরে শুনেছি তা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও, এটা নিশ্চিত বলতে পারি, দু’টি ঘটনাই দেশব্যাপী আলোচিত এবং আলোড়িত হয়েছিলো। দুই ঘটনার একটি একজন ডাক্তারের ছেলে মুনিরের পরকীয়া প্রেম ছিলো তার মায়ের বয়সী খুকু নামে এক নারীর সাথে; তারই জেরে মুনির তার স্ত্রী রিমাকে খুন ক’রে ব্রিজের নিচে ফেলে দেয়। রিমার বাবা ছিলেন ১৯৭১-এর শহিদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক; সঙ্গত কারণেই দেশের সাংবাদিক সমাজ বিষয়টি নিয়ে তৎপর ছিলেন। অন্যদিকে মনিরের মা দেশের একজন প্রভাবশালী চিৎিসক; উপর মহলে তাঁর শক্ত যোগাযোগ ছিলো; কিন্তু কোনভাবেই বাঁচাতে পারেননি ছেলেকে; বিচারে মুনিরের ফাঁসি হয় এবং ফাঁসি কার্যকরী করা হয়; সেই ঘটনা নিয়ে রচিত হয় খুকু-মনির কাহিনি। অন্যটি খুলনার ত্রাস এরশাদ শিকদার নামে এক কুখ্যাত সন্ত্রাসীর আলোচিত ঘটনা এবং ফাঁসির ঘটনা। দু’টি ঘটনাই সারাদেশে আলোচিত আলোড়িত ঘটনা। প্রথমটি সম্ভবত আশির দশকের গোড়ার দিকে, আর দ্বিতীয়টি নব্বইয়ের দশকে। এই দুই কবিতার পর আমি নিজে আর কখনো কোথাও পথকবিতা পঠিত হতে দেখিনি বা শুনিনি। তবে এ কথা নিশ্চত শুনেছি এখনও কেউ কেউ পথকবিতা লেখার কসরত করে থাকেন; আমি নিজেও সাম্প্রতিক করোনাকালে একটি পথকবিতা লিখতে চেষ্টা করেছি। একাধিক নাটকের সূচনায় পথকবিতার ব্যবহার করেছি এবং অনেককে করতে দেখেছি। আমার রচিত পথকবিতাগুলোর কিছু অংশ অবশ্যই উদ্ধার করতে চেষ্টা করবো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন গ্রামের হাটে আমি পথকবিতা শোনার সুযোগ পেয়েছি। আমার বন্ধু কবি হোসেন আলী মিয়া সে সময় বিভিন্ন গ্রামের হাটে বেশ ক’টি পথকবিতা রচনা করে পাঠ করেছেন, এবং সে কারণে তাঁকে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হোসেন আলী মিয়ার সেসব পথকবিতা আজ আর আমাদের সংগ্রহে নেই। কেবল হোসেন আলী মিয়া নন, সে সময় অনেকেই পথকবিতা লিখে আলোচিত হয়েছেন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও সে সময় বেশকিছু পথকবিতা রচিত হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজার-গঞ্জে কিংবা রেল স্টেশনে এসব পথকবিদের দেখা মিলত। তাঁদের গেটআপ দেখলে বুঝতে পারা যেতো, তিনি কবি। হাট বা স্টেশনের কোন একটা ফাঁকা জায়গায় আসর জমিয়ে জনসমক্ষে হেঁটে হেঁটে তাঁরা নিজের রচিত কবিতা সুর করে পড়তেন। তাঁদের পড়ার ভঙ্গিমার কারণে সাধারণ কাহিনিও অসামান্য হয়ে উঠত। একসময় রেল স্টেশনের বুকস্টলে পথকবিতার চটি পুস্তিকা কিনতেও পাওয়া যেতো। সময়ের বিবর্তনে পথকবিতা প্রায় বিলুপ্ত আজ। বিলুপ্ত হলেও পথকবিতার উপযোগিতা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বিশেষ করে লোকবাংলার সাধারণ এবং নাগরিক মানুষের কাছে পথকবিতার জনপ্রিয়তা এতটাই, যে শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা পথকবিতা প্রয়োগ হতে দেখি। মনে পড়ছে, জহির রায়হান প্রযোজিত রহিম নওয়াজ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’তে আবদুল লতিফ-এর কথায় শহিদ আলতাফ মাহমুদ একটি গানে পথকবিতার ঢং ব্যবহার করেছিলেন, এবং গানটি সে-সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। নিচে আমি সে গানটিরকয়েক পঙ্ক্তি স্মরণ করতে চেষ্টা করছি- “শোন শোন কন্যা ওগো কন্যা মনের কথা বলি / থাকলে কিছু দাওনা খাইতে ক্ষুধার জ্বালায় জ্বলি / শোন পরদেশী (২) পরবাসী বলি তোমার কাছে / খাইতে পারো বাগানে মোর তিনটা যে ফল আছে / কোনবা ফলের কী গুণ (২) মিঠা কি নুন করি জিজ্ঞাসন / জলদি কইরা বল তুমি সত্য বিবরণ / দেহে থাকে যদি (২) পুরান ব্যাধি দিনে দিনে বাড়ে / খাইলে এই ফল এক পলকে সকল ব্যাধি সারে।”
আধুনিক বাংলা নাটকের লোককাহিনীভিত্তিক নাটকে কেবল নয়, সমকালীন অনেক নাটকেই আমরা পথকবিতার ব্যবহার দেখতে পাই। এই মুহূর্তে স্মরণে আসছে ‘সমাপ্তি অন্যরকম’ নামে একটি নাটকের কথা, নাটকের নাট্যকার রবিউল আলম; সে নাটক শুরু হয়েছে পথকবিতা দিয়ে। স্মৃতি থেকে কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করছি- “বলি ভাইরে ভাই বলে যাই পুরান ঘটনা / বগুড়া জেলার ঘটনা ক্ষেতলাল থানা / সাকিন মধুমতি (২) করেন বসতি আবেদিন মাস্টার / করুণ কাহিনী আমি বলিব তাহার / মানুষ মহৎ অতি (২) সুন্দরমতি অতি সয়সজ্জন / স্বভাবগুণে মান্য করে পাঁচগাঁয়ের দশজন / অতি সাম্প্রতিককালে একজন তরুণ কবিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুেেক নিজের ছোট বোনের ছেলের বিয়েতে শুভেচ্ছা জানাতে দেখলাম পথকবিতা উচ্চারণের ঢঙে। সেই কবিতা থেকে সামান্য কয়েক পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরছি- ‘আমরা সকলে চাই সুখ-আনন্দে জীবনটা কাটাই: / নতুন আনন্দের কথা সবারে জানাই। / কী সে ঘটনাটা? / কী সে ঘটনাটা সবার জন্য আনন্দ ঘটনা / বিয়ে আনে সবার জন্য নয়া সম্ভাবনা / শোনেন বলবো বিশদ / শোনেন বলবো বিশদ / আসল কথা এই আনন্দ দিনে / সবাই আসুন ভালোবেসে সবাইকে নিই চিনে, / মাকসু আমারই বোন / মাকসু আমারই বোন ঢাকার শ’রে উত্তরাতে থাকে / সুখে দুখে আনন্দেতে সকলকে সে ডাকে।”
সমাজে বিলুপ্তপ্রায় পথকবিতা এভাবেও ফিরে আসছে। আমাদের লোকসংগীত, লোককবিতাগুলো যে সহজেই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবার সক্ষমতা রাখতো, তার প্রমাণ কিন্তু একটু মনোযোগী হলে আমরা সহজেই পেয়ে যেতে পারি। আধুনিক কালের বাংলা গানের দিকে যদি দৃষ্টি দিই, সহজেই চোখে পড়ে এ সময়ের গানের সুরে, কথায় এবং উপস্থাপন শৈলীতে লোকসংগীতের কতটা প্রভাব। আমি বলবো, এ সময়ের জনপ্রিয় গান সমূহের সুর-কথা ও উপস্থাপন শৈলীর সিংহভাগই লোকসংগীত দ্বারা প্রভাবিত। বাংলার লোকমানসের প্রেম-বিরহের অনুষঙ্গগুলো যেভাবে মানুষকে আচ্ছন্ন করেছিলো, আমার বিশ্বাস তারই পরম্পরা আজও বাঙালির মননে বহমান।
সবশেষে আমি মৈমনসিংহ গীতিকার কথা উল্লেখ করতে চাই। আমরা জানি মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো শত শত বছর ধরে বঙ্গ জনপদের মানুষকে আনন্দ-বেদনায় আপ্লুত এবং আকুল করেছে। দর্শক-শ্রেতা-পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখেই গীতিকার পালাগুলো নানান আঙ্গিকে রূপান্তরিত হয়ে উপস্থাপিত হয়ে চলেছে। আমাদের চলচ্চিত্র, নাটক, গান কবিতায় মৈমনসিংহ গীতিকার রূপান্তর নিয়ে ইতোপূর্বেই প্রকাশিত হয়েছে আমার নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ; আগ্রহীরা চাইলে পড়ে নিতে পারেন (স্বতন্ত্র: মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশনার শতবর্ষপূর্তি সংখ্যার সম্পাদকীয় ॥ সম্পাদক: ফরিদ আহমদ দুলাল)। মৈমনসিংহ-গীতিকার বিভিন্ন পালা নিয়েও রচিত হয়েছে পথকবিতা। আমি এখানে নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কবি রাখাল বিশ্বাস রচিত ‘কংক-লীলার প্রেম’ শিরোনামের কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি- “পভু নিরঞ্জন করি স্মরণ আমি অভাজন, বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বান্দিলাম চরণ। / কবি রাখাল বিশ্বাস (২) করি প্রকাশ শোনেন দিয়া মন, কংক-লীলার প্রেম কাহিনী করিব বর্ণন। / জেলা-নেত্রকোণা (২) কেন্দুয়া থানা, বিপ্রবর্গ গ্রাম। সেই গ্রামেতে বাস করিত গুনরাজ বিপ্র নাম। / ছিল অতি গরীব (২) ভিক্ষা করি দুঃখে দিন কাটায় মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীতে উপোষে দিন যায়।”
উপরের আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয়, একদিকে পথকবিতা যেমন বিলুপ্তির পথে, অন্যদিকে নবায়ন এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আজও পথকবিতা টিকে আছে সমাজে; বিষয়টি নিয়ে সচেতন মানুষের ভাবনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।